প্রেমের পাঁচফোড়ন ২ পর্ব-৬৬+৬৭

0
2312

প্রেমের পাঁচফোড়ন💖
#সিজন_২
#পর্ব_৬৬
#Writer_Afnan_Lara
🌸
বিকালবেলা,নামটা শুনলেই মনে হুট করেই একটা আলাদা আনন্দ কাজ করে,চায়ের সাথে একটা বিসকিট এটা ভাবলে তো দিল আমার খুশিতে আটখানা
সারাদিন ধরে কি ঝড় ঝাপটা গেছে তা না ভেবে এখন আমি ভাবছি চায়ে চিনি বেশি দেবো
চিনি হলেই চায়ের আসল স্বাদ বোঝা যায়,তবে বেশিও না আবার কম ও না
এক চামচ চিনি বেশি দরকার হলে আরেক চামচের ১৫%
ভাবতে ভাবতে শান্তর বারান্দার বিন ব্যাগটা থেকে উঠে দাঁড়ালাম চা বানাতে যাব বলে তবে পিছন ফিরতেই দেখলাম আমার রুগী জামাই চায়ের কাপটা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকালো হয়ত ডাকার জন্যই,
রিপা এসে দিয়ে গেছে মনে হয়
আমি এক দৌড়ে এসে হাজির তার কাছে,তার যে অসুস্থতা সেটা আমার মাথায় নেই,এখন আমার মাথায় ঘুরঘুর করছে কখন চায়ে বিসকিট ডুবিয়ে খাব
সাথে দেখছি চিনিছাড়া টোস্ট,মন ভালো করার মেডিসিন হলো চা
ভাবতে ভাবতে আহানা শান্তর পাশে বসে চা আর বিসকিট নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে,শান্ত গরম গরম চা খেতে খেতে আহানার চায়ের প্রতি এমন উন্মাদ হওয়া দেখছে
.
আহানা পুরোটা চা শেষ করে তারপর হাত দিয়ে মুখ মুছে শান্তর দিকে ফিরে তাকিয়ে বসলো,এবার সে গল্প করবে
.
শান্ত ও ফিরলো ওর দিকে
.
তো বলুন আপনি রতনের কি করবেন?
.
আমি তারে জেলে ঢুকাবো,ওসব বাদ দাও,আগে বলো মায়ের মুড কিরকম দেখলে?
.
শান্তি আন্টি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা স্বভাবের একজন মানুষ,তাকে যা বোঝানো হয় তাই বুঝেন,এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আপনি হসপিটাল থেকে এসে তাকে যা বুঝিয়েছিলেন তা তিনি বুঝেছেন
.
হ্যাঁ সেটা ঠিক,তবে মা ওভার টেনসন করে একদম তোমার মতো,তুমি তো পাগলামি শুরু করে দাও
কিন্তু মা নিরবে নিজেকে পোড়ান
.
এটা সবচেয়ে কষ্টের, যাই হোক আপনি বডিগার্ড রাখেন,এত টাকা নিয়ে তো কবরে যেতে পারবেন না,তাই টাকা কাজে লাগান,২/৩টা রাখলেই চলবে,অন্তত আপনার সেফটি জরুরি
ঐ যে শাহরুখ খান যে বডিগার্ড রাখে সেটা রাখেন,একদম সেফ
.
হাসালে আহানা
.
হাসালাম তো হাসেন,তারপর যা বললাম করেন,আমি কিছু শুনতে চাই না,আমার কথা যদি না শোনেন তাহলে কচু গাছে ফাঁসি দেবো
আমি আবার সুইসাইড এটেন্ড করতে অত্যন্ত পটু
আমার হাসবেন্ড বলেছিলো আমার সবকিছু “অত্যন্ত ”
.
শান্ত হাসতে হাসতে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়েছে
.
আহানা মুচকি হেসে বললো”ঝগড়া করবো না আর কোনোদিন, এভাবেই হাসবেন”।
.
নাহ
.
কি নাহ?
.
তোমাকে ঝগড়ায় মানায়,যে সম্পর্কে ঝগড়া হয় না সে সম্পর্ক বেশিদিন টিকে না
ঝগড়া হয়ে আবার মিটমাট হওয়া সম্পর্কগুলো হয় আজীবনকার জন্য,আমি চাই তুমি তোমার মতন থাকো
তোমার কোনো কিছু বদলাতে হবে না
একবার ভেবে দেখো না শুরু থেকেই কিন্তু আমরা ঝগড়া করে এসেছি কিন্তু তারপরেও আজ আমরা স্বামী স্ত্রী
.
সেটা ঠিক তবে আপনাকে হারানের ভয়টা মাথায় আসলে মন চায় আপনাকে নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দিই
.
শান্তর কাশি উঠে গেছে কথাটা শুনে,তারপর কোনোরকম কাশি থামিয়ে সে বললো”থাক থাক,এত এত সেবা লাগবে
না,আগের আহানাই বেস্ট
একটা কথা কি জানো?বেশি কেয়ার করলে সে হয় খালাতো বোন আর ঝগড়া করে মাথা খেলে সেটা হয় বউ
বুঝলে?”
.
আপনার খালাতো বোন আছে?
.
নাহ,থাকলে এতদিনে কাড়াকাড়ি লেগে থাকত
.
তা ঠিক,তবে আমার ইচ্ছা আপনার নানু বাড়ি যাব,কোনোদিন দেখা হয়নি
.
আমার নানু তোমাকে ছোট বেলায় পছন্দ করত না
.
কেন.?কি করেছি
.
উনি যখন বেড়াতে আমাদের বাসায় আসতেন তখন তুমি আমার সাথে খেলতে আমাদের বাসায় আসলে উনার পানের বাটুয়া থেকে চুন চুরি করে নিয়ে সারা মাথায় মেখে সাদা ওড়না গায়ে পেঁচিয়ে পুরো বাড়ি হাঁটতে হাঁটতে বলতে”আমি নানু সেজেছি,আমি নানু সেজেছি”
.
এ্যা মা!!!তারপর?
.
নানু অনেক রেগে যেতেন কারণ তিনি পান খেতেন ঘন্টা পরপর,আর সেখানে তুমি চুন নিয়ে ঝামেলা করতা বলে তার মেজাজ খারাপ থাকতো তার উপর আন্টি তোমাকে পানিতে চুবিয়ে তোমার চুলে হাজার সাবান- শ্যাম্পু দিয়ে চুল পরিষ্কার করতেন
.
তো এখন যদি আমরা আপনার নানু বাড়ি যাই আমাকে কি উনি ভালোবাসবেন না?
.
বাসবে অবশ্যই,আচ্ছা আমি মাকে বলে দেখি তোমাকে নিয়ে একবার নানুবাড়ি থেকে ঘুরে আসবো,আগে আমি সুস্থ হয়ে নিই,এই ব্যান্ডেজ নিয়ে নানুবাড়ি গেলে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আমাকে,আর অনেকে তোমাকে অলক্ষী এওয়ার্ড ও দিয়ে দিতে পারে
.
এ্যা!আমি কি দোষ করছি
.
সেটা তুমি জানো,জামাইরে ভালোবাসো না মনে হয় ঠিকমতন,তাছাড়া জামাই জোর করে ভালোবাসলে দুদিন গাল ফুলিয়ে রাখো তোমাকে অলক্ষী বলবে না তো কি আমাকে বলবে?
.
হ্যাঁ আপনাকেই বলবে কারণ আপনি বিয়ের এক মাস পর আমাকে আই লাভ ইউ বলেছেন তাও আমাকে কত ঘাটের পানি ও খাইতে হয়েছে
.
তুমি তো বলছো ২০দিন পর
.
তো?আপনার আগে বলছি তাই আমি জিতলাম এই যাত্রায়
.
সে যাই হোক কিস করতে গিয়ে তো ১০০বার চড় খেলাম সেটার কি হবে?
তোমাকে তো বক্স অফিস থেকে এওয়ার্ড দেওয়া উচিত চড় দেওয়ার জন্য
.
ভালো ছেলের মতন বিহেভ করলে চড় খায়না মানুষ
.
কিস কি শুধু খারাপ ছেলেরাই করে?
.
সবাই করে,কথা হলো আপনি সিরিয়াস মোমেন্টে কিস করতে আসছিলেন বলে আমি চড় মেরেছিলাম
.
কিস করার সময়টাই তো সিরিয়াস,কি বলো তুমি!
.
না সেটা না,আমি বলছি প্রথমবার আপনি রিয়াজ ভাইয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে আমাকে টেনে কাশফুলের কাছে নিয়ে এসেছিলেন সেখানে আশেপাশে নদীর উপর লঞ্চ স্টিমারে ভর্তি ছিল সেটা সিরিয়াস মোমেন্ট না?তার উপর দ্বিতীয় বার আপনার বুকে ছুরির ক্ষত দাগ ছিলো আমি সেটার দিকে চেয়ে কাঁদছিলাম আর ঐ সময়ে আপনি কিস করতে চেয়েছেন,সেটা সিরিয়াস মোমেন্ট নয়?
.
শান্ত কপাল কুঁচকে বললো”তোমার জন্মের পর আন্টি তোমার মুখে ঝিঙের খোসা দিয়েছিলেন?”
.
আহানা রেগে কুশন দিয়ে শান্তর গায়ে এক বাড়ি দিয়ে উঠে চলে গেলো রুম থেকে
.
শান্ত হাসতে হাসতে বললো”এই আহানাটাকেই চাই,ঝগড়াটে বউ”
.
আহানা একেবারে রাতেই রুমে আসলো তাও শান্তকে ডিনারের জন্য ডাকতে
.
শান্তকে আজ শান্তি রহমান নিজের হাতে খাইয়ে দিলেন,সাথে খাওয়ালেন নিতুকেও
আহানা ব্রু কুঁচকে সব দেখছিলো,ব্যাপারটা শান্তি রহমান বুঝতে পেরে আহানাকেও খাইয়ে দিচ্ছেন এবার
.
চিকেনের পাখনার মাংসটা আহানার ও পছন্দের আর শান্তর ও
মা সেই মাংস দিয়ে লোকমা বানাচ্ছেন,বিষয়টা দেখতে পেয়ে আহানা মুখ এগিয়ে নিলো লোকমাটা ওকে দেওয়ার জন্য,কিন্তু তার আগেই শান্ত আহানার কোমড়ে হাত দিয়ে নিজের মুখটা মায়ের দিকে এগিয়ে ধরলো
.
আহানা হেরে গিয়ে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে,শান্ত দাঁত কেলিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি হেসে যাচ্ছে অনবরত

রতনকে পুলিশ ২দিনের ভেতরেই ধরে ফেলেছে,খাগড়াচড়িতে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে ছিলো সে
শান্ত তার বিশ্বস্ত একজন পুলিশ ফ্রেন্ডকে কাজটা দিয়েছিলো
রতন আপাতত জেলে,১৭তারিখে কোর্টে আনা হবে তাকে,বাস যার থেকে ভাড়া নিয়েছিলো সে পুলিশ কাস্টাডিতে আছে,সব প্রুফ জোগাড় হয়েছে এবার শুধু শাস্তি শোনানোর পালা
তাছাড়া মজনু চাচার ও জেল হয়েছে কারণ কয়েকদিন আগে শান্তর উপর করা হামলার আসল রহস্য বেরিয়ে এসেছে এবং এর মূল হোতা মজনু এরেস্ট হয়েছে
সবকিছু শুনে আহানা এবার পুরোপুরি নিশ্চিত

আহানা????আহানা!!!আমি জামাটা পরতে পারছি না,পরিয়ে দাও না প্লিস
.
আমি গোসলে ঢুকছি মাত্র,আরও আগে বলতে পারেননি?সব আমাকে জ্বালানোর ধান্দা
.
আহানা শান্তকে এক ঝুড়ি বকাবকি করে ভেজা জামা পরা অবস্থাতেই বের হলো বাথরুম থেকে তারপর গাল ফুলিয়ে কাছে এসে শান্তকে ওর টিশার্টটা পরিয়ে দিতে থাকলো
.
স্বামীর সেবা করো তো ঠিকই তার আগে এত কথা শুনাও ক্যান বলোতো?
.
আপনি টাইমলি কাজের ফরমাইশ দেন না
.
কি করবো?ভেবেছিলাম নিজে নিজে পরতে পারবো কিন্তু হাতের জন্য পারছিলাম না বলেই তো ডাকলাম
.
আহানা কপাল কুঁচকে টিশার্টটা সম্পূর্ন পরিয়ে দিয়ে চলে যেতে নিতেই শান্ত ওর হাতটা ধরে ফেললো
.
কি?সময় নষ্ট করছেন কেন,আমার এখন ভেজা জামার কারণে জ্বর এসে যাবে
.
শান্ত আহানাকে জড়িয়ে ধরে বললো”আসবে না,প্যারাসিটামল খেয়ে নিবা
.
আপনার কি আমার জন্য মায়া হয় না
.
হয় বলেই তো বুকে ধরে রেখেছি
.
আহানা মাথা উঁচু করে বললো”শান্ত”
.
হুম বলো বউ
.
ঠাস করে ধাক্কা খাবা জামাই?
.
শান্ত ব্রু কুঁচকে বললো”ক্যান”
.
এরকম রোমান্স সময় অনুযায়ী করিয়েন কেমন?আমার গোসলের সময় কেউ ডিস্টার্ব করলে তার মাথা ফাটাতে ইচ্ছা করে
.
মাফ করো আর ধরব না,যাও
.
শান্ত আরেকদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো এবার
তা দেখে আহানার দয়া হলো কিছুটা
তাই এগিয়ে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সে শান্তকে
শান্তর কিঞ্চিত রাগ নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে,মুচকি হেসে সে পাশে তাকিয়ে বললো”কি ম্যাডাম?গোসলে দেরি হচ্ছে না এখন?”
.
আমার বর রাগ করেছে তাকে চড় মেরে ঠিক করবো বলেই ঝাপটে ধরলাম
.
শান্ত চোখ বড় করে বললো”আহানা মাঝে মাঝে ভাবি তুমি তো আমার বাচ্চাদের দিনে ২০০বার চড় মারবা মনে হয়”
.
ধুর!
.
আহানা গেলো গোসল করতে,শান্তর সাথে দু লাইন কথা বললেই শুরু হয় ঝগড়া,ঝগড়া ছাড়া যেন আর কোনো কথাই নেই

১৫/১৬দিন পর শান্ত সুস্থ হয়েছে প্রায়ই,এখন আর হাতে ব্যান্ডেজ নেই,মাথায় ও নেই,তার অবস্থার উন্নতি দেখে আহানা তো প্রতিদিন শান্ত আর শান্তি রহমানকে দেখিয়ে দেখিয়ে ট্রলি ব্যাগ বাসার সামনের পাকা রাস্তাটায় রোদে দেয়
.
শান্ত ও হাসে,মা ও হাসে,তো সেদিন বিকেলবেলা আহানা মুখ ফ্যাকাসে করে ট্রলি ব্যাগটা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বাসায় ঢুকার সময় শান্ত এসে দাঁড়ালো ওর সামনে
হাত ভাজ করে সে আহানার ট্রলি ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে আছে
.
কি এত দেখছেন?পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিলো বলে রোদে দিয়েছিলাম,আর কিছু না
.
আমি তো কিছু বলিনি
.
হুহ
.
আহানা মুখ বাঁকিয়ে রুমের দিকে চললো
শান্ত ওর পিছু পিছু এসে আলমারি থেকে নিজের জামা বের করতে করতে বললো”তা কেউ চাইলে আমার সাথে আমার নানুবাড়ি যেতে পারে”
.
আহানা তো নিজের কানে শুনেও কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না,এক দৌড় আলমারির কাছে এসে শান্তকে সরিয়ে দিয়ে সে এখন নিজের শাড়ীগুলো নেওয়ায় ব্যস্ত
.
শান্তর নানুবাড়ি হচ্ছে ঝিনাইদহের বেপারি পাড়ায়,তো ঢাকা থেকে গাবতলি গিয়ে সেখান থেকে লঞ্চে যেতে প্রায়ই ৫ঘন্টা পেরিয়ে আরও আধঘন্টা সময় লাগতে পারে
শীত পড়া শুরু বলে আহানা সবার আগে শীতের জামাকাপড় নিচ্ছে,নিজের এবং শান্তর জন্য।
.
সব শাড়ী নিয়েছে আহানা,,কোনো থ্রি পিস নেয়নি,কে জানে নানু যদি রাগ করে,এমনিতেও আগে ভাগে ছোটবেলায় কুকীর্তি করে তার মেজাজ বিগড়ে রেখেছিলাম
চলবে♥

প্রেমের পাঁচফোড়ন💖
#সিজন_২
#পর্ব_৬৭
#Writer_Afnan_Lara
🌸
সবাইকে বিদায় জানিয়ে আহানা শান্ত মিলে গাবতলি পৌঁছালো
এবার লঞ্চ আসার অপেক্ষা,আহানা ছোটবেলায় একবার কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে লঞ্চে করে সেন্টমার্টিনে গিয়েছিলো,অনেক বছর হয়ে যাওয়ায় লঞ্চে উঠার অনুভূতিটা নতুনই মনে হচ্ছে, শান্ত ব্যাগ হাতে নিয়ে রোবটের মতন দাঁড়িয়ে আছে শতে শতের মানুষের ভিড়ে,পাশেই আহানা চিমটি দিয়ে শান্তর জ্যাকেট ধরে আছে,কে জানি যদি হারিয়ে যাই,এত মানুষ জনমে দেখি নাই!
শান্তর পরনে ছিলো মেরুন কালারের একটা জ্যাকেট,চোখে ছিলো কমলা রঙের সানগ্লাস, আর আহানা কমলা রঙের একটা কোটা শাড়ী পরে আছে,চুলে খোঁপা করে সাদা রঙের গাজরা লাগিয়ে রেখেছে তাতে
তো এত এত মানুষের ভিড়ে তাদের দেখে মনে হচ্ছিলো একজোড়া উজ্জ্বল তারা
শত শত তারার ভিড়ে তারা শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা হয়ে প্রোজ্জ্বলিত হয়ে আছে যেন
আহানা তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লঞ্চ গুলোর ফাঁক দিয়ে চেয়ে দূরের পানিতে চলমান লঞ্চ গুলো দেখছে
কিরকম একটা শব্দ এই বাহনগুলোর,আহানার কেমন ভয় ভয় করে এমন শব্দ শুনলেই
লঞ্চ এসে পড়েছে ১৫মিনিটের মধ্যেই,শান্ত এক হাতে ব্যাগ নিয়ে আরেক হাতে আহানার হাত ধরে ওকে নিয়ে লঞ্চে ঢুকতেছে
.
আহানা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতে বললো”খোলামেলা জায়গা দেখে সিট নিয়েছেন তো?আমি কিন্তু ভিতরে বসবো না”
.
শান্ত পিছন ফিরে একবার তাকালো তারপর আবার হাঁটতে হাঁটতে বললো”ঠিক ধরেছো,আমি ভিতরের সিটই নিয়েছি”
.
কিন্তু কেন?
.
এত বাতাসে ঠাণ্ডা লেগে যাবে তার উপর পড়ে যাওয়ার চান্স থাকে
.
না প্লিস আমি বাইরে বসবো
.
সিটে ব্যাগ রেখে না হয় বারান্দা থেকে ঘুরিয়ে আনবো তোমাকে
.
আহানা মুখ গোমড়া করে বাধ্য হয়ে লঞ্চের ভেতরের সিটগুলোয় বসে আছে,শান্ত ওর পাশে বসে ফোনো গেমস খেলছে
সম্ভবত গেমসটার নাম”টিনি হোপ”
সেখানে একটা কিউট লিটল পটকার মতো বস্তু হচ্ছে নায়ক,সে উড়ে উড়ে,ঠেলে ঠেলে লাস্টে একটা গর্তে গিয়ে পড়ে খুশিতে ছলছল চোখে তাকায় থাকে,আহানা মনযোগ দিয়ে দেখলো,ভালোই লাগলো তবে বোরিং ও লাগলো
সব সেম,খালি ঠেলে ঠেলে সে গর্ত পর্যন্ত পোঁছায় আর কোনো কাজ নাই,গেমস হওয়া উচিত ইন্টারেস্টিং,রহস্যজনক,যেমন “ইসকেপ ডোর”ওগুলায় মাথা খাটিয়ে দরজা খুলতে হয়,আমার তো সেই গেমস ভাল্লাগে,আর এই মহাশয়কে দেখো,৫বছরের বাচ্চাদের গেমস খেলছে বসে বসে
.
আহানা এবার তার ডান পাশে তাকালো,একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা বসে আছেন,চোখে চশমা পরা তবে পরনে সেলোয়ার কামিজ,মাথায় ওড়না পেঁচানো,বেশ ভদ্রমহিলা তিনি,চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন,মাঝে মাঝে বলছেন কিরে তোরা আসবি কখন?আমাকে তো নেস নাই আমি নাকি কেঁপে পানিতে পড়ে যাব,ঠিক করিসনি আমাকে না নিয়ে
.
আহানা বুঝতে পারলো মহিলাটির পরিবার বারান্দা দিয়ে পানি দেখতে গেছে সাথে করে তাকে নেয়নি হয়ত তিনি পড়ে যাবেন এই ভয়ে
ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক কারণ এমন দূর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে,
যাই হোক ৫/৬মিনিট ধরে মহিলাটির চেঁচামেচির পর তার পরিবার আসলো
একটি মেয়ে সাথে তার জমজ দুটি ছেলে,বয়স ৫/৬বছর হবে
আহানা তাদের দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে,কি সুন্দর বাচ্চাগুলা,তবে বাচ্চাগুলোর সাথে মেয়েটির চেহারার সাথে মানালো না একটুও,কি হয় সে বাচ্চাদের?
.
মেয়েটা বয়স্ক মহিলাটির পাশে বসতেই আহানা বললো”এক্সকিউজ মি বাচ্চাগুলা কি আপনার? তাহলে কিছু প্রশ্ন করতাম,জমজ বেবি নিয়ে”
.
মেয়েটি কিছুটা চমকালো এমন প্রশ্ন শুনে তারপর বললো “হুম,,এরা আমার বাচ্চা”
.
ওহহ
.
আহানা আর কিছু বললো না
.
আহানা আর কোনো কথা বলছে না দেখে মেয়েটি ফের বললো”পিয়াশ তিয়াশ বাবারা যাও তোমাদের পাপার কাছে”
.
মায়ের কথা মতন বাচ্চাগুলা সিট থেকে নেমে বারান্দার দিকে ছুটলো,মেয়েটি শুকনো মুখ করে আহানার দিকে চেয়ে বললো”আপনার ঐ প্রশ্নের কারন আমি বুঝতে পেরেছি,আসলে ওরা আমার বাচ্চা না,আমি ওদের একটা অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিয়েছিলাম,আমি কোনোদিন মা হতে পারবো না বলে
তবে মনে যত খুঁত ছিলো এদের পেয়ে সব ভুলে গেছি,আমি এখন সুখী,আরও সুখী আমার এমন একজন স্বামীকে পেয়ে যে কিনা আমার অক্ষমতা জেনেও আমার পাশে আছেন আজও
.
আহানা মুচকি হেসে বললো”আলহামদুলিল্লাহ”
.
শান্ত গেমস খেলা রেখে আহানার হাত ধরে এক টান দিয়ে বললো”কি হয়েছে?”
.
একটা প্রশ্ন করি?
.
জি করেন
.
আমি যদি কোনোদিন মা না হতে পারি?
.
এক গবেষনায় দেখা গেছে অধিক ঝাঁঝ আলা মেয়েদের একটা নয় ২টা করে বাচ্চা হয়,সো আমার কোনো সন্দেহ নেই যে তোমার বেবি হবে
.
উফফফ,মজা করবেন না!সিরিয়াসলি উত্তর দেন না
.
বাচ্চাই জীবনের সব কিছু না আহানা!সো ডোন্ট ওয়ারি
.
শান্তর কথা শুনে আহানা খুশি হবে নাকি মন খারাপ করে থাকবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না
.
শান্ত সিটে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে কারণ বিকালে রওনা হয়েছে তারা আর এখন বাজে সন্ধ্যা ৭টা
.
আহানা যখন দেখলো শান্ত ঘুমাচ্ছে সে আস্তে করে উঠলো বারান্দাটা ঘুরে আসবে বলে কিন্তু আফসোস কিসের যেন টান খেয়ে সে এক কদমের বেশি ফেলতে পারেনি সামনে
তাই পিছন ফিরে চেয়ে দেখলো তার হলুদ রঙের শাড়ীটার আঁচল শান্তর হাতে গিট্টু দেওয়া
আজব তো!
গিট্টু দিলো কখন?আর কেনোই বা দিলো?
.
আহানা আবারও ফেরত এসে গিট্টু খোলায় মনযোগ দিয়েছে,শান্ত ততক্ষণে জেগে ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে বললো”কোথায় পালাচ্ছিলা?”
.
আপনি আগে বলেন আমার আঁচল বেঁধে রেখেছিলেন কেন?
.
কারণ তোমার স্বভাবের সাথে আমি খুব ভালোমতন পরিচিত,তুমি যখন দেখবা আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তখনি তোমার মাথায় ভূত চাপবে বারান্দায় গিয়ে নদী উপভোগ করার
.
তো?আমার বর তো আমাকে ঘুরাতে নেয় নাই,গেমস খেলে ঘুমাচ্ছিলো সে তাই বলেই তো চোরের মত যেতে হচ্ছিলো আমাকে
.
ওকে চলেন,আপনাকে নদী দেখিয়ে আনি সাথে একটু চুবিয়েও আনি
.
চুবাবেন আমাকে?
.
হু
.
শান্ত আহানাকে নিয়ে করিডোর পেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো,দূর দূরান্তে নৌকা,স্টিমার,লঞ্চ নজরে আসে শুধু
.
পানির ঢেউয়ে সেসব দুলে যাচ্ছে,পানি এসে বাড়ি খাচ্ছে বারবার
আহানার মন চাইলো একটু ছুঁয়ে দেখার কিন্তু পারলো না তার উপর পাশে শান্ত দাঁড়িয়ে এক হাত তার পকেটে রেখেছে আরেক হাত দিয়ে আহানার কুনুই ধরে রেখেছে যাতে ভুলেও না পড়ে যায় সে
.
দূরে একদম শেষ প্রান্তে লাল লাল হয়ে আছে,যেন অগ্নিশিখা তবে সেটা অগ্নিশিখা নয়,আশেপাশের লাইটের আলো একসাথে হয়ে এমন দেখাচ্ছে,আহানা প্রানভরে পরিবেশটা উপভোগ করছে,আশেপাশে দুএকজন মানুষ ও আছে তবে তারা একটু দূরে,কেউ ফোনে কথা বলছে,কেউ ছবি তুলছে,কেউ বাইরের দিকে চেয়ে আছে
আহানা মুচকি হেসে দূরের একটা লঞ্চের দিকে তাকানোর সময় গালে খোঁচা দাড়ির স্পর্শ পেয়ে চমকে পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলো তার বর চোরের মতন বিহেভ করে একবার এদিক তাকাচ্ছে তো আরেকবার ওদিক তাকাচ্ছে
আহানার বুঝতে বাকি নেই সবেমাত্র তার বর তার গালে চুমু দিয়ে দিয়েছে এরকম পাবলিক প্লেসে
আহানা এদিক ওদিক তাকিয়ে আশেপাশের মানুষদের অবস্থা চেক করলো, সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত
আহানা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দুম করে শান্তর ঘাড়ে একটা কিল বসিয়ে বললো”আর সময় পান না তাই না?”
.
না পাই না,তাই তো এখন দিয়ে দিলাম
.
চলুন ভেতরে যাই,খিধা লাগছে,কি খাব?
.
মা রিপাকে দিয়ে খাবার প্যাক করে দিয়েছে,চলো সেটা খাবো

ঝিনাইদহের বেপারিপাড়ায় এসে দুজনে এবার একটা রিকসা নিয়েছে,শান্তর মামা রিকসাটা পাঠিয়েছেন শান্তদের জন্য
রিকসায় বসে আহানা শান্তর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে,সারারাত সিটে বসে ঠিকমত ঘুম হয়নি তার
শান্ত মন দিয়ে তার নানুরবাড়ি যাওয়ার পথটা দেখতে ব্যস্ত
কতটা বদলে গেছে সব
২বছর আগে লাস্ট এসেছিলো শান্ত এখানে,দুবছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে এখানকার
নানুবাড়ির কাছাকাছি এসে পড়ায় শান্ত আহানাকে ডেকে তুলে বললো”ঠিক হয়ে বসতে,বাড়ির কাছে এসে গেছে তারা”
.
আহানা চোখ ডলে মাথায় ঘোমটা টেনে নিলো,একটা সাইডওয়ালের বিরাট বাড়ি নজরে আসছে,উপরে টিন,সামনে লম্বাতে চিকন মাটির রাস্তা,তার দুপাশে তালগাছ,তালগাছগুলোর গোড়ায় সাদা রঙ করে রাখায় দেখতে বেশ লাগছে
.
আহানা তো অবাক এত সুন্দর বাড়ি আর পথ দেখে,বাড়িটার সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে
আহানা রিকসা থেকে নেমে শান্তর জন্য অপেক্ষা করলো,শান্ত ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললো”চলো”
.
আহানা ওর সাথে সাথে চললো,বাড়ির সামনে শান্তর নানু,নানা,মামা মামি আর তাদের ছেলেমেয়েরা একজোট হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন
.
আহানা গিয়ে সবার আগে নানু আর নানাকে সালাম করলো তারপর মামা মামিকে,উনাদের সকলের মুখে হাসি,অনেক খুশি হয়েছেন তারা শান্ত আর আহানাকে পেয়ে
.
নানু আহানার থুতনি ধরে টেনে বললেন”কিরে শান্ত,এটা সেই মেয়েটা না যে আমার চুনের কৌটা খালি করতো সবসময়?”
.
শান্ত দাঁত কেলিয়ে বললো”ঠিক ধরেছো,এই সেই ধানিলংকা”
.
বেশ করেছিস এরে বউ করে
.
কেন?তোমার যে চুন নষ্ট করতো তোমার কি ওর প্রতি রাগ নেই?
.
নাহ রে কিসের রাগ,ওরে আমি সেসময়ে বকাবকি করতাম ঠিকই তবে ওরে আমি আদরও করতাম,কারণ ও আদর করার মতই ছিলো,ছোটবেলায় গালদুটো টমেটোর মতন ছিল ওর
.
আহানা লজ্জায় নিচের দিকে চেয়ে আছে
.
শান্ত হেসে বললো”এখন মনে হয় টমেটো শুকিয়ে চেরি হয়ে গেছে কি বলো?”
.
সবাই একসাথে হেসে দিলো,আহানা রাগে ফুলে শান্তর দিকে তাকালো একবার
একবার একা পাই এই কথা বলার শাস্তি দেবো!!
.
নানু আহানার হাত ধরে বাসার ভেতর নিয়ে চললেন
বাসার ভেতরে ঢুকলেই যে রুমটা পড়ে সেটাতে সোফা আর একটা খাট,নানু সোজা আহানাকে নিয়ে ভেতরের রুমে একটাতে নিয়ে আসলেন
সেখানে একটা খাট আর একটা টেবিল,রুমটা শান্তর মামাতো ভাই রিফাতের,এখন মেহমানের জন্য খালি করা হয়েছে
শান্ত গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়,সে অনেক টায়ার্ড
আহানা ওকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মামি এসে বললেন”আহানা মা একটু এদিকে আসো”
.
আহানা মুখ ঘুরিয়ে ঘোমটা টানতে টানতে সেদিকে চললো,মামি ওর হাতে একটা ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বললেন”তোমার বরকে নিয়ে খেয়ে নাও এগুলা তারপর একটু রেস্ট নাও,কেমন?”
.
আহানা মাথা নাড়িয়ে আবার রুমের দিকে চললো
.
শান্ত কোলবালিশ জড়িয়ে আরেকদিকে ফিরে শুয়ে আছে
আহানা ওর পিঠে একটা কিল বসিয়ে বললো”নিন,নাস্তা খেয়ে উদ্ধার করেন আমায়”
.
এরকম জোরে কিল মারো কেন?কি করছি?
.
আমার গাল শুকিয়ে টমেটো থেকে চেরি হয়ে গেছে?দাঁত ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দেবো আপনার,স্টুপিড!
.
ওহ সেটা মনে রাখছো এখনও?একটা কথা কি জানো?টমেটোর চেয়ে চেরির দাম বেশি এবং টমেটো থাকে তরকারিতে আর চেরি থাকে কেকের মাঝখানে
.
হইছে হইছে,নিন চা নাস্তা করেন
.
আহানা শান্তর পাশে বসে গপাগপ খাবার শেষ করে আবার ছুটলো বাহিরের দিকে
.
এই আহানা দাঁড়াও
.
কিছে?
.
নতুন বউ এরকম ডাকা ছাড়া বের হয় না মনে হয়
.
আপনাকে এই কথা কে বলেছে?নতুন বউকে ডাকলে সে আসবে এমনি আসবে না এটা আবার কেমন কথা!আমি তো না ডাকলেও যাব
চলবে♥

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে