ভুল সত্য পর্ব-১৬

0
79

ভুল সত্য

১৬
প্রচন্ড জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। ধর মর করে উঠে বসে প্রথমটায় কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। দরজা ধাক্কানো সমানে চলছেই। আমি বিরক্ত হয়ে উঠে দরজা খুলে দেখি, মা আমার চাইতেও বেশি বিরক্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। আমি দাতে দাত পিষে বললাম
কি হয়েছে?
মুকুল ফোন দিচ্ছে, ধরছিস না কেন?
মুকুল সকাল থেকেই ফোন দিচ্ছি। এমনটা যে হবে আমি ধারণা করেছিলাম। কাল সারাদিন ওর মিটিং ছিল শুধু রাতে একবার ফোন করে একটু কথা বলেছে। আজ সকালে কি একটা অনুষ্ঠান তারপরেই সারাদিন ওরা ফ্রি। আর কাল সারাদিন ওদের কোন কাজ নেই শুধু বেড়ানো।আগামিকাল রাতের ফ্লাইটে ওর রওয়ানা দেয়ার কথা।

আমি ইচ্ছা করেই ফোন ধরিনি। বলা ভালো ওর ফোন যেন ধরতে না হয় সেজন্যই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। মাও বাসায় ছিল না। ভেবেছিলাম সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত ঘুমাবো। মা এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলো কেন বুঝতে পারছি না।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে তিনটা বাজে। অবেলায় ঘুমিয়েছি তার উপর আবার ঘুমের ওষুধও খাওয়া হয় না সচরাচর। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। আমি ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম একুশটা মিস কল।

এখানে আসার পর আমি অনেক ভেবেছি। হতে পারে আমার কোন ভুল হচ্ছে। এমন হুট করে কারো ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া ঠিক হবে কি। ভাবলাম আরেকবার যাচাই করে দেখব। প্রয়োজনে ওর সঙ্গে সরাসরি কথা বলবো; দেখি কি বলে আর ও কি কি মিথ্যা সাজিয়ে রেখেছে।ও যাবার আগের দিন ইচ্ছা করেই ওর মোবাইলে ফোন না করে অফিসের নাম্বারে ফোন দিলাম। ওর এক্সটেনশন আমি জানি। এর আগেও দুই একবার কথা হয়েছে। প্রথমবার ফোন বেজে বেজে কেটে গেল দ্বিতীয়বার ফোন ধরল অন্য কেউ। আমি পরিচয় দিয়ে মুকুলকে চাইলে বলল
ও তো লাঞ্চ করতে অফিসের বাইরে গেছে
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম
কেন ক্যান্টিনে লাঞ্চ করছে না?
না ও আর শাওন তো প্রায়ই বাইরে গিয়ে লাঞ্চ করে
রাগে আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো। আমার সঙ্গে ঢং করে বলে যে আমার রান্না এত ভালো অথচ অফিসে খাবার দিতে চাইলে নিতে চায় না। এই তাহলে রহস্য। গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে প্রত্যেকদিন গিয়ে লাঞ্চ করবে। আর কথা বলার কোন দরকার নেই।
এরপর করি আমি মোটামুটি সব গুছিয়ে ফেলেছি। এই ছেলের সঙ্গে আর নয়। ওর মায়ের এত সার্কাস সহ্য করছিলাম শুধু এই ভেবে যে ছেলেটা অনেস্ট। আমারই বোঝার ভুল। এই জীবনে আরো একবার মানুষ চিনতে ভুল করলাম। তবে এটাই শেষ।শুরু থেকে কত চেয়েছিলাম যে ওকে বিশ্বাস করব না। কি করে যে কি হয়ে গেল। কবে কোন অবসরে যে ও আমার এত কাছে এসে গেল নিজেই টের পাইনি।

আবারো ফোন বাজছে। এবার আর না ধরে উপায় নেই। আমি ফোন ধরে বললাম
হ্যালো
কি হয়েছে তুলি, ফোন ধরছিলে না কেন?
ঘুমিয়ে ছিলাম
অবেলায় ঘুমাচ্ছিলে কেন? শরীর খারাপ?
না
মুকুল একটু চিন্তিত কন্ঠে বলল
তোমার কি হয়েছে? মন খারাপ?
আমি ঠিক করেছিলাম ওর সঙ্গে আর অভিনয় করব না কিন্তু কিছু করার নেই। আমি আবার আমার আগের রূপে ফিরে গেলাম স্মিত হেসে বললাম
কিছু হয়নি এমনি ঘুম থেকে উঠলাম তো। আপনার কি খবর?
তোমাকে খুব মিস করছি
হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে কেমন একটা ধাক্কা লাগলো। আমি জানি কথাটা সম্পূর্ণ বানানো। আমাকে ম্যানেজ করার জন্য নিশ্চয়ই বলছে হয়তো শাওন সামনে দাঁড়িয়ে আছে; এতক্ষণ দুজন জলকেলি করছিল। ভাবতেই মাথার মধ্যে চিনচিনে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করলাম তবু নিজেকে শান্ত করে বললাম
কেন?
এখানে একটা পুল আছে ছাদের উপর; খুব সুন্দর। এরা সবাই মিলে জোর করে আমাকে ওটাতে নামালো। এখন আমার ভয় করছে। তোমার কথা মনে পড়ছে। তুমি সেদিনের মত আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলে আর ভয় করত না।

আমার হঠাৎ করেই কেমন যেন কান্না পেল। আমি ফোনটা কেটে দিয়ে মেসেজ পাঠালাম নেটওয়ার্কে সমস্যা পরে কথা বলব, তারপর ফোনটা সুইচ অফ করে দিলাম।
মাথার ভিতর প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই আমার মাইগ্রেনের সমস্যা কান্নাকাটি করলে মাথা ব্যাথার তীব্রতা ভয়ংকর রকমের বেড়ে যায়। গত কদিনে যত কাঁদলাম মনে হয় গত ১০ বছরেও এত কাদিনি।আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম। মুকুলের প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা জন্মানোর কথা কিন্তু কেন যেন সেটা হচ্ছে না ও আমার সঙ্গে যেটা করেছে তাতে আমার ওর প্রতি খুব প্রতিশোধপরায়ন হওয়া উচিত ছিল কিন্তু কেন যেন পারছি না। এই একই জিনিস আমার সঙ্গে আগেও হয়েছে। খুব সম্ভবত আমার মধ্যে প্রতিশোধ পরায়ণতা নেই; যদি থাকত তাহলে আমার বাবা এতদিনে বেঁচে থাকতেন না।

ছোটবেলা থেকেই আমি বাবার ভীষণ ন্যাওটা ছিলাম।বাবার ব্যবহারে প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছিলাম আশরাফ চাচার ঘটনাটাতে। এরপর থেকে বাবার প্রতি আমার কেন যেন ধারণাটাই বদলে গেল। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম ওই ঘটনার পর বাবা সব সময় আমাদেরকে চোখে চোখে রাখতেন। কখনোই আমাকে একা ফেলে বাইরে চলে যেতেন না; এমনকি এক ঘরে থাকলেও পাশে বসে থাকতেন। ব্যাপারটা আমি বুঝলাম, চাচা ও যে বুঝতেন না তা নয়। ধীরে ধীরে বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হলেও কোথায় যেন একটা সুর কেটে গিয়েছিল। তবে এই সুর কেটে যাওয়া যে একসময় সুর ছিন্ন হয়ে যাওয়া হবে সেটা সে সময় ভাবিনি।

