প্রিয় বেগম পর্ব-১৬+১৭

0
1532

#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_১৬
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

দু রাত নির্ঘুম থেকে টুপিটা তৈরি করতে গিয়ে অপরূপা আর চোখ মেলতে পারছে না। সিভান এসে তাকে ডাকাডাকি করছে বুঝতে পেরেও সে চোখ মেলতে পারছেনা। সাথে দুর্বলও লাগছে। ফুলকলি তার গায়ে কাঁথা ঝাঁপিয়ে দিয়ে বলল, ছোট ভাইজান, সুন্দর বউ ঘুমাইতেছে। উঠতে পারবো না এখন।

সিভান জেদ ধরে বলল,

নাহ। মামা এসেছে। মামাকে দেখতে চেয়েছে সুন্দর বউ। এই বউ ওঠো।

কাঁথা নিয়ে ফেললো সিভান। অপরূপার গা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,

এই সুন্দর বউ! ওঠো।

অপরূপা পিটপিট তাকিয়ে আমর্ষ গলায় বলল,

কি হয়েছে? ঘুমাচ্ছি না?

সিভান ধমক খেয়ে চুপসে গেল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। ঠোঁট ফুলালো। অপরূপা বুঝতে পেরে উঠে বসলো। চোখ ঢলে বলল,

কি হয়েছে?

মামা এসেছে। দেখবে না?

মামা!

অপরূপা তড়াক খেয়ে বলল, তোমার মামা মহলে এসেছে?

হ্যা।

অপরূপা তড়িঘড়ি করে খাট থেকে নেমে মাথায় ওড়না জড়িয়ে বলল

চলো।

সিভান খুশি হয়ে তার হাতের আঙুল ধরে টেনে টেনে নিয়ে গেল।

মহলের কোনো এককোণা হতে জিকিরের শব্দ ভেসে আসছে হয়ত বেতার যন্ত্র চলছে। সারামহল রঙবেরঙের আলো আর লোক সমাগমে ঝলমল করছে। মেহমানদের বাচ্চাগুলো দৌড়াদৌড়ি করছে। রান্নাবান্নাও পরিবেশনের কাজে রত কাজের বুয়াগুলো লাল রঙের শামীয়ানায় ঢাকা খাবারের তালা হাতে সারি বেঁধে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে। সবার পড়নে আজ নতুন পোশাক। অপরূপা নিজের পোশাকটির দিকে তাকালো। দুপুরবেলা গোসল সেড়ে যেটা পড়েছিল সেটা। জলপাই রঙের । ফুলকলি দিয়েছে। ফুলকলি তাকে দুটো কাপড় দিয়ে দিয়েছে। কাপড়গুলো নতুন। লম্বা হওয়ায় সে তা কখনো পড়েনি। অপরূপার গায়ে তা ভালোই মানিয়েছে। সে অদলবদল করে পড়তে পারবে।
সিভান বলল,

তুমি ভাইজানকে কিছু দেবে না?

কি দেব?

উপহার?

আমার কাছে তো কিচ্ছু নেই।

আচ্ছা, চলো। ওইদিকে মামা আছেন।

ভীড় দেখা যাচ্ছে দ্বিতল ভবনের কক্ষপথটিতে। সিভান ভীড় ঠেলে অপরূপাকে নিয়ে ছুটলো। সবাই সিভান আর অপরূপাকে দেখে সরে দাঁড়ালো। সবার দৃষ্টি তখন তাদের দিকে। অপরূপা বলল,
আরেহ কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

সিভান থেমে গিয়ে বলল, মামা সুন্দর বউ চলে এসেছে। তোমাকে দেখবে। এদিকে ফিরো।

হামিদা, খোদেজা আর শাহানার সাথে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে কথা বলছিল লোকটা। সিভানের কথায় সামনে ফিরলো। সবার শাণিত দৃষ্টি অপরূপার দিকে। কটকটে হলদু রঙের পাঞ্জাবি পড়া লোকটার গায়ে লম্বা পাঞ্জাবি, লম্বা মুখ, জমিদারদের মতো লম্বা গোঁফ, বয়স পয়ত্রিশ ছত্রিশের মতো হলেও দেখতে অতটা মনে হচ্ছে না। অপরূপা লোকটাকে দেখে ঠোঁট টিপে হাসি চেপে রাখলো।

লোকটা সামনে ফিরেই অপরূপাকে আপাদমস্তক দেখলো। অপরূপার এতে অস্বস্তি লাগলো। লোকটা তুখোড় দৃষ্টিতে অপরূপাকে দেখে রসিকতা করে বলল,

এ তোমার সুন্দর বউ?

সিভান হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,

হ্যা।

হামিদা বলল,

হাবীব ও অপরূপা। আশ্রয়ে আছে।

হাবীব নামক লোকটা নিমগ্নকন্ঠে শুধালো,

মানুষের সাথে নামের এত মিল থাকতে তো দেখিনি।

আমি আসছি।

অপরূপা দ্রুতপদে ওখান থেকে চলে এসে হাসিতে ফেটে পড়লো। এই লোক সিভানের মামা? হাসতে হাসতে তার চোখে জল নেমে এল। পেছন পেছন সিভান দৌড়ে এসে বলল,

এই সুন্দর বউ তুমি চলে এলে কেন? মামা জিজ্ঞেস করছিল সুন্দর বউয়ের বর কোথায়?

অপরূপা হাসছে। তার হাসি থামছে না। আশেপাশের সবাই তাকে দেখছে। কাজের বুয়াগুলো তাকে এর আগে এভাবে প্রাণখুলে হাসতে দেখেনি।

সিভান বলল, তুমি হাসছো কেন? হাসি থামাও।
ওই দেখো শেহজাদ ভাইজানরা আসছে। বেশি হাসা পছন্দ করে না ভাইজান।

অপরূপা হাসির গতি কমালো কিন্তু হেসেই যাচ্ছে।

সিভান বুক ফুলিয়ে বলল,
সে বড় সম্রাট আর আমি ছোট্ট সম্রাট। এই থালাটা নাও। ভাইজানের মাথায় ফুল ছিটাও।

অপরূপা হাসতে হাসতে থালাটা হাতে ওদিকে তাকালো। অতি ব্যস্ত পায়ে হেঁটে শেহজাদ মহলে আমন্ত্রিত মেহমানদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কুশলাদি বিনিময় করতে করতে চত্বরের দিকে পা বাড়ানোর সময় সাফায়াতকে ডেকে বলল,

এখানে কি কোনে সার্কাস চলছে? এত হাসাহাসির কিসের?

সাফায়াত চারপাশে তাকিয়ে বলল,

কোথায় হাসাহাসি হচ্ছে? সবাই তো দেখি ফুল ছিটাচ্ছে।

তুমি দেখবে না কিছু।

ঠিক তখনি একটি থালাভর্তি ফুলের পাঁপড়ি এসে শেহজাদের মুখ বরাবর পড়লো। গোলাপের পাঁপড়িতে ঢেকে গেল তার মাথার চুল, মুখ।

থুহ করে ঠোঁটে লেগে যাওয়া পাঁপড়ি ঝেড়ে ফেলে কটমট গলায় হুংকার ছাড়লো শেহজাদ।

মুখের উপর এভাবে ফুল ছুঁড়লো কে?

ফুলকলি আর মতিবানুসহ সবাই মিলে ঘাড় ঘুরিয়ে অপরূপাকে দেখলো। অপরূপা মস্তক নামিয়ে থালাটা পেছনে লুকিয়ে সিভানের হাত চেপে ধরে মিনমিন করে বলল,

দেখলে তো।

সিভান হাসিতে ফেটে পড়ে বলল,

তুমি ফুলও ছুঁড়তে জানো না বউ?

আমি জানতাম নাকি মুখে গিয়ে পড়বে।

শেহজাদ চুল থেকে, মাথা থেকে গোলাপের পাপড়ি ঝেড়ে ফেলে অপরূপার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে চাইলো। অপরূপা চোখ তুলে তাকিয়ে আবার নামিয়ে ফেললো।

কিছু না দিয়ে শেষমেশ ফুল দিল। তাও আবার ছুঁড়ে!

অপরূপা সেখান হতে সরে পড়লো ধীরেধীরে। তটিনীরা সবাই তাকে ঘিরে ধরলো। সোহিনী বলল,

তোমার ঘুম হয়েছে?

