#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
একদিন মাঝ রাতে হঠাৎ রাজিবের কাশির শব্দে ঘুম ভাঙে মীরার। ধরমর করে উঠতে উঠতে বমি করে বিছানা ভাসায় ও। হঠাৎ কেন এমন বমি হলো কিছুই বুঝতে পারে না মীরা। কোন কিছু বুঝতে না পেরে
দৌড়ে পাশের ঘরের সামাদ ভাইকে ডাকে। তারা স্বামী স্ত্রী এসে দেখে রাজিব নিস্তেজ হয়ে পরে আছে।
সামাদ ভাই ফার্নিচারের দোকানের আসবাবপত্র ক্রেতার বাড়ি পৌঁছে দেবার কাজ করে। তিনি গ্যারেজে গিয়ে দ্রুত তার ভ্যান এনে রাজিবকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিক্যালে৷ কর্তব্যরত চিকিৎসক ওকে ইমারজেন্সিতে ভর্তি করে। দ্রুত তারা রাজিবের চিকিৎসা শুরু করে। ভোর রাতের দিকে তারা মীরাকে ডাকে রাজিবের ম্যাডিক্যাল হিস্ট্রি জানতে।
মীরা ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতেই মধ্য বয়স্ক ডাক্তার চাশমার ফাঁক দিয়ে বিরক্ত মুখে তাকিয়ে মীরাকে জিজ্ঞেস করে-
: “কি ব্যাপার?”
: “আমি ১০২ নম্বর বেডের রোগী…. ”
: ” রোগীর গার্ডিয়ান কেও নেই?” ডাক্তার সম্ভব বড় কাওকে আশা করেছিলেন।
: ” মানে আমি.., আমি রোগীর স্ত্রী”
: ” এটুকু ছেলে আবার বিয়েও করেছে? ”
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে –
: “এসো, তুমি করেই বললাম, তোমার বয়সী আমার একটা মেয়ে আছে। কিছু মনে করো না মা”
: ” না, না, সমস্যা নেই স্যার ”
মীরাকে বসতে বলে রিপোর্ট গুলো দেখতে দেখতে
ডাক্তার ওকে জিজ্ঞেস করে –
: ” বিয়ের বয়স কতদিন? ”
: ” সামনের পঁচিশ তারিখে চার মাস হবে ”
: ” রোগী মদ্যপান করতো কি?
অবাক হয়ে মীরা জবাব দেয়-
: ” রাজিব কখনো মদ্যপান করে না। এমন কি ধুমপান ও না। তবে….”
: ” তবে কি? ” উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার।
: ” মাস তিনেক আগে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে সু*ই*সা*ই*ড এটেম্প করেছিলো ও”
: ” আই সি!, রিলেশনশিপ কেস?”
মৃদু মাথা নেড়ে জবাব দেয় মীরা।
: দেখ মা রাজিবের হার্টে ব্লক হয়েছে। আমি খুবই দু:খিত, নববিবাহিত দম্পতি তোমরা, তবুও বলতে হচ্ছে দ্রুত চিকিৎসা করতে না পারলে ওর মৃ’ত্যু ঝুঁকি প্রবল।
কথা গুলো শুনে মীরার দুনিয়াটা হঠাৎ যেন দুলতে শুরু করে। ও কি কিছু ভুল শুনলো? কিন্তু সামনে বসে থাকা ডাক্তারের আহত চেহারাই সাক্ষী ও যা শুনেছে তা সত্য। ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তেই জ্ঞান হারায় মীরা। ঐ দিকে রাজিব শয্যা শায়ী। এদিকে মীরার অবস্থা খারাপ। ওদের এমন অবস্থা দেখে ওদের প্রতিবেশী ভ্যান চালক সামাদ কল করে রাজিবের আত্মীয়দের ফোনে। কেওই ফোন রিসিভ করে না। খুব সম্ভবতঃ রাত হওয়ায় ফোন সাইলেন্ট করা। কিংবা ওর নম্বর দেখে কেও কল রিসিভ করছে না।
ফোন লিস্ট ঘেটে খবরটা দেয়া যাবে এমন কাওকে পাওয়া যায় কিনা চেষ্টা চালাতে থাকে সামাদ৷ এত গুলো ফোন করলো সামাদ, শেষ পর্যন্ত ফোন ধরলো রাজিবের বন্ধু তন্ময়। ওকে ঠিকানা দিয়ে দ্রুত আসতে বললো হসপিটালে।
ভোরের দিকে ঘুৃম ভাঙলে মীরা কেঁদে বুক ভাসায়।
আল্লাহ এ কোন ওর সাথে এমনটা করলো। ও তো ভালোই ছিলো ঐ কুঁড়ে ঘরটাতে। শুধু ভালোবেসে এক সাথে পাশে থাকতে চেয়েছে ও, এরচেয়ে বেশি কিছু তো ও চায় নি। আল্লাহ কেন ওর এটুকু সুখ ও কেড়ে নেবার ব্যাবস্থা করেছে।
রাজিবের বোনকে ফোন করে জানালো সামাদ ভাই, তার স্বামী তাকে আসতে দিবে না। বিকেল নাগাদ রাজিবের মা এলেন হসপিটালে। তিনি এসে এক চোট ঝাড়লেন মীরাকে। অলক্ষ্মী, অপায়া ইত্যাদি বলে গালাগাল করলেন। অবাক ব্যাপার হলো রাত হতেই তিনি চলেও গেলেন।
এরপর একে একে কেটে গেলো তিনদিন। না কোও হসপিটালে এলো না, এমনকি কেও ফোন ও করলো না। মীরা বড়ই অবাক হলো তাদের এমন আচরণে। রাজিবের বন্ধু নাজমুলকে এ ব্যাপারটা বললে ও বললো –
” ভাবী সৎ মা তো, তাই এমন করতে পারলেন ?”
কথাটা শুনে ধাক্কা খেলো ও। সৎ মা মানে?।
নাজমুল মীরার চেয়ে ও বেশী অবাক হয়ে বলে-
” কেন আপনি জানেন না যে এটা ওর সৎ মা? ”
“না তো, ও আমাকে কিছু বলে নি তো এ ব্যাপারে।”
টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় রাজিবকে নিয়ে বাসায় ফিরলো মীরা। এত বড় অপারেশন, এতগুলো টাকার প্রয়োজন। কোন কূল কিনারা করতে পারলো না মীরা। আল্লাহ এ কোন পরীক্ষায় দাঁড় করালে ওকে? দিনরাত লুকিয়ে কাঁদে মীরা। রাজিব ও নির্বিকারে চোখের পানি ফেলে। বেচারী মীরাকে কোন বিপদে ফেলে দিল ও।
ধীরে ধীরে জীবণের এই বাঁকে নিজেকে অভিযোজিত করে নিলো মীরা। একমাত্র আয়ের উৎস্য কোচিং এর চাকরীটাতে মীরা যেতে শুরু করেছে এর মধ্যেই। কোচিং এর সবাই আগে থেকেই জেনেছে এ ব্যাপারটা, হসপিটালে রাজিবকে দেখতেও গিয়েছিলেন সবাই মিলে। কাজে ফিরলে মীরাকে তারা সাধ্য মতো সাহায্য করার আশ্বাস দিলো। মীরার কোচিং থেকে পাওয়া টাকায় কোনমতে দিন চললেও রাজিবের ওষুধ পত্রের খরচ জোগাড় করতে পারে না।
একদিন মীরা ওর বন্ধু লিপিকে নিয়ে গেলো রাজিবদের বাড়িতে। তারা মীরাকে বাড়িতেই ঢুকতে দিলো না। লোহার গেইটে তালা মরা অবস্থায়ই কোন কালে রাজিব কি অকাজ করেছে তার ফিরিস্তি দিলেন তিনি। রাজিবের কারনে কোথায় কত দেনা হয়ে আছে তারও মোটামুটি একটা হিসেব দিলেন তিনি মীরাকে। ওর বান্ধবী লিপি হেসে বললো-
: ” চলরে মীরা, যে পরিস্থিতি তিনি দেখালেন তাতে রাজিবকে সাহায্য করবে কি উল্টো তাদের এই সব দেনা সবার আগে তোর পরিশোধ করা উচিত ” কথাটা শুনে আর্দ্র চোখে ও তাকালো লিপির দিকে। সে দৃষ্টি হতাশা আর পথ হারাবার।
রাতে বাড়ি ফিরার পথে মীরা সবজি কিনে রান্নার জন্য। সাথে দুটো ডিম। দোকানির কাছে একশত টাকা ভাংতি না থাকায় ব্যাগে ভাংতি টাকা খুঁজতে থাকে মীরা। এমন সময় পাশ থেকে একটা কন্ঠ ভেসে আসে।
” কত হইছে মামা? ”
এ কন্ঠ এর আগেও শুনেছে মীরা, খুচরা খোঁজা বন্ধ করে তড়িৎ গতিতে তাকায় সে কন্ঠের উৎসের দিকে। দেখে রাহাত ওর পাশে দাঁড়িয়ে। মীরার হাতে থাকা সব কিছু পরে যায়, দ্রুত মীরা চলে আসে সেখান থেকে। রাহাত ও মীরার পিছু পিছু হাঁটে। ওর হাতে মীরার ফেলে দেয়া জিনিসের ব্যাগ।
: ” মীরা তোমার জিনিসগুলো তো নিয়ে যাও ”
বাড়ি ফিরে কাঁদতে থাকে মীরা। একসময় নিজের সৌন্দর্য নিয়ে খুবই আহ্লাদিত ছিলো মীরা। যা আজ ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানেই যাচ্ছে সবাই ওর বিপদে পাশে থাকার নাম করে নোংরা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ওর দিকে৷
একমাত্র ভরসা যাকে নিয়ে, এসব নোংরামির বিরুদ্ধে যার রুখে দাঁড়াবার কথা, সে লোকটা নিজেই দাঁড়াতে পারে না অন্যের সাহায্য ছাড়া। ওর দুনিয়াটা এত বদলে গেলো কেন। এত কষ্ট থাকার পরও কত সুখে ছিলো ওরা দুজন। কদিন ছিলো সে সুখ। হাতের আঙুলে গুনে হিসেব করা যাবে তার। মাঝরাতে মীরা কাঁদতে থাকে বাড়ির কথা ভেবে। মনে মনে ভাবে তাদেরকে কষ্ট দেবার শাস্তি হয়তো খোদা এমনি করে দিচ্ছে ওকে।
সে রাতের পর আরো একদিন রাহাতকে দেখেছিলো মীরা। না দেখার ভান করে হাঁটলেও রাহাত পিছু পিছু গিয়েছিলো ওর। দিনের আলো থাকায় এবার আর ভয় পায় নি মীরা। এক সময় বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ও। রাহাতের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে- এমন পিছু পিছু আসার মানে কি?
রাহাত বিশ্রী ভাবে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চেটে বলে-
” তুমি জানো না কি চাই আমি? ” অস্বস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নেয় মীরা। এমন নোংরা লোকেদের সাথে কথা বলাই মানে এদেরকে প্রশ্রয় দেয়া। উল্টো ঘুরে হাঁটা দিতেই, রাহাত বলে-
” আমি জানি মীরা রাজিবের অবস্থা বেশী ভালো না।
তোমার এখন অনেক বিপদ। তোমার টাকার অনেক দরকার। আর আমার দরকার তোমাকে। যত টাকা লাগে আমি তোমাকে দিবো, দরকার হলে ইন্ডিয়া নিয়ে যাবো ওকে। আমার চাওয়া একটাই তুমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে চলে আসবে আমার কাছে”
কথাটা শুনে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় মীরা। ওর ইচ্ছে হয় যে মুখ দিয়ে এমন নোংরা কথা বললো ও সেখানে এক দলা থুতু দিতে। কিন্তু ইচ্ছে হলেও মানুষ সব করতে পারে না।
দ্রুত হেঁটে সেখান থেকে চলে যায় মীরা। রাহাত দূর থেকে ওর শরীরের বাঁকে বাঁকে চোখ বুলাতে থাকে।
কোচিং এ এসে কাজে ডুবে যায় মীরা। এই কাজে ব্যাস্ত থাকার সময়টা মীরা সব ভুলে যায়। একদিন ছোট ক্লাসের পরীক্ষার খাতায় নম্বর যোগে ভুল করে মীরা। কোচিং এর মালিক যিনি সে স্যার এসে খুব রাগারাগি করে এ তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে। মীরার বুঝতে বাকী থাকে না যে এ রাগের উৎস কোথা থেকে এসেছে। মীরার অন্য কেন উপায় না থাকায় এমন পরিবেশে ও এসব সহ্য করে পরে আছে। অথচ তার ডাকে সারা দিলেই সব সহজ হয়ে যাবে ওর জন্য। একদিকে রাহাত, অন্য দিকে এই কোচিং-এর মালিক।
রাতে বিছানায় শুয়ে রাজিবকে দেখতে থাকে মীরা। প্রতিটা দিন কেমন কষ্টের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে ও। মাঝে মাঝে মীরার ইচ্ছে করে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে৷ কিন্তু রাজিবকে ও বড্ড ভালোবাসে। এই বেচারা এখন বড় অসহায়। এমন দূর্দিনে কেও নেই এক মীরা ছাড়া। রাহাতের কথাগুলো ভাবে মীরা।
” তোমার দরকার টাকা, আর আমার দরকার তোমাকে”
কি নোংরা, কি বিভৎস কথা। লিপি আজ বলেছিলো আবীরের কথা। আবীর যদি জানে তাহলে অবশ্যই ওর পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু ওর সামনে দাঁড়াবার মুখ নেই মীরার। আজ টাকার জন্য চোখের সামনে কষ্ট পেতে দেখছে প্রিয় মানুষটিকে। কান্না আর কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই মীরার। টাকা এমন এক জিনিস যা ওকে জীবণের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা দিয়েছে।
অনেক ভেবে মীরা সিদ্ধান্ত নেয় রাহাতের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার। হোক না এক অমানুষের নামে এ জীবণটা। তবুও ওর ভালোবাসা তো বেঁচে থাকবে….
চলবে…..
#প্রিয়_ভুল
লেখাঃ #মাহবুবা_মিতু
পর্ব-৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
মাঝ রাতে হঠাৎ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় মীরার। ঘুম থেকে উঠেই কিছু মনে করতে পারে না স্বপ্নের কথা। বিছানা থেকে উঠে পানি খায় ও। বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখে বিছানায় রাজিব পুঁটলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। শীত করছে বোধহয় ওর, এটা ভেবে চাদর টেনে দেয় গায়ে। পুরাতন এ চাদরটা তাসলিমা ভাবি দিয়েছিলো।
শীত আসছে সামনে, গায়ে দেওয়ার কোন কাঁথা বা কম্বল কিছুই নেই ওদের। কথাটা ভাবতেই বুকটা কষ্টে ছেয়ে যায়। ওর বাবার বাড়িতে ওদের সবার জন্য একটা করে আলাদা কাঁথা আর কম্বল আছে।
ওদের পাশের বাড়ির এক বৌয়ের বাবার বাড়ি যশোর। তারা কি সুন্দর কাঁথা তৈরী করে, তা দেখে মীরার মা ওদের দু বোনের জন্য যশোর থেকে এত সুন্দর কাঁথা বানিয়ে এনেছেন যে গায়ে দিতে মায়া হয়। এক রাঙা নতুন কাপড়ের মধ্যে বাহারী রঙের সুতার কাজ করা। একটা সাদা রঙের আরেকটা হলুদ। সাদা কাঁথায় লাল, সবুজ আর নীল সুতায় কাজ করা। হলুদটায় বেগুনী, খয়েরী, আর টিয়া রঙের সুতার কাজ। পুরো কাঁথার পাড়ে সুন্দর করে কুশিকাটার কাজ করা। দুটে কাঁথা তৈরী করতে ওর মা তাকে মজুরি দিয়ে ছিলো চার হাজার টাকা। সেগুলো তিনি আগে ভাগেই তৈরী করে রেখেছেন মেয়েদের বিয়ের সময় দিয়ে দিবে তাই। পরে যদি এমন লোক না পান সেই ভয়ে। তার উপর মেহমানদের জন্য ও আলমারীতে কত সুন্দর সুন্দর কাঁথা আছে। মীরার সৌখিন মায়ের একটা আলমারী ভরা শুধু চাদর আর কাঁথা দিয়ে৷ মানুষের একেক নেশা থাকে। মীরার মায়ের নেশা শপিং করা। দেখা গেলো মার্কেটে গেলো, কোন একটা জামা বা জুতা চোখে লাগলো, সেটা হাতে নিয়ে সে ভাবতে থাকে কার গায়ে বা পায়ে লাগবে এটা। এমন কোন মাস নেই সে চাদর বালিশের কভার না কিনে। অল্প কিছু দিন ব্যাবহার করেই একে ওকে দিয়ে দেয়। তাদের বাড়িতে যদি একসাথে বিশ জন মেহমান ও আসে তবুও কাঁথা বালিশের অভাব হবে না।
অথচ মীরা, বিছানায় বিছানোর জন্য চাদর একটাই, ময়লা হলে এটাকেই ধুয়ে, শুকিয়ে বিছানায় বিছাতে হয়। আর গায়ের চাদরটা, শীতের আগমনী এই দিনগুলোর শেষ রাতে এই পাতলা চাদরটা পিপাসিত পথিকের কাছে এক ফোটা জলের মতো। যা আছে কিন্তু পোষায় না ঠিক।
এ মুহূর্তে একটা কম্বল কেনার কথা চিন্তাও করতে পারে না ও। অথচ টিনের চালার এ ঘরটায় শেষ রাতে বাতাস আসে হুহু করে। তখন মনে হয় যেন ঠান্ডা বাতাস দাঁত বসিয়ে দিচ্ছে শরীরে। ও ভাবে মনে মনে গরমই ভালো। শীত কেন এলো। একটা কথা মনে পরে ওর। সৈয়দ মুজতবা আলীর মুসাফির বইতে একটা কথা আছে – হিট হার্টস, কোল্ড কিলস।
কথাটা সত্যি। গরম কষ্ট দিলেও মানুষ মানিয়ে নিতে পারে সহজে, কিন্তু শীতের রাতে গরম কাপড় না থাকলে ঘুম একবার যদি ভাঙে আর ঘুম আসে না।
চোখ বন্ধ করে এসব ভাবতেই চোখদুটো ভিজে যায় ওর। ভেজা এই চোখে আবীরের চেহারাটা ভেসে উঠে হঠাৎ। মহূর্তেই চোখ খুলে মীরা। না, না, ওকে ভাবার যোগ্যতাও নেই আমার। যে ক্ষতি আমি ওর করেছি তা জীবণেও পূরণ হবার নয়। জীবণের এই জায়গায় দাঁড়িয়ে ওর মনে হয় যে ও অন্যায় করেছে আবীরের সাথে, কিন্তু এতদিন একটা বারের জন্য ও অনুতপ্ত হয় নি মীরা আবীরকে ভেবে।
মনে পরে বিয়ের দিন সকালে আবীর এসেছিলো মীরার সাথে দেখা করতে। মীরা দেখা করে নি, ও জানতো ও না যে সেদিন রাতেই বিয়ে হবে ওর। জানলে ও আবীরের সাথে দেখা করে সব খুলে বলতো ওকে। আবীর নিশ্চয়ই ওকে সাহায্য করতো। তাহলে অন্তত ওর জীবণের খাতায় এই কালো দাগটা পরতো না।
আবীর বেচারা ওর বাবা ময়ের কারনে কষ্ট পেলো। ওর বাবা মা এ কাজটা চালাকি করে করেছে তা জানে মীরা। কারন তারা রাজিবের সাথে কথা বলেছিলো। প্রথম প্রথম অবশ্য রাজিই হয় নি তারা। কি সব কথা শুনেছে ওর সম্পর্কে, সেগুলো দিনরাত তবজির মতো জোপেছে ওর সামনে। কোন মতেই তারা ঐ ছেলের কাছে বিয়ে দিবে না ওকে। ওর মা জাহানারা বলেছেন – তারচে বরং তুই চলে যা বাড়ি ছেড়ে, তবুও আমরা ওকে মেনে নিবো না।
এদিকে মীরার পাগলামি দেখে ওর বাবা মোজাম্মেল বলেছিলেন যে রাজিবের সাথে বিয়ে দিবে ওর, তবে এখন না। আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে ওকে।
এদিকে রাজিবকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলে ঐদিকে আরেক জায়গায় বিয়ে ঠিক করে তারা চুপিচুপি।
সেদিন মীরাকে তারা বলেছিলো আবীরের বাড়ি থেকে দেখতে আসবে ওকে। মীরা তখন বলেছিলো আমাকে দেখতে আসার কি আছে, ছোট থেকে তো তাদের সামনেই বড় হয়েছি আমি। মীরা চিৎকার চেচামেচি করলে তারা ওকে বুঝ দিয়েছিলো তারা আসতে চাইছে, এখন না করবে কিভাবে। দেখলেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। মীরা কিছুটা শান্ত হয়, বলে এই কিন্তু শেষ। ওর বাবা কেমন একটা হাসি দিয়ে বলেছিলো- ” ঠিক আছে মা এই শেষ ”
আসলেই সেটাই শেষ ছিলো তাদের হিসেবে। ভেবেছিলো হয়তো- ” একবার বিয়েটা হয়ে গেলেই হলো, তারপর বিয়েটা বদলে দিবে ওকে ”
কিন্তু মীরার হিসেব যে রাত পেরুলেই উল্টে যাবে তারা তা ভাবে নি একটি বারের জন্য ও। সেদিনই যে ওর বিয়ে হয়ে যাবে তা ক্ষুনাক্ষরেও টের পায় নি মীরা। তাই তো পরদিনই এমন একটা কান্ড বাঁধায় ও।
ওর প্ল্যান ছিলো বাবা মা এমন করলো ওর সাথে, ও চলে গেলে দুদিন অন্ততঃ পার হবে ওকে খুঁজে পেতে, ততক্ষণে ওরা বিয়ে করে ফেলবে। কিন্তু আল্লাহর কি লীলা খেলা, যে দোকান থেকে মীরা ফোন করে ছিলো রাজিবকে সে দোকানের মালিক ছিলো আবীরের এক বন্ধু। সেই বন্ধুই সাথে সাথে ঘটনাটা জানায় আবীরকে। আবীর সেই নম্বর নিয়েই মীরার বাবা সহ পৌঁছে যায় রাজিবের দোকানে, মীরার তাসলিমা ভাবীদের বাড়ি পৌছানোর আগেই। তখনো চেষ্টা করলে আবীর ফিরিয়ে আনতে পারতো মীরাকে। কিন্তু কেন জানি কিছু করবার অনেক ইস্যু থাকা সত্ত্বেও কিছুই করে না আবীর। কারন ও জেনে গেছে মীরাকে ও ফিরিয়ে নিতে পারলেও ওর মনটা বাঁধা আছে রাজিবের কাছে। একসাথে ঘর করলেও যা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তাই মুক্তি দেয় ও মীরাকে। মীরার বাবা মা ও তাই কোন চেষ্টাই করে না ওকে খুঁজে পেতে। ফলাফল এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে শুরু করা সংসারটা এখন যেন কচু পাতায় থাকা এক বিন্দু পানি। টলমল করে দুলছে। এই বুঝি গড়িয়ে গেলো, পরে গিয়ে বিলিন হয়ে গেলো।
চারপাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে, টিনের চালের ফাঁক ফোকড় দিয়ে আলো ঢুকছে ঘরে। সে আলোতে রাজিবকে দেখছে মীরা। দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে ও, কেমন যে শ্রীহীন হয়ে পরছে ওর মুখটা। প্রায় রাতেই জ্বর আসে, খাবারে ও অরুচি এসেছে খেতেই চায় না ইদানীং। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে রাজিবের দিকে অপলক দেখছে আর মনে মনে বলছে- ” সবাই বলে আমি ভুল করেছি, খোদা সবার এই কথা, এই ভাবনাটাকে তুমি ভুল প্রমাণ করে দাও, আর কিছুই চাই না আমি ”
একটু পরে উঠেই পরের দিনের কাজ শুরু করে দেয় মীরা। এখানে ভাগের চুলায় রান্না করতে হয়। ও তাই একটু সকালে উঠে যাতে কারো সাথে না বাঁধে। খোলা বাড়ির এই লোক গুলো কেমন যে ঝগড়াটে স্বভাবের। উনিশ-বিশ হলেই বিশ্রী ঝগড়া শুরু করে দেয়। মীরা এসবে অভ্যস্ত না। তাই কষ্ট হলেও একটু আগে উঠে সব কাজ শেষ করে ফেলে। যাতে কারো সাথে কোন কিছু নিয়ে ঝগড়ায় না জড়াতে হয় ওকে।
তাছাড়া মানুষগুলো ওর অবর্তমানে রাজিবের খোঁজও রাখে। মানুষগুলো ঝগড়াটে হলেও তাদের মন ভালো। আসলে অন্য পরিবেশে ও বড় হয়েছে তাই তাদের সাথে হয়তো তাল মিলাতে পারে না ও। তারচে সকালে একটু আগে উঠলে সব কাজ দ্রুত শেষ হয়। ফলে তারা শান্তি মতো রান্না করে দুজন। অনেকটা গিভ এন্ড টেক এর মতো।
সব কাজ শেষ করে দুজনে খায় একসাথে। রাজিবকে ওর ঔষধ খাইয়ে, দুপুরের খবার আর ঔষধ গুছিয়ে বেরিয়ে পরে মীরা। হঠাৎ ব্যাগের সাইড পকেটে ভাংতি খুঁজতে গিয়ে একটা কার্ড পরে যায়। মীরা সেটাকে তুলে দেখে কার্ডে লেখা
” রাহাত গার্মেন্টস “, সেটাকে ভিতরে ঢুকাতে ঢুকাতে রাতের কথা মনে হয় ওর। ভাবে কোচিং এ গিয়ে কল করবে ও রাহাতকে।
হেঁটে এসে পৌঁছাতে আজ দেরি হয়ে যায় মীরার। এসে দেখে ও দেরি করায় ওর ক্লাসটা করাচ্ছে তমাল স্যার। যে ওকে বই,খাতা, আর এ চাকরীটা দিয়ে সাহায্য করেছিলো। তমাল স্যার ক্লাস করাচ্ছে ভেবে ওর আরেক কলিগ রুমির ফোন থেকে ফোন করে কার্ডে দেয়া নম্বরটাতে। রাহাত রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলো-
: কে?
: আমি মীরা,
: ওহ্ মীরা, মাই সুইট হার্ট, আমি জানতাম তুমি আমাকে কল দিবেই। কারন তোমার চারদিকে ঘোর অমানিশা। আমি ছাড়া তোমাকে আর কেও আলো দেখাতে পারবো না। তারপর ডার্লিং কবে হচ্ছে আমাদের বিয়েটা?
কথাগুলো শুনে বিরক্ত লাগলেও কিছুই করার নেই মীরার। একটু সময় নিয়ে ও বলে-
: আসলে আমার কিছু কথা ছিলো।
: বলো, বলো ডার্লিং, তুমি বলবে নাতো কে বলবে, বিয়ের পর আমি কোন কথাই বলবো না, সব তুমিই বলবে। আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনবো সে কথা রাজরানি হয়ে থাকবে তুমি আমার কাছে।
কথাগুলো শুনে কেমন অস্বস্তি হয় মীরার। এই লোকের ভালো কথা শুনতেও অসহ্য লাগে ওর। অথচ এর কাছেই বিক্রি হতে চলেছে ও। এমন সময় মীরা বলে যে তার দেয়া প্রস্তাবে ও রাজি। তবে শর্ত হচ্ছে আগে রাজিব সুস্থ হবে। তারপর ওর যা করাতে বলবে সব করবে, তার আগে যেন কোন ভাবেই ওকে হ্যারেস না করে রাহাত।
মীরার এমন প্রস্তাবে রাজি হয় না রাহাত। বলে-
: ” বোকা পেয়েছো আমাকে, রাজিব সুস্থ হয়ে যাক আর তোমারা হাওয়ায় মিলিয়ে যাও। না, না, তা হবে না আমার জান পাখি”
কথাটা বিশ্রী লাগে ওর কানে। তবে রাহাত মীরাকে পাওয়ার কোন সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না, তাই ও নিজেও একটা প্রস্তাব রাখে মীরার কাছে। কন্ট্রাক পেপারে সাইন করতে হবে মীরাকে। সেখানে এ ব্যাপারে লেখা থাকবে। মীরা রাজি হয় এতে। রাজিবের অপারেশন হলে ওকে ওর পাশে থাকতে হবে। তাই মীরার এমন চাওয়া। রাহাত বলে সবকিছু তৈরি করে ও জানাবে। মীরা যেন তখন ওর দেয়া ঠিকানায় চলে আসে। মীরা জানায় ও আসবে।
সেখানে ব্যস্ত হয়ে যায় মীরা পরবর্তী ক্লাসে ঢুকে। ক্লাস শেষ করে কলেজে যায় এডমিট কার্ড আনতে। পরীক্ষার বাকী আর মাত্র কয়েক দিন। এদিকে অসুস্থ রাজিব অন্য দিকে রাহাত। সব মিলিয়ে দিশেহারা মীরা কিছুই বুঝতে পারে না।
ছাত্রী কমনরুমে ঢুকে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে থাকে মীরা। এমন সময় ওর বান্ধবী লিপি ওকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। মীরা প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে সবটা খুলে বলে লিপিকে। লিপি ওর খুব ভালো বন্ধু। ওকে বলাটা দোষের কিছু হবে না। বরঞ্চ কাওকে কিছু না বলতে পেরে ও কেমন দমবন্ধ পরিস্থিতিতে পরে গেছে।
সবটা শুনে লিপি বলে –
: কাজ হাসিল করে সটকে পরতে পারবি তে?
অসহায় ভাবে তাকায় মীরা ওর দিকে, লিপি ভেবেছে মীরা হয়তো কাজ হাসিল করতে রাহাতকে ভাও দিচ্ছে। কিন্তু মীরাযে সত্যি নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছে তা বুঝে উঠতে পারে নি লিপি। পরে মীরা চেপে যায় বাকী কথা, যতটুকু বুঝেছে ও বুঝুক। নিজেকে আর নীচে নামাতে পারবে না ও।
মীরা চুপ করে বসে থাকে। লিপি বলে- চল ক্যান্টিনে যাই। মীরা কি মনে করে যেন হঠাৎ ওকে বলে-
: রাহাতের কাছে যেদিন যাবো যাবি আমার সাথে?
: জানাইস, যাবো নি। এখন চলতো….
চলবে…