প্রিয় অভিমান পর্ব-০৫

0
1118

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৫|

রনক ভয়ে ভয়ে রুহানির বাড়ির ভেতরে পা রাখল। রুহানি সামনে আর রনক পেছনে। রনক থমকে দাঁড়িয়ে রইল। এত বড় বাড়ি আর এমন চোখ ধাঁধানো লাইটিং আর দামী দামী আসবাবপত্র এর আগে ও দেখে নি। রনকের কেমন ভয়ও লাগছে। বুক ঢিপঢিপ করছে। বারবার শার্ট টেনে ঠিক করছে। পায়ের দিকে তাকিয়ে ওর পিলে চমকে গেল। সেলাই করা পুরনো জুতার মধ্যে ধুলোমাখা পা। ধুলো পায়ে এত চকচকে ফ্লোরে পা রেখেছে যদি নোংরা হয়ে যায় আর যদি কেউ বকে। রনকের ভয় লাগছে। আর ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। গলা শুকিয়ে আসছে। নিজেকে এই পরিবেশে বেমানান লাগছে। রুহানির বাবা-মা কি বলবে ওকে দেখে সেটাও ভাবছে। যদি অপমান করে? নাটক-সিনামায় তো তাই করে।

রুহানি রনককে সামনে না পেয়ে পেছনে ঘুরে দেখে ও দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি রনকের সামনে গিয়ে বলল,
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

রনক ভয়ে ভয়ে বলল,
“আমার ভয় লাগছে।”

রুহানি অবাক হয়ে বলল,”কেন?”

রনক কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
“আচ্ছা তোমার বাবা-মা কি জানে আমার ব্যাপারে? তারা রাগ করবে না তো আমাকে দেখে?”

রুহানি চিন্তিত মুখ করে বলল,
“তাই তো! বাবা-মাকে তো বলি নি তোর কথা। এখন কি হবে? যদি রাগ করে?”

রুহানির চিন্তিত মুখ রনকের আতংক বাড়িয়ে দিল। রনকের মুখটা চুপসে গেল।
রুহানি বেশ মজা পাচ্ছে। তারপর বলল,
“আমার মা কিংবা বাবা দেখলে বলব আমি চিনি না। তারপর আর কি চোর মনে করে তোকে ইচ্ছেমতো ধোলাই করবে তারপর পুলিশে দেবে।”

রনকের বুকটা রুহানির কথা শুনে কেঁপে উঠল। তাহলে এই ছিল রুহানির মনে। এইজন্য এত খাতির করেছে। এভাবে ফাসাবে?
রুহানি রনককে ধমক দিয়ে বলল,
“চল! আমার বাবা-মা কি তোকে গিলে ফেলবে না-কি? আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

রুহানি একজন সার্ভেন্টকে সব বুঝিয়ে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। সার্ভেন্ট রনককে একটা রুমে নিয়ে ওয়াশরুম দেখিয়ে বলল,
“স্যার, আপনি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। আপনার লাঞ্চ আসছে। লাঞ্চ শেষে স্টাডি রুমে যাবেন।”

সার্ভেন্ট চলে গেল। রনক হা করে আছে। এত সুন্দর একটা মেয়ে ওকে স্যার বলে গেল। রনকের মাথা ঘুরছে সব দেখেশুনে। রনক ফ্রেশ হয়ে বের হতেই টেবিলের উপর খাবার দেখল। কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেও ক্ষুধা পেয়েছে তাই খেয়ে নিল।

রুহানিকে পড়াতে গিয়ে পড়ল আরেক বিপাকে। কোন কিছুই মাথায় ঢুকাতে চায় না। বারবার রনককে দোষারোপ করে বলে ও না-কি ইচ্ছে করে ওকে কঠিন কঠিন পড়া পড়াচ্ছে। পড়া শেষ করতেই রুহানি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলল,
“এডভান্স দিলাম। আর ড্রাইভার তোকে দিয়ে আসবে।”

রনক জোর করে হেসে বলল,
“তার দরকার হবে না। আমি যেতে পারব।”

রুহানি চোখ পাকিয়ে তাকাতেই রনক চুপ হয়ে গেল।

মেসে গিয়ে গা এলিয়ে দিল রনক। ভাবছে কত শান্তির একটা টিউশনি পেয়েছে। গাড়িতে করে যাচ্ছে, গাড়িতে করে মেসে আসছে। আগে পায়ে হেঁটে যেত আবার পায়ে হেঁটে ফিরত। রনক ভাবছে কিছু টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে আর বাবাকে বলবে রূম্পা, টুম্পাকে কিছু যেন কিনে দেয়। উঠে গোসল করতে গেল। আবার টিউশনিতে যেতে হবে।

রুহানি আর ওর মা বাবার সাথে একটা বিজনেস পার্টিতে গিয়েছে। গাড়ি থেকে নামার সময় পাশের সাদা গাড়ি থেকে ফালাককে নামতে দেখল। স্যুট কোর্ট পরা। ওর গেটাব দেখে মনে হচ্ছে কোনো কোম্পানির হাই পোস্টে আছে আর সে কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছে। কিন্তু ও তো স্টুডেন্ট। রুহানির কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
রুহানি ভেতরে গিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে ফালাককে খুঁজতে লাগল। ও ভুল দেখেছে কি-না সেটা কনফার্ম হতে চায়। অনেক মানুষই থাকতে পারে যাকে কিছুটা ফালাকের মতো দেখতে লাগে।

রুহানি ফালাককে খুঁজে না পেয়ে হাল ছেড়ে দিল। বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর হাতে কোল্ড ড্রিংক।

ফালাক একজনের সাথে কথা শেষ করে সামনের দিকে যাচ্ছিল। হটাৎ করে ও থমকে দাঁড়িয়ে গেল। রুহানি হাতে গ্লাস নিয়ে হেসে হেসে মধ্যবয়সী একজনের সাথে কথা বলছে। তবে এ রুহানিকে চেনা যাচ্ছে না। পার্পল কালার ড্রেস, ম্যাচিং করে কানে এয়ারিং, গলায় চিকচিক করছে ছোট একটা লকেট, হাতে ব্রেসলেট, মুখে হালকা মেকাপের সাথে চোখে কাজল আর ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। চুলগুলো কার্লি করা। আজ প্রথম ওকে মেয়ে লাগছে। ভার্সিটিতে জংলী মেয়ের মতো লাগে। ছেড়া ফাটা জিন্স, শার্ট, টপসের সাথে এলোমেলো চুলে ওকে কখনো মেয়ে লাগে নি। কখনো মোহনীয় লাগে নি। রুহানির হটাৎ ফালাকের চোখে চোখ পড়ল। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। রুহানি চেয়ে চেয়ে ভাবছে তাহলে ভুল দেখে নি, ওকেই দেখেছে। আর ফালাক অন্যরকম রুহানিকে অবাক চোখে দেখছে। হটাৎ ফালাকের হুশ হলো ও কি করছে।
ফালাক দ্রুত চোখ সরিয়ে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রুহানি ওকে ফলো করছে। নামি-দামি বিজনেসম্যানদের সাথে কথা বলছে। রুহানির খটকা লাগছে।

পার্টি শেষে রুহানি বাবা-মায়ের সাথে বাড়িতে ফিরছে। বাড়িতে ওর ভাই একা আছে। ফালাকও চলে যাচ্ছে। বাড়িতে গিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। ফালাক গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে। তখন পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে আর একটা গাড়ি যাচ্ছে।

রুহানির দিকে আরেকবার চোখ পড়ল। গাড়ি স্লো করে যাচ্ছিল তাই বেশ দেখা যাচ্ছিল। রুহানি জানালার গ্লাস বন্ধ করে দিল।
ফালাক ড্রাইভ করছে আর ভাবছে রুহানির কথা। একটা মেয়ের কত রুপ তাই ভাবছে।
“আচ্ছা, রুহানিকে শাড়ি পরলে কেমন লাগবে? আর সেলোয়ার-কামিজে? নিশ্চয়ই অন্য রকম লাগবে। চেনা যাবে না। হয়তো ভয়ংকর সুন্দরী লাগবে।”
ফালাক কল্পনা করার চেষ্টা করছে। তারপর ওর খেয়াল হলো ও কি করছে।

নিজের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“ফালাক কি করছিস! পাগল হয়েছিস! কল্পনা করছিস? কল্পনার ঠেলায় সোজা উপরে চলে যাস না। মন দিয়ে ড্রাইভ কর।”
তারপর নিজের অজান্তেই মুচকি হাসল।

ফালাক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোর্ট খুলছে। আর ভাবছে ওর এই গেটাবের সাথে রুহানিকে কি মানাত? এক সাথে দাঁড়ালে কেমন লাগত।

তারপর আবার নিজের উপর বিরক্তি প্রকাশ করল।
“ওই অসভ্য, পাগল, তারছেড়া মেয়েকে নিয়ে কি ভাবছিস? ও তো মেয়ের ক্যাটাগরিতেই পড়ে না। বেয়াদব, অহংকারী, নিষ্ঠুর একটা মেয়ে। ওকে নিয়ে কি ভাবছি! ও আমার ভাবনার যোগ্যই না। উফফ, মাথা খারাপ করে দিল।”

ফালাক জোর করে নিজের ভাবনা আর কল্পনা থেকে রুহানিকে বের করে শক্তপোক্ত লক করে নিল নিজের মনের।

রুহানি বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আজকে কাকে মুরগী বানানো যায় তাই ভাবছে। রুহানি রনককে দেখতে পেয়ে ডাক দিল। রুহানির বন্ধুরা রনকের সাথে মেলামেশাটা একদম পছন্দ করে না। কিন্তু রুহানিকে খুলাখুলি কিছু বলতেও পারছে না।

রনক রুহানির সামনে এসে গুটিশুটি হয়ে দাঁড়ায়।
“বস! এখন তো ক্লাস অফ।”

রনক ওদের সাথে বসল। ফালাক ভার্সিটিতে তরিঘটি করে ঢুকছে। রুহানি ফালাককে দেখে বলল,
“কাল এটাকে পার্টিতে দেখেছি। একদম অন্য গেটাবে। ওকে দেখলেই আমার হাত ইসপিস করে।”

রনক শুনে বলল,
“কেন?”

“কারণ ও একটা ফাজিল।”

“ফাজিল! কই ছেলেটাকে তো যথেষ্ট ভদ্র মনে হয়।”

“ভদ্র না ছাই! ও যে কি তুই জানিস না।”

“কিন্তু সেদিন তো আমার সাথে কথা বলল। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। উনি যথেষ্ট ভদ্র, মার্জিত একটা ছেলে।”

রুহানি ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“ওই তুই আমার ফ্রেন্ড না-কি ওর? তুই জানিস ও আমাকে কি বলেছে? আমাকে বিল্লি রাণী বলেছে। আমার চোখ নাকি বিড়ালের মতো। কতবড় বেয়াদব। ওর চোখ যে খাটাশের মতো তা কি দেখেছে? আমি তো বলে দিয়েছি। আর তুই যদি আর একবার ওর সুনাম করিস তোর হাড়-গোড় ভেঙে দেব।”

রনক আর কিছু বলবেও না। সেদিন রনক ওকে এই বিড়ালের চোখের কথাটা বলেছে আর সেটাই রুহানিকে বলেছে। ভাগ্যিস নামটা বলে নি।
রুহানি যদি জানতে পারে ওকে আস্ত রাখবে না। মেরে একদম গেড়ে দেবে। তাই রনক চুপ করে গেল।

রুহানির বন্ধুরা খুশি হলো। রনককে রুহানি বকেছে। রনককে শুধুমাত্র ওর জন্য সহ্য করছে নয়তো আশেপাশে ঘেঁষতে দিত না।

তায়েফ রুহানিকে এসে বলল একটা জুনিয়র মেয়ে ওকে অপমান করেছে। ওর নামে কমপ্লেইন করেছে। মেয়েটাকে অন্যদিনের মতো র‍্যাগিং দিয়েছিল। রুহানির রাগ লাগছে আজকাল সবাই জবাব দিতে শিখে গেছে। সেদিন ফালাক জবাব দিল আর আজকে জুনিয়র মেয়ে! না এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। ডানা গজানোর আগেই ভেঙে দিতে হবে।

রুহানি গেল ওই মেয়েকে শায়েস্তা করতে। দুটো মেয়ে এক সাথে বসে আছে। দুজনেরই মুখ ভার।
রুহানি ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু ওরা খেয়াল করে নি। রুহানি টেবিলে চাপট মেরে বলল,
“এখানে তুলি কে?”

ওরা দুজনেই ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। রুহানির দিকে ভয়ে ভয়ে চেয়ে আছে। রুহানি বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কানে সমস্যা না-কি? ”

একটা মেয়ে হাত ঘষতে ঘষতে নিচু স্বরে বলল,
“জি আপু আমি।”

রুহানি ভ্রু কুঁচকে মেয়েটাকে দেখে নিয়ে বলল,
“এতবড় স্পর্ধা! আমার গ্যাংয়ের নামে কমপ্লেইন করেছো?”

তুলির পাশের মেয়েটা বলল,
“আপু এতে ওর দোষ নেই। ও কমপ্লেইন করে নি। আমি করেছি।”

রুহানি অবাক হয়ে বলল,
“তুমি! এক জনের জন্য আরেকজন? কেন?”

মেয়েটা কথা বলছে না। আর তুলি মেয়েটা বারবার হাতের এক জায়গায় অন্য হাত দিয়ে ডলছে। ব্যাপারটা রুহানির চোখে পড়েছে। মেয়েটার চোখ পানিতে পূর্ণ হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখুনি অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়বে।

তুলি ধরা গলায় বলল,
“ওই ছেলেটা আমার হাত ধরেছিল। আমি নতুন তাই চুপ করে ছিলাম। আড়ালে চোখের পানি ফেলেছি। কিন্তু ও সহ্য করতে না পেরে কমপ্লেইন করেছে। গায়ে হাত দেওয়া কি ধরনের র‍্যাগিং?”

রুহানির মাথায় আগুন জ্বলে গেল তুলির কথা শুনে। ভরা মজলিসে তায়েফের সামনে গিয়ে ঠাটিয়ে চড় মারল। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। ফালাক কফিতে চুমুক দিতে দিতে ওদের কাহিনী দেখছে। ঘটনা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তাই দেখার অধীর অপেক্ষা।

তায়েফ গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে রুহানির দিকে চেয়ে আছে।

রুহানি ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“র‍্যাগিং! মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া র‍্যাগিং? এরপর যদি কারো গায়ে হাত দিস, মেয়েদের অসম্মান করিস তাহলে আমি তোর হাত ভেঙে দেব। শুকরিয়া কর একটা চড় মেরেছি।”
রাগে রুহানির শরীর থরথর করে কাঁপছে।

চলবে….!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে