Sunday, October 5, 2025







প্রিয় বেগম পর্ব-২১+২২

#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_২১
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

কিভাবে মারা গিয়েছেন উনি?

শেহজাদ কঠোরভাবে বলে, আজ কত বড় ভুল করেছ তুমি জানো না। আমি জানিনা সবাইকে কি বলব। কেন ওই কক্ষে গিয়েছ? শুধুই কৌতূহলবশত?

অপরূপা জেদ বজায় রেখে বলে,

আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
আপনার ভাইজান কিভাবে মারা গেল বললেন না।

শেহজাদ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,

অপঘাতে। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিজের প্রাণ দিয়েছেন বড় চাচার উপর রাগে অভিমানে।
কারণ বড়চাচা ভাইজানকে তাজ্যপুত্র করেছেন।

অপরূপা অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে,

কেন? কেন তাজ্যপুত্র করেছেন?

কারণ ভাইজান মনে করতেন বড়মার মৃত্যুর পেছনে আমাদের সবার হাত ছিল। বড়চাচাকে খু*ন করতে চেয়েছেন ভাইজান। বড়চাচা তাই তাকে গৃহত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। বড়চাচা অনুতপ্ত না হলেও আমরা অনুতপ্ত। ভাইজান হারিয়ে যাক এটা আমি চাইনি।

অপরূপা তার চোখদুটো মেলে দ্বিধাগ্রস্তের মতো চেয়ে থাকে। কি অদ্ভুত! যারা তার মৃত্যু নিয়ে অনুতাপে ভুগছে সে কত আনন্দে আছে। তাদের ধ্বংস করতে তার কত লীলাখেলা! কতটা নৃশংস খেলায় মেতে উঠেছে সে। মাঝখানে তাকে পুতুলের মতো নাচিয়েছে। কি চায় সে? কেন তাকে এসবের মধ্যে জড়িয়েছে?

কক্ষের চাবি কোথায় পেয়েছ রূপা?

মিঠু নিয়ে এসেছিল।

এখন আমাকে এটা বলো যে ওই কক্ষে গিয়ে তুমি কি এমন পেয়েছ? সবাই জানাজানি হলে কি হবে তুমি ভাবতে পারছো?

আমায় শূলে চড়াবে?

শেহজাদ উত্তর দেয় না। খেয়াল করে দেখে অপরূপার কপালের একটা পাশ ফুলে ডবডবে হয়ে আছে। মাঝখানে একটা ফুটো। সেই ফুটে দিয়ে রক্ত বিচ্ছুরিত হচ্ছে। শেহজাদ হাতটা কোনোমতে বেঁধে দিয়ে বলে কপালেও আঘাত পেয়েছ।

অপরূপা দোলনা থেকে নেমে আসে। বলে,

কোনো ব্যাপার না। এর চাইতে বড় আঘাত আমি সয়ে বসে আছি। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

কেন?

এই যে আমাকে বাঁচালেন। হয়ত মহলের কারো হাতে পড়লে এতক্ষণে আমি বন্দি হয়ে যেতাম সেখানে স্বয়ং সম্রাট আমাকে রক্ষা করেছেন।

শেহজাদ উদগ্রীব হয়ে বলল, তোমার কপালে ঔষধি পাতা লাগিয়ে দিই তারপর..

না থাক। আপনাকে ধন্যবাদ।

কপালে ঔষধ লাগিয়ে কি হবে। তার তো হৃদয় ব্যাথা ।
শেরহাম সুলতান এজন্যই তাকে বলতো আমি তোমাকে রাণীর মতো করে রাখবো । আজ যদি সে অন্যায়ভাবে নিজের ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে রাজ্য কেড়ে নিয়ে রাজা হয়ও অপরূপা সেখানে রাণী কি করে হবে? এ অসম্ভব! কিন্তু কি করবে সে? কোথায় পালাবে?

তাকে নীরবে চোখের জল ফেলতে দেখে শেহজাদ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,

কিছু না বললে আমি বুঝব কি করে তোমার কি হয়েছে? তোমার চোখে জল কেন? কষ্ট হচ্ছে? কপালে যন্ত্রণা হচ্ছে নিশ্চয়ই। চলো ভেতরে চলো। ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসবো আমি। বলব তুমি না জেনে খুলে ফেলেছ।

না না। দয়া করে আপনি চলে যান। আপনার আম্মা জানতে পারলে আমার রক্ষে থাকবে না। আপনি নিজেকে আমার এসবে জড়াবেন না।

শেহজাদ রুক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সে তো জড়িয়েই আছে শুরু থেকে। আর ছাড়া পেল কই?
প্রচন্ড বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল,

যার সাথে জড়িয়েছ সে তোমাকে রেখে পালিয়েছে আর খোঁজও নেয়নি। নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে। আর তুমি তো নির্বোধ, আমার দেখা শ্রেষ্ঠ বোকা । এইসব মেয়েদের দেখলে আমার রাগ হয়। এরা নিজের জন্য না সবার জন্য ক্ষতিকর।

অপরূপার নাসিকাগ্র কাঁপতে কাঁপতে থাকে পরোক্ষ অপমানে। ফুঁপিয়ে উঠে বলে,

ক্ষতিকর বলেই তো আপনার আম্মা তার রাজপুত্রের সামনে যেতে বারণ করেছেন। তাহলে উনার রাজপুত্র কেন আমাকে রক্ষা করছেন?
এই ক্ষতিকর কীট থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন। আমি আপনার আশেপাশে যাই না আপনিও থাকবেন না। কেন এখনও দাঁড়িয়ে আছেন?

স্বয়ং সম্রাটের সাথে এমন ব্যবহার? শেহজাদ ক্রুদ্ধকন্ঠে বলে উঠলো,

কেন দাঁড়িয়ে আছি তা তুমি জানতে পারবে না। না বুঝতে পারবে। তোমার মতো নির্বোধ মেয়ের এতটা বুদ্ধি হয়নি যে আমার ছলাকলা বুঝতে পারবে। আমি তোমাকে সাহায্য করেছি মানে এই না আমি তোমাকে..

থেমে যাচ্ছেন কেন?

সম্রাট রাস্তার কুকুর বিড়ালকেও দয়া দেখায়। মনে করো তোমাকে দয়া দেখিয়েছি।

শেহজাদ হাতে থাকা ঔষধি পাতাগুলো দূরে ছুঁড়ে মারে। চলে যায়।
অপরূপা চোখ চেপে জল ফেলে গাল মুছে। এই মহলে আর এক মুহূর্তও নয়। কিন্তু এত এত রক্ষী পেরিয়ে পালাবে কি করে সে?

**************

শেহজাদকে উদভ্রান্তের মতো হেঁটে আসতে দেখে খোদেজা পথ আটকে দাঁড়ালো।

কোথায় গিয়েছ? রূপা মেয়েটা কোথায়? এদিকে ওই কক্ষের দরজা খোলা। আমার উত্তর চাই শেহজাদ।

আমার পথ আটকাবেন না আম্মা। আমার কাছে কোনো উত্তর নেই।

তুমি যতবড় সম্রাট হও আমার কাছে তুমি আমার সন্তান। আমাকে উত্তর দিতে তুমি বাধ্য।

রূপা যেখানে থাকার কথা সেখানে। আমি
আপনার সামনেই তো আছি আম্মা। অযথা সন্দেহ করবেন না। আমি তটিনীকে নিকাহ করছি। কেন কেন শুধু রূপাকে টানছেন? দয়া করে আমার মাথা নষ্ট করবেন না।

খোদেজা পথ থেকে সরে দাঁড়ায় । শেহজাদ পা বাড়াতেই খোদেজা বলে,

বিবাহের বন্দোবস্ত করছি তাহলে। মত দাও। নয়ত ওই মেয়েকে মহলের বাইরে রেখে এসো। সে উপস্থিত থাকতে পারবে না বিবাহের সময়।

শেহজাদ নিদারুণ মনোবেদনা লুকোতে গর্জন তুলে বলে,

কোনো মেয়েকেই আমি চিনিনা। আপনার যা ইচ্ছে তাই করুন। যাকে ইচ্ছে মহলে রাখুন, যাকে ইচ্ছে বাইরে। আমাকে জড়াবেন না। আমি কেউ নই।

তুমি রুঢ়স্বরে কেন কথা বলছো শেহজাদ? এটা একজন রাজার গুন নয়।

সবসময় ভালো করে কথা বলব এমন কোথায় লেখা আছে? রাজার বাইরেও আমি একজন মানুষ। আমাকে আমার মতো করে থাকতে দিন।

খোদেজা আর কিছু বলার আগেই গটগট পায়ের আওয়াজটা মিলিয়ে গেল।

_____________

ফুলকলিকে মফিজের ঘরে রেখে খিলখিল করে হাসতে হাসতে যুবতীর দল হঠাৎ করে অপরূপাকে দেখতে না পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়ে। তার কিয়ৎক্ষণ পরেই দক্ষিণ পাশের একটা কক্ষ খোলা নিয়ে মহলের ভেতর বিরাজ করে তুমুল হৈচৈ মাতামাতি। শেরতাজ সাহেব সেই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ভীষণ চেঁচিয়ে উঠেন। কাজের বুয়া আর রক্ষীদের উদ্দেশ্য রুক্ষমূর্তি ধারণ করে বলেন,

কার এত দুঃসাহস ওই কক্ষের তালা খুলেছে? মুখো খোলো সবাই। নয়ত গর্দান যাবে আজ।

একজন বলে উঠে,

আমি সম্রাটে সুলতানকে ওখানে দেখে চলে এসেছি হুজুর। উনি আমায় চলে আসতে বলেছেন।

ঠিক তখনি সম্রাট তার কক্ষ থেকে নীচে এসে সভায় আসন গ্রহণ করে। ভারী পোশাক বদল করে সে আরামদায়ক পোশাক পরিধান করে এসেছে। চোয়াল শক্ত। চোখমুখে নিদারুণ কঠোরতা। কর্কশ স্বরে বলল,

আমি খুলেছি। আমাকে জিজ্ঞেস না করে এভাবে চেঁচানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না চাচাজান।

শেরতাজ সাহেব বিশ্বাস করে উঠতে পারেন না। শাহজাহান সাহেব বলেন,

আমাদের একথা বিশ্বাস করতে বলো না পুত্র। তলোয়ার দুটো নীচে ফেলে রাখা। চাবিটা প্রায় বেঁকে গেছে। সবকিছু ইঙ্গিত করছে কেউ কৌতুহলবশত ওই কক্ষের কাছে গিয়েছে। এবং দরজা খুলেছে। কারণ ছাড়া কেউ ওই কক্ষের কাছে কেন যাবে? তুমি কি লুকচ্ছ?

মতিবানু আতঙ্কিত হলো অপরূপার কথা ভেবে। হায় খোদা! রূপা মেয়েটি নয়ত?

তন্মধ্যে সভায় উপস্থিত হয় খোদেজা। অপরূপাকে টেনে এনে সবার সামনে ছুঁড়ে ফেলে বলে,

এই মেয়ে করেছে। তার পোশাকে কালি, কপাল আর হাতের আঘাত সব কথা বলে দিচ্ছে। এই মেয়ে ছদ্মবেশে মহলে এসেছে। এই মেয়ে সব নষ্টের মূল। আমি আগেই বলেছি।

অপরূপা মুখ থুবড়ে পড়ে শেহজাদের পায়ে কাছে। শেহজাদ দাঁড়িয়ে পড়ে। সায়রা সোহিনীরা সবাই আঁতকে উঠে।

শেরতাজ সাহেব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দাঁড়িয়ে যান। শাহাজাহান সাহেব বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। শেহজাদের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ায় অপরূপা মুখ তুলতেই শেহজাদকে দেখে। শব্দহীন চোখের জল গড়াতে থাকে।

শেরতাজ সাহেব এগিয়ে এসে বলেন,

এই মেয়ে কেন খুলেছ ওই কক্ষের দরজা? উত্তর দাও। কি উদ্দেশ্য তোমার? কি উদ্দেশ্য নিয়ে এই মহলে এসেছ? তোমার কঠিন শাস্তি হবে। সত্যি কথা বলো। কে তুমি?

শেহজাদ নিরুত্তর। শক্ত খোলসের মধ্যেকার তুলতুলে শামুকের মতো মনটা আকুপাকু করতে থাকে কান্নারত মেয়েটির জন্য। কিন্তু যতদিন না সে তার মর্ম বুঝবে ততদিন সে আর নিজেকে জাহির করতে যাবে না। যদিও সে জানেনা সে অতটা কঠোর হতে পারবে কিনা রূপার সাথে। রূপাকে সে ভালোবাসে।

সায়রা এসে অপরূপাকে তুলতেই খোদেজা ডাক দেয়।

সায়রা ছাড়ো ওই মেয়েকে। ওই মেয়ে ছদ্মবেশী। সে ধ্বংস করতে এসেছে। এখন আমার কথা বিশ্বাস হলো তো ভাইজান?

শেরতাজ সাহেব হুংকার ছাড়ে।

চাবুক নিয়ে এসো। পঞ্চাশ ঘা দাও। মুখ না খুললে আরও পঞ্চাশ। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণে চাবুক মারবে। একথা মহলের বাইরেও যাবে না।

কাশিম নামক দৈত্যের মতো লোকটির ঘাড়ে আদেশ পড়ে। লম্বা লম্বা পা ফেলে লোকটা চাবুক হাতে এগিয়ে আসে। অপরূপা ভয়ে সিঁটিয়ে যায় শেহজাদের দিকে। চোখের আকুলতায় আশ্রয় চায়। কেন যেন অবচেতন মনটা বারবার বলে উঠছে, “ওই মানুষটার কাছে তোর আশ্রয় আছে। সে তোকে চায়। ভালোবাসে। একটুখানি চেয়ে দেখ, কখনো ফেরাবে না।”

অপরূপা তার চাউনি দেখে ব্যাকুল স্বরে বলে উঠে, সম্রাট আপনি জানেন আমি কোনো অন্যায় করিনি।

কাশিম নামক লোকটা অপরূপার দিকে নিজের বিশাল হাতের থাবা বাড়িয়ে দিয়ে নরম হাতটা ধরে টেনে নিয়ে যায়। আবারও ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অপরূপা ফের শেহজাদের দিকে তাকায়। লোকটা সপাং সপাং করে চাবুক তুলে মারতেই চাবুকটা আটকে যায় শেহজাদের হাতে। শেহজাদের কাছে ছুটে এসে বুকের উপর আঁছড়ে পড়ে অপরূপা। কান্নায় ভেঙে পড়ে।

মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় পরিবেশ। তটিনী হকচকিয়ে যায়। খোদেজা শাহানা আর হামিদা সহ সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে।
শেহজাদ চাবুক কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মেরে বলে, ওর গায়ে একটা আঁচড়ও যেন না পড়ে। দূরে যাও। আমার আদেশ।

কাশিম মাথা নত করে দূরে সরে গেল।

অপরূপা তাকে ছেড়ে দেয়। পেছনে গিয়ে শেহজাদের পিঠের পেছনে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ায়।

শেহজাদ হুংকার ছেড়ে বলে, মহলে এত লোকের সম্মুখে কোনো নারীর গায়ে আজ অব্দি কোনোদিন চাবুকের ঘা পড়েনি। আজও পড়বে না।

খোদেজা চেঁচিয়ে উঠে,

শেহজাদ নিজের ধ্বংস ডেকে এনো না। এই মেয়ে তোমার ধ্বংস। তোমার জন্য অশুভ। তোমার প্রাণনাশিনী। নিজের প্রাণের মায়া থাকলে এই কুহকিনীকে ছেড়ে দাও। তুমি অন্ধ হয়ে গেছ। এই বিষকন্যা তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে।

খোদেজার কথায় বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মতো চমকায় সকলে। তটিনী তৎপর হয়ে শাহানার কাছে ছুটে গিয়ে বলে

আম্মা এসব কি হচ্ছে?

শাহানা নিরুত্তর।

অপরূপা শেহজাদের পিঠের পোশাক খামচে ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে। শেরতাজ সাহেব এসে হেঁচকা টান দিয়ে কাশিমের দিকে ছুঁড়ে মারে অপরূপাকে। বলে,

বের করে দাও। প্রথমদিন থেকেই তাকে সন্দেহজনক লেগেছিল। সে বিপদজনক। এক্ষুনি বের করে দাও।

কাশিম তার হাতের মুঠোয় অপরূপার হাত ধরতেই শেহজাদ ডাক দেয়।

ওকে ছাড়ো। আমার আদেশ।

পা এগোতেই শাহজাহান সাহেব তার হাত ধরে ফেলে। পিতার দিকে প্রচন্ড বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায় শেহজাদ।

আব্বা আপনিও?

আমি তাকে এনেছি। আর আমিই বলছি তার চলে যাওয়াটা জরুরি। আমার কসম লাগে তুমি পা বাড়াবেনা।

আমায় ছেড়ে দিন আব্বা।

কাশিম অপরূপাকে টেনে নিয়ে যায়। অপরূপা চেঁচিয়ে বলে,

আমি কোনো অন্যায় করিনি। সম্রাট আমি মিথ্যে বলছি না। আমাকে বিশ্বাস করুন।

শেহজাদের হাতে শিকল পড়া। বাবার হাতের মুঠোয় চাপা পড়ে থাকে তার হাত। তাকে আকুল হয়ে ডাকতে থাকা মেয়েটার ডাকে সাড়া দিতে পারেনা। শুধু বলে,

রূপা কোনো অন্যায় করেনি আব্বা।

শেরতাজ সাহেব খেঁকিয়ে উঠে বলে,

করেছে, সামনে আরও করবে। যে ভুল আমি করেছি সেই ভুল তোমাকে করতে দেব না আমি। সম্রাট তুমি। তোমাকে একটা আশ্রিতার জন্য এতটা ব্যাকুল হওয়া মানাচ্ছে না। তোমাকে চেনা যাচ্ছে না। আমি নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি তোমার মাঝে। তুমি হেরে যাচ্ছ শেহজাদ।

পিতার দিকে রোষপূর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে শেহজাদ। শাহাজাহান সাহেব নিজ জায়গায় অটল। আজ তিনি বিচলিত হবেন না।

ক্রুদ্ধ অশ্বের তীব্র হ্রেষাধ্বনি ভেসে তখনি। অশ্বটা হুংকার ছাড়ছে। সারামহল কাঁপিয়ে তুলছে। সবার হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠলো প্রায়। অশ্বের এমন হ্রেষাধ্বনি অশুভ লক্ষ্মণ। প্রচন্ড হুংকারে সবাই ভড়কে যায়। ভীতি জাগে মনে।

শাহাজাহান সাহেবের হাত আলগা হয়ে আসে। সবাই ছুটে যায় সদর দরজার বাইরে। আর দেখে অপরূপাকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলেছে কাশিম। কস্টিপাথরে গিয়ে পড়ায় অপরূপার নাকঠোঁট কপাল ফেটে রক্ত মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। ঠিক তার সামনেই হুংকার ছাড়তে ছাড়তে এসে থামে একটি সাদা রঙের অশ্ব। রাজকীয় সাজের অশ্বটির চোখমুখে প্রচন্ড ক্ষোভ যেন উপচে পড়ছে। মাটি খুঁড়ে লাফিয়ে উঠে অপরূপার সামনে থামলো সেটি। তার পেছনে আরও কয়েকটি অশ্ব হুংকার ছেড়েই যাচ্ছে।

সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আসছে পাগড়ি পড়া একটা লোক। অপরূপা তাকে দেখে হতবিহ্বল চোখে চেয়ে রইলো। নিজের দু চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মাথার পাগড়ি খুলে শ্যাম লোকটা এসে হাঁটুভেঙে বসলো অপরূপার সামনে। অপরূপা থুবড়ে পড়া থেকে উঠে বসলো। লোকটা তাকে তুলে তার ঠোঁটের কোণার রক্ত মুছে দিল বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে। অপরূপাকে দাঁড় করিয়ে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এল। অপরূপার চোখ তখনও নিবদ্ধ লোকটার মুখপানে।

শেহজাদ দ্রুতপদে বাইরে এসেই লোকটাকে দেখে থমকে গেল। ক্ষুরধার, শাণিত চাহনি নিক্ষেপ করে চেয়ে রইলো। কে সে? এত চেনা চেনা!

লোকটা দু’হাতে তালি দিতে দিতে শেহজাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে উপহাস করে বলে,

বাহ! রূপনগরের সম্রাটের মহানুভবতার প্রমাণ আজ স্বচক্ষে পেলাম। কি মহান তিনি!

শেহজাদ অপরূপার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। দেখে, অপরূপা কেমন অবসন্ন চোখে লোকটার দিকে পলকহীন, অভিব্যক্তিহীন, শব্দহীন চেয়ে আছে।

শেরতাজ সাহেব এগিয়ে আসে। কথা বলতে গিয়ে কথা আটকে আসে।

এই এই কে তুমি? কে?

উনার কন্ঠস্বর কেঁপে উঠে।
সবাইকে ঠেলে সোহিনী এগিয়ে আসে। গালে হাত চেপে ঝরঝরে কেঁদে উঠে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দুগালে হাত রাখে। ডাকে,

আমার ভাইজান। শেরহাম ভাইজান।

সবার পায়ের নীচের মাটি কেঁপে উঠে।

চলমান….

#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_২২
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

ভাইয়ের গাল স্পর্শ করামাত্রই সোহিনীকে টেনে নিয়ে আসেন শেরতাজ সাহেব। ধমকে বলেন,

তোমার ভাইজান তোমার জন্য আসেনি। এসেছে নিজের স্বার্থের জন্য। নাহলে জিজ্ঞেস করো এতগুলো বছর ও কোথায় ছিল। কেন আসেনি। এত আবেগি হওয়া ভালো নয়।

সোহিনী কাঁদতে থাকে। শেরহাম চোখ সরিয়ে নেয়। তার পাথরের মতো মুখাবয়বে বদল দেখলো না কেউ।

বাজখাঁই গলায় অপরূপাকে জিজ্ঞেস করে,

তোমাকে ওরা মেরেছে? মহল থেকে বের করে দিচ্ছিলো তাই না? এরা এসব ভালোই পারে । তুমি এদের আরও কত রূপ দেখবে। এরা এমনই নিষ্ঠুর, পাষাণ, হৃদয়হীন অপা।

সকলেই আঁতকে উঠে শেরহামের মুখ নিঃসৃত সম্বোধনে। শেহজাদ বিস্ময়াবহ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। অপা? ভাইজান রূপাকে চেনে? রূপাও? এজন্যই কি আজ ভাইজানের সম্বন্ধে সব জানতে চাচ্ছিলো রূপা?

অপরূপা নিস্তেজ, দুর্বলচিত্তে এখনো চেয়ে আছে। সত্যি সত্যি রহমান এসেছে? উনি অভিভাবকহীন নয় তাহলে? শেরহাম সুলতান! এই পরিবারের বড় সন্তান?
এজন্যই রাজ্যর প্রতি তার এত ঝোঁক? নিজের অধিকার আদায় করতে এসেছে? অপরূপার মাথায় যন্ত্রণা হয়। বুক ধড়ফড় করতে থাকে। না, সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না।

শেরতাজ সাহেব কৌতূহল ভরা গলায় বলেন, তুমি ওকে চেনো? তারমানে তুমি ওকে পাঠিয়েছ? কেন পাঠিয়েছ? এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলে? বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি তোমার মধ্যে। কি চাও তুমি?

খোদেজাসহ বাকি সবাই অবাকান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। শেরহাম খেঁকিয়ে উঠে বলে,

আমি প্রশ্ন করেছি। আমার উত্তর আগে চাই।

শেহজাদ রাশভারি গলায় ডেকে উঠলো,

বড় ভাইজান তুমি..

কথা শেষ করতে দেয় না শেরহাম। বলে,

আমি কারো ভাইজান নয়। একদম আমাকে ভাইজান ডাকবি না। সরে যা।

শেহজাদ পিছিয়ে যায়। দীর্ঘ পনের বছর পর দেখা হওয়া বড় ভাইয়ের মুখে এমন কঠোর উক্তি তার বোধগম্য হয় না। যার সাথে একসাথে পনেরটা বছর বেড়ে উঠা, একসাথে তলোয়ার শেখা, ধনুবিদ্যা শেখা, ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটে চলা শিকারের উদ্দেশ্যে, কমলবিলে সাঁতার কাটা। ভাইজান আরও নির্দয়, পাষাণ নিষ্ঠুররূপে ফিরে এল।

শেরহাম পুনরায় কটমট গলায় বলে উঠে,

যার গায়ে হাত তুলেছিস। জানিস সে কে? কোনো ধারণা আছে তোদের?

শেহজাদ অপরূপার দিকে দৃষ্টি ফেলে। জানতে চায়,

কে?

অপরূপা নিভুনিভু চোখে বহুকষ্টে তাকায়। বড় বড় শ্বাস টানে। সিভান উঁকি দিয়ে বলল,

তুমি সুন্দর বউয়ের বর? এজন্য সবাইকে বকছো?

শেরহাম সিভানকে গভীর পর্যবেক্ষণ করে। বলে,

ঠিক।

শেহজাদ পুনঃ বিস্ময়-বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। অন্তঃপটে তীব্র ভাঙচুর হয়। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে।
তারমানে ভাইজান এখনো সেই জাদুবিদ্যার কাজে অভ্যস্ত? ভালোবাসার নামে রূপাকে দিনের পর দিন ব্যবহার করেছে? এখনো ভালো সাজছে! এই সেই ছদ্মবেশী রহমান, সামাদ, মুরাদ। বাহ, নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য একটা নিষ্পাপ ফুলের মতো মেয়েকে পর্যন্ত ছাড়লো না। কি চায় ভাইজান?

অপরূপা যন্ত্রণাদগ্ধ, আঘাতে মর্মাহত। তার কথা বলার শক্তিটুকু নেই। ঝিমিয়ে আসে শরীর। বন্ধ হয়ে আসে দুচোখ। টলতে টলতে আবছা আবছা
চোখে শেরহামকে দেখতে থাকে। অক্ষিপটে ভাসে দাদীর মৃত্যুর দৃশ্য। মিঠির মৃতদেহ। নিজের অসুস্থতার কথা। শেরহামের হাত খামচে ধরে ভগ্নকন্ঠে চেঁচিয়ে উঠে বলে,

আমাকে ছেড়ে দিন। আমি এখানে থাকব না। এতদিন কোথায় ছিলেন? আমি এতগুলো জন্তুজানোয়ারের সাথে থাকব না। একমুহূর্তও না।

সবাই তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তার কপাল বেয়ে রক্ত ঝড়ছে।

শেহজাদ ব্যথিত চোখে তাকিয়ে গর্জে উঠে বলে,

সাফায়াত ডাক্তারকে খবর পাঠাও।

জ্বি ভাইজান।,

সাফায়াত চলে যায়।

অপরূপা শেহজাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঝরঝরে কেঁদে উঠে বলে,

দরকার নেই। আপনি আমায় এই মহলে থাকতে বলবেন না। আপনি আদেশ দিন। কেউ আমাকে ঘাটের কাছে রেখে আসুক। আমি আমার বাড়িতে চলে যাব।

তার প্রস্থানের কথায় শেহজাদের হৃদকম্পন বেড়ে যায় অচিরাৎ । অজানা আশঙ্কার সুনামি উত্তাল উঠে। শেরহাম অপরূপার হাত শক্ত করে ধরে কুপিতস্বরে বলে,

কোথাও যাবে না তুমি। এখানেই থাকবে। এটা তোমারও মহল। তুমি আমার ভাবী বেগম। এই মহলে তোমার অধিকার আছে অপা।

অপরূপা উচ্চবাক্য করার পর আর শক্তি খুঁজে পায় না। রক্তলাল চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে
নির্জীব হয়ে আসে। টলতে থাকে। মাথা চেপে ধরে টলতে টলতে অচৈতন্য বরণ করে নেয়।

শেরহাম ওকে পাঁজাখোলা করে কোলে তুলে নেয়।হুংকার ছেড়ে বলে,

পথ ছাড়ো সবাই।

সকলেই পথ থেকে সরে দাঁড়ায়।
মহলে প্রবেশ করে সে। তার কোলে অপরূপার সুস্থির দেহ। সোহিনী তাকে নিয়ে যায় নির্দিষ্ট কক্ষের দিকে। শেরহাম সোহিনীকে অনুসরণ করে পা বাড়ায়। কক্ষে প্রবেশ করে অপরূপাকে চৌকিতে শায়িত করিয়ে দেয়। গালের পাশে আলতো চাপড় দিতে দিতে ডাকে,

অপা চোখ খোলো।

সায়রা, সোহিনী তাকে বাতাস করতে থাকে। ডাক্তার এসে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। শেরহাম ঢোকার আদেশ দিতেই ডাক্তার ভীতমনে পা বাড়ায়। মহলের থমথমে পরিবেশ দেখে যে কারো মনে ভয় জাগারই কথা। ডাক্তারও বেশ ভয় পেয়েছেন।

অপরূপার জ্ঞান ফিরে অনেকক্ষণ পর। জ্ঞান ফেরামাত্রই কপালে জ্বলুনির টের পায়। শেরহাম তার কাছে ঘেঁষে বসে কপালে ফুঁ দিতে দিতে বলে,

কমে যাবে।

অপরূপা চোখ বুঁজে থাকে। জ্বলুনি কমে আসতেই চট করে চোখ মেলে। ফুঁ দিতে থাকা মানুষটাকে সেদিন ডাকাতরূপে দেখেছিল মনে হতেই দূরে সরে পড়ে। কান্নায় ভেঙে পড়ে। সায়রা আর সোহিনী কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। তারা বেরোতেই শেরহাম তাকে টেনে নিজের সাথে চেপে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,

এবার নিকাহ না করে পালাবো না অপা।

অপরূপার বেড়ে উঠা নখের পুরোটা তখন তার গলায় গেঁথে গিয়েছে। তীব্র জ্বলুনি অনুভব হতেই সে অপরূপাকে ছেড়ে দেয়। বলে,

কি হয়েছে? এত রাগ দেখাচ্ছ কেন? আমার অনেক কথা বলার আছে তোমাকে।

দূরে যান।

সে যায় না। বরং অপরূপার গালের একপাশ হাত দিয়ে আগলে ধরে সে। বলে,

ওরা আমার মাকে মেরেছে। আমাকে মহল থেকে বের করে দিয়েছে। সব সম্পত্তি থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে। আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়ে কাকে দিয়েছে জানো? এক পালিত পুত্রকে।

অপরূপার অক্ষিকোটর হতে বিস্ময় স্ফুরিত হয়।

কে পালিত পুত্র?

শেহজাদ। ওর সাথে এই বংশের কারো সম্পর্ক নেই। তারপরও সব পেয়েছে ও। আমি ওদের রক্ত হয়ে কিছু পাইনি। ও আমার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। এই রাজ্যটা আমার। সম্রাট হওয়ার কথা আমার। অথচ সিংহাসনে কে বসে আছে দেখো।

আমি জানতাম না উনি পালিত পুত্র।

তুমি না। স্বয়ং সম্রাট নিজেও জানেনা তার সাথে এই মহলের কারো রক্তের সম্পর্ক নেই। ও তোমার গায়ে হাত তুলেছিল?

অপরূপা শব্দহীন চেয়ে থাকে। দু’পাশে মাথা নাড়ায়। বলে,

না। উনি ভালো মানুষ।

মুখোশ পড়ে থাকে ভালো মানুষের।

অপরূপা গর্জে উঠে,
মুখোশ তো আপনি পড়ে ছিলেন।

শেরহাম ওর কথায় হতচকিত হয়ে তাকায়।
আপনি ডাকাত সর্দার। আপনি আমাকে কোকেনের নেশা করিয়েছেন। আপনি আমার দাদীজানের মৃত্যুর কারণ। আপনি ওই নিষ্পাপ খরগোশটারও মৃত্যুর কারণ। আমাকে নেশাগ্রস্ত করিয়ে আপনার কি লাভ হলো? কি পেয়েছেন আপনি?

কলার ধরে ঝাঁকায় অপরূপা। শেরহাম ওর গাল আঁকড়ে ধরে বলে,

শান্ত হও। আমি তোমাকে সব বলব।

অপরূপা তার হাত সরিয়ে দেয়। বলে,

আমাকে ছুঁবেন না। খোদার কসম আপনি আমাকে ছুঁলে আমি নিজেকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করব।

শেরহাম ভীত হয় না। একজন পাষাণ, হৃদয়হীন ডাকাত সর্দার এমন ছোটখাটো ধমকে ভয় পায় না। বরং সে শক্ত করে নিজের সাথে অপরূপাকে চেপে ধরে বলে,

নিজের ভালো চাও তো আমার কথা শোনো অপা। ওরা তোমাকে বের করে দিলে আমি ছাড়া তোমার গতি কি?

অপরূপার হাত শিথিল হয়ে আসে। শেরহাম ওকে ছেড়ে দেয়। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ওর মুখপানে চেয়ে থাকে অপরূপা।

আমার দুর্বলতাকে তাই কাজে লাগাচ্ছেন?

মোটেও না। আমার সাথে থাকতে হলে তোমাকে আমার হয়ে কাজ করতে হবে। আমার সাথে তালে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। জীবনটা অনেক কঠিন। তুমি কোথায় যাবে আমাকে ছেড়ে? বেরিয়ে দেখো। শেয়াল কুকুর ছিঁড়ে খাবে। আমার দিকে তাকাও। আমার কথা শোনো। আমি তোমার খারাপ চাই না অপা। তুমি এই মহলের বেগম হবে। আমাদের সুখের সংসার হবে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি ডাকাতি ছেড়ে দেব। সব ছেড়ে দেব।

অপরূপার কোমলমতি মন গলে আসে। তার গাল আঁকড়ে ধরা হাতদুটের উপর হাত চেপে ধরে বলে,

সত্যি?

হ্যা সত্যি।

অপরূপা ওর হাত গাল থেকে নামিয়ে দেয়। বলে,

বিবাহের আগে এত কাছে আসা ভালো না।

শেরহাম বলে, আচ্ছা। যাব না। আমরা খুব তাড়াতাড়ি নিকাহ করে নেব।

অপরূপা তোতলে বলে,

ক-খ-ন?

দলিলপত্র বুঝে নেই । তারপর। এই সপ্তাহেই। তোমাকে ঘাটে রেখে পালিয়েছি বলে রেগে আছ?

অপরূপা পিছু হাঁটে। কান্না চেপে রেখে বলে,

বললাম তো কাছে আসবেন না। দূরে থেকে কথা বলুন। নিকাহ হলে তখন কাছে আসবেন।

আচ্ছা যাচ্ছি না। কিন্তু তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছ কেন? কথা বলতে বলতে কাঁদছো।

না ভয় পাচ্ছি না। বলুন সেদিন কোথায় চলে গিয়েছিলেন।

ওইদিন বাজার থেকে ফিরে দেখি দূরের জাহাজে শেহজাদ আর সাফায়াত ছিল। আমি তাদের জাহাজটা চিনি। জাহাজটা আমার দাদাজানের। ওরা সরে পড়ার পর যেই তোমার কাছে আসবো তখনি দেখি চাচা তোমার সাথে কথা বলছে। আর তুমি চাচার সাথে চলে এলে। আমি ওদের সামনে আসতে পারতাম না অপা। তাই তোমার কাছে আসতে পারিনি। আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি জানি। সেদিনই আমাদের নিকাহ হতো।

অপরূপা দেয়ালে চেপে গিয়ে ভেতরে কান্না গিলে বলে, কক্ষ থেকে যান। হুটহাট এই কক্ষে আসবেন না। নিকাহ হলে তখন।

শেরহাম একদম তার কাছাকাছি এগিয়ে আসে। অপরূপা মুখ তুলে বলে,

আপনাকে কি বললাম শুনতে পাননি? আমি এমনিতেই অপবিত্র হয়ে গিয়েছি। আপনার সাথে কি করে আমি বাড়ি ছাড়লাম তা ভেবে খোদার কাছে লজ্জিত হচ্ছি। দয়া করে যান। আমার পাপ আর বাড়াবেন না।

শেরহাম বলে,

আচ্ছা যাচ্ছি। তুমি কেঁদোনা।

বেরুবে ঠিক তখনি অপরূপা ডাক দেয়।

আপনার ছোট ভাই যে পালিতপুত্র তা উনাকে বলবেন না এখন।

শেরহাম ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়।

কেন? কেন বলব না?

অপরূপা দেয়ালে পিঠ চেপে লম্বা দম ফেলে বলে,

খোদার কসম আপনি যদি তা উনাকে বলে দেন আমি আপনার কোনো শর্ত মানব না।

ঠিক আছে। কিন্তু একসময় ঠিক বলব।

বেরিয়ে যায় সে। অপরূপা দেয়াল ঘেঁসে বসে পড়ে। কাঁদতে থাকে মাথার কাপড় টেনে ধরে। বিলাপ করে বলে “আমায় পথ দেখান খোদা, আমি পালাতে চাই এই মহল থেকে”।

*********

রাতের খাবার দাবার কারো খাওয়া হয়নি। সকাল সকাল সবাই জেগে উঠেছে। ভোরের আলো ফুটেনি তখন। বোনদের কক্ষ হতে ভেসে আসা কোরআন তেলওয়াতের শব্দে পা থমকে যায় শেহজাদের। সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয়। তটিনী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তেলওয়াত শেষ করে কোরআন শরিফটা নির্দিষ্ট স্থানে স্বসম্মানে রেখে দিয়ে এগিয়ে এল।
শেহজাদের হাতের মুঠোয় চাদর রাখা। মাথার চুল এলোমেলো হয়ে আছে। পান্ডুর, ফ্যাকাশে, রক্তশূণ্য মুখখানা দেখে তটিনীর মায়া হলো। খানিকটা ভীতমনে জানতে চাইলো,

মামীমা কাঁদছিলেন তোমাকে ফিরতে না দেখে। রাতে কিছু খাওনি।

মসজিদে ছিলাম। শিরনী খেয়েছি। মহলের কি অবস্থা?

কার কথা জানতে চেয়েছে তটিনীর বুঝতে অসুবিধে হলো না।

রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েছে।

তার লোকজন?

তারা খায়নি। সাফায়াত ভাইজান বলল ঘোড়াশাল থেকে নাকি তিনটে ঘোড়া নিয়ে তারা পালিয়েছে। শেরহাম ভাইজানকে বলতেই উনি বললেন তারা পুনরায় ফিরে আসবে। তাদের উগ্র মেজাজের অশ্বগুলি ঘোড়াশালে দুটো ঘোড়াকে আহত করেছে।

শেহজাদের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তটিনীর পেছন থেকে সায়রা ছুটে এল। শেহজাদকে দেখে তার মন খারাপে কান্না এল।

ভাইজান আপনি আম্মাকে দেখা দিয়ে আসুন। কেন উনার উপর রেগে আছেন? উনি আপনাকে নিয়ে আতঙ্কে থাকে তাই রূপার সাথে অমন ব্যবহার করে ফেলেছে।

আমি কারো উপর রেগে নেই।

তাহলে কেন মসজিদে রাত কাটিয়ে এলেন? আপনার অপেক্ষায় জেগে ছিলাম মধ্যরাত অব্দি। আপনি আমাদের শক্তি। মহলের ভীত তো আপনি। আপনাকে এভাবে দেখতে কষ্ট হচ্ছে।

শেহজাদ মুখ শক্ত করে বল,

আমি ক্ষণিকের জন্য বাইরে গিয়েছিলাম। দমবন্ধ হয়ে আসছিলো। কক্ষে খাবার পাঠিয়ে দাও। একসাথে খাব না।

জ্বি আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে কক্ষের দিকে পা বাড়ায় শেহজাদ। কেমন এক অদৃশ্য ভোজবাজিতে পা দুটো নিজকক্ষের দিকে যেতে যেতে থমকে যায় অন্য একটি কক্ষের সামনে। সে থামে জানালার কাছে গিয়ে। জানালা খোলা। পর্দা জড়ানো। শেহজাদ পর্দা সরায় ধীরেধীরে আলগোছে। পর্দা সরাতেই হ্দয় কম্পিত হয়।
সাদা ওড়নায় মাথা ঢাকা মেয়েটাকে দু-হাত তুলে জায়নামাজে বসে কাঁদতে দেখে পায়ের তলার মাটি শক্ত হয়ে উঠে। হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় অচিরাৎ। কোথাও একটা তীব্র হাহাকার জুড়ে থাকে। সমস্ত ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। রূপাকে সে সুস্থ করেছে, এবার দুঃখও ঘুচিয়ে দেবে।
একজোড়া পুরুষালী পদধ্বনি এসে থামে শেহজাদের কিছুটা পেছনে। শেহজাদ আর দাঁড়ায় না। চাদরটা কাঁধে তুলে নিজ কক্ষের দিকে এগুতেই থেমে যায় উপহাসবাক্যে।

রূপনগরের সম্রাট যুবতী মেয়েদের ঘরেও উঁকিঝুঁকি দেয় নাকি?

শেহজাদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। শেরহাম তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রুর হাসে শেহজাদ। শেরহামের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলে,

শুধু উঁকিঝুঁকি কেন কোকেইনও রাখি সাথে। জাদুবিদ্যাও ভালোই পারি।

শেহজাদ!!!

প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়ে গর্জে উঠে শেরহাম। চট করে দরজা খুলে অপরূপা। দু’জনকে দেখে অতি আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শেহজাদ একঝলক তার বদনখানি দেখে হাতের চাদরটা কাঁধে তুলে নিগূঢ় ভঙ্গিতে হেঁটে চলে যায়। শেরহাম অপরূপার দিকে তাকিয়ে বলে,

দরজা জানালা অযথা খোলা রাখবে না অপা।

অপরূপা তার মুখের উপর ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলে,

বেশ।

চলমান…..

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