হ্যা।

তটিনী বলল,

তোমার টুপিটা সম্রাটের পছন্দ হয়েছে। এই নাও পয়সা বাড়িয়ে দিলাম।

অপরূপা পয়সাগুলো নিয়ে হাসলো। তার প্রথম পারিশ্রমিক। হাতের মুঠোয় পয়সাগুলো চেপে ধরে দাদীজানকে স্মরণ করলো।

তটিনী বলল,

খুশি হয়েছ? আমি একটা চাদরে কিছু ফুল তুলবো। ও চাদর পড়ে তাই। তুমি করে দেবে?

জ্বি। চেষ্টা করব।

তটিনী তার গাল টেনে দিয়ে বলল,

তুমি খুব ভালো মেয়ে রূপা।

অপরূপা হাসলো। বলল,

আপনাদের সবাইকে অনেক সুন্দর লাগছে।

শবনম হেসে বলল,

লজ্জা দিওনা এভাবে।

অপরূপা মৃদু হাসলো। বলল,

আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমোবো। খুব ঝিমাচ্ছে।

সোহিনী বলল,

আচ্ছা তুমি যাও। খাওয়ার সময় আমরা ডেকে নেব। আরেকটা কথা তোমাকে হাসলে খুব ভালো লাগে। এভাবে হেসো।

অপরূপা মাথা নেড়ে বলল,

যাই?

হুমম।

অপরূপা তার কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। তাদের কক্ষটি রসাইঘরের ঠিক বাম পাশেই। কক্ষপথে পা বাড়াতেই একটি সাদা ধবধবে খরগোশকে ছোটাছুটি করতে দেখলো সে। থেমে গেল। ভাবলো,

সম্রাটের খরগোশ এখানে কি করে এল?

অপরূপা সেটির পেছনে ছুটলো।

তাকে দেখতে পেয়ে খরগোশটি পালাতে চাইলো। পালাতে পালাতে একসময় তাদের কক্ষের ভেতর ঢুকে পড়লো। মুখের ভেতর কিছু একটা। অপরূপা তাকে কোলে নিতেই মুখে আটকে থাকা জিনিসটি টেনে বের করলো। হাতে নিয়ে নিয়ে দেখলো, পুরোনো লোহার দুটো চাবি। চাবি দুটো টেনে নেয়ার সময় খরগোশের মুখ ছিঁড়ে গিয়ে রক্ত ঝড়ছে। চাবিতে রক্ত লেগে গিয়েছে। রক্ত দেখে অপরূপার হাত পা কেঁপে উঠলো। এখন কি করবে সে?

সম্রাট তো তার আস্ত রাখবে না।

চলমান…….

#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_১৭
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

হাবীবকে দেখতে চেয়েছিলে কেন রূপা?

পাটের চটের উপর ফুলকলি আর কুমু, টুনুর সাথে বসে খাচ্ছিল অপরূপা। ভাত মেখে লোকমা মুখে তোলার আগেই হামিদার এরূপ প্রশ্নে থেমে গেল সে। ইতস্তত বোধ করলো। বিব্রত মুখটা দেখে খোদেজা ভুরু কুঁচকে তাকালো। মৃদু হেসে অপরূপা জবাব দিল,

সিভানের মতো একটা লোক দেখেছিলাম পূর্বে। মনে হয়েছিল ওটা সিভানের মামা হবে। তাই দেখতে চেয়েছিলাম।

ওহহ। তাই তো বলি রূপা কেন তাকে দেখতে চাইলো। আচ্ছা খাও। আর একটু মাংস দেব?

অপরূপা ঘাড় নাড়ালো।

আচ্ছা, লাগলে বলো। এই ফুলি দেখিস ওর কিছু লাগে কিনা।

জ্বি বেগম।

সিভান রসাইঘরে পা রাখলো। অপরূপাকে দেখে কোমরে হাত দিয়ে গাল ফুলিয়ে বলল,

সুন্দর বউ তুমি আমারে রেখে একা একা খেয়ে ফেলছ?

অপরূপা লোকমা মুখে ওর দিকে চেয়ে রইলো। হামিদা বলল, তোমার রেখে মানে? তুমি তো তোমার আপাদের সাথে খাবে।

সুন্দর বউও তো আপাদের সাথে খাবে।

না আপাদের সাথে খাবে না বলছে ও। ওর নাকি ওখানে বসে খেতে লজ্জা করবে।

অপরূপা ওকে ডাকলো। সিভান ওর পাশে এসে বসলো। অপরূপা বলল,

আমি খাইয়ে দেই দুটো?

নাহ। দুটোতে হবে না।

অপরূপা হাসলো। লোকমা তুলে দিয়ে বলল,

আচ্ছা যত খেতে পারো।

হামিদা বলল,

লাই দিচ্ছ। মাথা খাবে তোমার।

অপরূপা হাসলো। শাহানা হেসে বলল,

ভাইজানদের সাথে খাবে না তুমি?

সিভান মজা করে খেতে খেতে বলল,

ভাইজানরা খাওয়ার সময় কঠিন কঠিন কথা বলে। আমার তাদের সাথে বসে খেতে ইচ্ছে করেনা। শোনো বউ, তুমি মামাকে দেখে ওভাবে হেসেছিলে কেন?

সবাই অপরূপার দিকে দৃষ্টি তাক করলো। অপরূপা কি বলবে এখন? এত মিথ্যে আর বলা যাচ্ছে না। সে সিভানের মামাকে রহমান ভেবেছিল! অথচ রহমানের সাথে এতটুকু মিল নেই লোকটার তাই বড্ড হাসি পেয়েছিল।

হামিদা বলল, তুমি বোধহয় ওর হলুদ পাঞ্জাবি দেখে হাসলে। আসলে ও এমনই। ওর পছন্দের রঙ হলুদ, কমলা, তোতা, টকটকে লাল এসব। এত বলি তারপরও শোধরায় না। ওর নাকি এসব রঙ পছন্দ।

কুমু আর টুনুরা সবাই খিকখিক করে হেসে উঠলো। অপরূপা তাদের হাসি দেখে মৃদু হাসলো। সিভান বলল, এজন্য হাসছিলে! আমি মামাকে বলব। মামা আমাকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করছে তোমার সুন্দর বউ আমাকে দেখে ওভাবে হাসছিলো কেন?

শাহানা বলল,

আচ্ছা, কেন ওকে সুন্দর বউ ডাকছো? ও কি বউ? ওর তো বিয়েই হয়নি।

অপরূপার ম্লানমুখে ভাত খেতে লাগলো। সিভানকেও খাওয়ালো। সিভান ভাত চিবোতে চিবোতে বলল,

আমি ওকে সুন্দর বউ-ই ডাকবো।

অপরূপা বলল, আচ্ছা ডেকো।

তক্ষুণি শেহজাদের প্রবেশ। গায়ে এখনো রাজকীয় শেরওয়ানি। চোখেমুখে নিদারুণ উৎকন্ঠা।
সে প্রবেশ করতেই আতরের সুগন্ধে ম ম করে উঠলো রসাইঘর। রহমানও ঠিক এমন একটা আতর দিয়েছিল অপরূপাকে। সুগন্ধিটা নাকে এলেই মনে হয় রহমান আশেপাশে আছে।

ঘেমে উঠেছে শেহজাদ। দেখতে অশান্ত, চিন্তান্বিত মনে হচ্ছে । অধীর গলায় বলে উঠলো,

আম্মা একটু গরম পানি দিন । মিঠুর মুখ থেকে রক্ত ঝড়ছে। দ্রুত করুন।

খোদেজা প্রশ্ন করে, কি হয়েছে মিঠুর?

জানিনা কি হয়েছে। ওর মুখে রক্ত দেখা যাচ্ছে।

একটু সময় দাও। পানি দিচ্ছি।

শাহানা আর হামিদা গরম পানি দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ওদিকে ফুলকলিদের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তারা আতঙ্কিত চোখে চেয়ে রইলো। শেহজাদ তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলাতে গিয়ে দেখলো অপরূপা পাতের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খাচ্ছে। সিভান তার পাশে বসে হাড্ডি চিবোচ্ছে।

_________________

নগরের মানুষকে খাবারের মোড়ক বিতরণ করা শেষ হয়েছে। নগরের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে মহামান্য ব্যাক্তিবর্গের সাথে সভা বসেছে। সেই সভায়
তিনজন লোক উপহার নিয়ে প্রবেশ করলো মহলের সদর কক্ষে।

হুজুর একটা আর্জি।

শেরতাজ সাহেব বললেন,

বলে যাও। সম্রাট উপস্থিত আছে।

উপহারগুলো নীচে রেখে লোকগুলো হাঁটুমুড়ে বসলো। শেহজাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,

