Monday, October 6, 2025







প্রিয় বেগম পর্ব-২৭+২৮

#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_২৭
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

শেহজাদের ঘোড়ার পিছুপিছু অনেকদূর ছুটলো অপরূপা। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে। শেহজাদের ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি আর শুনতে পাওয়া গেল না। সেইসাথে পথ হারিয়েছে সে। কিছুটা পিছু গেলেই বোধহয় পথ খুঁজে পাবে। তাই পেছনে তাকাতে তাকাতে ফের পৌঁছে গেল মসজিদের কাছাকাছি। ওই মেয়েগুলোকে খুঁজে না পেয়ে, শেহজাদের চলে যাওয়া দেখে, সব অপরিচিত মানুষজন দেখে সে দিশেহারা হয়ে পড়লো। কোথায় যাবে সে? কি করবে? কার কাছে আশ্রয় পাবে? তার জীবনটা কি এভাবে আশ্রয়ে আশ্রয়ে কেটে যাবে! অথৈ সমুদ্রে যুদ্ধ করে টিকে থাকা পালতৌলা নৌকোটির মতো শুধু যুক্ত করে যাচ্ছে সে। কিন্তু কোনো কূলকিনারা নেই। যেখানে যাই সেখানেই অশান্তি, যুদ্ধ, কলহ লেগেই থাকে। ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সে। আজকাল নিজেকে সত্যি সত্যিই অলক্ষী, অপয়া মনে হচ্ছে।
বুকের সাথে পুটলিটা চেপে ধরে নীরবে চোখের জল ফেললো। তারপর পথ খুঁজতে লাগলো। কোথাও ওই মেয়েদুটোকে দেখা গেল না। ঘোড়ার গাড়ি যেখানে থেমেছিল সেখানে গেল অপরূপা দেখলো ঘোড়ার গাড়ি নেই। আরও কিছুদূর গেল। সারি সারি যে গাড়িগুলো দাঁড়ানো ছিল তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করলো রূপনগর থেকে কেউ এসেছে কিনা। লোকগুলো জানালো তারা চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। অপরূপা হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লো। হাঁটতে হাঁটতে নির্জন জায়গায় এসে থামলো। সেখানে একটা বটগাছ আছে। বটগাছের নীচে শান বাঁধানো। সেখানে হতাশ হয়ে বসে পড়লো সে। পুটলিটা বুকে জড়িয়ে হাঁটুতে মাথা রাখতে গিয়ে কখন যে চোখে তন্দ্রা নেমে এল বিলক্ষণেও বুঝতে পারলো না সে। যখন চোখ খুললো তখন একদল সৈন্যসামন্ত দেখলো সে। মাথায় পাগড়ি বাঁধা। মুখ ঢাকা তার। মসজিদের আশেপাশে যারা ছিল তারাও কোনোমতে পালিয়ে গেল! ঘোড়াগুলি চিঁহি চিঁহি শব্দ তুলে পা তুলছে আবার শব্দ করে বসাচ্ছে।
অপরূপা জড়োসড়ো হয়ে বসলো। শঙ্কিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পুটলিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘কে আপনারা? কি চান? ‘

গাড়ি থেকে দু একজন লোক নেমে এল একসাথে। খুবই নিকটে তাদের মুখোশপরা মুখটা অপরূপা দেখতে দেখতে ঢলে পড়লো।

********

অতল আঁধারে নিমজ্জিত পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় একটা গুহার মতো বাসস্থান। সেখানে সারি সারি মশাল জ্বলছে। বন্য শূকরের গায়ের তীব্র গন্ধে গা গুলালো অপরূপার। বন্য শেয়ালের ভয়ংকর ডাক। হুতুম পেঁচার ডাক। পাহাড়ি নিজস্ব শব্দ। বনের ভেতরে বয়ে যাওয়া শাঁ শাঁ বাতাস। অপরূপার মনে হলো সে অন্য একটা জায়গায় আছে। নিজেকে একটা তাবুর মতো ঘরে আবিস্কার করলো সে। তাঁবু থেকে বের হতেই সেই মশালগুলো দেখতে পেল। তাঁবুর বিপরীত পার্শ্বে একজন কালো পোশাক পরিহিত এক বৃদ্ধ লোক বসে আছেন। সেখান হতে ধোঁয়ার কুন্ডলী ভেসে আসছে। বৃদ্ধকে ঘিরে সেই লোকগুলি বসে আছে যারা তাকে তুলে এনেছে । অপরূপা সাহস সঞ্চয় করে দুরুদুরু বক্ষে কাছাকাছি যেতেই সবাই একত্রে তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। অপরূপা পিছু হেঁটে বলল,

‘ কারা আপনারা? ‘

বৃদ্ধ লোকটি ইশারায় তাকে ডাকলো। অপরূপা কম্পমান বক্ষে এগিয়ে গেল। ভীত জড়োসড়ো হয়ে নির্দিষ্ট আসনে বসতেই লম্বা দাঁড়ি গোঁফওয়ালা বৃদ্ধ বলল,

‘ আমরা সন্ন্যাসী। যোদ্ধা। ‘

অপরূপা সকলের পাথরের মূর্তির ন্যায় পলকহীন মুখের দিকের চেয়ে ভয়ে ভয়ে বলল,

‘ আমার কাছ থেকে কি চান? কেন তুলে এনেছেন? আমাকে মুক্তি দিন। ‘

‘ তুমি এই গভীর রাতে গহীন বনে কোথায় যাবে? তোমার বাড়িঘর কোথায়?

‘আমার কিচ্ছু নেই। আমাকে ছেড়ে দিন। ‘

জ্বলন্ত আগুনের উপর একমুঠো ধুপ ফেলে দিতেই অপরূপা খুকখুক করে কেশে উঠতেই বৃদ্ধ বলল,

‘ তুমি দুটো দিন সময় কাটাও এখানে। ওই মনুষ্যসমাজকে তোমার তুচ্ছ মনে হবে। জীবন এভাবেই সুন্দর। নেই কোনো ঝঞ্ঝাট, নেই পিছুটান, নেই কারো মায়া। ‘

অপরূপা কাশতে কাশতে স্বাভাবিক হলো। বলল,

‘ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। খিদেও পেয়েছে। ‘

কমলা রঙের শাড়ির মতো পোশাক প্যাঁচানো দুটো মহিলা এসে তাকে তুলে নিয়ে গেল। তাঁবুর ভেতর বসিয়ে চুপচাপ চলে গেল। ফের দু’মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে বিরাটাকার একটি পাতায় করে খাবার নিয়ে এল। অপরূপা পিছিয়ে গিয়ে বলল,

‘ছিঃ এসব আমি খাইনা। পোড়া মাংস। আমি খাব না। নিয়ে যান। কিসের মাংস এসব? ‘

‘ পাখির মাংস। ‘

বলেই চলে গেল মহিলা দুটো। অপরূপা সেসব না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। মাঝরাতে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করে উঠলো তার। ক্ষিধে এমনভাবে কলিজা আঁচড়াচ্ছে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে চোখের পলকেই মাংসগুলো শেষ করে ঢকঢক করে মাটির কলস থেকে পানি খেল সে।
তারপর কান মাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠলো। তাঁবুর বাইরে বিশালাকৃতির একটা ছায়া চোখে পড়লো তার। ভয়ে তরতরিয়ে ঘাম ছুটলো । গলা শুকিয়ে এল। মাথা ঘুরে উঠলো।

তাঁবুর মধ্যে থাকা হারিকেনের পাশে ধনুক, বল্লম, ছোট ছোট চাকু, কুড়াল, পেরেক, মাতুলি দেখতে পেল সে। নিজের প্রাণসংশয়ের ভয় সে চট করে
ধনুক হাতে তুলে নিল। তাবুর ফটক দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ছায়াটি বরাবর আন্দাজে তীর ছুঁড়তেই নিজেই সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে ছিটকে পড়ে গেল। সাথেসাথে গোৎগোৎ শব্দ তুলে ভূমিকম্পের মতো মাটি কাঁপিয়ে জন্তুটি পালিয়ে গেল।

অপরূপা জড়বস্তুর ন্যায় পড়ে রইলো অবশ শরীরে। তার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা মৃত্যুভয়ে কাঁপছে। ভেতরের কান্না ভেতরেই চেপে গেল তার। এখানে কান্না মানেই তার বিপদ।
তাঁবুর বাইরে মনুষ্য পদধ্বনির শব্দ পেল সে। বেরিয়ে এল সাথে সাথেই । চেঁচিয়ে উঠে ধপ করে বসে পড়ে বলল,

‘ আমাকে মুক্তি দিন। আমি এখানে থাকতে পারব না। ‘

বৃদ্ধ লোকটি নিরুত্তাপ। রুক্ষস্বরে বলল,

‘কাল সেটি আবারও আসবে। প্রস্তুত থাকবে। ‘

কথাটি শুনে অপরূপার দমবন্ধ প্রায়। পালাতে পারবে না সে জানে। যতক্ষণ না এরা চায় ততক্ষণ সে পালাতে পারবে না। কিন্তু কাল কি করে লড়বে ওই জন্তুর সাথে। আজ কোনোমতে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু কাল?

___________

সুন্দরপুরের সমস্ত অলিতে-গলিতে পাঁচ পাঁচটা ঘোরাঘুরি করলো শেহজাদ। এক জমিদার বাড়িতে আতিথেয়তার গ্রহণ করলো। জমিদার বাড়ির একজন ভৃত্যকে সাথে নিয়ে সারা সুন্দরপুরের অলিগলিতে ঘুরে বুঝলো দারিদ্র্যতা এখানকার বড় সংকট। সচ্ছল অবস্থা মাত্র গুটিকয়েক বাড়ির।
নিজের জাগতিক সমস্ত দুঃখ, বেদনা, পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব, আর হার-জিতের কথা ভুলতেই তার এই পদক্ষেপ। দাদাজান বলতেন, তোমার দায়িত্বকে কভু অবহেলা করবে না, যাই হয়ে যাক। যা তোমার তা তোমার কাছে ফিরে আসবেই। যা কিছুর প্রতি তুমি আকৃষ্ট হও সেইসব যদি তুমি না পাও তবে আফসোস করবে না। মনে করবে তা তোমার জন্য অকল্যাণকর ছিল। দাদাজানের কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সে।
কিন্তু দিনশেষে যখন ক্লান্তি এসে ভর করে চোখের পাতায় তখনি ঝাপসা ঝাপসা ওই চোখদুটি ভেসে উঠে মানসপটে। অন্যায়, এবং সমীচীন নয় জেনেও তাকে ভাবতে বড়ই ভালো লাগে। মনে হয় রূপা তার জন্য কিছুতেই অকল্যাণকর হতে পারে না। কিছুতেই ওই সরল মনের মেয়েটি তার জন্য অশুভ হতে পারে না। হঠাৎ করে মনে হয় না ওই রাতটি মিথ্যে। তাদের নিকাহ হয়নি। সে মহলে ফিরে দেখতে পাবে রূপা নিকাহ করেনি। যার কাছে ধ্বংস তাকে রূপা ভালোবাসতে পারে না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় কি যায় আসে এতে? সামান্য স্বপ্নের মৃত্যুই তো ঘটলো। দিব্যি আছে সে। ভালোমন্দে বেঁচে আছে। বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। খেতে পারছে। বেশ আছে। জীবনে এত এত পূর্ণতার মাঝে এটুকু অপূর্ণতা থাকুক।
কিন্তু মহলে সে কি করে ফিরবে? এক ছাদের নীচে থেকে রূপাকে অন্য খাঁচায় দেখে নিজেকে সামলাবে কি করে? ভাবতেই বুকের বাম পাশ হতে ব্যাথা উদগম হয় তারপর একটু একটু করে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। মনটা তাকে শান্তি দেয় না। বারবার বলে, তোর মনটা ভালো নেই। মনটাই যে রূপা। তারমানে রূপা ভালো নেই।

মনের এই দোলাচালে সে চিঠি লিখলো সাফায়াতকে। জমিদার বাড়ির ঠিকানা দিল।
বত্রিশ ঘন্টার ভেতরেই কাশিম এসে হাজির এল
সেখানে। জানালো খোদেজা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শেরহামের লোকজন দিনদুপুরে নগরে লুটতরাজ করছে। দুটি মালবাহী জাহাজ সমুদ্রপথে আটকে রেখেছে শেরহাম। আর রূপা সেইরাতেই পালিয়েছে। আর সে সুন্দরপুরেই আছে।

সব শুনে শেহজাদের পায়ের নীচের মাটি সরে গেল। স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ধমকের সুরে গর্জন করে বলল, তাকে পালাতে দিলে কি করে? কিছু চেনে ও?

কাশিম মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। বলল, মা বেগম সাহায্য করেছেন।
শেহজাদের আর কিছু বলার রইলো না।
শেহজাদ কাশিমকে বলে সৈন্যদল ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল সুন্দরপুরে। শেহজাদ সেই মসজিদে নামাজ আদায়ের জন্য গেলে এক খতিবের মাধ্যমে জানতে পারলেন, সাদা পোশাক পড়া একটা মেয়ে ডাকাত সৈন্যদের হাতে পড়েছিল সেইরাতে।যেইরাতে মাহফিল ছিল। মেয়েটি অতিশয় রূপবতী ছিল।

সবটা শোনার পর শেহজাদ নিজেকে ধিক্কার দিল। রূপা তার এত কাছাকাছি ছিল আর সে দেখলো না, বুঝলো না? এখন কোথায় খুঁজবে সে রূপাকে? তারমানে ওইদিন চিরকুটটা সে লিখেনি? কত ভুল বুঝলো সে রূপাকে! এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কি করে করবে সে? ডাকাত সৈন্যরা রূপাকে অক্ষত রেখেছে কি আদৌ? খোদার দরবারে সে আর্জি জানায় রূপা যেখানে থাকুক ভালো থাকুক।

এদিকে, সন্ন্যাসীদের আঁখড়ায় বন্দি রূপার দিন কাটতে লাগলো রোজ রাতে বন্য শূকরের আক্রমণ ঠেকাতে, দিনের বেলায় ক্ষিধের জ্বালা মেটাতে মাছ শিকারে, আর পাখি শিকারে। পরপর কয়েকবার ঘোড়ার লাগাম হাত থেকে ছুটে গিয়ে বন্য মাটির ঝোপঝাড়ে, কাটাবনে পড়ে ক্ষতবিক্ষত হলো সে। আর তখন মনে হলো তার পালানোর দরকার। এ জীবন তার কাম্য নয়। সেও একটু ভালো থাকার অধিকার রাখে।
বড়ই অযত্নে সেই ক্ষত শুকানোর পর সেই লাগাম পুনরায় ধরে ঘোড়াটিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে জ্যোৎস্নারাতে। পেছনে তাকে তাড়া করে চলেছে সন্ন্যাসীদের দল। ছুটতে ছুটতে বিশাল জায়গাজুড়ে বসা একটি মেলার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতেই ঘোড়াটি তার কাঁধে মুখ ঘষলো। অপরূপা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ভালোই প্রশিক্ষণ দিয়েছি বল বন্ধু?’

বাতাসের সাথে সেই পরিচিত আতরের সুগন্ধি পুনরায় নাসিকাগ্রে প্রবেশ করতেই অপরূপা মাথা ঢেকে মুখ কাপড় বাঁধলো। পেছনে অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ের শব্দ এসে থামলো। অশ্বারোহীর একজন দরাজ গলায় বলে উঠল,

‘পথ ছেড়ে দাঁড়ান।’

সামনেও একদল অশ্বারোহী এসে দাঁড়ালো। যাদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছে সে। পেছনে শেহজাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অপরূপা আর অপরূপার সামনের লোকদের চেয়ে রইলো। অপরূপা দ্বিধাগ্রস্তের মতো চেয়ে রইলো। কি করবে এখন সে?

চলমান….

#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_২৮
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

অপরূপা দ্বিধাগ্রস্তের মতো চেয়ে রইলো। কি করবে এখন সে? পেছনে সম্রাট। যার কাছে সে ধরা পড়তে চায় না এই মুহূর্তে। আর সামনে তার মৃত্যু। এই সন্ন্যাসীরা মূলত শুধুই সন্ন্যাসী নয় সন্ন্যাসীরা একটা যুবতী মেয়েকে তাদের সাথে আটকে রাখবে এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তাদের কাজ যুদ্ধবিগ্রহ নয়। সন্ন্যাসীরা মূলত যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে দূরেই থাকে। তারা সারাক্ষণ ধ্যান জ্ঞানে মগ্ন থাকে। সন্ন্যাসী আবার পাশাপাশি যোদ্ধা শব্দদুটো অপরূপার কাছে কেমন বেমানান ঠেকেছিল প্রথম থেকেই। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। অপরূপা তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলো প্রায় তিন সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পর।

তখন মহিলাদুটোর সাথে গভীর বনের ভেতরে পাখি শিকারে যেত সে। মাঝেমাঝে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে হরিণ ছানাও শিকার করতো। পুরুষ লোকগুলো অন্যত্র যেত বৃদ্ধ লোকটার আদেশে। অপরূপা তখন ধনুক থেকে তীর ছুঁড়ে পাখি শিকার রপ্ত করে ফেলেছে । পাহাড়ের পাদদেশে ঝর্ণার পানিতে চিংড়ি ধরা, লেক থেকে বড়শীতে মাছ তোলা সব রপ্ত করেছে ওদের দেখে দেখে। ঘোড়ার লাগাম ধরে ছোটা তখনও অতটা সহজ ছিল না। টানা দু সপ্তাহ ধরে ঘোড়ার পিঠে চড়ে লাগাম টানলেও বেশিদূর যেতে পারলো না সে। ঢলে ঢলে পড়ে গেল। হাতের পেশি লাগামের ভার সইতে পারে না যার ফলে লাগাম ছুটে যায়। আর সে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে বন্য ঝোপঝাড়ে। হাত পা ছিলে যায়। পা মচকে যায়। সে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে মুক্তি চাই তাদের কাছ থেকে। তার দুঃখে গলে না বরঞ্চ তার অদক্ষতায় রুষ্ট হয়ে উঠে মহিলাগুলো। তার দুঃখ-কষ্টে তাদের কিছুই যায় আসে না। বরং সে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলে টেনে হিঁচড়ে তুলে আবারও ঘোড়ার পিঠে তুলে লাগাম ধরিয়ে দিয়ে বলে,

‘তোমার খাবার তোমাকেই শিকার করতে হবে।
নয়ত অভুক্ত থাকো। ক্ষিদেয় মরো।’

ক্ষুধার তাড়নায় অপরূপাকে লাগাম টেনে ছুটতে হয়েছে বনেবাদাড়ে। জীবনে একটা পিঁপড়ে মারতে যে মেয়েটি ভয় পেত, শতবার ভাবতো তাকে নিজের প্রাণ রক্ষার নিমিত্তে ধনু ছুঁড়তে হয়েছে বন্য হিংস্র পশুর দিকে। পালা দিয়ে ছুটতে হয়েছে ঘোড়ার পিঠে চড়ে। কি দূর্বিষহ সময়ের মধ্যে দিয়ে গেল একমাত্র সে-ই জানে। কখনো কখনো মনে হয়েছে ওই মহলে থেকে গেলে ভালো হতো। অন্তত এত আঘাত সহ্য করতে হতো না। ক্ষিদের তাড়নায় জন্তু জানোয়ারের সাথে লড়তে হতো না। এই ভয়ংকর অদ্ভুত মানুষগুলোর সাথে থাকতে হতো না।

বৃদ্ধ লোকটা যখনি আগুন ধরায় ধোঁয়ায় কালচে হয়ে উঠে গুহার প্রবেশ পথটা। কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উপরে উঠতে থাকে। বনজঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ে সেই ধোঁয়ার কালিমা। চারপাশে ঘোর অন্ধকার, শাঁ শাঁ বুনো বাতাসের মাঝে কালো কালো ধোঁয়া, বন্য পশুদের ডাক, গর্জন। সাথে তাদের অদ্ভুত শব্দে পঠিত তন্ত্র মন্ত্র আর পশুর হাঁড়গুড় নিয়ে আগুনের কুন্ডলীর চারপাশে নাচানাচি দেখে অপরূপা ভীত হয়। সকাল সন্ধ্যা রাতে তাঁবুর ভেতরে চুপচাপ বসে তাদের তান্ডবলীলা দেখতে থাকে।

প্রায় সময় বন্য শূকর এসে হামলা করে তাঁবুতে। রাতের বেলা সজাগ থাকতে হয়। ঘুম আসে ভোরে। ততক্ষণে আর ঘুমাবার জোঁ নেই। মাংস পোড়া গন্ধে ছেয়ে যায় চারিদিকে। অনিদ্রায়,কঠোর পরিশ্রমে,বারবার আঘাতে আঘাতে, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ চিন্তার মর্মাঘাতে অপরূপার নরমতরম কোমল মন শক্ত হয়ে উঠে। বাঁচতে হলে তাকে এখান থেকে পালানোর পথ খুঁজতে হবে। এভাবে বাঁচা যায় না। ভয় পেয়ে, কেঁদেকেটে এদের সহানুভূতি অর্জন করা সম্ভব নয়। বরং সে কান্নাকাটি করলে তারা তার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তাই সে আর ভাঙলো না। ভয় নামক জিনিসটি তলানিতে ঠেকলো ধীরেধীরে।

অপরূপা গোসল সাড়তো ঝর্ণার জলে। ওই লোকগুলো চাউনি লোভাতুর ছিল তাই সে সবসময় সতর্ক থাকতো। সব জায়গায় সে ঘোড়াটিকে নিয়ে যেত। ঘোড়াটির নাম দিয়েছিল সে টিংটিং। তার প্রিয় বন্ধু। তার প্রতি মনিবের অত্যধিক যত্নশীলতায় সে মনিবকে অল্প দিনেই ভালো করে চিনে ফেলেছে। ভালোবেসে ফেলেছে।
অপরূপা দেখলো তার নির্দেশমতো চলতে শুরু করেছে টিংটিং। তাকে দেখামাত্রই শূন্যে পা তুলে নেচে উঠে আনন্দে। তার গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেই অপরূপার কাঁধে মুখ ঘষে আনন্দ জানান দেয় সে। অপরূপা তার গলা জড়িয়ে ধরে আদর কাটে। বিষাদময় জীবনে এত ভয়ংকর মানুষগুলোর মধ্যে টিংটিং তার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠলো। ভরসাস্থল হয়ে উঠলো। যাকে সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে। টিংটিংকে পেয়ে ভেতরে ভেতরে অপরূপা সাহস সঞ্চয় করলো । লাগাম ধরা আরেকটুখানি মজবুত হয়ে এলেই সে টিংটিংকে নিয়ে পালিয়ে যাবে তাই নানানভাবে পালানোর পথও খুঁজতে লাগলো ফাঁকেফাঁকে। যখন সে কাজে বেরোয়।

চার সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরেই যখন তার লাগাম ধরা শক্ত হলো। তখন সকলের জন্য পাখি শিকারের দায়িত্বটা তার কাঁধে এসে পড়লো। কারণ জানতে চাইলে বৃদ্ধ লোকটি হুংকার ছেড়ে বলল, তাকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে কাজে লাগার জন্য। যাতে তারা তাদের কাজে মগ্ন ঘাকতে পারে আর অপরূপা খাবার যোগাড় করে এনে দিতে পারে। তার পেছনে দুজন শুধু তার পাহাড়ারত অবস্থায় থাকবে। কাজ তাকেই করতে হবে।

সকাল বিকাল দুপুরে বনেবাদাড়ে ঘুরে অপরূপা পাখি শিকার করে আনে। এবং মনোরঞ্জনের চেষ্টা করতে থাকে। ফলস্বরূপ কোনো উন্নতি দেখতে পায় না সে। বরঞ্চ এই কাজ সেই কাজ তাকে দিয়ে করানো হয়। কোনো উপয়ান্তর না দেখে সেও তাদের আদেশ পালন করতে থাকে। মাঝে মাঝে ভাবে যদি শেরহাম সুলতান ভুল করে হলেও এই পথে চলে আসতো তাকে খোঁজার জন্য? তার ধ্বংস জেনেও চলে যেত সাথে। শেহজাদ সুলতান তো আসবেন না। তাই শেহজাদের কথা ভাবতে চাইলো না সে। উনি তাকে ভালোবাসে কথাটা তার বিশ্বাস থেকে সেদিনই উঠে গেছে। হয়ত এটাও শেরহাম সুলতানের একটা মিথ্যে। কিন্তু খোদেজার কথাগুলোও ভাবালো তাকে। মহামতি সম্রাট তাকে ভালোবাসে এটা কেমন হাস্যকর ঠেকে আজকাল তার কাছে। উনার ভালোবাসার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য ছিল?
সে ভালোবাসা ছাড়া বাঁচতে শিখে যাবে একদিন। এই লোকগুলোর মতো বলতে ইচ্ছে করে ভালোবাসা মনুষ্যজাতির একটা রোগ। তারা সেই রোগ পালন করতে ভালোবাসে। অপরূপা সেই রোগে আর আক্রান্ত হবে না। কিছুতেই না। শেহজাদ সুলতানকে তো ভুলেও না। অমন নিঠুর মানুষদের প্রতি আজন্ম বিষাদ জমে গেছে তার। তারা দুই ভাই ভালোবাসার সংজ্ঞাটাকে কুৎসিত বানিয়ে ফেলেছে। অপরূপা আর মাথা নত করবে না ওই ভালোবাসার কাছে। প্রাণ থাকতে ভুলেও না।

পালানোর পথ খুঁজতে একদিন ভুলপথে হারিয়ে গেল সে। টিংটিংকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে পাহাড়ের উপরে উঠে গেল। যেতে যেতে বহুদূরে চলে গেল। দেখলো সেখান হতে নীচের লেকটা দৃশ্যমান। লেকটাকে ঘিরে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। মাথার উপর খোলা আকাশ।
সে যেখানে আছে তার আশেপাশে আগরবাতির সুগন্ধি, নানানরকম ফুলগাছ। এখানে কি কোনো মানুষ থাকে? অপরূপার কৌতূহল হলো। সে আরও খানিকটা পথ এগোতেই দেখতে পেল একটি বিশাল পাথরের উপর জায়নামাজে বসা মোনাজাতরত এক সাদা জোব্বা পড়া বৃদ্ধ। বুক অব্দি লম্বা সাদা দাঁড়ি, লম্বা গোঁফ, সাদা চুল, সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় পাগড়ী, গায়ে চাদর, হাতে তজবী ঝুলছে। পাশেই কিছু ফলমূল রাখা, সাথে একটা চাকু, মাটির কলস, একজোড়া চামড়ার জুতো, ধনুক ইত্যাদি ইত্যাদি।
অপরূপা টিংটিংয়ের পিঠ থেকে নেমে গিয়ে রশি ধরে টেনে এগিয়ে গেল মানুষটার দিকে। বৃদ্ধ ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন নীল রঙের লম্বা ঘেরুয়া পোশাকে, সাদা রঙের ঝালরবৃত হিজাব পরিহিত একটি মেয়ে কৌতূহলী চোখে ডানেবামে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে। সাহসী,সুকন্যাকে উনি দেখে বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলেন। অপরূপা টিংটিংকে গাছের সাথে বেঁধে বৃদ্ধ’র কাছে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, ‘সালাম হুজুর। আমি অপরূপা। খাবারের খোঁজে বেরিয়েছি।’
বৃদ্ধ ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে হাত বাড়িয়ে অপরূপার মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘তুমি কি বন্দিনী? ‘
‘কিভাবে জানতে পারলেন?
‘বন্দিনী ছাড়া এদিকে একা একটা মেয়ে এসময় কেন কিভাবে আসবে?’
অপরুপার মনে হলো এই মানুষটা তাকে সাহায্য করতে পারে। তাই সবটা উনাকে খুলে বললো। বলার পর বৃদ্ধ লোকটি জানালো তার মৃত্যু সন্নিকটে। যাদের হাতে সে বন্দী হয়েছে তারা পিশাচের পূজো করে। চাঁদ ডুবে গিয়ে অমাবস্যা নামলেই তাদের প্রয়োজন পড়বে সুন্দরী, রূপবতী, শক্তিশালী,সাহসী,তেজস্বী এক যুবতীর মুন্ডু। তাহলে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। অপরূপাকে প্রথম দেখায় উনার এমনটা সন্দেহ জেগেছিলেন। উনাকে লোকায়তে মানুষ আলী হুজুর নামে চিনতেন। অনেক বছর যাবত এই পাহাড়ে আছেন উনি। উনার ভৃত্য দুটি হাতুড়ি দিয়ে কিছু একটা ভাঙতে ব্যস্ত। উনি আরও জানালেন যে উনার কন্যা এই অশুভ কাজের সাথে লিপ্ত হওয়ায় উনি কন্যাকে অভিশাপ দিয়ে এই পাহাড়ে চলে আসেন। আজও তিনি সেই অশুভ শক্তির ধ্বংসের ধ্যানে মগ্ন থাকেন। তাই বিপদ-আপদের আশঙ্কা পান।

সবটা শোনার পর অপরূপা আঁতকে উঠলো। মৃত্যুভয় তাকে গ্রাস করলো। এখন তার উদ্দেশ্য একটাই । পালানো। যে করেই হোক পালাতে হবে। আর কিছু চায় না সে। একটি শিশি বাড়িয়ে দিয়ে বৃদ্ধ বললেন এই শিশির পানিটুকু তাদের খাবারে মিশিয়ে দিলে তারা কয়েক মুহূর্তের জন্য অজ্ঞান হয়ে যাবে।

অপরূপা শিশিটি তার কোমরের পুটলিতে বেঁধে নিল। কৃতজ্ঞতা জানালো। খেয়াল করলো ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ আসছে। বৃদ্ধ বললো
‘তুমি দ্রুত যাও এখান থেকে। আমার সাথে দেখলে ওরা তোমাকে সন্দেহ করবে। তোমাকে হাতে পায়ে বন্দি করার চেষ্টা করবে। ‘
অপরূপা টিংটিংকে নিয়ে পালিয়ে গেল। তার পরের দিন ভোররাতে স্পষ্ট সেকথা শুনতে পেল সে তাদের মুখে। সে ঘুমের ভান ধরে শুয়েছিল তাঁবুর ভেতর। সেই ভয়ংকর বৃদ্ধ লোকটা এও আদেশ দিল যে তাকে এখন থেকে বেশিবেশি করে খাওয়াতে হবে যাতে স্বাস্থ্য ভালো হয়। দেখতে আরও লাবণ্যময়ী হয়ে উঠে।

অপরূপা মনেমনে পণ করলো আজই পালাবে। তারপর শিকারের উদ্দেশ্য বেরিয়ে তার পেছনে পাহাড়ারত মহিলাদুটোকে অজ্ঞান করার পরিকল্পনা সাজালো। ক্ষিদের বাহানায় বন্য গাছের ডাঁসা পেয়ারা পেড়ে নিয়ে গাছতলায় বসলো। সেই পেয়ারায় শিশি থেকে বের করা পানীয়টি মাখিয়ে দিয়ে খেতে দিল। মহিলাগুলো পাখি দেখতে ব্যস্ত ছিল বিধায় অপরূপার সুযোগ হলো। অবিশ্বাস্যর মতো কাজ করলো পানীয়টি। মহিলাদুটো পেয়ারা অর্ধেক খাওয়া শেষ করার আগেই যেখানে ছিল সেখানে ঢলে পড়লো।
আর সুযোগ বুঝে অপরূপা টিংটিংকে নিয়ে পালিয়ে এল। সেই ভরদুপুর থেকে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটতে ছুটতে এখন প্রায় রাত। সে আর টিংটএ ক্লান্ত হয়ে নেমে পড়েছিল। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে পড়বে বিলক্ষণেও তা ভাবেনি।

শেহজাদের মুখ ঢাকা ছিল না আজ। ঘোড়ার লাগাম ধরে মুখ ঢাকা সৈন্যগুলো আর সামনে তাদের পিছু করে দাঁড়ানো লম্বাচুলো যুবতী অশ্বারোহীর হাবভাব বুঝার চেষ্টা করলো সে। এই সৈন্যগুলো নিশ্চয়ই ডাকাত? তারা রূপার খোঁজ দিতে পারবে কিন্তু সামনের কন্যাটি কে? কি তার পরিচয়?
রূপনগরের সম্রাটকে কে না চেনে। সন্ন্যাসীরূপী যাদুকরগুলিও চিনতে পারলো শেহজাদকে। চির অবিচল শেহজাদের চৌকস চাহনি দেখে তারা ভড়কে গেল। এ কেমনে বিপদে পড়ে গেল? মেয়েটা যদি সব বলে দেয়?

অপরূপা ততক্ষণে টিংটিংয়ের পিঠে চড়ে বসেছে। লাগাম টান দিতে যাবে তার আগেই শেহজাদের ভারী কন্ঠস্বরটি ধমকের সহিত ভেসে এল।

‘ কারা তোমরা? মুখোশ খোলো। নইলে আঘাত করব। ‘

প্রশ্নটিতে ভড়কে গেল দু’পক্ষই। অপরূপা বিচলিত হয়ে পড়লেও জেদ বজায় রাখলো। ফিরলো না। না মুখ থেকে কাপড় সরালো।

একজন বলে উঠলো,

‘ আমরা সন্ন্যাসী হুজুর। এই কন্যাটি আমাদের ঘোড়া নিয়ে পালাচ্ছে। ‘

অপরূপার ভয় হলো এবার। সত্যিই তো!
টিংটিং তো তার ঘোড়া নয়। কিন্তু টিংটিংকে ছাড়া সে থাকবে কি করে? বড্ড একা হয়ে যাবে। টিংটিং ও তাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে। না সে টিংটিংকে ছাড়বে না।

‘সত্যিই কি ঘোড়াটি নিয়ে পালাচ্ছেন আপনি?’

কথাটা অপরূপার উদ্দেশ্যে বলেছে বুঝতে পেরেও অপরূপা চুপ করে থাকলো। সে কথা বললেই যদি কন্ঠস্বর চিনতে পারেন উনি? নাহ সে কথা বলবে না।

অপরূপা লাগাম টেনে টিংটিংকে নিয়ে শেহজাদ আর তার দলবলদের পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল। চোখের পলকেই ঘটনাটি ঘটলো তাই সন্ন্যাসীরূপী লোকগুলো অপরূপার পেছনে ছুটলো। শেহজাদ পেছনে ফিরে দেখলো যুবতী ছুটতে ছুটতে চাঁদের আলোর আবছা অন্ধকারে নাই হয়ে গেল।

কাশিমকে আদেশ দিয়ে ঘোড়ার ঘুরিয়ে সেইপথে ছুটে গেল শেহজাদ। সেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছানোর পরপরই সবার চক্ষু ছানাবড়া।

চাঁদের আলোয় ফকফকা হয়ে আছে জায়গাটা। ওই দূরে নদীর কলকল ধ্বনি ভেসে আসছে। গাছের পাতা শনশন বাতাসে দুলছে।
একের পর তীর বিঁধে রয়েছে সৈন্যগুলোর হাতে পায়ে। নীচে ধরাশায়ী অবস্থায় পড়ে রয়েছে তারা।
যন্ত্রণায় সবাই কাতরাছে। শেহজাদ ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে সেখানকার একজনের পোশাক টেনে ধরে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,

‘ তোমরা ডাকাত? স্বীকার করো। নয়ত প্রাণ রাখবো না। ‘

ততক্ষণে শেহজাদের সৈন্যরা ঘিরে ফেলেছে সবাইকে। একজন কাতর স্বরে বলে উঠলো,

‘ আমরা ডাকাত নই হুজুর। ডাকাত নয়। আমাদের প্রতি সদয় হোন। প্রাণ ভিক্ষা দিন। আমাদের ঘোড়া চায় না। ‘

বহু অনুনয় বিনয়ের পর শেহজাদ তাদের ছেড়ে দিল উপযুক্ত কোনো কারণ না পেয়ে। আর বেশিক্ষণ থাকলে যন্ত্রণায় তারা মারা পড়বে। জান বাঁচা ফরজ হয়ে উঠেছে এখন। তাই তাদের ছেড়ে দিল সে।

পরক্ষণে গুনগুন কান্নার শব্দ ভেসে এল দূর থেকে। শেহজাদ কপাল ভাঁজ করে তাকাতেই কাশিম এসে বলল,

‘ সাহেব ঘোড়ার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে সেই কন্যাটি। নিশ্চয়ই তার ঘোড়াটি আঘাত পেয়েছে। সৈন্যদের তীর ঘোড়ার গায়ে লেগেছে হয়ত। ‘

শেহজাদ কৌতূহলী পায়ে এগিয়ে গেল। ঘোড়া আর মেয়েটির নিকটে পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই আচম্বিত মেয়েটি দাঁড়িয়ে ধনুক তাক করে ফিরলো তার দিকে। বলল,

‘ প্রাণ নিয়ে নেব আরেক পা এগোলে’।

শেহজাদকে দেখে সাথেসাথেই স্তব্ধ হয়ে গেল সে। শেহজাদ লক্ষ করলো তার কান্নারত চোখদুটো দিয়ে আগুন বর্ষণ হচ্ছে। ঘোড়াটি নিশ্চয়ই তার খুব প্রিয়?
চাঁদের নরম আলোয় দু-জোড়া শান্ত চাউনির মিলন ঘটলো খুব কাছ থেকে। অপরূপার হাত কেঁপে উঠলো। শেহজাদ এসে দাঁড়াবে তা ভাবেনি সে। শেহজাদ কুঞ্চিত কপালে অধিক কৌতূহলী হয়ে তাকিয়েই রইলো। কপালের উপর তার এলোমেলো হয়ে আসা চুল অবিন্যস্ত ভাবে পড়ে রয়েছে। শ্বেতশুভ্র বিবর্ণমুখ আর পিঙ্গলবর্ণ ক্লান্ত চোখদুটিতে কতগুলো নির্ঘুম রাতের স্পষ্ট ছাপ!
মহামতি সম্রাট শেহজাদের এ কেমন পরিণতি হয়েছে!

অপরূপা ধীরেধীরে তীর সরিয়ে পেছনে ফিরে ছুটবে ঠিক তখনি তার মাথায় প্যাঁচানো ওড়না খপ করে ধরতেই খুলে এসে হাতের মুঠোয় বন্দী হলো। টান বেশ জোরে দেয়ায় অপরূপার একঝাঁক কালো চুল ঝপাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়লো পিঠে। কবরীটি কোথায় যেন পড়ে গেল। পা জোড়া থমকে গেল তার। শেহজাদ ওড়নাটি হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে চাপা গলায় ডাকলো,

‘রূপাহ!!’

ক্রোধিত চোখে ফিরে তাকালো অপরূপা। সেই রাগ, ক্রোধ, ক্ষোভ ভোজবাজির মতো এক নিমেষেই মিলিয়ে পিঙ্গলবর্ণ চোখদুটির সাথে দৃষ্টি মিলন হতেই। শেহজাদের হাত থেকে চট করে ওড়না কেড়ে নিতে যেতেই শেহজাদ ওড়নাটি তার গায়ে জড়িয়ে ধরে তাকে কাছে টেনে এনে দু বাহু ঝাঁকিয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁসে রুক্ষ গলায় ধমকে বলল,

‘ কোথায় ছিলে তুমি? খোদার কসম এই একমাসে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমি তোমাকে খুঁজিনি। এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন? আমাকে দেখেও পালাচ্ছ? কেন? উত্তর দাও রূপা।

ধমকে অপরূপা কেঁপে উঠলো। স্থির চেয়ে রইলো ক্রোধের অনল ঝড়ে পড়া চোখদুটোর দিকে। মনে হলো সম্রাটের এই অবস্থার জন্য সে দায়ী। চোখের কাতরতা, মুখের ব্যঞ্জন, কন্ঠের শীতলতা তাকে আবারও কোনো এক অদৃশ্য মায়ায় শান্ত করিয়ে দিয়েছে। দেখানোর মতো রাগ, ক্রোধ, ক্ষোভ কিছুই সে খুঁজে পাচ্ছে না। আবারও সর্বনাশী গ্রাসে সে তলিয়ে যাচ্ছে।

চলবে…..

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