#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_২৯
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
পুনরায় ধমকে উঠলো শেহজাদ।
‘ ওরা কে ছিল? কোথায় ছিলে তুমি? ‘
অপরূপা ঢোক গিলে এতক্ষণে মুখ খুললো।
‘ ওরা জাদুকর ছিল। আমাকে বলি দেয়ার পরিকল্পনা করছিলো। আমি পালিয়ে এসেছি। এই একমাস ওদের কাছে ছিলাম। ওরা খুব খারাপ লোক। ‘
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠলো সে। মনে হয়েছে তার সকল কষ্টগুলো কলকলিয়ে বলা যাবে এই মানুষটার কাছে। অথচ এক আকাশ রাগ, ক্ষোভ পুষে রেখেছিল সে এতদিন।
শেহজাদ হতভম্ব। অবিলম্বে তার চোখের রঙ পরিবর্তন হয়ে গেল। কটমট গলায় বলল,
‘ আমাকে আগে বলোনি কেন? আমি ওদের ছেড়ে দিলাম। ওরা তোমার কোনো ক্ষতি করেছে? ‘
অপরূপা দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,
‘ এই একমাস আমাকে গাঁধার মতো খাটিয়েছে। বনেবাদাড়ে পাখি শিকার করতে পাঠিয়েছে। ‘
শেহজাদ দ্বিগুণ বিস্মিত হয়ে বলল,
‘ তুমি? পাখি শিকার? ‘
‘ হ্যা শিকার না করলে খেতে দেয়নি। ‘
শেহজাদ ওর কান্নাভেজা মুখের দিকে বিমূঢ় হয়ে ভাবলো এবার সে রূপাকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করবে না। তার জন্য রূপাকে অনেক বিপদে পড়তে হয়েছে।
এতদিন পর একটা দুঃখ ঝাড়ার মানুষ পেয়েছে অপরূপা। নিজের সমস্ত রাগ, ক্ষোভ ভুলে গিয়ে এতদিনের জমানো কান্না ছেড়ে দিল। তার কান্নার চোটে তার শীর্ণদেহ দুলে উঠলো।
শেহজাদ তার গালে হাত দিয়ে পানি মুছে দিয়ে বলল,
‘ আমি তোমাকে আর একা ছাড়বো না। ‘
‘ ঠিকই ছেড়ে গেলেন। নিজের ভাইয়ের সব অপকর্ম জেনেও আমাকে মানিয়ে নিতে বলে মহল ছাড়লেন। ‘
‘ অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গেছে রূপা। আমার কাছে এমন একটা চিরকুট এসেছিল যেখানে তুমি লিখেছিলে তুমি ভাইজানকে সুযোগ দিয়েছ, আমি যেন তার অধিকার ফিরিয়ে দিই। ওইসময় আমি মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম তারউপর তোমার এমন চিরকুট। ‘
‘ আমি কোনো চিরকুট পাঠাইনি। ‘
‘ আমিও না। যেটা পাঠিয়েছিলাম সেটা তোমার কাছে পৌঁছায়নি। আমি জানতে চেয়েছিলাম তুমি বিবাহে রাজী ছিলে কিনা। উত্তরে এসেছিল, হ্যা। তুমি যেমন আমাকে ভুল বুঝে পালিয়ে যাচ্ছ, আমিও তেমনটা ভেবেছি। ‘
অপরূপা চোখ চেপে জল ফেললো। এতটা অবিশ্বাসের ভেতরও কোথাও একটা বিশ্বাস ছিল যে সবটা মিথ্যে প্রমাণিত হবে। ঠিক তাই হলো। শেরহাম সুলতান এমন কোনো কাজ বাকি রাখেনি যা দিয়ে শেহজাদ সুলতানকে পরাস্ত করতে পারবে।
কাশিম দূরে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ সাহেব মাঝ নদীতে একটি জাহাজ দেখা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে। সম্ভাবনা আছে জাহাজে শেরহাম সুলতান আর উনার লোকবল আছেন। ‘
অপরূপা আঁতকে উঠলো। শেহজাদ আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘ কোনো ভয় নেই । আমি আছি। ‘
অপরূপা আশ্বস্ত হয়ে টিংটিংয়ের কাছে যাচ্ছিলো মাথায় কাপড় টেনে। শেহজাদের কথায় থেমে গেল।
‘ আমাকে বিশ্বাস করো তুমি? ‘
অপরূপার হাত মাথার দুপাশে ওড়নায় আটকে থাকলো। ফিরে তাকাতেই পুনরায় দুজোড়া চোখের মিলন ঘটলো।
ঢোক গিলে মোলায়েম কন্ঠে শেহজাদের অধৃষ্য চোখে চোখ রেখে অপরূপা শুধালো,
‘ করতে ইচ্ছে করেনা। তারপরও ভুল করে করে ফেলি। ‘
শেহজাদের ঠোঁটের কোণায় দুর্লভ হাসির ঝলক দেখা গেল একটুখানি। এই ভুল করে ফেলা বিশ্বাসে আর একফোঁটা আঁচও লাগতে দেবে না সে।
_______
তারা সেই আগের মসজিদে চলে এল । সেখানে আশ্রয় নিল। টিংটিংয়ের সাথে হেঁটে এসেছে শেহজাদ। অপরূপা তার ঘোড়ার পিঠে চড়ে। সম্রাট এসেছেন শুনে সেই মসজিদের খতিবরা আপ্যায়নের ত্রুটি রাখলেন না।
অপরূপাকে নিয়ে গেল এতিমখানার রাঁধুনিগুলো। শেহজাদ তাদেরকে বলে দিয়েছে, যেন তাকে আরামের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। রাঁধুনিগুলো তাই করলো।
অপরূপা রাতে খেল না। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। অনেকদিন যাবত সে ভালো করে ঘুমায় না। ভোররাতে স্বপ্নে সাদা পাঞ্জাবিতে মোড়া এক শুভ্র পুরুষকে দেখলো সে। মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। চারপাশে তীব্র আতরের সুগন্ধি। তাদের ঘিরে অসংখ্য প্রজাপতি উড়োউড়ি করছে। সেই শুভ্র পুরুষ খুবই নিকটে তার কপালের ঝালর সরিয়ে শুভ্র স্পর্শে তাকে রাঙিয়ে দিল। অপরূপা অনুভব করলো এত ভালোবাসা মিশিয়ে কেউ কখনো তাকে ছুঁইনি। এমন অনুভূতি আগে কখনো পায়নি। অপরূপা তুলতুলে পাখির ছানার মতো গুঁজে গেল একটি চাদরের নীচে। মনে হলো তাকে আর কেউ দেখবে না। না শেরহাম সুলতান না কোনো অশুভ কিছু। এমন একটা আশ্রয় তো সে চেয়েছিল! কেন পায়নি? শরীরের প্রত্যেকটি শিরা উপশিরা ঝণাৎ করে কেঁপে উঠে ঘুম ছুটে গেল তার। কানে এল আজানের প্রতিধ্বনি। পুরোনো জং ধরা ইটের চার দেয়ালের ঘরে সে একা। খাট থেকে নেমে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। রাঁধুনিগুলোও উঠে গিয়েছে। তাদের অনেক রান্না করতে হবে আজ। সম্রাট আছেন। অনেক কাজ তাদের।
ফজরের নামাজের জন্য মসজিদের দিকে চলে গেল অপরূপা। মহিলাদের কক্ষের দিকে পা বাড়াতেই দেখতে পেল কক্ষটি খালি। কেউ নেই। সে ফজরের নামাজ আদায় করে নিল। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো, শুকরিয়া আদায় করলো। মোনাজাত শেষ করতে করতে কানে এল সেই দরাজ গলার স্বর আর আতরের সুগন্ধি। অপরূপা সম্মোহিত হয়ে পড়ে এই গন্ধ নাকে এলে।
কয়েক পা এগিয়ে কক্ষের জানালার কাছে দাঁড়াতেই ঝটকা খেল পুনর্বার। সাদা ধবধবে সেই শুভ্র পুরুষটি শেহজাদ সুলতানের রূপে দাঁড়িয়ে মসজিদের সবচাইতে বয়োজ্যেষ্ঠ মৌলবির সাথে কথা বলছেন। তরতর করে কাঁপতে থাকা হাতটা তুলে মৌলবি সাহেব শেহজাদের মাথায় রাখতে চাইলেই শেহজাদ মাথা নামিয়ে দিল। উনি মাথায় চাপড় দিতে দিতে বললেন,
‘ খোদা তোমায় নেক হায়াত দিক। বিবাহিত জীবন সুখের হোক। ‘
শেহজাদ কিঞ্চিৎ হেসে মাথা তুলে তাকাতেই অপরূপার দিকে চোখ পড়লো হঠাৎ। অপরূপা দ্রুত সরে গিয়ে নামাজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। কান্নায় ভেঙে পড়লো। উনি কি মহলে ফিরে গিয়ে তটিনীকে নিকাহ করবেন? তটিনীর সাথেই তো বিবাহের কথা ছিল। উনি মহলে ফিরে গেলে তার কি হবে? সে তো মহলে ফিরতে পারবে না। কখনো ফিরবে না। কোন ব্যাথায় সে কাঁদছে তা সে নিজেই বুঝতে পারছেনা, নিজের সুরক্ষার কথা ভেবে, নাকি অন্যকিছু? শেরহাম সুলতানের পাপে পাপিষ্ঠ সে অমন পুতঃপবিত্র মানুষকে কেন স্বপ্নে দেখলো?
তিনিও তো পাপিষ্ঠ রূপাকে ভালোবাসেননি। তাহলে পাপমোচন করতে কেন যাবেন?
অপরূপা কান্নার মাঝে খেয়াল করেনি শেহজাদ এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। পাশে এসে বসেছেও। অপরূপা কান্নামুখর চোখে তার দিকে তাকালো। শেহজাদ তার কান্নার কারণ জানতে চাইলো না। বলল,
‘ কোথায় যাবে ভেবেছ? ‘
অপরূপা কান্না রোধ করে ভাঙা গলায় বলল,
‘ গ্রামে। ‘
শেহজাদ চাপাস্বরে জানতে চাইলো
‘ গ্রামে কি? ‘
অপরূপা চোখ নত করে দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,
‘ কিছু না। ‘
‘ আমার দিকে তাকাও। ‘
অপরূপা তাকালো না। বলল,
‘ পারব না। ‘
শেহজাদ তার থুঁতনি ধরে মুখ তুলতেই অপরূপা কান্নাভেজা চোখে দেখলো সেই মোহনীয় দৃষ্টি! সেই আতরের ঘ্রাণ। সেই শুভ্র স্পর্শ। হৃৎস্পন্দন থেমে গেল তার। কানদুটো গরম হয়ে এল। শ্বাসপ্রশ্বাস রুদ্ধ এল। শেহজাদ বলে ফেললো,
‘ চলো নিকাহ করে ফেলি। ভালো পরে বেসো। ‘
চলমান….
#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_৩০
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
অচিন্তনীয় প্রস্তাব শ্রবণে স্নিগ্ধ কপালে ভাঁজ পড়লো অপরূপার। অত্যধিক আশ্চর্যান্বিত হওয়ায় শুষ্ক ওষ্ঠপুট কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেল। শেহজাদের দৃষ্টিজোড়া নিরুত্তাপ। নিজ অবস্থানে অটল অবিচল থেকে দৃষ্টিজোড়া শান্ত রেখে উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে রইলো। যেন খুব স্বাভাবিক একটা কথা বলেছে সে। তার কাছে স্বাভাবিক হলেও অপরূপার কাছে এটা চমকানোর মতো। স্তব্ধ হয়ে শেহজাদের পানে চেয়ে থাকতে থাকতে অপরূপা ভুলেই গেল উত্তরের আশায় সামনের ব্যক্তিটি বসে আছে। সংবিৎ ফিরতেই চোখ নামিয়ে নিল। এরূপ পরিস্থিতিতে বোধহয় সে এই প্রথম। কি বলা উচিত সে বুঝে পাচ্ছে না, খুঁজে পাচ্ছে না। শেহজাদ অতি ব্যস্ত গলায় বলল,
‘ তুমি যদি ভেবে থাকো এখন ‘না’ বলবে তাহলে আমি কিন্তু টলছি না। তোমাকে আমি আর ছাড়ছিনা। তোমাকে জানানো প্রয়োজন তাই জানাচ্ছি। আমি জানি আমার কাছেই তোমার শেষ গন্তব্য। ‘
অপরূপা চোখ তুলে চাইলো ফের। শেহজাদ ভুরু উঁচিয়ে বলল,
‘ কিছু বলবে? ‘
নীরবতা ভেঙে এইবার মুখ খুললো অপরূপা। সন্দিহান গলায় বলল,
‘ আপনি এসব সত্যি সত্যি বলছেন?’
শেহজাদ অমায়িক হাসলো। বলল,
‘ মসজিদের অভ্যন্তরে বসে আমি মিথ্যে কথা বলব? তোমাকে আগলে রাখার একটা দায়িত্ব তো সম্রাটের আছে বলো। কোনো এককালে সে নাকি তোমাকে ভালোটালো বেসেছিল। তাকে ভালোটালো বাসার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সারা রূপনগরের মানুষ তাকে ভালোবাসে সেখানে তুমি একজন না বাসলে কি আসে যাবে?’
অপরূপা তার রসিকতায় কান্নামুখে ঠোঁট এলিয়ে হেসে ফেললো। শেহজাদ দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই আবারও মলিন করে ফেললো মুখটা।
শেহজাদ হাতঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অপরূপার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ আজ বাদে জোহর নিকাহ পড়ানো হবে। ওঠো। প্রস্তুত হও। ‘
কেমন একটা বিষাদে অপরূপার হৃদয় ভার হয়ে এল। ভারাক্রান্ত মুখে শেহজাদের বাড়িয়ে দেয়া হাতের পানে চেয়ে রইলো। ধীরেধীরে হাত বাড়াতেই শেহজাদের কথায় চমকে গেল।
‘ শক্ত করে ধরো। একটা পুরো জীবন পার করতে হবে। রাস্তা নয়। ‘
অপরূপা ফুঁপিয়ে উঠলো। হাতটা শেহজাদের হাতের উপর রাখলো। তার প্রথম এবং শেষ গন্তব্য যার কাছে তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলো। আজ থেকে তার হার, তার জিত, দুঃখকষ্ট, হাসি কান্না সব এই মানুষটাকে ঘিরে হবে। ভালো থাকার জন্য সে ভালোবাসার কাছে থাকবে আর ভালোবাসা শিখবে। যেখানে স্বার্থ নেই, হারজিতের লড়াই নেই, চাওয়া-পাওয়ার হিসেবনিকেশ নেই, অতিরঞ্জিত কিছুই নেই সেখানে সে ভালো থাকবে, ভালো রাখবে।
******
দিনটা শুক্রবার হওয়ায় জুমার নামাজের পর নিকাহ পড়ানোর সময় নির্ধারণ হয়েছে। রাঁধুনিদের রান্নার ধুম পড়ে গেল। কয়েকজনকে পয়সার বিনিময়ে ভাড়া আনা হয়েছে। তারা রান্নাবান্না করে খাওয়াদাওয়া সেড়ে পয়সা নিয়ে চলে যাবে।
অপরূপা দেখলো পটু হাতে তারা কত বড়বড় ডেকচিতে রান্না পাকাচ্ছে। সম্রাটের ভাবী বেগমকে তাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। অপরূপা তাদের হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছিলো। সামনে কাজ দেখে বসে থাকার অভ্যাস তার নেই। কিন্তু রাঁধুনীরা তাতে অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, “আমাদের বেয়াদবি হয়ে যাবে। সম্রাটের কানে গেলে এসব আমাদের লজ্জা। আপনি শুধু দেখুন। আর একআধটু ছেঁকে দেখুন খেতে কেমন হয়েছে। ”
অপরূপা দেখলো, বিহারি, শামি আর তুনরি কাবাব তৈরি হচ্ছে। এর পাশাপাশি মোরগ মোসাল্লাম, ডাল মাখানি, আলু গোশত, তান্দুরি, টিক্কা, কোফতা, কোরমা। এছাড়াও ফিরনি, কুলফি, শাহি টুকরা—লোভনীয় সব মিষ্টি খাবারের আয়োজন করছে অন্য একদল রাঁধুনি। বড়সড় একটি থালা বাদাম, কিসমিস, ফল, খেজুরের মতো উপকরণ দিয়ে সাজানো। অসাধারণ চমকপ্রদ ভোজ। রান্নার সুগন্ধিতে ম ম করছে রন্ধনশালার আশপাশ। সম্রাটের নিকাহ উপলক্ষে আনন্দিত মজলিশ। জৌলুশে ভরপুর চারপাশ। তারা কুক্ষণেও ভাবতে পারেনি রূপনগরের সম্রাটের নিকাহ পড়ানো হবে তাদের মসজিদে। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হবে এই রন্ধনশালায়।
অপরূপা চেয়ে চেয়ে দেখলো আর ভাবলো এই সুন্দর স্বপ্নটা কখন না জানি ভেঙে যায়। তার কপালে তো সুখ সয় না।
জুমা’র নামাজের আগেই অপরূপার সাজগোছ শেষ। রাঁধুনিরা তাকে সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছে। এটা তাদের পরম সৌভাগ্য। সম্রাটের কাছ থেকে তারা পয়সাও পাবে। সম্রাটের একজন দেহরক্ষী এসে অপরূপার সাজের পোশাকআশাক আর গহনাদি দিয়ে গেল। পান্না সবুজ রঙের একটা ঘাগড়া। রূপোর গহনা। কপালের টায়রা। নাকের টানানথ। গলার একটা গহনা। হাতের কঙ্কন। সবকিছুর বন্দোবস্ত করেছে শেহজাদের সৈন্যদল। শেহজাদ ভেবেছিল সাধারণ পোশাকেই নিকাহ পড়ে ফেলবে কিন্তু তার সৈন্যদল তা হতে দেয়নি। তাকে না জানিয়ে সবকিছুর বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। এমনকি রান্নাবান্নাও।
পোশাক আর অলংকার পরিধান করার পর অপরূপার চোখে কাজল পড়িয়ে দেয়ার পর সাজ সম্পূর্ণ করলো সবাই মিলে। অপরূপা আরশিতে নিজের প্রতিভিম্ব দেখে কয়েকপল চেয়ে রইলো। নিজেকে সে চিনতে পারছেনা। রাজকীয় পোশাক আর অলংকারে তাকে শুধুমাত্র বেগমের মতো দেখাচ্ছে তা নয়। এই সাজ তার মাথার উপর অনেক বড় দায়িত্ব সপে দিয়েছে। সে রূপনগরের সম্রাটের অর্ধাঙ্গিনী হতে যাচ্ছে। তাই আজ থেকে সে রূপনগরের সম্রাজ্ঞী। তার দায়িত্ব অনেক।
অল্পবয়সী রাঁধুনি মেয়ে গুলো বলে বলে হাসাহাসি করছিল, ‘ আজ বেগমের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারবেন না সম্রাট। ‘
অপরূপার তখনি হুঁশে এল শেহজাদের কথা। কোথায় উনি? রন্ধনশালায় ঢুকার পর আর দেখতে পায়নি সে। একবারও দেখা দেবেন না এমন তো নয়। তাহলে কোথায়? শঙ্কিত হয়ে পড়লো সে। রাঁধুনীরা তাকে সাজিয়ে কক্ষ থেকে বের হলো। দু’একজন বসা ছিল। মসজিদ হতে খুতবা পাঠের আওয়াজ ভেসে আসছে। অপরূপা কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। তার হাতের কঙ্কন শব্দ করে উঠতেই কক্ষে অবস্থান রত দু’জন তার পিছু পিছু বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ কোথায় যাচ্ছেন? ওদিকে যাবেন না। আজ জুমাবার। মসজিদ মাঠ মুসল্লীতে ভর্তি। বেগম যাবেন না। ‘
অপরূপা তাদের কথা শুনলো না। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
‘ আমাকে আটকাবে না। আমার কাছ থেকে নিশ্চয়ই কিছু লুকোনো হচ্ছে। আমি জানতে চাই। ‘
সে আবারও ছুটে গেল। শেরহাম সুলতানের জাহাজ এসেছিল ঘাটে। ঘাট থেকে এই মসজিদ তো বেশিদূর নয়। তাহলে কি সম্রাট সেখানে গিয়েছেন? সে যে এই মসজিদে আছে তা কি শেরহাম সুলতান জানতে পেরেছেন? যুদ্ধে সে ভয় পাচ্ছে না। ভয় পাচ্ছে শেরহাম সুলতানের মুখোমুখি হতে। শেরহাম সুলতানকে সে একসময় ভালোবেসেছিল, আজ সে তার জন্য আতঙ্ক বৈকি কিছু না। যে মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভালোবাসা খুঁজতো সেই মুখ না দেখার জন্য খোদার দরবারে রাতদিন সে ফরিয়াদ জানায়।
তাকে কেউ আটকাতে পারলো না। রাঁধুনিরা তার পেছনে ছুটে গেল।
অপরূপা রাঁধুনীদের শয়নকক্ষ পার হয়ে যেই পাশের কক্ষটির গলি ধরতে যাবে ঠিক তখনি শক্তপোক্ত কিছু একটার সাথে ধুম করে বাড়ি খেয়ে নাকের নথে ব্যাথা পেল । চোখ বুঁজে নাকের সেই পাশটাতে আলতো ছুঁয়ে বলল,
‘ ইশশশ ‘।
তারপর মহাবিরক্তিতে চোখ মেলতেই তার কুঞ্চিত ললাট মসৃণ হয়ে এল। দেখলো, সোনালী রঙের কারুকাজময় পাঞ্জাবি পরিহিত সুঠাম দেহের সুপুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার গালের ঘন কালো খোঁচা দাঁড়িতে ঘূ্ণিপাকটি চোখে পড়ার মতোই সুন্দর। সুরমা পরিহিত চোখদুটো তার বিরক্তিতে ছেয়ে যাওয়া মুখের দিকে মোহিত নয়নে চেয়ে রয়েছে। অপরূপা সেই পিঙ্গলবর্ণ চোখদুটিতে নিজের সর্বনাশ দেখতে পেল। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল অচিরাৎ। শুকনো ঢোক গিললো।
রাঁধুনিরা শেহজাদকে দেখে চোখ নত করে যে পথে এসেছে সেই পথে চলে গেল হেসে। পাশ দিয়ে দু’জন মৃদু হাসতে হাসতে হেঁটে গেল ফুলের ঢালা হাতে নিয়ে।
শেহজাদ তাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে অপরূপার দিকে তাকালো। কপাল উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘ কোথায় ছুটছিলে এভাবে? ‘
বলতে অপরূপার লজ্জা লাগলো।
মৃদুমন্দ হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
‘ না। তেমন কিছু না। ‘
শেহজাদ তার কিঞ্চিৎ সরে যাওয়া টায়রা ঠিকঠাক জায়গায় বসিয়ে চাপাস্বরে বলল,
‘ দেখা হয়ে গেছে। আসি। ‘
‘ কি দেখেছেন?’
প্রশ্নটি করে ফেলার পরই মনে হলো সে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে।
শেহজাদ সেই প্রশ্নশুনে ঘাড় ফিরিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতেই ভয়, লাজ, সংকোচ সব মিলিয়ে শিরশির করে উঠলো অপরূপার হাত-পা। সে দ্রুত পালিয়ে গেল শেহজাদের দৃষ্টিসীমানা থেকে।
***********
মধ্যাহ্নের সেই কাঙ্ক্ষিত লগ্ন চলে এল। চারপাশে সবার হৈচৈ ছোটাছুটি। অপরূপাকে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড়। মাঝখানে সাদা পিনপিনে একটা পর্দা টেনে দিয়ে অপরূপাকে একপাশে বসানো হলো। অপরূপা ঘোমটার আড়ালের চোখ তুলে দেখলো অস্থিরচিত্তে কাশিম আর সৈন্যদের সাথে কথা বলছে শেহজাদ। রুমাল দিয়ে ঘনঘন কপালের ঘাম মুছে এইসেই দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। তারমানে কি উনি কিছু লুকচ্ছেন তার কাছ থেকে? কি লুকচ্ছেন?অপরূপার মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো। অজানা একটা ভয় বুক কামড়ে ধরে আছে। সত্যিই কি নিকাহ হচ্ছে? আর কয়েক মুহূর্তের পর সে সম্রাটের বেগম! সে কি আদৌ যোগ্য সম্রাটের? কেন এত অভাগিনীকে ভালোবাসতে হলো? এই সুন্দর সময়টা অন্তত উপভোগ করতে পারতেন উনি।
কথা বলা শেষে শেহজাদ এসে বসলো। পর্দার ওপাশে অপরূপাকে দেখলো। তার সমস্ত চিন্তাচেতনা এসে হালকা হয়ে যায় মেয়েটার মুখটা দেখলে। বুকের ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে উঠে। এ তো সেই রূপা, যার প্রেমে পড়ার জন্য তার দুটো চোখই যথেষ্ট ছিল, যার মায়ায় পড়ার জন্য তার দূর থেকে একঝলক দেখা যথেষ্ট আজ সে তার বেগম হতে যাচ্ছে। তার সম্রাজ্ঞী।
কাজীসাহেব বিবাহের খুতবা পাঠ শেষে ইজাব পেশ করে শেহজাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘মরহুম আমজাদ তৈমুরের সুকন্যা অপরূপা তৈমুরকে একশ এক পয়সা মোহরানায় আপনার কাছে বিবাহ দিলাম, আপনি বলুন ‘কবুল’। ‘
অপরূপা চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে রেখেছিল সেসময়টাতে। মনে হচ্ছিল এইমাত্র কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। সব শেষ হয়ে যাবে। সব এলোমেলো হয়ে যাবে। তা কিছুই হলো না। রোধ করে রাখা দম ছাড়া পেল শেহজাদের কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই।
‘ কবুল। কবুল। কবুল। ‘
কাজী অপরূপাকে বললেন,
‘ কন্যা আপনি বলুন ‘ আলহামদুলিল্লাহ’।
একজন বিবাহিতা রাঁধুনী অপরূপাকে দু কাঁধে হাত রেখে উৎসাহিত করলো। ভেতরে হতে উগলে আসা কান্না গিলে অপরূপা বলল,
‘ আলহামদুলিল্লাহ ‘
সকলের ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ফুটে উঠলো। উপস্থিত সকলেই সুন্নতি দোয়া পাঠ করলো তাদের দাম্পত্য জীবনের জন্য।
‘ আল্লাহ তোমার জন্য বরকত দিন, তোমার ওপর বরকত দিন ও তোমাদের দুজনকে কল্যাণের সঙ্গে মিলিত করুন। ‘
কাশীম এসে কানেকানে কিছু বলতেই শেহজাদ মাথার টুপি খুলতে খুলতে ব্যস্তপায়ে সেখান হতে বেরিয়ে গেল। অপরূপা তার যাওয়া দেখলো।
——————-
শেরহামের সৈন্যদল চারপাশ ঘিরে ফেলছে খবরটা এগারোটার ক্ষণে কানে এসেছে শেহজাদের। কোনোমতে বিয়ে পড়ানোর অপেক্ষায় ছিল। কাশীম এসে তাগাদা দিয়ে বলল,
‘ সাহেব দ্রুত এই জায়গা থেকে ছোটে বেগমকে নিয়ে আপনি প্রস্থান করুন। আমরা ওদের দেখছি।’
শেহজাদ বলল,
‘ নাহ। পালাবো না। আমার আর ভয় নেই। তোমরা বিচলিত হবে না।’
কাশীম বলল,
‘ আমরা ছোটে বেগমের জন্য বিচলিত হচ্ছি। আজকেই নিকাহ। আজকেই উনি যুদ্ধ বিগ্রহ দেখলে ভেঙে পড়তে পারেন। আমাদের উপর ছেড়ে দিন। আপনি দ্রুত এখান থেকে চলে যান। ‘
শেহজাদ তার কথায় রাজী হলো না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর এক সৈন্য খবর নিয়ে এল শেরহাম সুলতান উনার সৈন্যদের নিয়ে এদিকেই আসছেন। মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা, এতিমখানার ছোট ছোট বাচ্চাদের নিরাপত্তা রক্ষার কথা ভেবে শেহজাদকে এখান থেকে সরতে হলো।
অপরূপাকে কিছুই জানানো হয়নি। ছোট পুটলিতে ভরে নানান প্রয়োজনীয় জিনিস, কিছু খাবার, দিয়ে দিল সবার বয়োজ্যেষ্ঠ রাঁধুনী মহিলাটি। শেহজাদ সবাইকে পুরস্কৃত করলো। সুলতান মহলে দাওয়াত করলো। বলল
‘ এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। ‘
তারা বলল,
‘ বেগম তেমন কিছু খাননি। পথে আপনাদের এসব কাজে লাগবে। তখন খেয়ে নেবেন দু’জন। এখানে আরও জরুরি জিনিসপত্র আছে। ‘
শেহজাদ নিয়ে নিল পুটলিটা । কাশীম তাড়া দিচ্ছে। সাহেব দ্রুত করুন। নইলে বিপদ হয়ে যাবে।
শেহজাদ অপরূপার কক্ষে গিয়ে ওর হাত ধরে টেনে বেরিয়ে এল। অপরূপা হতভম্ব। কি হচ্ছে? কোথায় যাচ্ছে? উনি কথা বলা ছাড়া কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? সবাইকে আতঙ্কিত দেখাচ্ছে কেন?
শেহজাদ থেমে তাকে শান্তস্বরে বলল,
‘ এখানে বিপদ তাই চলে যাচ্ছি রূপা। এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্ন নয়। ‘
অপরূপা নিশ্চুপ, নিঃসাড়। সে যা ভেবেছে তাই কি? শেহজাদের সাথে যেতে যেতে বলল
‘ কিন্তু টিংটিং? আমি টিংটিংকে রেখে কি করে যাব? ‘
শেহজাদ বলল,
‘ টিংটিংকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ও অসুস্থ। আমার ঘোড়া নিয়ে যেতে হবে। ও সুস্থ হলে কাশীম ওকে আমাদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেবে। ‘
অপরূপা টিংটিংয়ের কাছে চলে গেল। টিংটিং তাকে দেখে খুশিতে নেচে উঠলো। গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অপরূপা তার গলা জড়িয়ে আদর করে বলল,
‘ তুমি আবারও আমার কাছে ফিরবে। এখন আসি। আল্লাহ হাফেজ বন্ধু। ‘
টিংটিং চেয়ে রইলো ও যতদূর গেল। অপরূপা কান্নাচোখে বারংবার ওর দিকে ফিরে ফিরে চাইলো।
শেহজাদ ওর শক্তিশালী ঘোড়ার পিঠে চেপে বসেছে। সবাই তাদের বিদায় জানানোর জন্য দাঁড়িয়েছে। শেহজাদ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ এসো। ‘
অপরূপা শুকনো ঢোক গিলে ওর হাতের উপর হাত রাখতেই শেহজাদ ওকে টেনে তুললো।
অপরূপা ওর পেছনে বসে পিঠে আলতোভাবে হাত রাখলো। সবাই তাদের বিদেয় জানালো। রাঁধুনিরা বলল, ‘ বেগমকে নিয়ে আবারও যেন আসেন তিনি। ‘
সম্রাট কথা দিল আসবে। মৌলবি সাহেব বললেন,
‘ তোমাদের যাত্রা মঙ্গলময় হোক। আল্লাহ হাফেজ।’
শেহজাদ ঘোড়ার লাগাম টানতেই হ্রেষাধ্বনিতে মেতে উঠলো চারপাশ। মাটিতে খুঁর গেঁথে ছুটতে শুরু করতেই অপরূপা ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো শেহজাদের পিঠ। এমন কোমল স্পর্শে শেহজাদের মজবুত শরীর কেঁপে উঠলো একবার। অপরূপা ভয়ে তার পিঠে মুখ লুকিয়ে বলল,
‘ দয়া করে লাগাম আমাকে দিন। পেছনে ভয় করছে । আগে কোনোদিন বসিনি। ‘
শেহজাদ বলল,
‘ আমি পেছনে বসলে তোমাকে ঠিক এভাবেই ঝাপটে ধরবো । তখন অসুবিধে হবে না তো? ‘
অপরূপা সাথে সাথেই মাথা দুলিয়ে না না করে উঠলো। তার দরকার নেই।
শেহজাদ সশব্দে হেসে উঠলো। অপরূপা লজ্জায় রাঙা হলো।
বসতিস্থল, রাস্তাঘাট, খাল-বিল,পথপান্তর পেরিয়ে তাদের ঘোড়া ছুটতে লাগলো পাহাড়ের অনেকটা দূরের একটা খোলা বিলের পাশ দিয়ে। সেই ধূ ধূ বিলে চড়ছে অসংখ্য ভেড়া। আকাশের সাদা মেঘের আড়ালে লুকোচুরি করছে থোকা থোকা কৃষ্ণবর্ণের মেঘ। গৌধূলির কমলা আলো নব্য মেঘের পদচারণায় আকাশকে দিয়েছে গম্ভীর রূপ।
সাঁজের বেলায় পাখিরা নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত। অপরূপা আবদার করলো
‘ এখানে থামুন দয়া করে। ‘
শেহজাদ থেমে গেল। অপরূপা লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ছুটে গেল ভেড়াদের পালের ভেতর। মিশে গেল তাদের সাথে। পাল্লা দিয়ে ভেড়াদের সাথে ছুটতে ছুটতে শেহজাদকেও ডাকলো। শেহজাদ গেল না। আকাশের অবস্থা দেখে বুঝলো যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। সামনেই জঙ্গল। থাকবে কোথায়?
চলমান.