প্রিয় বেগম পর্ব-১৮+১৯

0
1631

#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_১৮
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

সবার গায়ে রাজকীয় পোশাক। তাদের দেখলেই বুঝা যাচ্ছে তারা মহলের কন্যা। মাথায় জমকালো ঝালর বাঁধাই করা। চোখের পর থেকে ঝালর দিয়ে মুখ ঢাকা। রূপার দিকে সাদা গোলাপি রঙের একটা পোশাক বাড়িয়ে দিয়ে তটিনী বলল,

এটা পড়ে নাও। সম্রাটের আদেশ।

অপরূপা পোশাকটি হাতে নিল। বলল, কিন্তু আমি তো প্রস্তুত।

সায়রা হেসে বলল,

ভাইজান এইমাত্র এসে বললো তোমাকে একটা নতুন পোশাক দিতে। আর আমাদের মতো করে প্রস্তুত হয়ে নাও। মহলের কন্যাবেশে যাবে। ওখানে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারো।

কিন্তু…

কোনো কিন্তু নয় রূপা। তাড়াতাড়ি যাও।

অপরূপা ভেবেছে আজ পালা দেখতে যাবে না। কিন্তু তাকে যেতেই হচ্ছে। তার উপর এসব পোশাক পড়তে ইচ্ছে করছেনা তার।

অপরূপা পোশাক পড়ে নিল। তটিনী এসে তাকে মাথায় হিজাব পড়িয়ে ঝালর পড়িয়ে দিল। শুধু চোখদুটো দৃশ্যমান। দর্পনের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন এক রূপাকে আবিষ্কার করলো অপরূপা। তাকে রাজকন্যাদের মতো দেখাচ্ছে। সিভান এসে ডাকলো,

সুন্দর বউ!

অপরূপাকে চিনতে বেগ পেতে হলো তাকে।

সুন্দর বউ কোনটা?

অপরূপা হাত বাড়িয়ে ঢাকলো।

এইতো আমি। বলো কি বলবে?

সিভান এগিয়ে এসে তার হাত ধরলো খপ করে। টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

ভাইজান কখন থেকে ডাকছে। চলো।

রূপাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। শেহজাদ তার দলবল গাড়ি আর ঘোড়ার আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সিভান ওর হাত ছেড়ে আবারও মহলের ভেতরে চলে গেল।
প্রাঙ্গন তেমন আলোকিত নয় তাই শেহজাদ অপরূপাকে তটিনী ভেবে বলল,

ওদের ডেকেছ?

অপরূপা কোনো উত্তর দিল না। এককোণায় দাঁড়িয়ে থাকলো। শেহজাদ কথা বলা শেষে অপরূপার দিকে ভালো করে না তাকিয়ে গাড়ি দেখিয়ে দিয়ে বলল

বাকিরা কোথায়? গাড়িতে উঠে বসো। সাফায়াত সবাইকে ডাক দাও।

সাফায়াত সবাইকে ডাকার জন্য ভেতরে চলে গেল। শেহজাদ ঘোড়ার পানি খাওয়া বালতিটা রূপার সামনে রেখে বলল, একটু পানি নিয়ে এসো দ্রুত।

রূপা নড়াচড়া করলো না। শেহজাদ বলল, দ্রুত যাও।

অপরূপা পানির আনার জন্য কূপের দিকে চলে গেল। পানি এনেও দিল। শেহজাদ তার অশ্বের যত্ন নিতে মত্ত।

মহলের ভেতর থেকে সবাই চলে এল। তটিনী ডেকে বলল,

রূপা তুমি এখানে?

শেহজাদ সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। একদম চোখ বরাবর তাকাতেই নিজেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। অপরূপা মুচকি হাসলো যদিও তা শেহজাদ টের পেল না। শেহজাদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

তোমরা গাড়িতে উঠে বসো।

সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠে বসলো। অনেক গাদাগাদি হলো। তবে গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর আর কষ্ট হলো না কারো। রূপা পুরোটা পথজুড়ে মুগ্ধনয়নে রূপনগরের রূপের ঝলকানি দেখলো। নদীর পাশ দিয়ে জঙ্গলের সড়ক ধরে বড় সড়কে উঠতেই দৃশ্যমান হলো দূরপাহাড়, ধূ ধূ করা বিল, বিশাল প্রান্তরের পাশে প্রকান্ড এক বটগাছ, আরও আরও দূরে জনবল পেরিয়ে চোখের সীমানা পেরিয়ে অবস্থিত সবচাইতে বড় মসজিদ, ওলি-আউলিয়ার মাজার, আল্লাহু আল্লাহু জিকিরে তা মেতে থাকে সর্বদা। যদি মহলের কাছাকাছি হতো রূপা একদিন ঠিক যেত সেখানে। ওখানে গেলে বোধহয় মনটা শান্ত হতো।

শেহজাদ তার দলবল নিয়ে অশ্বারোহণে পৌঁছেছে যাত্রাপালায়। ঢাকঢোল পিটিয়ে শিল্পীদের মঞ্চে যাতায়াত শুরু হচ্ছে। নির্দিষ্ট আসনে অপরূপাদের বসার জায়গা হলো। আজ বিন্দুবাসিনীর শেষ যাত্রা। যেখানে স্বয়ং বিন্দুর শেষ যাত্রা দেখানো হয়। পতিদেবের কাছেই যার প্রাণবধ হয়। নিষ্ঠুরপ্রিয়াকে ছলনা করা জন্য নিষ্ঠুরতম প্রিয় তার প্রাণবধ করে ভেঙে পড়ে গগনবিহারী ক্রন্ধনে। চুপ করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শিল্পীদের অভিনয় দেখতে দেখতে কোমলপ্রাণ দর্শকের অক্ষিকোটর চোখের জলে ভেসে উঠে। প্রিয় স্বামীর হাতে মৃত্যুবরণ করা বিন্দুবাসিনীর গভীর নিস্তব্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতে আচ্ছন্ন হতে হতে মঞ্চের আলো নিভে আসে। পতিদেব পরমের ভাঙা হৃদয়ের আর্তনাদ হাহাকারে মেতে উঠে চারপাশ। ভেসে আসে শব্দমালা,

প্রাণনাশিনী! আমার বিন্দুবাসিনী।

অপরূপার চোখজোড়া জলে চিকচিক করে উঠে কোনো এক বেদনাবিধুর দুঃখে। দুঃখটা রহমানের জন্য নয়। নিজের জন্য। নিজেকে সে চিনতে পারছে না। এই অপরূপাকে সে নিজেই চেনে না।

সুষ্ঠুভাবে পালা দেখা শেষ হওয়ার পর মঞ্চ আলোকিত করে দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য মঞ্চে এসে দাঁড়ালো শেহজাদ। দর্শক মন তখনো আচ্ছন্ন বিন্দুবাসিনীতে। তারা স্তব্ধ হয়ে আছে। দ্বেষ ফুটে উঠেছে সকলের চেহারায়। এ যেন এক লেখকের কলমের নিদারুণ কেল, আর এক পরিচালকের অসাধারণ বিস্ময়কর সাফল্য।
মঞ্চ কাঁপিয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরটি যখনি আপামরজন সাধারণের উদ্দেশ্য কয়েকটা কৃতজ্ঞতাসূচক বাক্য বলা শুরু করলো ঠিক তখনি কোথাও বজ্রপাত হলো যেন। গোলাগুলির বিকটশব্দে ভয়ে শঙ্কিত প্রাণ নিয়ে ছুটছে মানুষ। গোলাগুলি ছুঁড়ছে শেহজাদের লোকবলও। ডাকাতদের লক্ষ্য ছিল মঞ্চে দাঁড়ানো শেহজাদ। কিন্তু ভুলক্রমে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। শেহজাদের লোকজন গোলাগুলি থামিয়ে লোকজনকে মাইকে ডেকে আশ্বস্ত করলো আপনারা পালাবেন না। নিরাপদ জায়গায় দাঁড়ান। নয়ত বিপদে পড়বেন।

কিন্তু কে শোনে কার কথা? প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সবাই হৈ হৈ করে ছুটলো।

তটিনী সবাইকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে গেল। শেহজাদ তাদের কাছে ছুটে গিয়ে বলল,

আমি আসা পর্যন্ত কেউ সরবে না এখান থেকে। রূপা তুমিও না।

অপরূপা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে। কি ঘটছে এসব!

শেহজাদ লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল।
দেশ-বিদেশ থেকে আগত অতিথিরা, শিল্পীরা বেশ অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল,

গতবারও এমন হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে এখানে আর আসা সম্ভব না। বেয়াদবি মাফ করবেন আপনার নগর দিনদিন কেমন উচ্ছিষ্টে পরিণত হচ্ছে সম্রাট।

শেহজাদের চোখমুখ ক্রোধের অনলে লাল হয়ে উঠলো। রক্তলাল চোখ আর শক্ত চোয়াল। কপালের পাশ বেয়ে অজস্র গড়িয়ে পড়া ঘাম মুছে ধপাস করে এসে বসে পড়লো কেদারায়। হাতের বন্দুকটি ছুঁড়ে ফেলে ক্রুদ্ধ গলায় বলে উঠলো,

সাফায়াত এত এত সুরক্ষাব্যবস্থা থাকা স্বত্তেও কি করে ডাকাতদল নগরে প্রবেশ করলো?

পুলিশের লোক দ্বয় চুপ করে থাকলো। সাফায়াত বলল, আয়শা কাঁদছে। বাকিরা আতঙ্কিত হয়ে আছে। আমার মনে হয় এখন আমাদের মহলে ফেরা উচিত। তারপর এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনায় বসা উচিত।

শেহজাদ উঠে দাঁড়ালো। বলল,

সবাই গমনের জন্য প্রস্তুত হও।

সায়রাদের কাছে আসতেই সায়রা উৎকন্ঠিত গলায় বলল,

ভাইজান ওরা কেন তোমার দিকে গুলি তাক করলো?

তার চোখে জল। শেহজাদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

কান্না নয়। মহলে গিয়ে আম্মাকে এসব বলবে না। মনোবল আনো নিজের মধ্যে। দুর্বলদের পিঁপড়েও লাতি মারে।

সায়রা কান্না চেপে রাখলো। অপরূপার চোখেমুখে প্রাণ নেই, ভাষা নেই। এমন গোলাগুলির মতো বীভৎস ঘটনা সে আর দেখেনি। সে স্তব্ধ হয়ে আছে। শেহজাদ তার চাউনি দেখে কিছু বলল না। কিছুপরে এসে বলল,

সবাই গাড়িতে উঠে বসো। আমরা রওনা দেব।

আকস্মিক ঘটনায় বিহ্বলিত কারো মুখে কোনো কথা নেই। নীরবতায় কেটে গেল অর্ধেকটা পথ। দর্পনে শেহজাদের চিন্তিতবদন দেখে অপরূপার খারাপ লাগলো। ভালো মানুষের পেছনে লাগার মানুষের অভাব হয় না। এই একটা মানুষের উপর পুরো একটা নগরের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নির্ভর করছে, যে মানুষটা নগরের প্রত্যেকটা মানুষের জন্য উছিলাসরূপ সেই মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়ার কেন এত শখ সে বুঝে পেল না।
কিন্তু তাদের আর শেষ রক্ষে হলো না। নদী ও জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সড়কপথে পুনরায় ডাকাত আক্রমণ হলো। কালোপোশাকে ঢাকা ডাকাতসৈন্যগুলোর অশ্ববাহিনীর তীব্র হুংকার ছেড়ে থামলো তাদের গাড়ির সামনে। সবার মুখ ঢাকা। জ্বলজ্বল করছে চোখজোড়া। সাফায়াত পেছনে তাকিয়ে বোনদের আশ্বাস দিল।

তোমাদের কিচ্ছু হবে না।

শেহজাদকে অতি শান্ত দেখালো। গাড়িতে বসেই রইলো সে । সাফায়াত বিড়বিড়িয়ে ডাকলো,

ভাইজান!

পেছনে আমাদের বাহিনী আসছে। আপাতত শান্ত থাকো।

ওদিকে সায়রা সোহিনী কেঁদেই উঠলো। সায়রা ডাকলো,

ভাইজান তুমি নামবে না।

ওরা আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না। কতবার বারণ করেছি না কাঁদার জন্য।

সায়রা কান্না গিলে নিল। অপরূপা পূর্ণ দৃষ্টিতে দম না ফেলে তাকিয়ে রইলো ডাকাতগুলোর দিকে। জীবনের সমস্ত বাজে অভিজ্ঞতা যেন আজই হয়ে যাচ্ছে। তাদের গাড়ির পেছন পেছন আরও কয়েকটা ঘোড়া টগবগিয়ে এসে থামলো। মুহূর্তেই শুরু হলো গুলি ছোড়াছুড়ি। তবে বেশিক্ষণ না হতেই গোলাগুলি বন্ধ হতেই শেহজাদ বজ্রগম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

কি চাও তোমরা?

বাকবিভূতিহীন ডাকাতদলের একজন প্রচন্ড ক্রোধের দাবানলে আছড়ে পড়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,

এই রাজ্য। এই নগর।

তা কখনোই পাবে না। আমার দেহের শেষ রক্তবিন্দু থাকা অব্দি পাবে না।

নরদানবের মতো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো তারা। ঠিক সেই সুযোগে গাড়ি থেকে নেমে বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে শেহজাদ এগিয়ে গেল। হাত থেকে বন্দুক পড়ে গেল। তাদের অশ্বগুলোর পায়ে গুলি লাগলো। অশ্ব ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালাতে লাগলো তারা। এদিকে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছে অপরূপা।
শেহজাদ পিছু ফিরে তাকে না দেখে বলল,

রূপা! রূপা কোথায়?

ঠিক সেই মুহূর্তে হাতের বাহুর মধ্যে এসে বিঁধে একটি তীরের ফলা। শেহজাদের লোকজন বন্দুক নিয়ে এগিয়ে যেতেই ডাকাতরা পিছিয়ে গেল। বাহু চেপে ধরে গাড়ির সাথে লেগে বসে পড়লো শেহজাদ। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে নেমে পড়লো সায়রা তটিনীরা। শেহজাদ বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে শুকনোমুখে জিজ্ঞেস করলো,

একটা মেয়ে তোমাদের পাশ থেকে নাই হয়ে গেল কি করে?

সায়রা বলল,

রূপা কখন নেমে গেল বুঝতে পারিনি ভাইজান। আমরা মাথা নামিয়ে বসেছিলাম।

তটিনী বলল, শান্ত হও। তোমার রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রচুর।

ঝাড়া মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল শেহজাদ।

রূপা আমার তত্বাবধানে ছিল। ওর কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। কোথায় ও? ধিক্কার তোমাদের।

তটিনীরা সবাই মাথা নামিয়ে ফেললো।

******

দৌড়াতে দৌড়াতে পায়ের চটি খুলে পড়ে গেল রূপার। পায়ের তলায় কাঁটা বিঁধে গেল। রক্তে মাখামাখি হলো পা জোড়া। বন্দুক আর তীর হাতে নদীর ঘাটের উদ্দেশ্য ছুটে যাওয়া ডাকাত সৈন্যদের সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালো সে। ডাকাত সৈন্যগুলো ভয়ংকর দৃষ্টি দিয়ে আপাদমস্তক দেখে নিল অপরূপাকে। অপরূপার মুখ তখনো ঝালর দিয়ে ঢাকা। তার দিকে লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগুতে থাকা সৈন্যগুলোর পা জোড়া থেমে গেল জলদগম্ভীর এক ভয়ংকর এক আদেশে। পা পিছিয়ে নিয়ে গেল, বিপরীতদিকে মেয়েটি এগিয়ে এল তাদের দিকে। এগিয়ে আসতে আসতে নিজের ঝালর তুলে দিয়ে মুখটা অনাবৃত করে টেনে ধরলো কালো পোশাকে আবৃত ডাকাত সর্দারের কাঁধের পোশাক। অন্য হাতে মুখের মুখোশ সরিয়ে দেয়ামাত্রই বহুদিন পর সুপরিচিত মানুষটার এমন ভিন্নরূপ দেখে ভেঙে পড়ে আশাহত হয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে বলল,

যাকে মন দিয়েছিলাম তার কন্ঠস্বর চিনতে তাহলে ভুল হয়নি। প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক। ভালোবাসা আজ এখানেই কবর দিলাম।

তার নরম গালটা শক্ত দু’হাতে আগলে ধরে লোকটা তার কপালে চুম্বন খেয়ে বলল,

আমার কথা শোনো অপা। আমার সাথে চলো। আমি তোমাকে নিয়ে যেতেই এসেছি।

অপরূপা সজোড়ে চড় বসালো তার গালে। ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলল,

মরে যাব। তবু আপনার কাছে আর ফিরব না। আপনি আমার জন্য হারাম।

আমাকে ভুল বুঝছো অপা। আমার কথা শোনো। ফিরে এসো।

আর কিছু বলার সুযোগ হলো না। তন্মধ্যে শেহজাদের গলার স্বর শুনতে পেতেই রহমান পালিয়ে গেল তার লোকবল নিয়ে। ঘাটে রাখা তাদের জাহাজ। অপরূপা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। জাহাজ ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গিয়েছে।

শেহজাদ দূর থেকে অপরূপাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। তারপর এগিয়ে এল। তার উপস্থিতি টের পেয়ে অপরূপা কান্না থামিয়ে দিল। চেহারা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।
শেহজাদ তার সামনে এসে হাঁটুমুড়ে বসলো। বজ্রগম্ভীর স্বরে ধমকে বলল,

এমন পাকামো করতে কে বলেছে তোমাকে? কেন এখানে এসেছ?

অপরূপা নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। রোধ হয়ে আসা কন্ঠে বলে,

ভেতরের পথ দিয়ে ওদের পিছু পিছু এসেছি।
আমিও এককালে তাদের সদস্য ছিলাম কিনা জানতে এসেছি। আপনাদের মতো তো আমি ডা*কাত।

শেহজাদ আর কিছু বলতে পারলো না। চেয়ে রইলো নিরুত্তর।
তখনি রক্তে ভিজে উঠা শেহজাদের বাহুর দিকে নজর পড়তেই আঁতকে উঠলো অপরূপা। তটিনী তেঁতো পাতা খুঁজে আনলো। দু’হাতের তালুতে পিষে শেহজাদের বাহুতে চেপে ধরে শবমনের কাছ থেকে কাপড় নিয়ে বাহুতে বেঁধে দিতে দিতে বলল,

ওঠো। তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

শেহজাদ দাঁড়িয়ে পড়লো। অপরূপার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,

ওঠো। আর কখনো ওদের পিছু নেবে না। ওদের মনে দয়ামায়া নেই একটুও।

অপরূপা নিজে নিজে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল,

আপনার হাতের জরুরী চিকিৎসা প্রয়োজন।

শেহজাদের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ওভাবে রয়ে গেল।

অপরূপা গাড়ির দিকে এগুতে এগুতে কেঁদে বুক ভাসালো। তার সাথে কেন এমন হলো?

শেহজাদ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাকিদেরকে বলল, রূপার মতো সাহসী হও। অযথা ভ্যাঁ ভ্যাঁ কাঁদা আমার একদমই পছন্দ নয়।

চলবে….

#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_১৯
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

খোদেজা সদর ঘরের আসনে বসে আহাজারি করছিল। ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি কানে আসতেই সে ছুটে গেল উন্মাদের মতো। শেহজাদ গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। বাম হাতের বাহুতে একটি কাপড় বাঁধা। খোদেজা তার বুকে আছড়ে পড়ে হু হু করে কেঁদে উঠে বলল,

এই পালা অশুভ হয়ে গেছে তোমার জন্য। এত বাঁধা আসছে তারপরও কেন তুমি থামছো না শেহজাদ?

শেহজাদ কন্ঠস্বরে নমনীয়তা এনে বলল,

শান্ত হোন আম্মা। তেমন কিছু হয়নি।

গাড়ি থেকে সায়রা তটিনীরা সবাই নেমে এল। সবার পেছনে অপরূপা দাঁড়িয়ে আছে। সায়রাদের চোখেমুখে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্বচক্ষে ডাকাত দেখলো তারা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। মুখে কথা নেই কারো। ছেলে মেয়েদের দেখে শাহানার যেন প্রাণ ফিরে এল। সিভান পালা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সোহিনীর কাঁধে মাথা রেখে। তার ঘুম ভার। সে ডাকাত দেখতে পায়নি। যখন জেগে উঠেছে তখন ডাকাতরা পালিয়েছে। শুধু শেহজাদ ভাইজানকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে শিউরে উঠেছিল। তার চোখেমুখেও ত্রাস। হামিদা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কত প্রশ্ন করলো। সে একটারও জবাব দিল না। জীবনেও আর যাত্রা দেখতে যাবে না সে।

শাহাজাহান সাহেব এসে বললেন, সবাই ঠিক আছ? কারো কোনো ক্ষতি হয়নি তো?

সায়রা কান্না বিজড়িত গলায় বলল,
ভাইজানের হাতে তীর লেগেছে।

খোদেজা শেহজাদের হাতের বাহুর দিকে তাকিয়ে বলল,
হে খোদা! কতখানি রক্ত ঝড়েছে। তোমার কি একটুও ব্যাথা অনুভব হচ্ছে না পুত্র?

শেহজাদ অগ্নিময় কন্ঠে বলল, হচ্ছে। এত কঠোরভাবে সুরক্ষাব্যবস্থা থাকার পর কি করে নগরে ডাকাতরা প্রবেশ করলো? আমার মাথাব্যথা সেখানে। কি করে ঘাটে জাহাজ এসে থামলো? কারো কাছে এর উত্তর আছে?

তার গর্জন শুনে দু’জন শক্তিশালী লোক সামনে এসে দাঁড়ালো। তাদের দৈত্যের মতো শরীর। পুরুষ্টু দেহ, এক একটি হাতের থাবা বিশাল, চোখগুলো রক্তাভ যেন কতশত রাত তারা ঘুমায়নি। তারা কাশিম আর কামীল। শেহজাদের কিছুটা দূরে দুজনেই চোখ নত করে দাঁড়ালো। কাশিম বলল,

সাহেব সীমানায় যারা পাহাড়ারত ছিল তাদের সবাইকে জঙ্গলে অচেতন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। তারা কোনো কথা বলছে না। নেশাগ্রস্তের মতো দেখাচ্ছে। তাদের বন্দুকগুলোও নিখোঁজ। শঙ্কা করছি ডাকাত সৈন্যরা তা নিয়ে পালিয়েছে।

বেশ ভালো খবর। শুনে ধন্য হয়ে গেলাম।

সবাই নতমাথায় দাঁড়িয়ে রইলো।

মহলের ফটকের সামনে কয়েকটি অশ্ব এসে থামলো। পরপর ছ-সাতজন ভৃত্য এসে হাজির হলো। তাদের চোখমুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে তারা কোনো দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে।

শেহজাদ এগিয়ে গেল। জানতে চাইলো,

আবারও কোনো দুঃসংবাদ?

জ্বি জনাব। নগরের পয়তাল্লিশটি বাড়িতে প্রতিবছরই ধানও অন্যান্য ফসলাদি চাষ হয়। তাদের নিজস্ব গুদামঘর আছে। তন্মধ্যে পঁচিশটি গুদামঘরে আগুন জ্বলছে। তাদের খাজনা ও জমাকৃত ফসল মহলের মজুতঘরে আসেনি।
নগরের চারিদিকে ডাকাত সৈন্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজে লেগে পড়েছে। বাড়ির মানুষগুলোর আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়েছে। আমাদের অপারগতার জন্য আমার অনুতপ্ত। আমাদের ক্ষমা করুন।

শেহজাদ বাকহারা হয়ে পড়লো। তার নিস্তব্ধতা সবাইকে আরও বেশি শঙ্কিত করে তুললো।
খোদেজা কপাল চাপড়ে বিলাপ করে, হায় খোদা! এ কেমন ধ্বংসলীলা শুরু হয়েছে এই সোনার নগরে! এবার তো খাদ্যসংকট শুরু হবে।

শেহজাদ ডাকলো, সায়রা!

সায়রা দ্রুতপদে এগিয়ে আসে।

জ্বি ভাইজান।

সবাইকে নিয়ে ভেতরে যাও।

জ্বি।

সোহিনী, তটিনী, শবনম আর আয়শার পিছু পিছু অপরূপা যাওয়ার সময় খোদেজা থামিয়ে দিল। শেহজাদ মায়ের দিকে তাকিয়ে ফের অপরূপার দিকে তাকালো।

তোমার পা খালি কেন?পায়ে কি হয়েছে? পায়ে রক্ত কেন?

অপরূপা ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে তাকালো। সিভান বলল,

বড়মা সুন্দর বউ ডাকাতের পিছু নিয়েছিল।

খোদেজা কিছু বলতে যাচ্ছিলো শেহজাদ তাড়া দিয়ে বলল,

আম্মা কথা বাড়াবেন না। রূপা ভেতরে যাও।

সায়রা খোদেজাকে নিয়ে চলে গেল। অপরূপা তাদের পেছনে পেছনে অন্দরমহলে চলে গেল। তার হেঁটে যাওয়ার ধরণ দেখে শেহজাদের কপালে ভাঁজ পড়লো। কি হলো রূপার?

অপরূপা কক্ষে প্রবেশ করামাত্রই দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে পিঠ লাগিয়ে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ভেঙে পড়লো। এতটা নিষ্ঠুরভাবে কখনো তাকে কেউ ভাঙতে পারেনি। টলাতে পারেনি। বুকের ভেতরটাতে এতটা দহন কখনো হয়নি। এমনভাবে কেউ তাকে ঠকায়নি। বিশ্বাস ভাঙেনি। কেন এমন করলো সে ? কিসের এত শত্রুতা তার রূপনগরের সম্রাটের সাথে? দাদীজান কি তবে সত্যি ছিলেন? তিনি যে বলতেন, তোকে কেউ ভালোবাসবেনা অপু, ভালোবাসা এত সহজ নয়। তোকে ভালোবাসা তো আরও কঠিন। সবাই শুধু তোর রূপের প্রেমে পড়বে। তোর বসন্তদূতীর মতো কন্ঠস্বরের প্রেমে পড়বে। তোর গভীর মৃগনয়নার প্রেমে ডুবে যাবে । কিন্তু কখনো ভালোবাসবে না।
সবাই তোর প্রেমে পড়বে ক্ষণিকের জন্য। যে প্রেম চক্ষুআড়াল হলেই হাওয়া হয়ে যায়। স্বার্থে লাগলে হয়ে উঠে হিংস্র, তুই বিপরীত হলে হয়ে উঠবে ভয়ংকর। সেই প্রেমের অনল তোকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে। নিঃস্ব করে দেবে অপু। আজ দাদীর কথা যেন সত্যি প্রমাণিত হলো। দাদীজান কি তবে ভবিতব্য জানতেন? কি করে এমন ধ্রুব সত্যি কথা তিনি বলে গেলেন?
যতবারই সব মিথ্যে মিথ্যে মনে হচ্ছে ততবারই ঝাপসা চোখের পাতায় বারংবার ভেসে উঠছে সেই মুখখানা। যার মায়ায় একদিন সে প্রথম লুকিয়ে চিঠি লিখেছিল। যার মায়ায় দাদীজানকে প্রথম মিথ্যে বলেছিল। যার মায়ায় চাচীর রান্নাঘর হতে ভাজা মুড়ি চুরি করে বিলের ধারে দুপুরবেলা তার ক্ষিদে নিবারণ করেছিল। যার কাঁধে মাথা রেখে সন্ধ্যেঅব্দি চোখ বুঁজে একটু শান্তির খোঁজ পেয়েছিল সে। যার চোখের দিকে তাকালেই শান্তিতে মনটা ভরে উঠতো। যার বক্ষস্থলে মাথা রাখতেই আশপাশটা তার ধোঁয়াশা হয়ে উঠতো,
যার মায়ায় পড়ে দিনদুনিয়া ভুলে এক অপরিচিত অপা হয়ে উঠেছিল সে। তাকে যে মানুষটা ছোট্ট কুটিরের ছোট্ট একটি সংসারের লোভ দেখালো সেই কিনা ক্ষমতার লোভে এমন নিকৃষ্টতর জীবে পরিণত হয়েছে? তার উষ্ণ ওষ্ঠপুটের স্পর্শে যেখানে তার সুখসাগরে হারিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে তার তীব্র ঘৃণা হচ্ছে। সে ভাবতে পারছেনা, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা ওই সরল চেহারার মানুষটা তার সাথে এমন করেছে। তার বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বিশ্বাস ভাঙার কষ্ট। স্বপ্ন ভাঙার মর্মবেদনা। চোখের জল চোখেই শুকিয়ে গেল। বুকের মতো চক্ষুজ্বালাও করতে লাগলো।
সত্যি এটাই, বিশাল এই পৃথিবীর মাঝে দাদীজান ছাড়া আর কোনো মানুষই তার আপন হয়ে উঠতে পারেনি।
এবার সে কোথায় যাবে? যার আশায় মহলে এতদিন কাটিয়ে দিল সে তার সব আশায় জল ঢেলে দিল। তাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, তোর মতো অভাগিনীকে ভালোবাসা যায় না শুধুই ব্যবহার করা যায়, শুধুই সময় কাটানো যায়, পুতুলের মতো নাচানো যায়, হাসানো যায়, কাঁদানো যায়। তোর বাহ্যিক রূপে মোহিত হয়ে মুগ্ধ হয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রেমে পড়া যায় ঠিক কিন্তু মায়া? তোর মায়াতে কেউ কভু পড়েনি। পড়বে না। তোকে বুকের মাঝে আগলে রেখে ভালোবাসার মতো মহৎপ্রাণ মানুষ নেই। হবেও না।

কিছু্ক্ষণের মধ্যেই মহলে হৈচৈ পড়ে যায় । একটি কথা কানে আসে “মিঠি মারা গিয়েছে”।
হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠলো প্রায়।

*************

শেহজাদ হাসপাতাল থেকে ফিরে এল। তখন রাত্রিগভীর। মাঝেমধ্যে বন্য শেয়ালের ডাক ভেসে আসে। কালু মিয়া আর মফিজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে তবে কাজ করার মতো অবস্থায় এখনো ফিরেনি তারা। হাসপাতালে তাদের টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। নগরের এমন বিধ্বংসী অবস্থার কথা শুনে তারা আরও উতলা হয়ে উঠলো মহলে ফেরার জন্য। শেহজাদ তার হাতের চিকিৎসা নিয়ে তাদের সাথে ফিরে এল। পোড়া গুদামের মালিকদের ভরসা দিয়ে এল। যতদিন সম্রাট আছে ততদিন তাদের ভয় নেই। এবার সম্মুখযুদ্ধের আহৃবান করবে সে। পরিণতি যাইহোক।

মহলে ফিরেই শুনতে পেল তার মিঠি মারা গিয়েছে। তটিনীর কোলে তার মৃতদেহ। তটিনী এগিয়ে এসে বলল, তোমার কক্ষে ওদের খেতে দিতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ও শুয়ে আছে চুপচাপ। কোলে নিয়ে দেখি ঠান্ডা হয়ে আছে। প্রাণ নেই। ডাক্তার বাবু কিছুই বুঝতে পারছেনা।

খোদেজা কপালে হাত চেপে বসে আছে। শেহজাদ নিস্তব্ধ হয়ে হাত বাড়িয়ে কোলে নিল মিঠিকে। গায়ে হাত বুলিয়ে কামীলকে ডেকে কোলে তুলে দিল। বলল,

বাগানের পশ্চিমদিকে কবর দিয়ে এসো।

জ্বি সাহেব।

ফের পিঠে হাতে বুলিয়ে আদর করে দিয়ে শেহজাদ বিড়বিড় করলো, আলবিদা।

সায়রা ফুঁপিয়ে উঠলো। সকলেই দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিদায় জানালো মিঠিকে।

রাতটা কেটে গেল কোনোমতে। কারো ভালো করে খাওয়া হলো না সেরাতে।

*****************

খুব ভোর নামাজ আদায় করে নিল অপরূপা। কয়েক পাতা কোরআন পড়লো। মনটা শান্ত হচ্ছে না তারপরও। মনে হচ্ছে রহমানের কথা তার শোনা উচিত ছিল। সবাই মহান মানুষদের আত্মকথন শুনতে চায়। কেউ চোর ডাকাতদের আত্মকথন শুনতে চায় না। কেউ কি ইচ্ছে করে ডাকাত হয়? হয় না। কিন্তু কোথায় গেলে সে সত্যিটা খুঁজে পাবে? সবটা যে তার জানা দরকার। নইলে তার অস্থিরতা কাটছে না।

কোরআন পড়া শেষে কোরআনটা নির্দিষ্ট স্থানে রাখতেই সায়রা কক্ষে এসে বলল, রসাইঘর চলে এসো রূপা। আম্মা ডাকছেন।

অপরূপা তাকে ডেকে বলল, আমাকে রূপা বলে ডাকছো কেন?

সায়রা মৃদু হেসে বলল, ভাইজান বলেছেন রূপা বলে ডাকতে। তাছাড়া রূপা নামটা ভীষণ সুন্দর। আমার ভাইজানের পছন্দ দারুণ। সম্রাট তোমাকে নাম দিয়েছে এটা স্বসম্মানে গ্রহণ করা উচিত।

অপরূপা চোখ নত করে বলল, জ্বি করলাম।

সায়রা খুশি হলো। তার গাল টেনে দিয়ে বলল, দ্রুত এসো। কাল রাতে কারো কিছু খাওয়া হয়নি। নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।

হ্যা।

ঠিক আছে। চলে এসো।

অপরূপা জায়নামাজ ভাঁজ করে ঘরটা গুছিয়ে রাখলো। তারপর বেরিয়ে গেল। রসাইঘরে পা রাখতেই সবাই তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সাদা ওড়না দিয়ে ঢাকা তার মস্তক, ফুল হাতা কামিজ আর কালো সেলোয়ার পড়া। খোদেজা তার মুখের দিকে তাকালে আর রূঢ় গলায় কথা বলতে পারেন না। মেয়েটাকে দেখলেই বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরে। কেমন রহস্যেআবৃত এক শান্তময়ী সে! মাঝেমাঝে শৃঙ্খল ভেঙে দু একটা কথা মুখের উপর বলে ফেলে। আজকাল সেটাও তেমন লক্ষ করা যাচ্ছেনা।

খোদেজা ডাক দিল..

ফুলকলি!

জ্বি মা বেগম।

টেবিল সাজিয়ে দিয়ে আয়। শেহজাদকে কুসুম গরম পানি দিবি। তার ঔষধ গরম পানি দিয়ে খেতে হবে।

আইচ্ছা। যাইতাছি।

অপরূপা রুটির প্লেট তুলে নিয়ে হামিদাকে বলল, আমি সাহায্য করি।

তোমার পায়ের তলায় না কাঁটা বিঁধেছিল!

ব্যাথা আছে। কমে যাবে।

হামিদা আর কিছু বলতে পারলো না। অপরূপা বেরিয়ে গেল। মহলের পুরুষমানুষের খানাপিনার কক্ষের দিকে পা বাড়াতেই শেহজাদের সামনে পড়ে গেল। শেহজাদ সেই কক্ষেই যাচ্ছিলো। অপরূপা থেমে গেল শেহজাদ যাওয়ার জন্য। এদিকে শেহজাদ দাঁড়িয়ে গেল অপরূপা আগে যাওয়ার জন্য। অপরূপা তার নড়চড় না দেখে পেছনে ফিরে তাকালো। বলল,
আপনার হাতের অবস্থা কেমন!
শেহজাদ গুরুতর ভঙ্গিতে বলল,
খুব খারাপ!
অপরূপা আহত চোখে হাতের বাহুর দিকে তাকালো। বলল,
মনে হচ্ছে না খুব খারাপ।
শেহজাদ হাসলো। তারপর এগিয়ে গেল।
অপরূপাও কিঞ্চিৎ হেসে পা বাড়ালো তার পিছুপিছু। শেহজাদ চেয়ার টেনে বসলো।
অপরূপা টেবিলের উপর তার হাতের বাসনটা রাখতেই শাহজাহান সাহেব হেসে বললেন
অপরূপা শোনো,
পরক্ষণেই শেহজাদের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বলল,

দুঃখীত,শুধুই রূপা। তোমার না হওয়া বরের নাম তো রহমান নয়। সামাদ। ব্যবসায়ীরা তাকে সামাদ নামে চেনে। পলাশপুরে আবার সে মুরাদ নামে পরিচিত। এত রূপ তার। তুমি কি এসব বিষয়ে জানো?

অপরূপা দু’পাশে মাথা নাড়ালো। বলল,

তার বিষয়ে আর ঘাটাঘাটি না করার অনুরোধ। আমি মহল থেকে চলে যাব। তার ফেরার হলে আমি যেখানে থাকি সেখানে ফিরবে।

শেহজাদ শর্তজুড়ে দিয়ে বলল,

চলে যাব বললেই তো হয়ে গেল না।

বলে ফেলার পরই মনে হলো সাবধানতা অবলম্বন করে কথা বলা সম্রাট এবার ভুল করে বসলেন। বাবা চাচার দৃষ্টি দেখে সহজাত ঔদার্যবোধ দেখিয়ে বলল,

একটা একা মেয়েমানুষ কোথায় যাবে?

অপরূপা তাতে জল ঢেলে দিয়ে বলল,

আমাকে নিয়ে এতটা চিন্তিত হবেন না দয়া করে।

ফুলকলি, মতিবানু বাকিগুলো নিয়ে এসে টেবিল সাজিয়ে দিতে দিতে অপরূপাকে বেড়ে দিতে বলে চলে গেল। সাফায়াত আর ডাক্তার সাহেবও এসে যোগ দিল টেবিলে। ডাক্তার সাহেব অপরূপাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,

সুপ্রভাত রূপা।

অপরূপা মিষ্টি হেসে বলল,

সুপ্রভাত।

শেহজাদ হাসিমুখে বলল, আপনাকে বললাম আর ক’টা দিন থাকতে।

ফজল সাহেব বললেন, না রূপা এখন সুস্থ।
আমার আর থাকা হচ্ছে না। আমার স্ত্রীর চিঠি এসেছে। ফিরতে হবে। তবে তার খুব ইচ্ছে ছিল একদিন সুলতান মহলে আসবে।

শেহজাদ প্রসন্নকন্ঠে বলল,

অবশ্যই। এর পরের বার উনাকে নিয়ে আসবেন। কবে আসবেন বলুন।

যত দ্রুত সম্ভব তাকে নিয়ে আসবো। ততদিন কি রূপা মহলে থাকবে?

শেহজাদ অপরূপার দিকে তাকালো। কৌতূহল দেখিয়ে বলল,

রূপা কেন?

ফজল সাহেব হেসে বললেন, কারণ রূপা একজন চমৎকার মেয়ে। প্রথম দেখায় ওকে খুব জেদী মনে হয়েছে কিন্তু এখন দেখছি সে খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার স্ত্রী ওকে পেয়ে আরও খুশি হয়ে যাবে। তাছাড়া মহলে আরও মিষ্টি মেয়ে আছে।

শাহাজাহান সাহেব বলে উঠলেন, কেন থাকবে না। অবশ্যই থাকবে। আপনি শীঘ্রই চলে আসুন আপনার স্ত্রীকে নিয়ে। খুব বেশি দেরী করবেন না।

ফজল সাহেব বললেন, চেষ্টা করব।

শেহজাদ খেয়ে পানির গ্লাস টানতেই অপরূপা গরম পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিল। বলল,

মা বেগম আপনাকে গরম পানি দিতে বলেছেন।

কিন্তু গরম পানি খেতে আমার ভালো লাগে না।

ভালো না লাগলেও খেতে হবে। এটা উনার আদেশ।

শেহজাদ গরম পানির গ্লাস সরিয়ে দিয়ে বলল,

খাব না, এটা আমার আদেশ।

অপরূপা দ্বিধাগ্রস্তের মতো চেয়ে রইলো। তারপর খালি গ্লাসে খানিকটা গরম পানি, তার উপরে খানিকটা ঠান্ডা পানি ঢেলে শেহজাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

আমাকে দুজনের আদেশ পালন করতে হবে।

সাফায়াত টেবিল চাপড়ে হেসে উঠে বলল,

দারুণ কাজ করেছ রূপা।

সিভান এসে চেয়ার টেনে বসলো। হেসে বলল,

সুন্দর বউ তোমাকে আজ সত্যি বউ বউ লাগছে।

শেহজাদ মহাবিরক্তি নিয়ে পানি খেতে খেতে বলল,

বউটা কার?

সম্রাটের।

সবাই থতমত খেল। শেহজাদ পানিটুকু ভেতরে গিলতে পারলো না। মুখে নিয়ে বসে থাকলো।
সিভান খিকখিক করে হেসে নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল,

ছোট সম্রাটের। ছোট সম্রাট কে বলোতো?

সাফায়াত তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল,

সিভান সাহেব। তারমানে রূপা সিভানের বউ?

হ্যা। সুন্দর বউ।

শেহজাদ বলল,

কিন্তু তোমার সুন্দর বউ তো চলে যাবে। তখন?

সিভান কপাল ভাঁজ করে ফেললো। রুটি ছেঁড়ার সময় জোর দিয়ে বলল,

রশি দিয়ে ওই ভূতের ঘরে বেঁধে রাখবো।

সবাই হেসে উঠলো একসাথে।

তৎক্ষনাৎ রূপার মনে পড়লো ওই কক্ষ দুটির কথা। ওই ঘরের রহস্য সমাধান করার পরপরই সে মহল ছেড়ে চলে যাবে। তার কাছে পয়সা আছে।

*******

গুদাম পুড়ে যাওয়া লোকগুলিকে পনের দিনের খাবার দেয়া হয়েছে। পঁচিশটা বাড়ি থেকে পঁচিশজন এসেছে। সম্রাট তাদের মাঝে চাল, ডাল আর শস্যাদি বিতরণ শেষ করে কক্ষে ফিরে হাম্মামখানায় গোসল সাড়তে চলে গেল। ফিরে এসে দেখল মা বসে আছে তার ঘরে। সে মাথার জল মুছে নিতে নিতে বলল,

কিছু বলবেন আম্মা?

হ্যা। তোমাদের নিকাহ’র কথা ভাবছি আমি। নিকাহ হয়ে গেলে অনেক বালামুসিবত আপনাআপনি কেটে যায়। একই মহলে অবিবাহিত ভাবী বেগম নিয়ে একসাথে উঠাবসায় আরও পাপ হচ্ছে।

মফিজ সুস্থ হয়েছে। আগে ফুলকলির নিকাহটা সম্পন্ন হোক। তারপর..

খোদেজা খানিকটা সন্দেহের চোখে তাকায় ছেলের মুখপানে। সেইবার ইন্দিরাপুরের যাত্রা থেকে ফিরে একটা মেয়ের কথা বলেছিল সে খোদেজাকে। বলেছিল, আম্মা দূরদেশ হতে আপনার জন্য একটা বন্ধু নিয়ে আসলে কেমন হয়? সে একদম আপনার মনের মতো হবে।
খোদেজা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
দূরদেশ? কতদূর? কে সে? কতদিন ধরে চেনো?

দাদাজান বলতেন আমি মানুষ চিনে ফেলি সহজে। সেহেতু নিশ্চিন্তে থাকুন সে ভুল মানুষ হবে না। তার খোঁজ নিয়ে দেখেছি সে সেখানকার জমিদারের নাতনি। দাদীজানের আদরের পুতুল। আমি চাইলেই আমাকে দিয়ে দেবে। আমি রূপনগরের সম্রাট বলে কথা। আপনি কি বলেন?

খোদেজা রুক্ষস্বরে বলেছে,
এতকিছু জানিনা। তোমার দাদাজান বলে গেছেন শাহানার বড় কন্যার সাথে তোমার নিকাহ দিতে। রক্তের সম্পর্কের বাইরের কাউকে তুমি নিকাহ করতে পারবে না। ধ্বংস ডেকো না।

শেহজাদ সেকথা পাত্তা দিল না। বলল

তটিণী আমার বোনের মতো। ওকে আমি নিকাহ করতে পারবো না। এ অসম্ভব আম্মা।

খোদেজা পুত্রের মুখ চেয়ে সেদিন বলেছিল, ঠিক আছে। ওই মেয়েকে একদিন নিয়ে এসো। আমি দেখার পর ভেবে নেব সে রূপনগরের সম্রাটের বেগম হওয়ার যোগ্য কিনা। যোগ্য হলেই তাকে নিয়ে আসবো আমার মহলে। আর না হলে তোমাকে তটিনীকে নিকাহ করতে হবে।

শেহজাদ মাকে কথা দিল। কিন্তু তারপরের বার ইন্দিরাপুর থেকে এসে সে সেই মেয়ের কথা তুলতেই চাইলো না। এড়িয়ে গেল বারংবার। খোদেজা জানতে চাইলে বিরক্ত হয়ে একসময় বলল,

হারিয়ে গেছে। তটিনীকে বিয়ে করব। শান্তি আপনি? আর জানতে চাইবেন না তার কথা।

খোদেজা সেদিন কষ্ট পেল। মনে মনে দ্বেষ পুষে রাখলো সেই মেয়েটির জন্য। কত রাজকপাল তার রূপনগরের সম্রাট তাকে একদেখায় চেয়ে বসেছিল! আর সে কোথায় হারিয়ে গেল?

আম্মা, কি ভাবছেন এত?

শেহজাদের কথায় খোদেজা হুশে ফিরে, চমকে তাকায়। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখে তার দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শেহজাদ। ঘোরলাগা চোখে পুত্রের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চুলগুলোতে হাত বুলায়। কতকষ্টে এই একটামাত্র পুত্রের প্রাণ বাঁচিয়েছে খোদেজা! তার আগের ছ’ছটা সন্তান তার কোল খালি করে চলে গেল। এজন্যই তো তাকে নিয়ে মায়ের মন বড়ই দু্শ্চিন্তায় ভুগে।

এই আম্মা! আপনার আজ কি হলো? আর কিছু বলতে চান? আমাকে বেরুতে হবে।

খোদেজা চট করে প্রশ্ন করে,

আমায় সত্যি কথা বলবে পুত্র। সেই মেয়েটা কি অপরূপা-ই?

শেহজাদ মায়ের প্রশ্ন হতচকিত চোখে তাকায়। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তারপর সরে পড়ে চাদর টেনে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। তক্ষুণি অপরূপা তার সামনে এসে পড়ে। তার কোলে মিঠু। চোখ নত করে থমকে গিয়ে বলে,

দুঃখীত। আমি মিঠুকে দিতেই আসছিলাম। ও আমার ঘরে গিয়ে বসে আছে।

খোদেজা কক্ষ থেকে বের হয়ে একবার শেহজাদ আরেকবার অপরূপার দিকে তাকায়। শেহজাদ অপরূপার দিকে একপলক তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অপরূপা ওর যাওয়া দেখে ভাবে, সে ভুল কিছু করেছে?

খোদেজা ধমক দিয়ে ডাকে, এই মেয়ে তুমি এই ঘরের আশেপাশে ভুলেও আসবে না।

জ্বি।

অপরূপা মিঠুকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নামিয়ে চলে যেতে থাকে। মিঠু আবারও তার পিছু পিছু দৌড়ায়।

খোদেজা মহাবিরক্ত হয়ে বলে, সবারই কাঁটার প্রতি ঝোঁক।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে