প্রিয় সুনন্দ – সবুজ আহমেদ মিজান

0
508

#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০

প্রিয় সুনন্দ,
কেমন আছ? অনেক বছর পর তোমাকে এভাবে দেখবো কখনো ভাবনায় আসেনি। বড্ড বদলে গেছে তোমার আগের সেই সুদর্শন চেহারাটা। যে মোহিত চেহারায় ডুব দিয়ে আমি প্রেমের কাব্য সাজাতাম স্বপ্নে, ভাবনায়। সামনে এসে আচ্ছন্ন হতাম নিবিড় সম্মোহনে। অবশ্য আমিও কম বদলে যাইনি। তরুণী বয়সের প্রাণোচ্ছল ছাপ কবেই মিইয়ে গেছে অবয়ব থেকে। বড্ড ফুরিয়ে যাচ্ছি দিনদিন। বাম চোখটাতে আজকাল একটু ঝাপসা দেখি। তোমার মতো আমাকেও চোখে চশমা পরতে হয় এখন। শরীরের চারদিকে জরাজীর্ণ রোগের বাসা। বয়সের দোষ বুঝলে। সব বয়সের দোষ।
.
সুনন্দ, সেদিন বাজারের সামনে স্কুলের গেইটে তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, সাদা পাঞ্জাবীতে চিনতে যদিও একটু সময় লেগেছিল। কিন্তু হৃদয়ে একসময় যে মানুষটা দাপট নিয়ে ঘুরে বেড়াত, তাকে চোখদুটো চিনতে না পারলেও মনটা একচিমটি ব্যথায় ঠিকই চিনিয়ে দিয়েছে। বড্ড সংসারী হয়েছ তুমি, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। হাতে বাজারের ব্যাগ, আঙুলে আবদ্ধ বড় ছেলের কন্যা। মনটা ভরে গিয়েছিল খুব জানো। যে মানুষটা আমার বিয়ের কথা শুনে একদিন নিজেকে চিরকুমার করে রাখার একরোখা শপথ করেছিল, সে’ই এখন সংসারের কর্তা। কত দায়িত্ব তার কাঁধে, কত তাড়া, কত ব্যস্ততা যেন উঁকি দিচ্ছিল চোখজোড়ায়। অথচ দ্যাখো, আমার সংসারের গল্পটা কেবল আমার মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। প্রজাপতি ডানা ছোঁয়া বিয়ের ছয় বছর যেতে না যেতেই সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল। তখন আমার কোলে দুই বছরের এক পুত্র সন্তান। দুকূল ছাপানো কষ্টের মাঝে মুমূর্ষু সংসারটাকে ধীরে ধীরে টেনে তুলেছি। ছেলেটাকে মানুষের মতো মানুষ করেছি। সে এখন আমেরিকায় থাকে। নতুন সংসার পেতেছে সেখানে। আমার এখানেও মিছে মায়া বাড়াতে তিন-চার বছরে একবার আসে কয়েকদিনের জন্য। প্রথম প্রথম বুকভাঙা কান্না পেত ছেলেকে ছাড়া থাকতে। এখন সব সয়ে নিয়েছি। একাকীত্বটাতেও বড্ড বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আর কদিনই-বা আছি পৃথিবীতে বলো!
.
সুনন্দ, জীবনের রঙ হারানোর এই শেষবেলায় এসে ঈশ্বর তোমার সাথে দেখা করাবে তা কল্পনাও করিনি। কী অদ্ভুত দ্যাখো, আমরা এখন একই শহরের বাসিন্দা! মাঝখানে শুধু একটা গলিরই ব্যবধান। গলির মোড়টা পেরিয়ে সবুজ রঙ করা ছোট্ট বাড়িটা আমার বর্তমান ঠিকানা।
.
তোমার মনে পড়ে সুনন্দ, যেদিন তুমি প্রথম আমাদের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরটাতে উঠলে, আমি সেদিন ছাদে আচার শুকোতে দিচ্ছিলাম। আমার ষোড়শী চোখের পাতায় সেদিনই তুমি প্রেমের প্রথম ভাগ খুলে দিয়েছিলে। এক অনামী, অচেনা পুরুষ হয়েও মুহূর্তেই ছুঁয়েছিল আমার অতলান্তিক হৃদয়। তোমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলেছিলাম, ‘বলা নেই কওয়া নেই ঘরে ঢুকছেন যে!’ তুমি কোনো উত্তর না দিয়েই লজ্জাবনত চোখে হুরহুর করে ঘরে প্রবেশ করেছিলে। পরে বারান্দায় গিয়ে শুনলাম, তুমি বউদির দূর সম্পর্কের এক দাদা হও। চাকরীর সুবাদে আমাদের বাড়িতে থাকবে কিছুদিন। তোমাকে দেখার তৃষ্ণায় মাঝেমধ্যে চা দিয়ে আসতাম। তুমি যখন শব্দ করে চা খেতে আমি আড়াল থেকে শব্দটা শুনতাম। সেই চায়ের পর্ব কখন যে চাওয়ার জন্ম দিলো মনে তা আমারই অজানা ছিল। আচ্ছা সুনন্দ, এখনও কি শব্দ করে চা খাও?
.
একদিন চা দিতে গিয়ে দেখি, তুমি টেবিলে বসে কী যেন লিখছো! আমাকে দেখে দ্রুত লেখা বন্ধ করে কাগজটা বই দিয়ে ঢেকে রাখলে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়েছিল তখন। ভেবেছিলাম, প্রেমিকাকে চিঠি লিখছো তুমি! তার পরপরই দাদার ডাকে তুমি নিচের কক্ষ যেতেই আমি চুপিচুপি সেই চিঠিটা মেলে পড়ি। আর পড়তেই সে কী লজ্জা আর রাগের যুগপৎ অনুভবে ভাসছিলাম আমি! তোমার মাকে লেখা চিঠিতে আমাকেই ভালোলাগার কথা লিখেছিলে তুমি। সেদিন মেঘ না চাইতেই একমুঠো জল হয়ে আমাকে ভিজিয়েছিলে অনুরাগের বৃষ্টিতে। কেমন করে যেন শুরু হলো আমাদের অনবরুদ্ধ ভালোবাসার অধ্যায়। কয়েকদিন করে করে চারটি বছর পার করলে আমাদের বাড়িতে থেকেই। একসাথে দুর্গাপূজোয় ঘোরাঘুরি, ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো, দীপাবলির রাতে আলোভরা উঠোনে দুজনের হৃদয়ের অলিগলি চষে বেড়ানো…সবকিছুই যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল। দেখতে দেখতে আমাদের প্রেমের বয়স তখন তিন বছর।
.
সুনন্দ তোমাকে যখন শেষবার দেখলাম, তখন আমার গায়ে কাঁচা হলুদের ঘ্রাণ। মনে পড়ে তোমার? পুরো বাড়িতে বিয়ের সাজ, বাদ্য বাজছিল একনাগাড়ে। তুমল বৃষ্টিও ছিল সেদিন। গায়ে হলুদের মঞ্চে একবার আমাকে দেখেই সেই যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে আর তোমার খোঁজ পাইনি। ঝড়ের মতো এসে যেভাবে আমাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিলে, বৃষ্টির জলে সেভাবেই আবার ভিজিয়ে হারিয়ে গেলে আমার জীবন থেকে। দ্বিরাগমনে এসে তোমার বাড়ি ছাড়ার খবর যখন পেলাম, তোমার ঘরটা তখন তন্নতন্ন করে খুঁজেছিলাম। যদি তুমি কিছু লিখে গেছ আমার জন্য! কিন্তু না সুনন্দ, কিছুই লিখোনি তুমি। শুধু ধুলোপড়া টেবিলটাতে তোমার চশমাটা পড়ে ছিল। সেটা হাত দিয়ে ছুঁতেই বুকটা মোচড়ানো কান্নারা যেন হুরমুড়িয়ে চোখ বেয়ে নেমে আসতে শুরু করলো। চোখ মুছে তোমার শেষ চিহ্নটা সেদিন রেখেছিলাম আমার ভালোবাসার সাক্ষী করে। ঠিক এখনও যেভাবে যতন করে রেখেছি চোখের উপর।
.
আমি জানি সুনন্দ, আর কিছুই চাওয়ার নেই, পাওয়ার নেই আমাদের মাঝে। দুটো পথ যখন দুদিকে আমাদের আলাদা করে দিয়েছে। সেখান থেকে আর ফিরতে পারবো না কোনোদিন। তবুও ভালোবাসায় যদি কোনো পুনর্জন্ম থাকে আমি সে জন্মেই তোমার নাম নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। ঈশ্বরের পাশে তোমাকেও রাখতে চাই আমার পূজোর দেবতা হিসেবে। সেদিন আমাকে ছেড়ে হারিয়ে যেও না সুনন্দ। তুমিহীন শূন্যতা কী যে কষ্টের তা আমার চোখযুগল দেখলেই বুঝতে তুমি!
অনেক রাত হলো। ঘুমের জন্য চোখদুটো কেমন খচখচ করছে। আর লিখতে পারছি না। পারলে একবার এসো আমাকে দেখতে সুনন্দ। না হয় তোমাকে দূর থেকে দেখেই আমার প্রাণটা খানিক জুড়াবো। ভালো থেকো।

ইতি
তোমারই হারানো নন্দিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে