#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০
চিঠি নং ০১
প্রিয় মা,
তোমাকে কতোখানি ভালবাসি কখনো মুখ ফুটে বলতেই পারিনি। মা ডাকটা নাকি অতি সুমধুর! আমার জন্ম তো মা তোমার গর্ভেই,মাগো আমার ডাক কি মধুর লাগে নি তোমার কাছে??
তোমার আর বাবার যখন বিচ্ছেদ হয়ে যায়,তখন আমার জীবন ছিল ভাসমান। তোমাদের দুজনের অভিমানের গন্ডির মাঝ বরাবর ছিলাম আমি।
তোমাদের দুজনের দায়িত্ব ছিল আমার খেয়াল রাখা। কিন্তু তুমি মাঝপথে আমাকে আর বাবাকে দুঃখের অতল গহবরে তলিয়ে চলে গেলে। বাবার ভালবাসাকে তুচ্ছ ভেবে গড়ে ওঠা স্বপ্নগুলো ধুলিসাৎ করে চলে গেলে। বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমাকে আটকাবার সাহস পায়নি। চোখের জলে বুক ভাসানো ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না মানুষটার।
তোমার আর বাবার সম্পর্কটা মরিচিকা ধরে গেছিল। সম্পর্কের ফাটল জোড়া লাগে না হয়তো। একজীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছো হয়তো,তাইতো আরেক জীবনে সুখের সন্ধানে নেমেছো। সেই সুখ হয়তো পেয়েছ,তাই আর আমার খোঁজ নাও নি।
তোমাদের দুজনের মাঝখানে ঝুলে ছিল আমার জীবন। আমাদের ভালবাসাকে জলাঞ্জলি দিতে একটুও কি বুক কাঁপে নি তোমার? তুমি কি পারতে না আমার মুখ চেয়ে বাবাকে মানতে??বাবা আমার দেখতে কুৎসিত ছিল হয়তো। কিন্তু খারাপ ছিল না। আমি হাজার বার তাকে চুমু খেয়েছি।বিশ্বাস করো মা আমার একটুও ঘৃণা লাগে নি। বিচ্ছেদের সময় যখন তুমি চলে যাচ্ছিল,তখন আমি তোমার আঙুল মুষ্টিমেয় করে ধরে রেখেছিলাম। ছোট ছিলাম তবুও এটুকু বুঝেছিলাম তুমি আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছ। আমার সেই মায়া জড়ানো কন্ঠের ডাক তোমাকে ফেরাতে পারে নি।
তারপর যখন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত,বিছানায় হাত বুলিয়ে তোমাকে খুঁজে পেতাম না বলে চিৎকার করে কান্না করতাম। তখন বাবার চোখ আদ্র হয়ে উঠতো করুণ সুরে বলতো মাকে এনে দেবো সোনা আর কাঁদে না। বাবাই তখন আমাকে বুকে জড়িয়ে নিতো। তবুও আমি চারিপাশে শুধু মা মা করে ডেকে বেড়াতাম। বাবা আমাকে নতুন একটা মা এনে দিয়েছিল। মাগো,তোমার মতো তারও হয়তো আমার মা ডাকটা মধুর লাগেনি। যতদিন বাবা বেঁচে ছিল ততদিনে এটা বুঝতেই পারিনি। তোমার মতো বাবাও আমাকে ফাকি দিয়েছে,আমাকে না বলেই না ফেরার দেশে চলে গেছে। লোকে বলে যার বাবা নেই তার অর্ধেক পৃথিবী নেই,আর যার মা নেই তার পুরো পৃথিবী নেই। কিন্তু আমার বেলায় উল্টো ছিল। বাবাকে হারিয়ে বুঝেছি বেদনা কাকে বলে! বাবা নামের ছায়াটা হারিয়ে বুঝতে পেরেছি রোদের তীব্রতা কতোটা প্রখর আমার জন্য।
আমি আমার বাবার কাছে রাজকন্যা ছিলাম। বাবার আকাশে ইচ্ছেমত ডানা মেলে উড়ে বেড়াতাম। খেতে না চাইলে বাবা আর আমার নতুন মা আমাকে জোর করে খাওয়াতো। কোনো কাজ করতে দিতো না। কিন্তু এখন আর কেউ খোঁজ রাখে না আমার। ছোট মা এখন আর আমাকে সহ্য করতে পারে না দুর দুর করে।
জানো মা,আমি এখন ঘর মোছা,রান্না করা,থালাবাসন ধোয়া সব করতে পারি। তোমার সেই ছোট্ট মেয়ে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তোমাকে খুব মনে পড়ে। ছোটবেলায় যখন তোমার কথা মনে পড়তো,চিঠি লিখে আকাশে উড়িয়ে দিতাম। আদৌ সেই চিঠি তোমার কাছে পৌছাতো কিনা না জেনেই অভিমান করতাম। এখন আর সেই অভিমান নেই। একজন ক্যান্সার রোগীর রাগ-অভিমান,বেদনা- যাতনা কিছুই থাকতে নেই। তবে তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছা করে। শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না আজকাল। সকলে আমার থেকে দূরে দূরে থাকে। আচ্ছা মা ক্যান্সার কি ছোঁয়াচে রোগ?? মাগো আমিতো চিরকাল ভালবাসার কাঙাল। সুখ পাখি কিছুতেই থাকতে চাই না বেশিক্ষণ ।
কাল রাতে বাবাকে স্বপ্নে দেখেছি। আমাকে বাবার কাছে নিতে চাই । আমাকে ছাড়া সেও বোধহয় ভালো নেই। খুব শীঘ্রয় বাবার আর আমার দেখা হবে। আমার প্রাণ বায়ু এখন কচু পাতার পানির ন্যায়। জীবনের প্রদীপ নেবার আগে তোমায় দেখার যে বড়ই স্বাদ।
কতোদিন হয়ে গেছে মাগো, তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াও না। সময় পেলে দেখে যেও।
ইতি তোমার অভাগী মেয়ে
আখিঁ আক্তার