সাহেব! বছর কয়েক আগে একডা বিবাহযোগ্যা কন্যার লা*শ পাইছিলাম আমাগো বাড়ির গোয়ালের পিছনে বস্তাবন্দি অবস্থায়। সেকথা হক্কলে জানে। আমার বাড়িতও দুইডা বিবাহযোগ্য কন্যা আছে। এলাকায় ডাকাতের উৎপাত বাড়তেছে দিনদিন। কন্যাদের নিয়া আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাছি। আমার রাতের ঘুম হারাম হইয়্যা গেছে। আমি আপনের কাছে আমার কন্যা দুইডার ইজ্জতের নিরাপত্তা চাই সাহেব। আমারে ফেরাইবেননা। আমারে যেকোনো একটা ফয়সালা দিন।

শেহজাদ মনোযোগ দিয়ে পুরোটা শুনে বলল,

দুই কন্যাই যেহেতু বিবাহযোগ্য সেহেতু নিকাহ পড়িয়ে দিন। যোগ্য পাত্রের সন্ধান পেলে মহলে এসে হাজিরা দিয়ে যাবেন। সমস্ত খরচাপাতি দেয়া হবে। বিনিময়ে খাজনা পরিশোধ করা থাকতে হবে। কোনো অনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত আছেন এমন তথ্য পাওয়া গেলে শাস্তি পেতে হবে। জমিতে উৎপাদিত ফসলাদির বিশ শতাংশ মহলের মজুদঘরে জমা দিতে হবে। যান। এরপরের জন বলুন।

সম্রাটের হাজার বছর আয়ু হোক” বলেই লোকটা নতজানু হয়ে বিদেয় নিল।

এরপরের লোকদুটোকে দেখে সাফায়াত বলল,

ভাইজান এরা একে অপরের প্রাণের শত্রু বলা চলে। গতকাল মারামারি করে একে অপরের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আমি তাদের খবর পাঠিয়েছিলাম খাবার বিতরণের পরেই যেন সভায় হাজির হয়। তাই এসেছে।

শেহজাদ প্রশ্ন করলো,

মারামারির বিষয়বস্তু কি ছিল?

লোকদুটো ভীতু দৃষ্টিতে চাইলো। একজন বলে উঠলো,

হুজুর তার পোলা ভেড়াপালে। আমার কন্যারে নিকাহ করবার লাগি পরাণ দিতাছিল। আমি আর আমার বেগম রাজী আছিলাম না। আমার অল্পবয়সী কন্যা দুনিয়াদারির হিসাব বুঝেনা তাই ওই রাখাল পোলার লগে পলাইছে। আমার মাথা গরম হইয়্যা গেছিল তাই আমি এরে গালাগাল করছি, আর এ আমারে মাথা ফাডায় দিছে। আমিও দিছি।

শেহজাদ কেদারায় পিঠে এলিয়ে বসে প্রশ্ন করলো,

কত বয়স কন্যার?

ষুলো বৎসর সাহেব।

শেরতাজ সাহেব বলে উঠলেন, মাথামোটা, চৌদ্দ বছরে মেয়েদের নিকাহ দিচ্ছে আর ষোল বছর কম? তারা সাবালক হয়েছে। নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারবে।

শেহজাদ বলল,

ওরা একে অপরকে পছন্দ করে?

হ, তাই কয় সাহেব কিন্তু…

কোনো কিন্তু না। ছেলের পিতাকে বলছি আপনি পুত্রবধূকে স্বসম্মানে ঘরে তুলবেন। আর কন্যার পিতাকে বলছি, আপনিও মেয়েজামাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলবেন। মারামারি করে যেহেতু দু’জনেরই মাথা ফেটেছে সেহেতু বিচার সেখানেই সমাপ্ত। এর পরের বার যদি এরূপ কোনো খবর আসে তাহলে দুজনের জায়গা অন্ধ কারাগারে। সোজা হিসেব। যান।

