ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব-০৯

0
3884

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব-০৯
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় আবির!
বার বার প্রতিধ্বণিত হতে থাকে নীলিমার বলা শেষ কথা,
“সেই বুড়োকে ভালোবাসবে ডাক্তার নীলিমা?”

ভিষণ কষ্ট পায় আবির কিন্তু ভেঙে পরেনি। মুখে জোর করে একটা হাসির রেখা টেনে নীলিমার হাতটা ধরে।
হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে হাসিমুখেই বলে, আমি জানি! আমার নীলি আমার সাথে মজা করছে। ও আমার সাথে এমন করতেই পারে না। কারণ, ও যে আমাকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসে…!!!
একটা ধাক্কা দিয়ে আবিরকে ফ্লোরে ফেলে দেয় নীলিমা। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
হা, হা, ভালোবাসা?!!!
সেতো ফুলশয্যার রাতেই মরে পঁচে গেছে;

ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ায় আবির,
নীলিমার সামনে দাঁড়িয়ে ওর দু’গাল স্পর্শ করে বলে, আমি জানি তো! তুমি এসব রাগ করে বলছ, অভিমান থেকে বলছ….
হাত দুটো ছাড়িয়ে দেয় নীলিমা। আবিরের চোখে চোখ রেখে বলে,
অভিমান…?!!!
সে’তো তার সাথেই মানায়,
যাকে মন থেকে ভালোবাসা যায়।

এমন কেন করছ? একটু শান্ত হও তুমি….
এই কথা শুনে আবিরের কাছে চলে আসে নীলিমা। চোখে চোখ রেখে জোর গলায় বলে উঠে, বুঝতে কেন পারছেন না, আমি সত্যি বলছি…. আমি আপনাকে ভালোবাসি না, বাসতে পারি না….
আবির দু’হাত দিয়ে নীলিমার একটা হাত চেপে ধরে। দু’চোখ দিয়ে অথৈ জলরাশি নিচে গড়িয়ে পরছে। কান্না ভেঁজা গলায় প্রশ্ন করে আবির,
” কেন করলে এমন’টা?”
নীলিমা আবিরের হাতের দিকে চোখ ইশারা করে উত্তর দেয়, এই যে আজকের এই দিনটি দেখার জন্য….
আবির হাতটা ছেড়ে দেয়। নীলিমা সেই অবস্থায়’ই কাপড়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আবিরের দিকে তাকায়। আবির তখনো সে স্থানে’ই ঠায় দাঁড়িয়ে। কাঁপা গলায় “আসি” বলে বিদায় নেয় নীলিমা….

আবিরের রুম থেকে বেরিয়ে নিচে রাস্তায় গিয়ে সরাসরি রিক্সায় উঠে পরে নীলিমা। অতঃপর বাসস্টপে গিয়ে বাসে উঠে রওয়ানা দেয় নরসিংদীর উদ্দেশ্যে। মাকে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে,
“ছোট ভাই আর লিমাকে নিয়ে দু’দিন পর’ই চিটাগাং মামার বাসায় যাচ্ছি। ঐখানকার হসপিটালে একবছর কাজ করতে হবে। তোমরা রেডি থেকো।”
নীলিমা বাসায় পা রাখা মাত্র’ই কল করে নীলিমার শ্বশুর। ভয়ে ফোনটাই অফ করে ফেলে নীলিমা। বুঝতে পারে, আবির ওনাকে নিশ্চয় কিছু একটা বলছে। তাই আজ হঠাৎ এ সময়ে ফোন করছে। আবির যদি সব বলে দিয়ে থাকে, তাহলে এটা নিশ্চিত ওনি এ বাড়িতে চলে আসবে। মা, কাকা, কাকিমা’রা এসব জানবে। সাথে তুলকালাম সৃষ্টি হবে। নাহ, আর একমুহূর্তও এখানে থাকা যাবে না। সে রাতটা কোনো মতে কাটিয়ে পরদিন ভোরের ট্রেনে নীলিমা ওর মা ও ছোট ভাই বোনদের নিয়ে চিটাগাং চলে যায়।

কেটে যায় দু’দিন__
” বাবা! কি হলো? ফোন ধরেছে নীলিমা? কথা বলেছ ও বাড়িতে?”
সেদিন আবিরের বাবা ও মা এসেছিল তাদের বউ-ছেলেকে দেখতে। এসে আবিরের অগোছালো রুম ও রক্ত লাল চক্ষু দেখে ভড়কে যায়। জানতে পারে, আসল ঘটনা। আবিরের বাবা মা দু’জনেই স্তম্ভিত। হওয়ার’ই কথা। এরকম কিছু ওরা যে কল্পনাতেও নীলিমার থেকে প্রত্যাশা করেনি। যায় হোক!
ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকে মা। আবিরের বাবা এবার কল দেয় নীলিমার মায়ের ফোনে। সালাম দিয়ে কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে জানতে পারে, নীলিমা ওদের নিয়ে চিটাগাং মামার বাসায় উঠেছে। কোনো বনিতা না করে আবিরের বাবা সোজাসাবটা নীলিমার মায়ের কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলে। লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায় নীলিমার মায়ের। কারণ ওনি জানেন আর যায় হোক আবিরের বাবা কখনো মিথ্যে কথা বলার মানুষ না। সে রাত্রে’ই মেয়ের মুখোমুখী হয় মা। প্রশ্ন করেন- কিরে জামাই কল দেয় নি যে আজকে একবারও, জামাইয়ের সাথে কি কিছু হয়েছে? মায়ের প্রশ্নে রেগে যায় নীলিমা। সামনে থাকা গ্লাসটা ছুড়ে মারে ফ্লোরে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে জবাব দেয়, আর কখনো যদি এই জামাই জামাই শুনি, তাহলে কুরুক্ষেত্র বয়ে যাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে স্থান ত্যাগ করে নীলিমার মা। মায়ের সাথে এরকম চোখ রাঙানোতেই বুঝতে পারেন ওনি, ওনার মেয়ে নিচে নামতে নামতে এতটাই নিচে নেমে গেছে যে ঘৃণা করতেও ওকে মানুষের বিবেকে বাঁধবে। দুপুরে লাঞ্চ করে রুমে বসেছিলেন নীলিমার মা, তখনি কল আসে নীলিমার শ্বশুরবাড়ি থেকে। রিসিভ করতেই ওনারা জানান-
আবিরের অবস্থা খুব খারাপ, আপনারা যত শিগ্রয় সম্ভব একবার ঢাকায় আসুন। হসপিটাল থেকে কেবল ফিরছিল নীলিমা। ড্রেসটা চেঞ্জ করে, জরুরী একটা কাজে খাতা কলম নিয়ে বসেছিল। ঠিক তখনি রুমে মায়ের আগমন। অনেকটা ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠেন-
” নবাবজাদী! কলম ঘুরাতে হবে না। আগে আমার সাথে ঢাকায় চল।”
রাগ উঠে যায় নীলিমার। অনেকটা জোর গলায় কলম নাড়িয়ে অসময়ে রুমে আসা এবং নবাবজাদী কথাটা বলার জন্য মাকে কতগুলো তিক্ত কথা শুনিয়ে দেয়। মাথায় রক্ত উঠে যায় নীলিমার মায়ের। ড্রেসিংটেবিলের উপর পরে থাকা ধারালো ছুড়ি হাতে এগিয়ে যায় মেয়ের দিকে। এক হাত দিয়ে নীলিমার হাতটা টেবিলের উপর চেপে ধরে, তারপর আরেক হাতে রাখা ছুড়িটা আঙুলের উপর চেপে ধরে নীলিমার মা। দাঁতে দাঁত চেপে শরীরের সবটুকু ভর দিয়ে মা তার মেয়ের আঙুলে ছুড়িটা চেপে ধরে। রাগে জ্ঞানশূন্য মায়ের কানে মেয়ের আর্তনাদ না পৌঁছলেও পাশের রুমে ভাই বোন এবং মামীর কানে ঠিক পৌঁছে। চিৎকার শুনে দৌঁড়ে আসে ওরা। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ওমাগো করে বিছানায় চিতল মাছের মতো তড়পাতে তড়পাতে সবার চোখের সামনেই জ্ঞান হারায় নীলিমা। নীলিমার ডান হাত থেকে বৃদ্ধা আঙুলটা আলাদা করে ফেলেছে ওর মা। এটা দেখে ওর ভাই জ্ঞান হারায়। বোন লিমা ও মামি একটা চিৎকার দিয়ে নীলিমার কাছে ছুটে আসে। লিমা ওর বোনকে জড়িয়ে ধরে আপু, আপু বলে আর্তনাদ করতে থাকে। একি করলেন আপা? হাত থেকে একটা আঙুল’ই আলাদা করে ফেললেন? পাশ থেকে নীলিমার মামি প্রশ্নটা করে।
উত্তর আসে- বেশ করেছি! ভাগ্য হাতটা কেটে ফেলিনি এখনো। কলম নাড়ানো…!!! জন্মের মত কলম নাড়ানোর শখ মিটিয়ে দিতাম। কথা বাড়ায়নি নীলিমার মামি। লিমাকে সাথে করে নীলিমাকে ধরে সিএনজিতে করে হসপিটালে নিয়ে যায়। ততক্ষণে জ্ঞান ফিরে নীলিমার ছোট ভাইটার। মায়ের দিকে একরাশ ঘৃনার চোখে একবার তাকিয়ে মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে সেও ছুটতে থাকে হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
জ্ঞান ফিরে নীলিমার। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে রাত্রি ১১টায় বাসায় নিয়ে আসা হয় ওকে। পরদিন ভোর বেলা একরকম জোর করে নীলিমার ছোট দু’ভাই বোন নিয়ে ওর মা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। আসার আগে একমাত্র ছোট ভাই ও ভাবিকে মেয়ের কৃতকর্ম সম্পর্কে সবকিছু জানিয়ে আসেন। এত অসুস্থতার খবর পাওয়া সত্ত্বেও নীলিমা আসেনি, এটা শুনে আবির বুঝে যায় নীলিমার জীবনে ওর স্থানটা কোথায়…!

নীলিমা চলে যাওয়ার পর আবির প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। বাসায় চিৎকার করে কেঁদে উঠত। পরিপূর্ণ জীবনে হঠাৎ বিশাল শূন্যতা ও সামলে উঠতে পারছিল না। বন্ধুরা এসে ওকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। কিন্তু কোনো সান্ত্বনা ওকে বাঁধতে পারল না। আবির কলেজ থেকে ছুটি নিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যানে একা একা ঘুরতে লাগল।

আবার শিক্ষকতা শুরু করল। প্রথমে প্রতিটি কাজে ভুল হতো। পরে আস্তে আস্তে সব ঠিক হতে লাগল। আবির স্বাভাবিক হতে লাগল।

দুই বছর পর আবিরের ফোনে একটা কল এলো। রিসিভ করে হ্যালো বলতেই নারী কন্ঠে বলল, কেমন আছ?
চিনতে অসুবিধে হয়নি, এ নীলিমা। উত্তর দিল আবির, ভালো।
ওপাশ থেকে ভেসে এলো, স্যরি। পুরনো ক্ষতকে নতুন করে জাগানোর কোনো ইচ্ছে’ই আবিরের ছিল না। তাইতো কল কেটে ফোনটা বন্ধ করে ফেলল। অপরপ্রান্তে অন্ধকার রুমে হু, হু করে কেঁদে উঠল নীলিমা। গত একবছর ধরে নীলিমা ঢাকা শহরে। একই শহরেই দু’জনের বসবাস। অথচ নীলিমা পারছে না আবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা মনের অব্যক্ত কথাগুলো বলতে। হয়তো আর কখনো বলা’ই হবে না….!!!

ফাল্গুনের দু’সপ্তাহ আগে, প্রিন্সিপাল স্যার সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে মিটিংয়ে বসলেন। আলোচ্য বিষয় এবারের বসন্তের প্রথম দিন ঠিক কিভাবে উৎযাপন করবেন। আলোচনা চলল টানা ৩ঘন্টা, আলোচনার এক পর্যায়ে বক্তব্য রাখেন হিসাববিজ্ঞানের সাইফুল স্যার। ওনি চান, কলেজে এবার বসন্ত উৎসবের পাশাপাশি প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের পূর্নমিলনীর ব্যবস্থা হোক। প্রিন্সিপাল ওনার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানান। জানিয়ে দেয়া হয় ২০** সালের ব্যাচের সকল প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের কল করে যাতে বিষয়টা জানিয়ে দেয়া হয়। আবিরকে বলে দেয়া হয় আবির যেন নীলিমাকে বিষয়টা জানিয়ে দেয়। সেদিন কলেজের হয়ে মেসেজের মাধ্যমে আবির নীলিমাকে বিষয়টা জানায়। খুশিতে লাফিয়ে উঠে নীলিমা। অনুষ্ঠানের দিন নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই নীলিমা কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছিল, পথিমধ্যে এক বৃদ্ধার এক্সিডেন্ট হলে ওনাকে হসপিটালে দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তবেই রওয়ানা দেয়। নীলিমা কলেজে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেকটা দেরী হয়ে যায়, ততক্ষণে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। সঙ্গীত অনুষ্ঠান পরিচালনার পুরো দায়িত্ব ছিল বাংলার অধ্যাপক আবিরের উপর।

” কলেজের সকল প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহন করার বিনীত অনুরোধ করা হচ্ছে। কলেজ গেইট থেকেই নীলিমা মাইকে আবিরের কন্ঠটা শুনে নেয়। কম্পন শুরু হয়ে যায় ভিতরে। ভীরু পায়ে কলেজ মাঠে মঞ্চের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে। এখানে এসে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে নীলিমার। সবাই কিরকম সুন্দর করে সেজে এসেছে। ছেলেরা পাঞ্জাবী আর মেয়েরা বাসন্তী রঙের শাঁড়ি। কি সুন্দর’ই লাগছে সবাইকে। বিশেষ করে আবিরের থেকে তো চোখ’ই সরানো যাচ্ছে না। পাঞ্জাবী’তে অস্থির লাগছে আবিরকে। ইশ! কেন যে আজকে শাঁড়ি পরে এলাম না….!!!!”

নীলিমা মুগ্ধ দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন আবিরকে দেখার তৃষ্ণা এ জন্মে ওর মিটবে না। আবির পাশে বসে থাকা অতিথি মেম জ্যোতি মেয়েটার সাথে কি একটা বিষয় নিয়ে যেন হাসাহাসি করছিল, তখন’ই পিছন থেকে ইতিহাসের অধ্যাপক জনাব মামুনুর রশিদ মাইক হাতে নিয়ে বলতে থাকেন, আবির স্যার! অনেক অপেক্ষা করিয়েছেন। এবার তো শুরু করুন। ওরা যে আপনার কন্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হওয়ার জন্য অধির আগ্রহে বসে আছে। আবির মাইকের অনেকটা কাছে গিয়েই বলে, কি করে শুরু করব স্যার? জ্যোতি মেম এত সুন্দর করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারে, ওনাকে বললাম আমার সাথে গাওয়ার জন্য, ওনি রাজি হচ্ছেন না…!!!
মন খারাপ করে আবির বলে, ঠিক আছে, আমি একা একা’ই শুরু করছি….. সবাই নড়েচড়ে বসে। আবির গাইতে শুরু করে-

” যদি তারে নাই চিনি গো সেকি…..”

এটুকু বলে আবির থামতেই ডান পাশ থেকে খালি গলায় গেয়ে উঠে নীলিমা-
” যদি তারে নাই চিনিগো সেকি…..
সেকি আমায় নিবে চিনে এই নব ফাল্গুনের দিনে জানিনে…..”

চমকে উঠে আবির মঞ্চের বামপাশে তাকালো, আবিরের সাথে অন্যান্য শিক্ষকরাও তাকালো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে