#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম
#ফারজানা_মুমু
[১১]
আষাঢ়ের পৃথিবী থমকে গেল। বারবার ঝুমঝুমির বলা শব্দটি কানে বেজে চলেছে। কয়েক মুহূর্ত নিরব থাকল। হৃদয়ের বিশাল ঢেউ শান্ত হতে চাইছে না। শব্দ বের হচ্ছে না কন্ঠস্বর থেকে। প্রিয় মানুষটির অপ্রিয় সত্য কথাটি কোনোভাবেই মানতে পারছে না। মেয়েদের মত ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি গিললো। নিজের অবস্থার মজবুত করে বলল, তুমি আ’মৃ’ত্যু পর্যন্ত শুধু আমার। তোমার অতীত নিয়ে আমার যায়-আসে না। তোমাকে আমি ভালোবাসি কথাটি যেমন সত্য তেমনি তোমার অতীতকে আমার প্রত্যাখ্যান করা সত্য। দোষ থাকলে দোষারোপ করা যায় কিন্তু আমি তোমার দোষ খোঁজে পাইনি দোষারোপ করার প্রশ্নই আসেনা। বিশ্বাস রাখো আমি কখনোই তোমাকে তোমার অতীত নিয়ে টানবো না। তাছাড়া আষাঢ়ের ভালোবাসা তুচ্ছ নয় যে সামান্য বাক্যতে শেষ হবে। আমার প্রেমের সূচনা তুমি ছিলে, উপসংহারে তুমিই থাকবে। ঝুমঝুমি নামের হীরা পাথরকে আমি কখনই হারাতে চাইনা। পাথরের হৃদয়ে অতি যত্নে নাম লিখে বুঝিয়ে দিবো আমি তোমায় কতখানি ভালোবাসি।
ঝুমঝুমির অতীত সম্পর্কে বিস্তারিত বলল ঝুমঝুমি। সব শুনে আষাঢ় কিছুক্ষণ অদ্ভুদ চাহনিতে তাকিয়ে ছিল ঝুমঝুমির পানে। নিজেকে ধাতস্থ করে উপরের কথাগুলো এক নিমিষে বলে ফেলল। গোপনে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঝুমঝুমি বলল,
-” আবেগ,মৌহ সব সময় থাকে না আষাঢ়। আপনি আমায় ভুলে যান।
-” আমার বয়সটা আবেগের নয় ঝুমি। তোমাকে ভুলে থাকার চেয়ে নিজেকে শেষ করা শ্রেয়।
-” নিব্বাদের মতন কথা বলবেন না।
-” তুমি বাধ্য করছ। আমাকে মেনে নাও।
ঝুমঝুমি কথা এড়ানোর জন্য বলল, আমরা এখান থেকে যেতে চাই।
আষাঢ় শান্ত চাহনি ফেলে বলল, বিকালে যাত্রা দিবো তোমরা রেডি থেকো।
ঝুমঝুমি চলে গেল। আষাঢ়ের সামনে দাঁড়ানোর সাহস তার হচ্ছে না। ঝুমঝুমির মনে হলো হঠাৎ এই লোকটাকে দেখলে ওর সব এলোমেলো হয়ে যায়। কঠিন হতে পারে না। চাইলেও ভুলতে পারে না। মনের দিক থেকে পজিটিভ আভাস পাচ্ছে সে কিন্তু উপর থেকে নেগেটিভ। লোকটার কথাগুলো আফিমের মত। হ্যালুসিনেশন হয় তখন নিজের মধ্য থাকে না ঝুমঝুমি।
ঝুমঝুমির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল আষাঢ়। হৃদয়ে মহাপ্রলয় সৃষ্টি করে মেয়েটা তাকে কষ্ট দিচ্ছে। ভালোবাসায় এত কষ্ট থাকলে কখনোই ভালোবাসতো না। প্রেয়সীর হৃদয় ছুঁয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা করতো না। খুবই নিষ্ঠুর ওর প্রেয়সী। হৃদয়ে প্রেম সৃষ্টি করা মানে মরুভূমিতে হাল চাষ করা। কবে যে শুনতে পারবে নিষ্ঠুর প্রেয়সীর কাছ থেকে প্রেমের শব্দযোগ।
জমিদার বাড়ির বিশাল বৈঠক খানায় চলছে ঝগড়া। তৃষ্ণার চেঁচামেচিতে রুমে থাকা যাচ্ছে না। কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে পাশের বাড়ির আন্টিদের মতন ঝগড়া করে যাচ্ছে তৃষ্ণা। নীরা নিরন্তন চুপ থেকে আড়চোখে হিরণকে দেখছে। হিরণ মাঝে-মধ্যে ইশারায় চুমু ইশারা করতেই লজ্জায় আপেল রূপ ধারণ করে সে। অন্যদিকে তৃষ্ণার সাথে কথায় না পেরে মিরাজ হার স্বীকার করে। তৃষ্ণার মুখশ্রী জুড়ে খুশির জোয়ার। জয়ী হওয়ার কারণে ভাব কিছুটা বেড়েছে। তবে মনে-মনে ঠিক করেছিল যদি ঝগড়ায় জিততে না পারে থু-থু ছিটাবে মিরাজের উপর। থু-থু ফেলতে হলো না তার পূর্বেই মিরাজ চুপ। নাজিম এতক্ষণ ধরে উৎসাহ দিচ্ছিল মিরাজকে। শেষমেষ বন্ধুর পরাজয় মেনে আশ্বাস হারিয়ে তৃষ্ণাকে বলল, আমি জানতাম আমার বন্ধু তোমার সাথে পারবে না। মনে-মনে কিন্তু আমি তোমার দলেই ছিলাম।
আমার বন্ধু হেরে গিয়ে স্বীকার করল পরাজয়
ঝগড়ায় পারদর্শী ঝগড়াটে তৃষ্ণার হলো জয়।
মিরাজ ফিক করে হেসে দিল। তৃষ্ণা গরম চোখে তাকালো। নাজিমের উদ্দেশ্য বলল, আপনাকে আমাদের দেশ ডিজার্ভ করে না নাজিম ভাই। আপনার তো খুব টেলেন্ট। গরু ছাগলদের সাথে থেকে-থেকে ভালো না হয়ে বিপথে যাচ্ছেন।
নাজিমের মনে ধরল তৃষ্ণার কথা। হিরণ ও মিরাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, আমাদের অপমান করলে?
তৃষ্ণা বলার আগেই নাজিম বলে ফেলল, গরু-ছাগলদের আবার কীসের অপমান,তোদের সাথে থেকে আমার চলল মানসম্মান।
হিরণ ও মিরাজ, নাজিমকে চ্যাংদোলা করে বাইরে নিলো।
-” আজ তোর মান সম্মানের কালি না লাগা অব্দি ছাড়ছি না। কবিতা বলিস তাইনা আজ দেখব তুই কত প্রকার কবিতা বলতে পারিস।
ওদের কাহিনী দেখে নীরা-তৃষ্ণা জোরে-জোরে হাসতে লাগলো। তৃষ্ণার মনে হলো ট্যুরে আসাটা সার্থক হলো। না হলে কত বিনোদন যে মিস করতো।
______________________
গোধূলি লগ্ন থেকেই সুরের মাধুরী শোনা যাচ্ছে। বিনোদনের জন্য রয়েছে নাজিম। আষাঢ় প্রিয় মানুষটিকে উদ্দেশ্য করে গান গাইছে,
আমার এই আঁধার, আমার কবিতা
সময়ের পাতায় যা লিখে চলি,
ছিল সবি তোমারি , আছে আজো তোমার
আঁধারের নির্জনতায়