ছোটবেলায় বাবার প্রতিটা কথাই আমার কাছে ঠিক মনে হতো। বাবা যখন মাকে বকতেন, মায়ের প্রতিটা কাজে ভুল ধরতেন তখন মনে হতো, সত্যিই তো কাজগুলো তো ওভাবেই হওয়া উচিত ছিল। মাটাই কিছু করতে পারেনা। মা কিছু বলত না, মুখ বুজে সব মেনে নিত। আমি যত বড় হতে লাগলাম ধীরে ধীরে মনে হতে লাগলো আমার মা একটা বোকা, কিচ্ছু পারে না। তবু মায়ের মনটা এত ভালো এত নরম যে মাকে ভালো না বেসে পারতাম না। তবে একটা সময় বুঝেছিলাম মা আসলে বোকা নয়, ভীতু, ভীষণ রকম ভীতু। আমার মা সারাক্ষণ ভয়ে থাকত। সমাজের ভয় সন্তান হারাবার ভয় মাকে এমন কাবু করে রেখেছিল যে মার জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হত।

বাবার সত্যটা জানতে পেরেছিলাম অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে। বলতে দ্বিধা নেই কলেজ পাশ করার পর যখন অনার্সে ঢুকলাম হঠাৎ করেই আশেপাশের সবার দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারতাম যে আমাকে অসাম্ভব রকমের সুন্দর দেখায়। সেই সময় আবার খেয়াল করলাম আশরাফ চাচার আমাদের বাড়িতে আনাগোনা বেড়ে গেছে। ততদিনই আমার বুদ্ধি বেড়েছে সেই সঙ্গে অভিজ্ঞতাও। আমার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি আমি খুব ভালোই বুঝতাম তাই কলেজ শেষ করার পর আর বাড়ি না ফিরে তিথিদের বাসায় চলে যেতাম।

সেদিন তিথিদের বাসায় একটা অনুষ্ঠান ছিল। অনেক লোকজন দাওয়াতে এসেছিল, তিথি কলেজে আসেনি। আমারও আর ওদের বাসায় যেতে ইচ্ছা করলো না। তিনটা নাগাদ কলেজ থেকে বেরিয়ে আমি ঢাকা মেডিকেলে চলে গেলাম। বাবার চেম্বারের বাইরে কালাম ভাই বসে থাকে একটা টুলের উপরে। আমাকে দেখে সেদিন কেমন যেন হকচকিয়ে গেল। আমি কাধ থেকে ব্যাগ নামাতে নামাতে বললাম
কালাম ভাই, খাবার কিছু নিয়ে আসেন তো, ভীষণ খিদে পেয়েছে
কালাম ভাই কেমন কাচুমাচু হয়ে বলল
আপনি আজকে এত তাড়াতাড়ি চইলা আইলেন যে
আমার ক্লাস শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি যান না , খিদা পেয়েছে তো। বাবা কি সার্জারিতে?
স্যার রুমেই আছে আপনি বরং ক্যান্টিন থেকা কিছু খায়া আসেন
আমি একটু অবাক হলাম। বাবা সাধারণত আমাকে হাসপাতালের ক্যান্টিনের
খাবার খেতে দেয় না। কালাম ভাইকে পাঠিয়ে চানখার পুল থেকে কিংবা নিরব হোটেল থেকে খাবার আনায়, মাঝে মাঝে নাজিমুদ্দিন রোড থেকে বিরিয়ানিও নিয়ে আসে। আজ হঠাৎ কি হল? আমার কেমন যেন একটু সন্দেহ হলো। আমি বললাম
আমি ক্যান্টিনের খাবার খাব না
বাবার চেম্বারের দিকে এগিয়ে যেতে নিলে কালাম ভাই আমাকে আটকাল। বলল
তুলি আম্মা এখন যাইয়েন না
আমি কথা শুনলাম না দরজার সামনে দিয়ে দাঁড়ালাম।। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ কিন্তু বাইরে থেকেও কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। আমার সারা শরীর জমে পাথর হয়ে গেল। যে কণ্ঠস্বরটা ভেতরে কথা বলে যাচ্ছে সে লোকটা কি সত্যিই আমার বাবা? আমারই বাবা?

চলবে,….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে