#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_২৩
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
গতকালের ঘটনার নিমিত্তে মহলে হৈচৈ নেই।মহারবে মেতে থাকা মহলের প্রতিটি কোণায় বিষণ্নতা, মনখারাপের গল্প লুকোনো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আতঙ্ক। সেই পদধ্বনির শব্দ যেদিকেই যাচ্ছে সেদিকে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছে যেন। অপরূপা কক্ষের ভেতর নিজেকে বদ্ধ করে রেখেছিল সকাল থেকে। একবারও বেরোয়নি। একেকটা মুহূর্ত যাচ্ছে চিন্তায়, উৎকন্ঠায়। জানেনা কি হবে এরপর।
ভাগ্যের পরিহাসে আজ সে রূপনগরের সুলতান মহলের বড় সন্তান শেরহাম সুলতানের ভাবী বেগম। এটা আসলেই কতটুকু আনন্দের অপরূপার বোধগম্য হলো না। সুখ নামক শব্দটির উপর হতে তার বিশ্বাস কবেই উঠে গেছে। তাকে স্বপ্নদেখানো পুরুষটাকে সে দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এখন কিন্তু বেলাশেষে তার ঠিকানা শেরহাম সুলতানের কাছে। শেরহাম সুলতান সবার কাছে আতঙ্কের হলেও তার কাছে নয়। তবে খোলাখাতাও নয়। তার কোনো উদ্দেশ্যই অপরূপার কাছে স্পষ্ট নয়। রাজ্য দখল করতে সে এতদিন কেন আসেনি? কেন রূপাকে হাতিয়ার করে এই মহলে এল? কেন সবকিছুতে রূপাকে জড়ালো। তার শত্রুতা তো শেহজাদ সুলতানের সাথে। রূপার সাথে নয়। তাহলে কেন তাকে কোকেইনে নেশা করিয়ে বাড়ি ছাড়িয়ে তাকে অসুস্থ উন্মাদ বানিয়ে ঘাটে ফেলে গেল?
শেরহাম তার উত্তর দিতে নারাজ। সে শুধু রূপাকে বুঝাতে ব্যস্ত সে তার অধিকার ফিরে পেলে পরিবর্তন হয়ে যাবে, সব তার আর রূপার ভালোর জন্য করছে। মহলের একমাত্র উত্তরসূরী হয়ে কেন সে সামান্য সবজি ব্যবসায়ী হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেবে? সে রূপাকে একটা ভালো জীবন দিতে চায়। এটা তার অধিকার। সে পেতে বাধ্য।
আগে সে দুর্বল ছিল এখন সে শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে। এখন তাকে ঠেকানোর সাহস কারো নেই। শেহজাদ সুলতানের সাথে সে অস্ত্র তুলে যুদ্ধ করবে না। সে জানে সেখানে তার পরাজয় নিশ্চিত। সম্রাটের এক ডাকে সারা নগরবাসী ছুটে আসবে। তার বিপক্ষে অস্ত্র তুলে নেবে। বিরোধিতা করার মতো মানুষ গুটিকতক।
সে যুদ্ধ করবে শেহজাদ সুলতানের দুর্বলতা, অপারগতা, কোমলতাকে হাতিয়ার বানিয়ে ।
রূপা তার একটি।
নগরের উপর নানাবিধ বিপর্যয়, দুর্যোগেও শেহজাদ এতটুকুও বিচলিত হয়নি। বরং সে শক্তপোক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
শেরহাম একের পর এক নিকৃষ্টতর পন্থা অবলম্বন করেও শেহজাদকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি । অযোগ্য প্রমাণ করতে পারেনি শেহজাদকে।
বরং দৃঢ়চেতা, দূরদর্শী সম্রাট নগরের আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকতো বিধায় পূর্বপরিকল্পনার ছক তার সাজানো থাকতো। তাই উল্টোদিক থেকে কেউ কোনো আঘাত হানলে সে সহজেই রুখে দাঁড়াতে পেরেছে।
কোমলপ্রাণ নীতিবাদী হলেও নিজ দায়িত্ব কর্তব্যে সে অটল,কঠোর, প্রয়োজনে নির্মম।
নইলে সেই ভাঙাচোরা কলুষিত কুসংস্কারের বেড়াজালে অন্ধকারাচ্ছন্ন অভিশপ্ত নগরে কোনোদিন রৌদ্রময় ঝলমলে দিনমণির দেখা মিলতো না। যেসময় চাঁদের জ্যোৎস্না বিচ্ছুরিত কুয়াশাজড়ানো ধোঁয়া দেখেও নগরবাসী ভয়ে কাঁপছিল তরতরিয়ে, রাতের অন্ধকারে মৃত্যুভয়ে বিভোর থাকতো সকলে, ভোরের আলো মৃত্যুপথ হতে অক্কা দিত, ঠিক সে-সময় সেই অন্ধকারের উৎস হতে তীব্র আলোর ঝলকানি দিয়ে জ্বলে উঠলো এক জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের মতো অশ্বারোহী। টগবগিয়ে ঘোড়ার লাগাম আর অপর হাতে মশাল নিয়ে আলোর শিখা হয়ে আবিভূত হলো এক টগবগে যুবক। সকলের দুঃখ-দুর্দ্দশা, দুরাবস্থা, দুর্ভোগ তার কোমলমনে গভীর ছাপ ফেললো। সুকৌশলে, নিজ প্রচেষ্টায়,নিজের শৈল্পিক গুন আর নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে নগরকে সে নিজের রূপ ফিরিয়ে দিল। ঢাকঢোল পিটিয়ে মরণাপন্ন সম্রাট সলিমুল্লাহ ঘোষণা করলেন, আমার যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আজ থেকে তোমাদের সম্রাট হবে আমার উত্তরসূরী আমার প্রপৌত্র শেহজাদ সুলতান। তোমরা কষ্টে থাকলে তার কাছে অভিযোগ নিয়ে আসবে নির্ধিদ্বায়, সুখে থাকলে তা ভাগাভাগি করে নেবে। আর কোনো ভয়ংকর মায়াবী জাদুকরী অভিশাপ তোমাদের গ্রাস করতে পারবে না। দাদাজানের প্রিয় তলোয়ার দু’হাতে তুলে শেহজাদ সেদিন দাদাজানকে কথা দিয়েছিল, পণ করেছিল। সে বেঁচে থাকতে নগরে আর কোনো দুর্দিন আসতে দেবে না। আজ সাত বছর ধরে নগরবাসী তার কথার প্রমাণ দেখছে। সে সত্যিই দুর্দিন দেখতে দেয়নি। কিন্তু এখন দুর্দিন এসেছে। যার পতনের কারণে রূপনগর একটু শান্তির মুখ দেখেছে ঠিক তারই পুত্র মাতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ফিরে এসেছে।
__________________
সূর্যের আলোকচ্ছটা এসে দেয়ালে পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয়া তৈলচিত্র’র উপর হতে পর্দা সরিয়ে ফেলতেই শেহজাদের সামনে উদ্ভাসিত হলো এক সুঠামদেহী বীরবলের ছবি। তার দাদাজান। তার শক্তি। তার আদর্শ। যখনই সে দোটানায় পড়ে যায়, দুর্বিপাকগ্রস্ত হয়ে পড়ে, মনের দোলাচালে ফেঁসে যায় ঠিক তখনি তার কাছে সমাধানের রাস্তা হয়ে উঠে দাদাজানের এই তৈলচিত্রটি। মানুষটার তৈলচিত্রটি তাকে পুনরুজ্জীবিত হতে সাহায্য করে। তার ক্ষুরধার চোখের দিকে দৃষ্টি পড়লে বক্ষ শক্ত হয়ে উঠে, সাহস পায়, মনোবল পায়। দাদাজানকে দেয়া প্রতিজ্ঞার কথা মনে হতেই শক্তি উদ্ভূত হয়।
হন্তদন্ত পায়ে কক্ষে সায়রার প্রবেশ। তার হাতে খাবার। টেবিলে সাদা চাদর বিছিয়ে খাবার রেখে বলল,
ভাইজান খেয়ে নিন।
শেহজাদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। হেঁটে এসে খেতে বসে। সায়রা জিজ্ঞেস করে,
আপনার হাতের অবস্থা কেমন?
তীরে যদি বিষাক্ত কিছু থাকে তাহলে ক্ষত তাড়াতাড়ি শুঁকোবে না।
চিন্তা করো না।
শেহজাদ খেতে খেতে ওর দিকে তাকায়। আবারও খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। সায়রা উশখুশ করতে করতে জিজ্ঞেস করে,
রূপার কথা জানতে চাচ্ছেন?
শেহজাদ খানিকটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল ছোট বোনের সামনে।
দেখেই এলাম। তুমি এসো।
সায়রা মাথা হেলিয়ে বের হয়ে যেতেই পথে সোহিনীর সাথে দেখা মিললো। সোহিনী বলল,
শেহজাদ ভাইজান কি উনার কক্ষে খাচ্ছেন?
সে চিন্তা তোকে করতে হবে না। তুই তো নিজের ভাইকে পেয়ে আর কাউকে চোখে দেখছিস না। এক রাতের মধ্যেই কত বদল!
সোহিনী অবাক গলায় বলল,
কি বলছিস এসব? পাগল হয়ে গেছিস? উনি তোর ভাইজান নয়?
তুই আমাকে আগে বল শেহজাদ ভাইজান এতদিন তোকে আগলে রাখেনি? ভালোবাসেনি? এখন এমন আচরণ করছিস যেন শেহজাদ নামের কোনো ভাইজানই নেই আমাদের।
সোহিনী বলল,
তোর মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে সায়রা?
সাফায়াতের আগমনে তাদের বাকবিতন্ডায় ভাটা পড়লো। সাফায়াত বলল,
ভাইজান খাবেন না। আসছেন না কেন?
সায়রা ক্ষিপ্তকন্ঠে বলল,
আপনি খান। এমন স্বার্থপর মানুষজনের সাথে একসাথে বসে না খাওয়ায় ভালো। উনাকে রেখে বড় ভাইজানের সাথে খেতে বসে গেলেন। আপনাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে এতদিন শেহজাদ সুলতান একা একাই সবকিছু ভক্ষণ করেছেন কারো জন্য কিছু করেনি। সব কটা স্বার্থান্বেষী।
সাফায়াত ধমক দেয়, সায়রা মুখ সামলে!
সায়রা থামে না। ছলছলে চোখে তাকিয়ে বলে,
ভাইজান কাল সারারাত বাইরে ছিল তার খোঁজ রেখেছিলেন? আপনি আপনার মাকে নিয়ে বড় ভাইজানের সাথে গল্পে মজে ছিলেন। আপনাকে দেখে হাততালি দিতে মন চাচ্ছে।
মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল সায়রা। সাফায়াত ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে ওর যাওয়া দেখলো। সোহিনী বলল,
সাফায়াত ভাই ওর কথায় রাগ করবেন না।
না করছি না। অবাক হচ্ছি। ও আমার সাথে এমন ব্যবহার করলো?
সোহিনী জানে সাফায়াত সায়রাকে ভালোবাসে তাই ওর ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে। সে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মন খারাপ করবেন না। খেতে চলুন।
না। খাওয়া হয়ে গেছে।
সাফায়াত চলে গেল। সোহিনী দ্বিধাগ্রস্তের মতো চেয়ে রইলো।
______________
অপরূপা রসাইঘরে আসতেই সকলের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। সবাই তাকে বিপক্ষীয় দল হিসেবে দেখছে। আলোচনা তাকে নিয়েই হচ্ছিল। ছদ্মবেশী, ডাকিনী, কুহকিনী সব রকমের অপবাদ তার গায়ে মাখিয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় রত সবাই। শ্বাশুড়ির মতো সবাইকে চুষে খাবে” এমন কথাও কানে এল। কথাটা বলেছে মতিবানু। ওরা এতদিন অপরূপাকে চোখে হারাতো এখন অপরূপা তাদের চক্ষুশূল। শেরহামের আম্মা কেমন ছিল? মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।
অপরূপা চুপচাপ বাসনকোসন গুলো রাখতেই সায়রা বলল,
ভাবী বেগম আপনার হবু স্বামীর কোনো আলাদা খাবারের আবদার থাকলে জানিয়ে দিন।
অপরূপা তার দিকে ফিরে চাইলো অবাক দৃষ্টিতে। সম্বোধনও পাল্টে গেল? তারা কি জানে সে কতটা কষ্টে আছে? কতটা দোটানায় আছে। এমন একজনও কি নেই যে তাকে বুঝবে?
উনার কাছ থেকে জেনে নিও।
তা পারি অবশ্য। আর হ্যা মোবারাকবাদ।
অপরূপার ওর দিকে পুনরায় তাকালো।
আগামী শুক্রবার আপনাদের বিবাহ। তাই জানালাম।
অপরূপা পরিশ্রান্তবদনে বলল,
তার পরের দিন বোধহয় সোহিনী আর সাফায়াত সাহেবেরও বিবাহ। আমি বলছিনা, তোমার ফুপু আর তোমার বড় ভাইজানের মধ্যে কথা হচ্ছিল শুনলাম। তোমার সোহিনী আর সাফয়াত সাহেবকেও গিয়ে মোবারকবাদ জানানো উচিত।
সায়রার পায়ের তলার মাটি যেন দুলে উঠলো মুহূর্তেই । কম্পিত হৃদয়ে কান্না গিলে কক্ষ থেকে বের হয়ে নিজকক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো স্তব্ধ হয়ে। চোখের জল গড়াতে লাগলো নীরবে।
এ কি করে হতে পারে? সে জানতো সাফায়াত তাকে ভালোবাসে। সেও তো খুব।
______________
দক্ষিণ কক্ষদুটি হতে পোঁড়া ছাই পরিষ্কার করা হয়েছে। লোক নিয়োগ করেছে শেরহাম। রঙের প্রলেপ দেয়া হবে। বিবাহের পর সে অপরূপাকে নিয়ে ওই কক্ষে থাকবে। অপরূপার মনে হাজারো প্রশ্ন। ওই কক্ষটা পোড়া কেন? কিভাবে আগুন লেগেছিল? এমন হাজার প্রশ্ন নিয়ে এগুতেই কুমুদিনীর মুখোমুখি হলো। কুমুদিনী বলল,
বিয়ার পর তুমি তোমার সোয়ামীর লগে এই ঘরে থাকবা।
অপরূপা প্রশ্ন করলো, কক্ষটা পোঁড়া কেন?
ক্যান তোমারে কয়নাই সে?
নাহ। তার মা মরছিল এই ঘরে। আগুনে পুইড়া।
অপরূপা আঁতকে উঠে।
আগুন কীভাবে লেগেছিল।
কেডা জানে।
কক্ষটি পরিষ্কার করে ময়লা ফেলার বালতিটা নিয়ে যাচ্ছিলো লোকগুলো। অপরূপা বলল,
আমাকে দিন। আমি ফেলে আসি পেছনে। আপনারা আপনাদের কাজ করুন।
লোকগুলো বলল,
আপনি কেন করবেন?
আমার কাজ করতে ভালো লাগে। পেছনে ফেলে আসবো। এসব আশেপাশে ফেললে নোংরা হতে পারে।
ঠিক আছে।
অপরূপা বালতিটা নিয়ে মহলের পেছনে চলে গেল। বালতি হতে ময়লা ফেলতেই দেখলো সব ছাই আর ছাই। মাকড়সার জাল সাথে পোড়া কাপড়চোপড়। অপরূপা সেখানে তন্নতন্ন করে খোঁজাখুঁজি করতে করতে একসময় একটা মূর্তি পেল। উদ্ভট মূর্তি। কয়েকটা রূপোর পোড়া ছোট ছোট কঙ্কাল। পশুর হাঁড়। অপরূপার বুক কেঁপে উঠলো ধড়ফড়িয়ে। দাদীজান বলতেন এসব কাজ করে যারা কালোজাদু জানে তারা।
পেছনে পুরুষালী পদধ্বনি টের পেতেই চমকে উঠে পেছনে ফিরতেই অপরূপা দেখলো শেরহাম দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে কঠোরতা, ছতুরতা। দৃষ্টিজোড়ায় অপরূপার জন্য কামনা,বাসনা, প্রেম।
অপরূপা ওকে দেখে বাকহীন দাঁড়িয়ে পড়ে হাতের জিনিসগুলো বাড়িয়ে অশ্রুসজল চোখে চেয়ে বলল,
আপনার মা শয়তানের পূজো করতো? কালোজাদু? আপনি কি আমার উপরও কালোজাদু করেছেন? এজন্য আমি আপনার বশবতী ছিলাম? আপনি নিজেও এসব জানেন? এজন্য সবাই আপনাকে তাজ্যপুত্র করেছে? তাড়িয়ে দিয়েছে? বলুন। উত্তর দিন।
চেঁচিয়ে উঠে সে।
শেরহাম এসে ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
হ্যা হ্যা তাই। শব্দ করবে না একদম। আমি সব ছেড়ে দেব বলেছি না? একদম সব ছেড়ে দেব। প্রতিজ্ঞা করছি অপা।
আমি আপনার ভাইকে বলে দেব যে আপনি ডাকাত দলের সর্দার। আপনি জাদুবিদ্যার মাধ্যমে সব রক্ষীকে অজ্ঞান করে নগরে প্রবেশ করেছিলেন। সবটা বলে দেব।
শেরহাম ওর হাতদুটো পেছনে নিয়ে গিয়ে চেপে ধরে শক্ত করে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে,
তোমার উপর জাদু প্রয়োগ করতে আর বাধ্য করোনা। এমন অবাধ্য হয়েছিলে বলে জাদু প্রয়োগ করতে হয়েছিল। তুমি আমাকে ভালোবাসো তাই আমি যা-ই করিনা কেন তুমি আমার পক্ষে থাকবে। তুমি যদি আমার অবাধ্য হও তাহলে আমি আবারও প্রয়োগ করতে বাধ্য হবো। এমনকি এই মহলের সবার উপর। আমি চাচ্ছিনা সবাই আমার বশবতী হয়ে থাকুক। আমি চাই সবাই সজ্ঞানে আমাকে সম্রাট মেনে নিক।
অপরূপা ওর হাত সরিয়ে দেয় মুখের উপর থেকে। দূরে সরিয়ে দিতে দিতে বলে,
আপনাকে ভালোবেসে আমি পাপিষ্ঠ। আমি নষ্ট। আমি দোযখে আছি মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। আপনার লোভ সম্রাটের আসন। আমাকে কেন ব্যবহার করছেন?
আমার লোভ তোমার প্রতি। তোমাকেও চাই আমার।
বলতে বলতে ঝট করে কোলে তুলে নেয় সে। অপরূপার কোমলপেলব সিক্ত ভেজা ঠোঁট দুটোতে চোখ আটকে গেল। ঝুঁকে ঠোঁটের উপর শক্তপোক্ত চুমু খেতে যাবে ঠিক তখনি অপরূপা হাত দিয়ে মুখ চেপে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে বলে, আল্লাহ এই নরক যন্ত্রণার চাইতে মৃত্যু দিন।
শেরহাম হো হো করে হেসে বলল, আগে তোমার ঠোঁটে কত চুমু খেয়েছি জানো তুমি?
অপরূপা ধস্তাধস্তি করতে করতে বলে,
সব মিথ্যে। মিথ্যে কলঙ্ক। মিথ্যে অপবাদ। মিথ্যে ভালোবাসা। আমি অতটা বেহুশ ছিলাম না।
যাও মিথ্যে মানলাম। শুক্রবার আসার বাকি আর মাত্র দু’দিন। সেদিন তুমি পুরোটা আমার। কাল থেকে আয়োজন শুরু হবে।
************
মহলের সদর কক্ষে পা রাখতেই আসনে উকিল সাহেবের সাথে শেরহামকে শাহজাহান সাহেব আর শেরতাজ সাহেবের সাথে বসা দেখলো শেহজাদ। শাহজাহান সাহেব চোখ নামিয়ে নিলেন।
শেহজাদ শেরহামের সামনে আসনে বসলো। উকিল সাহেব সব দলিলপত্রাদি দেখিয়ে বলল,
আপনার ভাইজানের দলিল।
শেহজাদ কাগজপত্র গুলো নিয়ে চোখ বুলিয়ে বলল,
আমাদের কাগজপত্র ডাকাতি হয়েছে। নতুন কাগজপত্র এখনো আসেনি। এইসব কাগজপত্র সঠিক নয়। আর এই মহলের মধ্যে কোনো ভাগ হবে না। এই মহলের অধিকার তার যে সম্রাটের আসনে বসে আছে। সুতরাং এই মহল ততদিন অব্দি থাকবে যতদিন আমি থাকবো।
শেরহাম বলল,
আর আমার ভাগ কোথায়? মগের মুল্লুক পেয়েছিস?
এখানে কি আমি একা থাকছি? সম্রাট বলে সব আমি একাই গলাধঃকরণ করছি সব? সবাই থাকবে এখানে। এটি আমি ভাঙতে দেব না।
শেরহাম বলল,
এই মহলের ভাগ চাই আমার। প্রয়োজনে ভাঙবো। তারপরও সমান সমান ভাগ চাই আমার। আমি স্ত্রী সন্তান নিয়ে তোদের সাথে থাকবো না।
ওর কথা শেষ হতে পারলো না। আচম্বিত সব কাগজপত্র একে একে ছিঁড়ে ফেললো শেহজাদ। অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বাজখাঁই গলায় বলল,
আমি এই মহলে একটা আঁচও পড়তে দেব না।
শেরহাম এসে ওর কলার যেই চেপে ধরলো কাশিম আর কামীল বন্দুক ঠেকিয়ে ঘিরে ধরলো শেরহামকে। শেরহামের লোকজনও ফের ছুটে এসে কাশিম আর কামীলের মাথায় বন্দুক ধরলো। হৈচৈ পড়ে গেল। সিভান চেঁচিয়ে উঠে বলল,
আম্মা। বড় আম্মা। ভাইজানরা ঝগড়া করছে।
সবাই ছুটতে ছুটতে এল। সায়রা সোহিনী ছুটে এসে কান্না জুড়ে দিল। সিভান ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মায়ের কাছে মুখ লুকোলো।
শাহজাহান সাহেব ব্যগ্র কন্ঠে অনুরোধ করে বলল,
থামো থামো। কি করছো তোমরা? শান্ত হও শেরহাম।
শেরতাজ সাহেব অগ্নিময় গলায় বললেন,
শেরহাম ও তোমার ছোট ভাই। ছাড়ো ওর কলার।
শেরহাম ছেড়ে দিল। শাসিয়ে বলল,
তোর সম্রাটগিরি গুছিয়ে দেব আমি।
শেহজাদ রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বলল,
রহমান! একবার সামাদ, আরেকবার মুরাদ। অন্ততঃ তোমার মতো বহুরূপী নই আমি। মেয়েদের ব্যবহার করিনা।
শেরহাম পুনরায় ওর কলার চেপে ধরে ঘুষি বসাবে তক্ষুণি সাফায়াত ছুটে এসে ওর হাত ধরে ফেললো।
একজন রক্ষী মহলে প্রবেশ করে বলল।
সাহেব উনি ডাকাত সর্দার।
উপস্থিত সকলেই হতভম্ব, হতচকিত হয়ে যায়। অতি বিস্ময়ে শব্দহীন, বাকবিভূতিহীন দাঁড়িয়ে থাকে সকলে।
শেরহাম ধমকে বলল,
এই যাহ এখান থেকে।
রক্ষীটি দমলো না। চেঁচিয়ে বলল,
উনি ডাকাত সর্দার। আপনার হাতে তীর ছুঁড়েছেন উনি। পালায় সন্ত্রাস হামলা থেকে শুরু করে মহলের ডাকাত আক্রমণ, ফুলকলির ইজ্জতভ্রষ্ট করেছে উনার লোক, উনি করেছে সব। উনার একটা লোককে আমরা বন্দি ধরেছি। সে সব বলেছে আমাদের।
শেরহাম নিজেকে সামলে নেয়। উত্তেজনা দমিয়ে রাখে। ভুল করা চলবে না। সব হাতের নাগালে চলে যাবে। সবাইকে দ্বিগুণ চমকে দিয়ে সে বলে উঠলো,
তো কি হয়েছে? একশবার ডাকাতি করব। ডাকাতি না করলে খাব কি? আমি সম্রাট সলিমুল্লাহর নাতি হয়ে ভিক্ষে করে খাব? এরাই আমাকে ডাকাত হতে বাধ্য করেছে।
শেহজাদ বলল, বাহ এখন ডাকাতও? আর কত নীচে নামা বাকি আছে ভাইজান?
দাঁত কিড়মিড়িয়ে শেরহাম ওর দিকে পুনরায় তেড়ে যেতেই সাফায়াত এসে ওকে টেনে ধরে। বলে,
কি করছেন? মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
শেরহাম মহল কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলে উঠে,
আমি ডাকাত হয়েছি সব থেকেও। তুই সম্রাট হয়েছিস ভিখারির ছেলে হয়ে। তোর লজ্জা হওয়া উচিত। তোর কারণে আমি ডাকাত হয়েছি। তোকে শেষ করে তবেই আমি শান্তি।
বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের আগুনলাভা কেলি করে যায় সদর কক্ষটিতে। নিস্তব্ধতায় ডুব দেয় সকলের উত্তেজিত মস্থিষ্ক। খোদেজা হতচকিত হয়ে মুখে আঁচল গুঁজে কেঁদে উঠে বলল, হায় আল্লাহ! তুমি এটা কি করলে?
শাহজাহান সাহেব কপাল চেপে ধরে বসে পড়ে। শেরতাজ সাহেব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সায়রা, সোহিনী,সাফায়াত বিস্মিত হয়ে শেরহামের মুখপানে চেয়ে থাকে।
শেরহাম বলতে বলতে থাকে।
তুই পালিত পুত্র। পালিত। পালিত। ভিখিরিনীর ছেলে। তোর জন্মের ঠিক নেই। গোবর থেকে উঠে এসেছিস। নিজেকে দেখ আর আমাকে দেখ। জিজ্ঞেস কর তোর পালিত মা বাপকে। তুই পালিত পুত্র। সম্রাট হওয়ার যোগ্য নোস তুই। সম্রাট আমি। আমি যোগ্য। একমাত্র উত্তরসূরী।
শেহজাদ শাহজাহান সাহেবের দিকে তাকায়। উনি তাকান না। মাথা হেঁট করে বসে থাকেন।
শেহজাদ খোদেজার দিকে তাকায়। খোদেজা কাঁদতে থাকে।
চিবুক শক্ত করে ভেতরে রাগ গিলে ফেলে শেহজাদ। চোখের দৃষ্টি শক্ত হয়ে উঠে। চোখের তারা জ্বলজ্বল করে উঠে।
খোদেজার দিকে নয়ননীর সমেত জ্বলন্ত চোখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রোষাবিষ্ট হয়ে অভিমানী স্বরে ডাকে,
আম্মা!
খোদেজা সশব্দে কেঁদে উঠে।
শেহজাদের পায়ের নীচের ভীতটা হৃদয়ের মতো ভেঙে ঝুরঝর করে ঝড়ে পড়ে।
দ্বিতল চত্বরে দাঁড়িয়ে অপরূপা দেখে এক বিশাল মন ভাঙার দৃশ্য।
চলবে…..