ভুল সত্য
৯
তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তুলি?
আমি কি জবাব দেব বুঝতে পারলাম না। প্রশ্নটাই বুঝলাম না। আমি ছেড়ে চলে যাব মানে কি? এখন চলে গেলে তো ও এই হাটু পানিতেই ডুবে যাবে। তাছাড়া আমি ওকে ডুবতে দিলে তো? সুইমিং এ এতগুলো মেডেল কি আমি এমনি এমনি পেয়েছি? নাকি ও ভাবছে আমি ওকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাব? সেটাই বা কেন ভাববে? আর আমি যাবটা কোথায়? বাবা মায়ের কাছে তো আমি মরে গেলেও ফিরে যাব না। যারা বিয়ে হবার আগেই আমাকে বোঝেনি তারা এখন কি বুঝবে।
মুকুল অনেক ক্ষণ জবাবের জন্য অপেক্ষা করে একসময় আমাকে ছেড়ে আস্তে আস্তে হেটে ঘাটের দিকে চলে গেল। আমি ওর যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেমন কুজো হয়ে আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত ওর ভীষণ মন খারাপ হয়েছে। মন খারাপ হলে ও এমন কুজো হয়ে হাটে। এই কদিনে আমি এটা লক্ষ্য করেছি।
ও চলে যাবার পর আমারো আর পানিতে থাকতে ইচ্ছা হল না। উঠানে এসে দেখলাম মরিয়ম বিবি সর্ষে ইলিশ বসিয়েছে। এই আইটেমটা সামনাসামনি দেখার আমার খুব শখ ছিল। আমি কয়েকবার ট্রাই করেছি। সবই ঠিক থাকে কিন্তু কেন যেন একটু তেতো হয়ে যায়। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের মাটির ঘরের দরজা বন্ধ। মুকুল নিশ্চয়ই চেঞ্জ করছে। ওর সাধারণত এসব কাজে অনেক সময় লাগে। সকালে অফিস যাবার আগে ও দেখি দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করে তারপর যত্ন করে তৈরি হয়। এমনিতেই ওর ঠান্ডার ধাত, তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নিলেই ভালো। আমার আবার এসব ঠান্ডা জলে কিছু যায় আসে না। আমি দিন রাত বৃষ্টিতে ভিজেও দিব্যি সুস্থ থাকতে পারি।
আমি চুলার ধারে বসে পড়লাম। মরিয়ম দিবি আমাকে একটা কাঠের পিড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল
চা খাইবা?
খাব। একটু আদা দিয়ে রং চা দিতে পারবেন? উনার আসলে একটু ঠান্ডার ধাত তো
বলতে বলতে আমি কি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম? তা কেন? মরিয়ম বিবির সঙ্গে তো আমার অভিনয় করার দরকার নেই। ধুর! সারাক্ষণ অভিনয় করতে করতে এমন অবস্থা হয়েছে যে এখন কোনটা অভিনয় কোনটা সত্যি নিজেই বুঝতে পারি না।
ব্যবস্থা মনে হয় করাই ছিল। মরিয়ম বিবি চটপট চা দিয়ে দিল। স্বচ্ছ কাঁচের কাপে সোনালী লিকারটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে। মাঝে কিছু আদা আর এক টুকরো লেবু ভাসছে। আমি কাপ দুটো তুলে নিয়ে ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলাম। কি আশ্চর্য! দরজা খোলাই। ভেতরে ঢুকে দেখলাম মুকুল দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বিছানায় বসে আছে। আমাকে দেখে চোখ তুলে তাকাল। ওর চোখ কেমন লাল হয়ে আছে। এই রে, ঠান্ডা বাধিয়ে ফেলেছে। সব আমার দোষ। কেন যে পানির মধ্যে নিয়ে গেলাম। আমি ওর হাতে চায়ের কাপ দিয়ে বললাম
তাড়াতাড়ি চা টা খান। গলা ব্যথা করছে?
ও আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল
তুমি চেঞ্জ করে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে।
আমার শাড়ি শুকিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চা টা খান তো। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
মুকুল চায়ের কাপে চুমুক দিল। দেখে মনে হচ্ছে বেশ আরাম পাচ্ছে। আমি আমার হ্যন্ডব্যগ থেকে পানির বোতল সেই সঙ্গে ঠান্ডা আর মাথাব্যথার ওষুধ বের করে দিয়ে বললাম
জলদি খেয়ে ফেলুন। আপনাকে পানিতে নামিয়েছি জানতে পারলে মা আমাকে আস্ত রাখবে না
মুকুল কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল, যেন আমি খুব অবান্তর কিছু বলে ফেলেছি। কেন যেন হঠাত আমার ওর জন্য খুব মায়া হল। ওর মায়ের সঙ্গে কেমন একটা দূরত্ব, আমার সঙ্গে ও সুবিধা করতে পারছে না। পৃথিবীতে কত আজেবাজে ছেলেরা মায়ের আদর পায় আবার একান্ত বাধ্যগত বউ ও পায়। বেচারা ওর ভাগ্য দুদিক দিয়েই খারাপ। কিন্তু তাতে আমার কি? হঠাত করে আমার ওর প্রতি এত আলগা দরদ উথলে উঠল কেন? আমি শক্ত হাতে নিজের মনের লাগাম টেনে ধরলাম। আর যাই করি ওকে বিশ্বাস করর মতো ভুল আমি করব না। তবে একথা সত্যি যে মুকুলার প্রতি আমার এক ধরনের মায়া জন্মেছে। সেটা আহামরি কিছু না। মায়া তো আমার টুক্টুকির জন্য ও আছে। ওকে তো মাত্র আজই পেলাম। সেখানে মুকুল তো আমার সঙ্গে গত দশ দিন ধরে আছে। আর আমার অনেক উপকার ও করেছে। ও সাহায্য না করলে আমার মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া হত না। আমার ভর্তি র কথা শুনে শাশুড়ি অনেক তুলকালাম করেছে। মুকুলের সঙ্গে সুবিধা করতে না পেরে একদিন আমাকে ডেকে বললেন
শুনো ওইসব পড়ালেখার ধান্দা মাথা থেকা বইর কইরা ফালাও
কিভাবে মাথা থেকে বের করব? নাকের ফুটা দিয়ে না কানের ফুটা দিয়ে?