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে লোকদুটো প্রস্থান করলো।

সাদা রঙের পর্দা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল মহলের নারীদের জন্য। যাতে তারা ভবন চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে নীচতলার কার্যক্রম দেখতে পারে। পর্দা সরিয়ে বিচার কার্যাদি দেখতে থাকা যুবতীদের সাথে অপরূপাও ছিল। সবার সাথে সেও হেসে উঠলো লোক দুটোর পালানো দেখে। তটিনী অপরূপাকে বলল,
তুমিও সাবালিকা। পালিয়ে ভালো কাজ করেছ। দেখো রূপনগরের সম্রাট তা সমর্থন করে। উনার ফয়সালা সবসময় উত্তম হয়।

অপরূপার মুখটা মলিন হয়ে এল। যত দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে রহমান তার অনেক অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।

বিচারকার্য শেষ হওয়ায় অপরূপা তার কক্ষের দিকে পা বাড়ালো। পথিমধ্যে ডাক্তার আবুল ফজলের সামনে পড়ে গেল। খাওয়াদাওয়া শেষে অতিথিকক্ষে আরাম করছিলেন তিনি। হঠাৎ মনে হলো অপরূপার সাথে জরুরি কথা বলার দরকার তাই ছুটে এলেন। অপরূপাকে উনাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

আমাকে খুঁজতে যাচ্ছিলেন?

হ্যা রূপা। তোমার কি মনে হচ্ছে না তোমার দাদীজানের মৃত্যুটা অস্বাভাবিক? সবটা শোনার পর আমার তেমনটা মনে হচ্ছে।

অপরূপার মনে হলো পৃথিবীটা যেন দুলে উঠেছে।

অস্বাভাবিক!

হ্যা। অস্বাভাবিক। তুমি কাল আমায় বলেছ তোমার দাদীজান পানের সাথে শুকনো ফুলের পাঁপড়িও খেয়েছিল সেইরাতে।

হ্যা, দাদীজান প্রায়ই অমন খেতেন। সেদিন শুকনো ফুল ছিল না দাদীর কাছে । আমি আমার কাছ থেকে দিয়েছিলাম যেগুলো রহমান আমায় দিত।

হ্যা, তারপরের সকালেই তোমার দাদীকে মৃত দেখেছ।

অপরূপা অতি আশ্চর্যান্বিত চোখে চেয়ে বলল, কি বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন।

ফজল সাহেব সোজাসাপটা রহমানের বিপক্ষে কোনো কথা বললেন না শেহজাদের বারণ থাকায়। শুধু বললেন,

তোমার কাছে যে ফুলের মালাটা ছিল সেটাতে আমি কিছু বিষাক্ত জিনিস পেয়েছি যা দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

কি জিনিস পেয়েছেন?

কোকেইন। কোকেইন চেনো?

অপরূপা ভাবান্বিত হলো।

হ্যা। মানুষ পাগল হয়ে যায় ওসব নাকে গেলে।

হ্যা। আর পেটে গেলে মৃত্যু।

কিন্তু ফুলগুলো তো রহমান দিয়েছিল। কেন বিষাক্ত কিছু থাকবে?

সেটা রহমানই বলতে পারবে।

অপরূপাকে বিষয়টা ভাবিয়ে তুললো। রহমান তাকে ভালোবাসে। সে এমন কোনো কাজ করবে না যার কারণে অপরূপার কোনো ক্ষতি হতে পারে।

তুমি ভাবো। তারপর আমাকে জানিও কি বুঝলে।

জ্বি।

ডাক্তার চলে গেল।

___________

যাত্রাপালার শিল্পীরা গতকাল এসেছিল অভিষেক উপলক্ষে। আজ পালা বসবে। মহলের সবাই উত্তেজিত। সায়রা তটিনীরা পরিকল্পনা করছে কে কিভাবে কি পরিধান করে যাত্রা দেখতে যাবে। সাফায়াত এসে জানালো রূপাকেও তাদের সাথে নিয়ে যেতে।
সেইবার যাত্রাপালাটির পর আর কোনো যাত্রাপালায় যায়নি অপরূপা। এবার যাবে। কারণ এবার সাথে স্বয়ং সম্রাটের পরিবারের সাথে যাবে সে। ভয় নেই। ফুলকলির দেয়া নীল সাদা পোশাকটি পড়লো সে। কুমু আর টুনু সাজগোছে ব্যস্ত। কৌটো থেকে কালি বের করে কাজল পড়লো, লিপস্টিক বের করে ঠোঁট রাঙালো। তারপর মাথার চুল ঢাকলো ওড়না জড়িয়ে। অপরূপাকে বলল,

এই আসো। সাজাইয়া দেই। তোমারে আরও সুন্দর দেখাইবো।

অপরূপা হ্যা না বলে বাড়াবাড়ি না করে চুপচাপ ওদের হাতে সেজে নিল। পিতলের হাতলওয়ালা একটা আয়না ওর সামনে ধরে কুমুদিনী বলল,

কাজলচোখী তোমারি দু নয়নে আমি আমারে দেখি!

অপরূপা হেসে উঠে বলল, সুন্দর! এটা কার লেখা?

কক্ষে সায়রা প্রবেশ করতেই তার জবাব দিল,

বিন্দুবাসিনীর লেখক সম্রাট শেহজাদের। বিন্দুর অর্ধাঙ্গ তাকে মুগ্ধ চোখে দেখে বলেছিল,

কাজলচোখী তোমারি দু নয়নে আমি আমারে দেখি।
তোমার অধরো হাসিতে আমার মরণ লিখি।
আমার সারাটা নিশীথে আমি তোমারে রাখি।
শোনো হে কাজলচোখী, আমি তোমারি আঁখিতে আঁখি রাখিয়া পুষি ভালোবাসার পাখি।
আমি শয়নে-স্বপনে তোমারে দেখি, তোমারে আঁকি, তোমারে ডাকি।
কাজলচোখী তুমি জানো কি?
আমি তোমারে আমার মনের ভিতরে বড়ই যতনে রাখি।

অপরূপা মুগ্ধকন্ঠে বলল, চমৎকার। কিন্তু কি হলো শেষমেশ! বিন্দু তো কখনোই তার অর্ধাঙ্গকে ভালোবাসেনি।

কারণ বিন্দু ছিল নিষ্ঠুরপ্রিয়া।

অপরূপা বিড়বিড় করলো, নিষ্ঠুরপ্রিয়া! নিষ্ঠুর কন্যা তাও সে প্রিয়া? এমনও হয়?

****

কক্ষের দরজার কাছে এসে মিঠু আবারও থামলো। কিছু একটা নিয়ে খেলা করছে, খাচ্ছে।
অপরূপা দেখলো একটি শুকনো গাঁদাফুল। অপরূপা তার কাছে গিয়ে কোলে তুলে নিল। ফুলটা নিয়ে ফেললো। বলল,

আজ আবারও এসেছ?

খরগোশটা মুখ দিয়ে তার হাতে কিছু একটা খুঁজছে। নরম তুলতুলে মুখটা হাতে লাগতেই সুড়সুড়ি লাগলো অপরূপা। সে হাসলো।

তন্মধ্যে শেহজাদ মিঠি মিঠি ডেকে ডেকে পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসে। বিদ্যুৎ চলে যায় তখুনি। শেহজাদ লাইটার জ্বালায়। এদিকওদিক চোখ বুলিয়ে সাবধানে পা ফেলে হাঁটে।
অপরূপা মিঠিকে কোলে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। কোমল স্বরে বলে, মিঠু এখানে।

শেহজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে অপরূপাকে দেখে আগুনের লেলিহান শিখার আবছা আলোয়। অপরূপা হাসিমুখে বলে,

ও খেলছিল এখানে। আপনার কয়টা খরগোশ?

অনেক। ও মিঠু নয়, মিঠি। মিঠুর বান্ধবী।

বন্ধুকে রেখে ও বাইরে বাইরে কি করছে?

বন্ধুর সাথে রাগ করেছে হয়ত।

অপরূপা হেসে ফেললো।

ওদের আবার রাগ আছে নাকি?

আছে।

অপরূপার কোল থেকে মিঠিকে নিয়ে ফেললো শেহজাদ। চট করে লাইটার বন্ধ হয়ে যেতেই অপরূপা কেঁপে উঠলো। শেহজাদ আবারও লাইটার জ্বালিয়ে অপরূপার চুপসে যাওয়া মুখখানা আর মোটা কাজলের আলপনায় আঁকা চোখদুটো দেখে হেসে উঠে বিড়বিড়িয়ে বলল..

আমার বিন্দুবাসিনী!
কাছে তবু শত দূরের তুমি, দূরবাসিনী।

চলমান……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে