Monday, October 6, 2025







প্রিয় ভুল পর্ব-৯+১০

#প্রিয়_ভুল
লেখাঃ #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

পরদিন সকালে মীরা ঔষধ আনতে বের হয়ে ফোন করে ওর বান্ধবী লিপির কাজিন পাভেলকে। পাভেল একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী। ওদের সংগঠন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, প্রায় প্রতি বছরই শীতে গরম কাপড়ও বিতরণ করে, তাছাড়া দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগী যারা টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারে না তাদেরক আর্থিক সাহায্য করে। মীরা নিজেও গত বন্যার সময় ওর পরিবার আত্নীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে সাহায্য তুলে জমা করেছিলো ওদের সংগঠনে। শীতের সময় কাপড় জোগাড় করে দিয়েছিলো বেশ কয়েকবার। মীরা নিজে স্কাউটের সদস্য হওয়ায় বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে ছোটবেলা থেকেই সক্রিয় ছিলো। সেই সুবাদে পরিচয় পাভেলের সাথে।

লিপি প্রথমেই বলেছিলো পাভেলকে ব্যাপারটা জানাতে। কিন্তু কেম যেন বাঁধো বাঁধো ঠেকেছে ওর কাছে। পরে লিপি সব জানিয়েছিল পাভেলকে। ও কাগজপত্র চেয়ে পাঠিয়ে ছিলো মীরার কাছ থেকে। মীরা ওকে দিয়ে ছিলো সবই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মীরার টাকাটা জরুরি দরকার ছিলো। আর ওদের সংগঠন তো জমানো টাকা দেয় না, টাকা তুলে তারপর দেয়। সেক্ষেত্রে সময় লাগে অনেক। তার উপর কাগজপত্র যাচাই বাছাইয়ের একটা ব্যাপার থাকে। সে জন্য মীরা সে আশা বাদ দিয়ে নিজেকে বন্ধক রেখেছিলো রাহাতের কাছে।

এতদিন এইসব ঝামেলায় এ কথা ভুলেই গিয়েছিল মীরা। গতরাতে লিপি কল করায় মনে পরে কথাটা। কেন জানি তখন ওর মনে হয় এটা হয়তো রাহাত নামক রাহুর বলয় থেকে নিজেকে বের করে আনার একটা রাস্তা হলেও হতে পারে। শেষ চেষ্টা যে করবে তার জন্য মানসিক শক্তি নেই ওর।

আজ সকালে খবর এসেছে কিছু টাকা জমা হয়েছে, তা দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে। লিপি সব খুলে বলেছ পাভেলকে৷ কর্তৃপক্ষ যদি জানে যে রাজিবের চিকিৎসা হয়ে গিয়েছে তাহলে তারা আর সাহায্য করবে না। পাভেল বললো-
: ” দেখো মীরা লিপি সব বলেছে আমাকে, আমি জানি তুমি কী রকম পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছো। তাছাড়া তুমি কেমন মেয়ে, আমি তা জানি, শুধু তোমার জন্য এ কাজটা করছি আমি। জানা জানি হলে আমার এতো দিনকার রেপুটেশন নষ্ট হবে, তুমি ব্যাপারটা সাবধানে হ্যান্ডেল করবে প্লিজ, ভিজিটিং এ যদি আসে তাহলে তাদেরকে বিশ্বাস করাতে হবে যে আমরা যা বলছি তা সব সত্যি”
: ” আমার নিজের ও তো কত দরকার টাকা গুলো, আপনার রেপুটেশন আমি নষ্ট হতে দিবো না ভাইয়া৷ আপনি শুধু আমাদেরকে উদ্ধার করুন, আমার হাতে সময় খুব কম”

দুদিন পর পাভেল মীরাকে কিছু টাকা দেয় পাভেল। বলে এটা সাবধানে রাখতে। এ সপ্তাহের মধ্যে আবার কিছু টাকা আসার কথা আছে, তবে সমস্যা হচ্ছে টাকাটা এবার ফান্ড ম্যানেজার নিজে হসপিটালে ভিজিট করার পর দেয়া হবে। তার রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বাকী টাকা পাবে তোমরা।

মীরার মাথায় বাজ, কারন ওরা তো বাসায় এসে পরেছে। হসপিটালে তিনি আসবেন কিভাবে? লিপি আর কোচিং এর স্যার বুদ্ধি দিলো কোন এক বাহানায় রাত করে ইমারজেন্সীতে যেতে। তারা অনেক সময় অবজারভেশনে রাখতে রোগীকে হসপিটালে রাখে কিছুক্ষণ। বাকীটা আমরা ম্যানেজ করে নিবো।

সেই প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হলো। পেট ব্যাথা নিয়ে হসপিটালে গেলো ওরা। ডাক্তার অবজারভেশনে রাখলো রাজিবকে। কিন্তু সমস্যা হলো ম্যানেজার সেদিন এলো না। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা, সিচুয়েশন সব অনুকূলে রাখা খুব টাফ। কারন পরদিনই যদি আবার যায় হসপিটালে একই বাহানায় হসপিটালের লোকেরা বুঝে যাবে।

পরদিন পাভেল হসপিটালের এক ওয়ার্ড বয়কে কিছু টাকা দিয়ে ঠিক করলো৷ তবে সে ওয়ার্ডে কোন বেড দিতে পারবে না, কারন বেড সব সময় ফুল থাকে। ও যা পারবে তা হচ্ছে একটা স্ট্রেচারে করে হসপিটালের কোন এক জায়গায় ওকে রাখতে পারবে। টেস্ট করাবার রুম গুলোতে সবচেয়ে বেশী ভিড় হয় সরকারী হাসপাতাল গুলোতে। পরে লিপি বুদ্ধি দিলো স্ট্রেচারে রাজিবকে শুইয়ে রেখে ওরা এক্সরে রুমের বাইরে অপেক্ষায় থাকা মানুষ গুলোর মধ্যে মিশে থাকবে। যেন ওরাও অপেক্ষায় রয়েছে এক্সরে করাতে।

ইঁদুর কপালে বলে একটা কথা আছে না? মীরার হচ্ছে সে দশা। কাজ শেষ করে চলে যাচ্ছিলো একে একে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা লোক গুলো। খালি হয়ে যাচ্ছিলো ভিড়ে গিজগিজ করা জায়গাটা। সব লোকের শেষ হয়ে গেছে এবার ওদেরকে ডাকবে। লিপি তাই স্ট্রেচার নিয়ে সরে গেলো অন্যপাশে। একটু পরে কোন রোগী না থাকায় তালা দিয়ে এক্স-রে রুমের লোকটা বাইরে চলে গেলো। তবুও ম্যানেজার ব্যাটার আসার নাম নাই। আসলে তারা এমনি, হুট করে চলে আসে।

এত লম্বা সময় শুয়ে থেকে রাজিবের পিঠে ব্যাথা অনুভূত হওয়ায় রাজিব একটু হাঁটাহাঁটি করবে বলে উঠতে নিতেই মীরা দৌড়ে এসে শুইয়ে দেয় ওকে। রেগে গিয়ে বলে এমন কেন করছো তুমি, সারাদিন তো শুয়ে বসেই থাকো। আজকের দিনটাই তো শুধু”
রাজিব কিছুটা আহত হয় মীরার আচরণে। এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে প্রচুর লজ্জায় বলতে পারছে না। এত পেরেশানির মধ্যে রয়েছে চার চারটা মানুষ তাদের ও খাওয়ার নাম গন্ধ নেই। ও কি করে বলে নিজের ক্ষুধার কথা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। এক এক জন করে জমতে লাগলো এক্সরে করাতে আসা মানুষের ভিড়। মীরা এক সময় তাদের সাথে মিশে গেলো। এই প্রথম মীরার এমন ভীড় ভালো লাগলো।

অবশেষে সন্ধ্যার আগে হসপিটালে আসেন ফান্ড ম্যানেজার রুহুল আমীন। তাকে পাভেল বোঝায় যে ওরা এক্সরে করানোর জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সময় গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এসে হাজির ওয়ার্ড বয় কুদ্দুস। এসেই চিৎকার চেঁচামেচি করছে স্ট্রেচার চেয়ে। এক বেলার কথা বলে সারাদিন পার করে ফেলেছে বলে রাগারাগি করে সে। লিপি তাকে সাইডে নিয়ে শান্ত করে। বলে এজন্য ওরা তাঁকে বাড়তি কিছু দিবে। তিনি কিছুটা শান্ত হলেন বটে তবে ব্যাপারটা চশমার ফাঁকে চোখ গলিয়ে দেখলো ফান্ড ম্যানেজার রুহুল আমীন। তিনি কি বুঝলেন তা জানা নেই, তবে বললেন তিনি আবার একদিন আসবেন রাজিবের খোঁজ নিতে। মীরা যেন সমুদ্রে পরলো। আরো একদিন আসবে মানে এমন হ্যাপার আয়োজন আরো একদিন সাজাতে হবে!

তবুও ভালো, রাজিবের সাথে কথা বলে চলে যান রুহুল আমীন সাহেব। বলেন আমি নিজেও ব্যাক্তিগত ভাবে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবো ওকে। রাজপুত্রের মতো চেহারা ছেলেটার। টাকার অভাবে ম’র’বে? দেখি কি করা যায়। এই কেইসটা আমি স্পেশাল ভাবে দেখবো বলে মীরার মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে চলে যান তিনি। মীরার মায়া হলো এ লোকটার প্রতি। আচ্ছা ওরা এই লোকটাকে কি ঠকাচ্ছে? রুহুল এসাহেব চলে গেলে মীরা রাগত কন্ঠে রাজিবকে বলে-
” ওঠো এবার, অনেক কষ্ট করলে আমাদের জন্য”

রাজিব কিছু বলে না, চুপ করে উঠে বসে সামনে থাকা একটা চেয়ারে। মীরার কেমন খারাপ লাগে ওর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে। মনে মনে ভাবে এভাবে না বললেও পারতো। কিন্তু কি করবে মীরা, ভিতরে এত এত মানষিক চাপ, কুটিলতা নিয়ে সহজ ব্যাবহার আসে না।

পরের সপ্তাহে মীরা মোট পেলো আশি হাজার টাকা।
বানিজ্য মেলায় অর্থ সংগ্রহ ভালো হয়। তাই টাকার অংকটা বেশী এবার। তাছাড়া রুহুল আমীন সাহেব সব জায়গা থেকে কালেক্ট করা টাকা গুলো রাজিবকেই দিতে বললো। কারন কাগজপত্রে তারা কোন ঝামেলা পান নি। এগুলো তো সত্যিই সমস্যা ছিলো রাজিবের।

রাজিবের চিকিৎসায় পুরো তিন লক্ষ খরচ হয় নি, সেখানে হাজার পঞ্চাশের মতো অবশিষ্ট আছে। আর সেই সংগঠন থেকে হাতে এসেছে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার। মোট এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকা মীরা একসাথে রাখে। ওর হাতে সময় আছে মাত্র ন’দিন। এর মধ্যে টাকাটা জোগাড় করে রাহাতকে ফিরিয়ে দিবে মীরা।

এদিকে হঠাৎই চট্টগ্রামে বিভীষিকাময় এক অ*গ্নি*কা*ণ্ড ঘটলো। এর আগে এমন বিপর্যয়, এত মানুষের মৃ’ত্যু দেখেনি বাংলাদেশের মানুষ। ঢাকা থেকে কাপড় খাবার যে যা পারছে সাহায্য পাঠাচ্ছে। তারা এখন সেখানে সাহায্য পাঠাতে ব্যাস্ত। আপাততঃ রোগীর চিকিৎসায় সাহায্য করা বন্ধ রেখেছে তারা। মীরার আর কোন পথ খোলা রইলো না।

অন্ততঃ লাখ দুই টাকা জোগাড় হলেও ফিরিয়ে দিতে যেতে পারতো রাহাতের কাছে। তাও সম্ভব হচ্ছে না পঁচিশ হাজার টাকা কম থাকায়। একেকটা দিন যায় আর একটি করে চিন্তার ভাঁজ যোগ হয় মীরার কপালে। এদিকে কোচিং-এর ভাইয়া একটা পরামর্শ দেন। কলেজে গিয়ে স্টুডেন্টদের কাছে সাহায্য চাইতে। মীরা ক্ষীণ স্বরে বলে এ ভিক্ষাটাই ছিলো বাকী। চল এটাও করে ফেলি, বলেই অপ্রাকৃতস্তের মতে হাসে মীরা। লিপি অপলক চেয়ে দেখে বিশ্রী সেই হাসিটা।

চলবে…

#প্রিয়_ভুল
লেখাঃ #মাহবুবা_মিতু
পর্ব -১০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

খুব শীত পরেছে এবার। মীরা সুতির থ্রি-পিছ পরেছে। গায়ে পাতলা একটা চাদর। তাও পুরাতন। পাশের ঘরের ভাবী দিয়েছে ওকে ওর গরম কাপর না থাকায়। কম্বল একটা দিয়েছে লিপি। যদিও তা একজনের মাপের। এদিক টানে তো ঐদিকে ফাঁকা। রাতে এ নিয়ে হাসাহাসি করে দুজনে। যেন সিঙ্গেল কম্বল থাকাটা ভীষণ মজার।

বাড়িতে থাকতে শীতের দিনে প্রায় সবসময়ই পাখা ছাড়া নিয়ে ইরার সাথে রাগারাগি হতো মীরার। ইরার শীত সহ্য ক্ষমতা কম। দুনিয়ার সর্বনিন্ম তাপমাত্রা হয়তো ওর পা দুটিতেই রেকর্ড হবে। এত ঠান্ডা পা যে মীরার গায়ে লাগলে খুব রাগ করতো মীরা। বেচারীর পা দুটো এত ঠান্ডা হয়ে থাকতে যে ঘুমাতেই পারতো না । মাঝে মাঝে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে ওর পা গরম করে দিতো মীরা। মোটা উলের মজা এনে দিতো ইরাকে। তবে মীরা কিন্তু উল্টো মেরুর লোক। গায়ে কম্বল দিলেও ফ্যান না চললে ঘুম আসে না তার। এ নিয়েই দু-বোনে বাঁধতো বিপত্তি। মা মীরাকে খুব বকতো ওর এ স্বভাবের কারণে৷ এত ছোট ব্যাপার ও এডজাস্ট করতে পারতো না। আর এখন কত কি করতে হচ্ছে সংসারটাকে বসাতে।

গরম কাপড়ের অভাবে যখন ঠান্ডায় নাকাল মীরা, ঐ সব দিনের কথা হঠাৎ মনে পরলো ওর। এ কদিনের দৌড়াদৌড়ি, মানসিক চাপ, অনিশ্চয়তায় ও ভুলতে বসেছে ওর পরিবারের কথা, বাবার কথা, ছোট্ট বোন ইরার কথা। মা’কে ও ভালোবাসে, তবে তার জায়গা সবার শেষে। মীরার আজকের এ জীবণের জন্য সবাই ওকে দায়ী করলেও মীরা যদি বলো- ” আমার মা দায়ী আমার এ পরিণতির জন্য” ভুল হবে না খুব একটা। যদিও মীরা এমনটা ভাবে না। ও নিজেকেই দায়ী করে সবকিছুর জন্য। সে দীর্ঘ গল্প অন্য কোন দিন হবে। তবে বাবা আর ছোট বোনটার জন্য মন পোড়ে মীরার।

খিলক্ষেতের মেইন রোড ছেড়ে অনেকটা ভিতরে রাহাতের ক্ষণিকালয়। মনে মনে ভাবছিলো ও চিনবে তো। সেই যে একবার এসেছিলো তাও তো রাত করে। তবে গ্রামীণফোনের বিশাল সাইজের বিলবোর্ড দেখে ও মুচকি হাসলো। ঐ যে একটা এ্যাড চলছে না ইদানীং টিভিতে, একটা মেয়ে অনেকগুলো বয়োমে কথা জমা করছে। সেই এড ফুটে উঠেছে বিলবোর্ডে। ভীষণ সুন্দর হয় গ্রামীণ ফোনের এ্যাড গুলো। একেবারে হৃদয়ে ধাক্কা দেয়, চোখ ভিজিয়ে দেয় নিজের অজান্তেই।

মীরা বামের গলি ধরে হাঁটতে শুরু করেছে। সকাল সাড়ে দশটা। লোকজন তেমন নেই পথে। শীতের দিন তার উপর আবাসিক এলাকা। লোকজন তেমন নেই একটা। এখানকার লোকেরা হাঁটতে ও যায় গাড়িতে করে। মিনিট পাঁচেক পর মীরা পৌঁছে গেলো “ক্ষণিকালয়ের” সামনে৷ গেইটের দারোয়ান যেন ওরই অপেক্ষায় ছিলো। মুচকি হেসে অভিবাদন জানালো যেন ওকে। আচ্ছা ও তো কাওকে জানিয়ে আসে নি, তাহলে লোকটা ওকে চিনলো কিভাবে?
এসব বাড়িতে তো পরিচিত ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। তবে…!

ভিতরে ঢুকতেই খোলা দরজা দেখে মীরার বুকটা ধক করে উঠে। এ দরজা দিয়ে এখন ভিতরে প্রবেশ করাটা ওর জীবণ বদলে দেবে। হয় ও রাহাতকে মানাতে পারবে, নয়তো বন্দী হবে রাহাতের সোনার খাঁচায়। ধীর পায়ে ঢুকতেই দেখলো জেরিন আসবাবপত্রের ধুলো পরিষ্কার করছে। সবকিছু চকচকে। আভিজাত্য পরিপূর্ণ এ আবাস, ধুলোর এখানে প্রবেশ নিষেধ। তবুও নিয়ম করে হয়তো জেরিন এসব পরিস্কার করে, এটাই হয়তো ওর নিয়মিত কাজ।

মীরার আগমনে সাড়া দেয় না জেরিন। নিজের কাজে ব্যাস্ত জেরিন খেয়ালই করে নি যে ড্রইংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন। বিশাল কাঠের অলংকৃত দ্বারে মৃদু করাঘাত করে মীরা জেরিনের মনোযোগ আকর্ষণে। দ্রুত ভীত দৃষ্টিতে ঘুরে তাকায় জেরিন। অসময়ে কে এলো তাই ভেবে হয়তো। মীরাকে দেখে ওর ভীতি ভাব বদলে গেলো হাসিতে। হাতের ফার্নিচার পরিস্কারের ব্রাশটা পাশে রেখে মীরার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে –
: ” শুভ সকাল ম্যাডাম, এত সকাল সকাল? আজ কি আপনার আসার কথা ছিলো? ”
: ” আপনার স্যার আছেন বাড়িতে? ”
উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলো জেরিনকে।
: ” স্যার উঠেছেন, শাওয়র নিচ্ছেন হয়তো, আপনি বসুন উনাকে আমি বলি আপনি আসার কথা। ”

বলে দ্রুত পায়ে চলে যায় জেরিন। মীরা একটা সোফার এক কোণে বসে জেরিনের চলে যাওয়া দেখছে। মেয়েটা শ্যাম বর্ণের। তবে ভিষণ মিষ্টি চেহারা, ব্যাবহার ও এত আন্তরিক যে মাঝে মাঝে কেমন অস্বস্তি হয় মীরার। আচ্ছা এ মেয়েটা এখানে নিরাপদে আছে তো? নাকি ওকেও রাহাতের….

এসব ভাবতেই কেমন একটা ভাবনা ওকে ঘিরে ধরলো চারপাশ থেকে। কি হবে, কি হতে যাচ্ছে তা ভেবে মীরার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাত ঘেমে জবজবে হয়ে আছে। দেখার মতে অনেক কিছু রয়েছে এ বিশাল ঘরে, আগের বার যখন এসেছিল এক পলক দেখেছিলো তখন। কিন্তু এত অভিজাত জিনিস ওকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। মাথা নিচু করে কেমন ভাবনায় বুদ হয়ে আছে ও।

ঠিক কত সময় পার হ’য়েছে জানে না, বুজে থাকা চোখ খুলে দেখতে পেলে এক জোড়া পা, মস্তিষ্ক জানান দিলো পা জোড়ার মালিক রাহাত। ধীর গতিতে মাথা তুলে এক পলক দেখলো রাহাতের দিকে। ক্যাজুয়াল একটা টিশার্ট পরে আছে রাহাত, প্যান্টটা জিন্সের। কে বলবে অল্প বয়সী এ ছেলে পাক্কা ব্যাবসায়ী। বয়স কত হবে আন্দাজ করতে চেষ্টা করে মীরা। ছাব্বিশ নাকি আটাশ?

রাজিব বলেছিলো ওর ব্যাবসায়ীক খ্যাতি ছাড়িয়ে গেছে বাবার রেকর্ড ও। ওর বাবা ওকে আশীর্বাদপুষ্ট মনে করে। ওর জন্মের পরই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে বোরহান সাহেবের। মূর্খ বোরহান ভেবেছিলো ছেলেকে বিদেশ পড়তে পাঠাবে। কিন্তু ছেলেটা পড়াশোনা বেশী করে নি। তা নিয়ে অনেক চেষ্টা চালিয়েছিলেন তারা। শেষে নিজের ব্যাবসায় ঢুকিয়ে দিলেন। কিছু অন্ততঃ করুক। ছেলের পড়াশোনা না করাটা শাপে বর হলো বোরহান সাহেবের জন্য। রাহাত শুধু সুদর্শনই নয়, বুদ্ধির দৌড়েও এগিয়ে অনেক দূর।
একটা সময় পর ওর পরিশ্রম, তত্বাবধান, আর পরামর্শে বোরহান সাহেব ডিঙিয়েছেন সাফল্যের সিঁড়িগুলো। তাই কখনোই বোরহান সাহেব কোন কিছুতে শাসন, বারন করতেন না রাহাত কে। ফল স্বরূপ এত ভালো গুনের, সুদর্শন রাহাতের যাতায়াত শুরু হলো গণিকালয়ে। ধরলো ম’দ, সহ নানান নেশা।

এ ছেলের হাত ভালো। যাই ধরে সোনা হয়ে যায়, এমনটাই বলেছিলো রাজিব। যদিও ওর বাবা তার পুরাতন ব্যবসা নিয়েই রয়ে গেছেন। তার ব্যাপ্তি বেড়েছে কিন্তু পরিবেশ বদলায় নি বোরহান। সেই সাদামাটা পোশাক আর জীবণের প্রথম কেনা জীর্ণ বাড়িটায়ই রয়ে গেছেন তিনি। বিশাল জমি পরে থাকলেও সেখানে নতুন আর আধুনিক ভবন তৈরীর কথা ভাবেননি হয়তো। তা না হলে আজকালকার দিনে এত বিশাল জয়গা ফেলে রাখে?

রাহাত নিজেও তাই। ওকে দেখে কেও বলবে না এ ছেলে তলে তলে এত সম্পদের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে। তবে এসব সম্পদ ও বৈধ উপায়ে রোজগারে করা। আসলে ব্যাপার হচ্ছে কেও যখন একবার রাস্তা চিনে ফেলে উপরে উঠার, সে যদি কোন কারনে নিচে পরেও যায়, আবার সে পথ খুঁজে বের করে উপরে উঠার। রাহাত অল্প বয়সেই সে রাস্তার খোঁজ পেয়েছে। বিভিন্ন ব্যাবসায় ওর ইনভেস্ট করা আছে। সেখান থেকে নিয়মিত লভ্যাংশ জমা হয় ওর একাউন্টে। আপনার হয়তো ভাবছেন লোখিকা গল্পটাকে চুইংগামের মতো অযথা টানছে। না গল্পের প্রয়োজনে এ বর্ণনাটুকু করা হচ্ছে। তা আপনারা বুঝতে পারবেন আরো কিছুটা সামনে এগুলে।

তো, কোথায় যেন ছিলাম? ওহ্ মীরার সামনে রাহাত বেচারাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি আমি!

এরপর,
মীরা উঠে দাঁড়ায় রাহাতকে দেখে। কিছুক্ষণ আগে তোলা চোখ দুটিকে সংকোচে নামিয়ে ফেলে মীরা। নিজেকে কেমন তুচ্ছ মনে হয় ওর রাহাতের সামনে। যেন কোন ঋণগ্রস্ত প্রজা দাঁড়িয়ে রয়েছে তার ভূস্বামীর সামনে।

রাহাত বললো-
: ” বসো”
মীরা অনেক সংকোচ নিয়ে বসলো, যতটুকু গুটিয়ে রাখা যায় নিজেকে তার সবটুকু চেষ্টা করলো ও।
: ” এত সকালে?, কি মনে করে?”
কাতর চোখে এক পলকের জন্য তাকায় মীরা রাহাতের দিকে, চোখ দিয়ে কিছু বলবার ব্যার্থ চেষ্টা হয়তো। কিন্তু রাহাত এসব কিছু বুঝলো না, আবার প্রশ্ন করলো-
: ” এত সকালে এসেছো কেন? নিশ্চয়ই কোন দরকারে এসেছো ”

মীরা অবাক হয়ে তাকায় ওর দিকে। রাহাতের চেকবাহী খামে দেয়া তারিখ পার হয়ে গেছে অনেক দিন। এর মধ্যে রাহাত একটা বারের জন্য ও ফোন করে নি মীরাকে। তার উপর ওর বাড়িতে আসায় উল্টো জিজ্ঞেস করেছে কেন এসেছে? এ ছেলের মাথায় কি চলছে? ও কি ভুলে গেছে যে মীরাকে ও টাকা ধার দিয়েছিলো কয়েকটা শর্ত সাপেক্ষে?

একটু সময় নিয়ে কথাগুলো গুছায় মীরা। কথা শুরু করার আগে ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে সেন্টার টেবিলের উপরে রাখে মীরা। মীরার উল্টো দিকে বসা রাহাত বিরক্ত মুখে সেখানে তাকায় সেখানে। রাহাত ও হয়তো আন্দাজ করছে কিছু একটা নিজের মতো করে। এরপর মীরা একদমে বলে পুরো কথাটা। ধৈর্যশীল শ্রোতার মতো রাহাত তা মনযোগ দিয়ে শোনে। মীরা যখন কথা শেষ করে চুপ করে বসে ওর হাত খুঁটছে, রাহাত মীরাকে জিজ্ঞেস করলো –
: ” তোমার কথা শেষ হয়েছে? ”
: ” হুম” ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দেয় মীরা।

অট্টোহাসিতে ফেটে পরে রাহাত। মীরা দ্রুত মাথা তুলে তাকায় সেদিকে। প্রাণবন্ত হাসি সেটা। এত সুন্দর লাগছে রাহাতকে, ও ঠিক মিলাতে পরছে না এর সাথে নারিন্দার বাসার সেই রাহাতকে। হাসি থামিয়ে রাহাত জিজ্ঞেস করে –
: ” নাশতা করে এসেছো?”
মীরা যেন বুঝতে পারলো না ঠিক রাহাতের কথা, যেন রাহাত অজানা কেন ভাষায় কথাটা জিজ্ঞেস করলো ওকে।
“চলো আমিও নাশতা করি নি, দু’জন একসাথে নাশতা করি”

মীরা এমন শান্তিপূর্ণ কিছু আশা করে নি। মনে মনে ভাবে-
” আচ্ছা এটা কি দূর্যোগের আগের স্থবিরতা? ”

চলবে…

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