ওই বেয়াদ্দব মাইয়া। শাশুড়ির লগে কেম্নে কথা কইতে হয় বাপ মায় শিখায় নাই।
না তো
খাড়াও তোমার বাপ মায়েরে খবর দিয়া আনাইতাসি। ভাইবো না এই বার জামাইয়ের গলা ধইরা কইলে লাভ হইব। বউ বাড়িতে থাকবো, রানবো, বাড়বো। জজ বালেস্টর বউ দিয়া কি করুম?
উনি বোধহয় ভেবেছিলেন এই কথা শুনে আমি তার পায়ে উপুড় হয়ে পড়ব। সিরিয়ালের নায়িকাদের মত বলল
না না মা, অমন করবেন না । ওতে যে তারা অনেক কষ্ট পাবে।
আমি তার ধার দিয়েও গেলাম না। নির্বিকার ভাবে বললাম
খবর দেন।
ভালোই হবে। তারাও এসে দেখুক কেমন ঘরে বিয়ে দিয়েছে। তখন যে ছেলেকে দেখে রসগোল্লা মাকে পান্তোয়া ভেবেছিল এখন এসে দেখে বুঝুক তারা আসলে কি।
আমার নির্বিকার ভাব দেখে উনি একটু থমকে গেলেও দমে গেলেন না। রাতের বেলা খাবার টেবিলে এই নিয়ে কথা উঠল। বাবা মা কে খবর দিয়ে আনানোর কথা শুনে মুকুল রেগেমেগে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। উনি কয়েকবার পেছন থেকে ডাকলেন কিন্তু লাভ হল না। অগত্যা তিনি ও উঠে পিছু নিলেন। আবার রুদ্ধদ্বার বৈঠক হল। যথারীতি বাইরে থেকে কিছুই শোনা গেল না। কিন্তু এর পর আমার শাশুড়ি আর এই নিয়ে একটা কথা ও বললেন না।
বাবা মা কে আনানো হল না বলে আমার বরং একটু আফসোসই লাগতে লাগল। প্রথমদিন মুকুল আমাকে সঙ্গে করে কলেজে নিয়ে গেল আবার দুপুরে সঙ্গে করে নিয়েও এল।
বাড়ীতে এসে দেখি এলাহি কারবার চলছে। নাজু আপা তার স্থূলকায় শরীর নিয়ে নিচের হলঘরে রীতিমতো দাপাদাপি করছে। আমাদের দেখে শরীর নাচিয়ে বলল
ভাইজান আমি আর কাম করুম না।
মুকুল থম্থমে গলায় বলল
কেন, কি হয়েছে?
খালাম্মায় আমারে অপমান করসে। আমারা গরীব বইলা কি আমোগো আত্ম সন্মান নাই?
আমি তার ভাষা জ্ঞান দেখে চমৎকৃত হলাম। তার মধ্যে এত সুপ্ত প্রতিভা আছে জানা ছিল না। যদিও তার আর একটু বহিঃপ্রকাশ দেখার সুযোগ পেলাম না। আমার শাশুড়ি গর্জে উঠে বললেন
ওই মাথারি কি অপমান করসি তরে? তুই যা তরে তো তাই কইসি।
নাজু আপা হঠাত পল্টি খেয়ে উনাকে বাদ দিয়ে আমাকে নিয়ে পড়ল।
ভাবী আপনের কিন্তু কপাল পুড়সে। এমুন শাশুড়ি পাইসেন। আপ্নের কপাল নিরুপামার থেকা ও খারাপ।
ওই বেটি নিরুপামার কেডা?
কেন, আপনি ইস্টার পেলাস দেহেন না?
আমার শাশুড়ি স্টার প্লাস দেখেন না, তিনি পাকিস্তানি সিরিয়ালের ভক্ত। নিরুপামা না বলে যদি তেরে বিন কিংবা মুরাত মান্নাত বলত তাহলে বোধহয় ভালো হত। যদিও দ্বিতীয়টা উনার সঙ্গে ভালো যেত। ইস্টার পেলাস না দেখলেও উনি অবশ্য দমে গেলেন না। ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে বললেন
ওই মুকুল, এই বেটির চুলের মুঠিটা ধইরা এরে বাড়ি থেকা বাইর কর। আজকা ইস্টার পেলাস আমি তর………
আমি পরম আনন্দে স্টার প্লাস এবং স্কাই টিভি বাদ দিয়ে আমার সামনে অভিনীত বঙ্গ সিনেমার ব্যপক মজা নিতে লাগলাম।
চলবে……