এই নিজুম রাতে একা আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে,
চিৎকার করে বলতে চাই তোমায় আমি,
ভালোবাসি
শুধু তোমায় ভালোবাসি
এ . . এখনো
শুধু তোমায় ভালোবাসি।
আমার এই ভোরের আলোয় ছুটে চলা
শুধুই কল্পনায় ছুঁতে চাওয়া
তুমি রাতের আঁধার ঘিরে এলে, তুমি আমার ভোরের আলোয় পাওয়া
অন্তহীন এ পথে
এই ভোরের স্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে লাল আকাশে চির ধরিয়ে
চিৎকার করে বলতে চাই তোমায় আমি,
ভালোবাসি
শুধু তোমায় ভালোবাসি
এ . . এখনো
শুধু তোমায় ভালোবাসি
ঝুমঝুমি জানালার গ্লাস খুলে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। আষাঢ়ের বলা গান তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা সে জানে তবুও কোনো প্রকার হেলদোল করেনি। ভাবখানা এমন যেন সে কিছুই শুনেনি। আষাঢ়ের মনক্ষুন্ন হলো। ঝুমঝুমির সাড়া পাওয়ার জন্য নীরাকে বলল, তোমার বান্ধবী গানে তুলো গুজেছে? আমার কথা শুনছে না।
নীরা বলল, ও বেশি কথা বলে না। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে।
আষাঢ় ওহ বলে চুপ করে রইল। তারপর হিরণের দিকে চেয়ে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ইশারা করল। হিরণ ঠোঁট চেপে ভাবলো। হাসির উত্তরে হাসি দিয়ে চোখ টিপলো। পিছন ফিরে মিরাজ,নাজিমকে চোখে ইশারা করতেই ওরা মুচকি হাসলো। মিরাজ পিছনে ঘুরল, তিনজন মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। কন্ঠস্বর ভারী করে বলতে লাগলো, সাপপপপপপপপ পিছনে।
ঝুমঝুমি প্রথম হকচকিয়ে উঠলেও শব্দ করল না। নীরা-তৃষ্ণা চিল্লিয়ে উঠল। দুজন মেয়ের চিল্লানো শুনে গাড়ি থামালো আষাঢ়। ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। যার জন্য মিথ্যা অভিনয় সে কত সুন্দর চুপচাপ বসে আছে। সাপের কথা শুনে কোনো প্রকার রিয়েক্ট করল না। আষাঢ়ের মন মাঝে-মধ্যে চিন্তিত হয়। এই মেয়ে কী মাটির তৈরি জানতে বড্ড ইচ্ছে করে। আশাহত হয়ে পিছনে ঘুরল দেখল ঝুমঝুমি নির্লিপ্ত নির্বিকার ভাবে বসা। তৃষ্ণা-নীরা ভয়ে কাবু। হিরণ আষাঢ়কে বলল,
-” দোস্ত, ভাবী তো আনকমন পারসন। কোনো কিছুই ওর মনকে জাগাতে পারে না। এ মেয়েরে তুই সহজে পাবি না।
-” তবুও আমি ওর থাকতে চাই হিরণ। আমার অস্তিত্ব জোরে শুধু ঝুমঝুমি। নিষ্ঠুর ঝুমঝুমি।
তৃষ্ণা-নীরার চেঁচামেচিতে এবার মুখ খুললো ঝুমঝুমি। ধমকে বলল, গাঁধীর দল গাড়িতে সাপ আসবে কীভাবে? ভয় দেখাচ্ছে আমাদের বুঝিস না?
দুজন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারদিক বুলিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে মিরাজকে বকা শুরু করে । মিরাজ কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনতে লাগলো।
আঁধার নামলো ধরিনি জুড়ে। ঝুমঝুমির হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করল। মনে-মনে দুআ করল এখনই যেন এই সমস্যায় পড়তে না হয়। সমস্যাটা সত্যি হলে লজ্জিত হবে। নীরাকে ফিসফিসিয়ে বলল, রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ানোর জন্য। ক্ষুধা পেয়েছে ওর।
নীরা ভ্রুকুটি করলেও ঝুমঝুমির মুখশ্রী জুড়ে বিন্দু-বিন্দু ঘাম দেখে চিন্তায় পড়ে গেল। আষাঢ়কে বলল ওদের ক্ষুধা পেয়েছে।
নামিদামি এক রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামলো। ভিতরে ঢুকে প্রথম লেডিস ওয়াশরুমে ঢুকলো ঝুমঝুমি। সন্দেহ ঠিক হলো। ইরেগুলার পিরিয়ড ওর জীবনটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বুঝে উঠার আগেই হয়ে যায়। আজ এমন সময়ে হয়েছে ওর মাথা কাজ করছে না। নীরা-তৃষ্ণাকে ডেকে সমস্যার কথা জানানোর পর দুজনেই হতাশ হলো। কত করে বলেছে গাইনী বিশেষজ্ঞ ডক্টর দেখানোর জন্যে কিন্তু ঝুমঝুমি দেখায় না। কারণ, ডক্টরের কাছে যাওয়া মাত্রই অনেকগুলো পরীক্ষা করতে বলে। অনেক টাকা খরচ করতে হয়। বাধ্য হয়েই ভোগ করে ইরেগুলার পিরিয়ড সমস্যা।
তৃষ্ণা বলে, তুই এখানে দাঁড়া আমি সিনোরা কিনে আনছি।
নীরা ঝুমঝুমির পাশে রইল তৃষ্ণা একা চলল।
অনেকক্ষণ ধরে টেবিলে বসে থেকে আষাঢ় উঠে দাঁড়াল। বন্ধুদের উদ্দেশ্য বলল, তোরা বস আমি আসছি। ওরা আসলে খাবার অর্ডার করিস।
আষাঢ় রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে দেখল দূরে তৃষ্ণাকে দেখা যাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করল, তৃষ্ণা ওখানে কী করছে?
প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তৃষ্ণার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, কী হয়েছে তৃষ্ণা? তুমি এখানে কি করছো? ঝুমঝুমি কোথায়?
##চলবে,
#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম
#ফারজানা_মুমু
[১২]
আষাঢ়ের প্রশ্নে লজ্জিত হলো তৃষ্ণা। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে দুচোখের লজ্জা আড়ালে রাখার চেষ্টা করল। আষাঢ় কপালে ভাঁজ করে স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়াল। তৃষ্ণাকে লজ্জা পেতে দেখে আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-” কথা বলছো না কেন?
-” আফা আপনার প্যাড।
ফার্মেসির ছোট্ট ছেলেটির কথা শুনে তৃষ্ণা লজ্জায় মরি-মরি। চট জলদি শপিং ব্যাগের ভিতর প্যাড ভরে টাকা দিয়ে চলে গেল। আষাঢ় আটকাল না। মূলত সে তৃষ্ণাকে লজ্জা দিতে চাইলো না। মনেমনে অংক কষতে লাগলো। দুয়ে-দুয়ে চার মিলাতে খুব একটা কষ্ট হলো না। বুঝল ঝুমঝুমির অস্বাভাবিক আচরণের কারণ। স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ছেড়ে রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকলো।
______________
টেবিলে খাবার রাখা হয়েছে। কিন্তু ঝুমঝুমি কিছুই খেতে পারছে না। পেট ব্যাথায় অস্থির। ঠিক এ সময়ে মৃ’ত্যু ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হয় ও’কে। তীব্র ব্যাথার চটে কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। মুখশ্রী জুড়ে উত্তেজনা ভাব। আষাঢ় খেয়াল করল সব। গোপনে ঝুমঝুমির হাতে ওষুধের প্যাকেট ধরিয়ে ফিসফিস করে বলল, একটু খাবার খেয়ে নাও। তারপর ওষুধ খাবে দেখবে ব্যাথা কমে যাবে।
ঘাবড়ে গেল ঝুমঝুমি। ওর অসুস্থতার কথা আষাঢ়ের জানার কথা নয় তবুও জানে। সন্দিহান নজরে তৃষ্ণাকে দেখে প্রশ্ন করতে যাবে তখন আবার আষাঢ় বলল, তৃষ্ণা কিছু বলেনি। ওকে প্যাড কিনতে আমি দেখেছি। লজ্জা পাবার কিছু নেই। বরং পিরিয়ড হলো নারীর অহংকার। একজন পুরুষের বাবা ডাক শোনার কারণ। পিরিয়ড শুধু একটি মেয়েলি বিষয় নয়, একটি সভ্যতার এগিয়ে যাওয়া। পিরিয়ড নিয়ে কথা বলা, লজ্জার কোনো বিষয় নয়। কিন্তু দেখা যায় অনেক মেয়েরাই লজ্জা-সংকোচের কারণে এ বিষয়ক চাহিদার কথাও পরিবারের সদস্যদের কাছে খোলামেলাভাবে বলতে পারে না। ফলে অসুবিধে বেড়ে চলেছে। পুরষের বাবা হওয়ার সাধ, সন্তানের মুখ থেকে বাবা ডাকার আনন্দ এখান থেকেই উৎপত্তি ঘটে তাহলে লজ্জার কী আছে এখানে?
ঝুমঝুমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল আষাঢ়ের মুখপানে। এই প্রথম কোনো পুরুষকে ওর ভিন্ন রকম লাগছে। অদ্ভুদ মোহনীয় ভঙ্গিতে কথাগুলো বলা আষাঢ়কে হঠাৎই বিশ্বাস করতে চাইছে।
ওদের দুজনের এরূপ ভঙ্গি দেখে কেশে উঠল হিরণ। টিটকারী করে বলল, চোখে-চোখে কথা বলো মুখে কেন বলো না….. মন নিয়ে খেলা কর একি যন্ত্রণা।
আষাঢ় চোখ পাকালো। হিরণ থামলো না বরং হিরণের সাথে-সাথে মিরাজ-নাজিম শুরু করল দুষ্টুমি। ঝুমঝুমি লজ্জায় মুখ লুকানোর জন্য সামান্য খাবার মুখে দিল। আষাঢ়ের দেওয়া ওষুধ খেয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। ব্যাথা কিছুটা কমেছে। দু’চোখ ঘুমে টলমল করছে। নীরার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। আষাঢ় ঘাড় বাঁকিয়ে ঘুমন্ত ঝুমঝুমিকে দেখল মুগ্ধ নয়নে। মেয়েটার সবকিছুই খুব টানে ওকে। জীর্ণ-শীর্ণ মুখটি শুধু ভালবাসার উপযোগী। দেখলেই ভালোবাসা-ভালোবাসা পায়। ভালোবেসে আমরণ অনশন করতে রাজি সে তবে শর্ত একটাই ঝুমঝুমিকে পাশে চায়,কাছে চায়,নিজের একান্ত মানুষরূপে দেখতে চায়।
সাঁই সাঁই করে বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে সবাইকে। হিরণ-নীরাকে দেখে মুচকি হাসলো। নীরা অপ্রস্তুত হয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। নাজিম কবিতা আবৃত্তি করল, হিরণও একা, আর নীরাও একা
প্রেম জমবে ওদের “ঝাকানাকা”
নাজিমের কবিতা শুনে হেসে দিল তৃষ্ণা। মিরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে তৃষ্ণাকে হাসতে দেখে ফিচেল হাসলো। বলল, রাত বেড়াতে এভাবে হাসলে পেত্নী ভেবে ভয় পাবে সকলে।
তৃষ্ণা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ছেলেদের কলিজা থাকতে হয় বড়, মুরগির কলিজা নিয়ে থাকলে সকল হাসিকেই পেত্নীর হাসি ভেবে ভুল করবে। হার্ট অ্যাটাক করবে, অজ্ঞান হবে।
কথায়-কথায় চলল ঝগড়া। ওদের ঝগড়ার মাঝেই হিরণের ফোন আসলো। ‘আব্বা ‘ লিখাটা ঝলমল করল ফোনের স্ক্রিনে। হিরণ রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ঠান্ডা কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-” আব্বা আফনে কোথায়? ফোন ধরেন না কেন?
-” আব্বা আমি ত আপনার বউমাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছি। কীভাবে ফোন ধরব বলুন।
-” আপনারে বলছি কয়টা দিন ধৈর্য ধরতে তবুও আফনে আমার কথা শুনছেন না। আমার ছেলে হয়ে অবিবাহিত মেয়ে নিয়ে ঘুরাঘুরি করছেন লোকে জানলে ভোট দিবে?
-” লোকের ভোটের দরকার কি আব্বা? আমি নির্বাচনের আগের রাতে গিয়ে বেশঅর্ধেক ভোট দিয়ে দিলে হবে না? আপনি শুধু-শুধু চিন্তা করছেন।
মেয়র হান্নান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আব্বা আফনে শুধু ঘুরাঘুরি করেছেন বেশি কিছু তো নয়?
-” আপনার দাদা হওয়ার কাজকর্ম এখনও করা হয়নি আব্বা। চিন্তা করবেন না বিয়ের প্রথম বছরেই আপনার ডজন খানেক নাতি-নাতনী আসবে। আপনাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবে।
মেয়র হান্নান চট করে ফোন কেটে দিলো। লাগাম ছাড়া কথাবার্তা ফুরোবে না হিরণের। ফোন কেটে দেওয়ার পর শুনতে পেল একঝাঁক হাসির রোল। গাড়িতে থাকা প্রতিটি সদস্য হাসছে। ঝুমঝুমি পর্যন্ত হিরণের কথা শুনে হাসলো। হিরণ মাথা চুলকিয়ে নীরার উদ্দেশ্য বলল, আব্বার ইচ্ছেটা পূরণ করবে না নীরু পাখি?
নীরা লজ্জায় ঝুমঝুমির কাঁধে মুখ লুকালো। আষাঢ় চাপড় মেরে বলল, লজ্জা সরম রাখিস একটু। বেলেহাজ কথাবার্তা শুনে নীরা লজ্জা পাচ্ছে দেখ দেখ ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে বাসর ঘরে বসে আছে।
ঝুমঝুমির চোখ কপালে উঠল। লোকটা কথা বলতে পারে। বন্ধুরা সব একই রকম। তৃষ্ণা বাঁকা সুরে বলল, আপনার তো বেশ লজ্জা। লজ্জায় তো মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। এত লজ্জা নিয়া ঘুমান কেমনে?
-‘ তোমার বান্ধুবির চিন্তায় ঘুম কি হয় আমার? ঘুমাতে পারি না সারারাত ধরে,বুকের ভিতরটা ঝুমঝুমি-ঝুমঝুমি করে।
কথার ছন্দে-ছন্দে শেষ হলো রাত্রি যাত্রা। ভোর সকালে বাসার সামনে গাড়ি থামলো। ঝুমঝুমিরা চলে গেল ওদের রুমে। আষাঢ় সারারাত ড্রাইভ করার ফলে প্রচুর ক্লান্ত দেখাচ্ছে ও’কে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া মাত্রই ঘুমের রাজ্য পাড়ি দিল।
________________
সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। নিজের গন্তব্য মত চলতে থাকে। তেমনি ঝুমঝুমির জীবন থেকে চলে গেলো আরো ছয়টি দিন। সারাদিনের ব্যস্ততা নিয়েই নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছে। আষাঢ় বারবার কথা বলতে আসলে,প্রেমের প্রস্তাব পাঠালে ববাবরের মতোই প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছে। চাইছে না ছেলেটাকে কষ্ট দিতে তবুও বিবেকের কাছে হেরে গিয়ে বারবার কষ্ট দিচ্ছে।
ছাদের একোনে সবজি চাষ করেছে ঝুমঝুমি। টবের মধ্য করলা গাছ, মরিচ গাছ,টমেটো, ক্যাপসিকাম থেকে শুরু করে অনেক কিছু। ভোরে পানি দিতে আসার পরক্ষনেই আষাঢ়ের মুখোমুখি পড়তে হলো ঝুমঝুমিকে। পাশ কাটিয়ে চলে যাবার সময় আষাঢ় বাধ্য হয়েই চেপে ধরল ঝুমঝুমির হাত। হেচকা টান দিয়ে শরীর থেকে এক ইঞ্চি দূরত্ব রেখে আহত গলায় বলল,
-” তুমি যা বলবে তাই করব প্লিজ আমাকে একটা সুযোগ দাও। অভিযোগ করতে দিবো না কখনও। আমি তোমাকে খুব চাই ভীষন ভাবে চাই। বিশ্বাস করো তুমি আমার মনে নয় বরং হৃদয়ে থাকবে। অনেক যত্নে রাখব তোমাকে। কখনো কোনো আঘাত তোমায় স্পর্শ করতে পারবে না।
“তুমি সেই কবিতা !
যা প্রতি দিন ভাবি..
লিখতে পারিনা ॥
তুমি সেই ছবি !
যা কল্পনা করি..
আঁকতে পারি না ॥
তুমি সেই ভালবাসা !
যা প্রতিদিন চাই..
কিন্তু তা কখনো-ই পাই না ॥”(কালেক্টেড)
ঝুমঝুমির হৃদয় নাড়া দিল। ইচ্ছে হলো ভালোবাসতে। কিন্তু বিশ্বাস? যেখানে আপনজনদের প্রতি বিশ্বাস আসে না সেখানে আষাঢ় তো অনেক দূরে। তবুও আষাঢ়ের মোহনীয় মাতাল করা দুচোখের দিকে তাকালে ইচ্ছে হয় ভালোবাসতে, বিশ্বাস করতে। দুটনায় পড়ল ঝুমঝুমি। কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল,
-” আমার সময় চাই।
-” কত দিন সময় চাও তুমি?
-” জানি না। তবে আপনাকে নিয়ে ভাবতে হলে সময় চাই আমার।
দুর্বোধ্য হাসলো আষাঢ়। ঝুমঝুমির কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, যত সময় চাও পাবে, তবুও একবার বলো তুমি আমার হবে?
-” আল্লাহ তায়ালা আগে থেকেই ভাগ্য লিখে রেখেছেন। ভাগ্যয় যা থাকবে তাই হবে। আপনার সাথে আমার জুড়ি লিখা থাকলে আমি আপনারই হবো। আর যদি অন্যকারো সাথে হয়ে থাকে তাহলে আমি তার। এব্যাপারে আপনাকে আমি কথা দিতে পারছি না।
ঝুমঝুমির কথা মনে ধরল না আষাঢ়ের। টগবগ করে রাগ বাড়তে লাগলো। হাত মুষ্টি করে রাগ কন্ট্রোল করে স্বাভাবিক ভাবেই বলল, আমি ভীষন ভালো ঝুমঝুমি। আমায় খারাপ বানিও না। তোমার জন্য যদি অতি ভালো ছেলেটা খারাপ হয়ে যায় তাহলে খুব মুশকিল হয়ে যাবে। খারাপকে ভালো বানালে যেমন বাহবা পাওয়া যায় তেমনি ভালোকে খারাপ বানালে জীবনের সুখ হারিয়ে যায়। আমি চাই না তোমার বিরহে বাজে হতে। আমি চাই তোমার মাঝে থেকে আমি ভালো থেকে মহা ভালো হতে।
আষাঢ় পা বাড়ালো। গেইটের কাছে গিয়ে আবারও পিছন ফিরে তাকালো। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে বলল, ভালোবাসি।
##চলবে,,