#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_১৩
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
আচ্ছা কান ধরলাম। রূপা কখন হুট করে চলে এল আমি বুঝতেই পারিনি।
শেহজাদ পেছনে হাত ভাঁজ করে গোমড়ামুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে জানালার পাশে। কর্কশ স্বরে বলল,
তোমার বোকামির জন্য আমাকে চোর উপাধি শুনতে হয়েছে। ভাবতে পারছো কি বলেছে আমাকে?
সাফায়াত করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,
চোর বললে কি তুমি চোর হয়ে গিয়েছ?
তারমানে বলতে চাইছো যে যখন ইচ্ছে আমাকে চোর ডাকাত বলে দিতে পারবে?
সাফায়াত শান্তস্বরে বলল,
কানে তো ধরলাম। এখন বলো কি পেয়েছ ওই ঘরে?
শেহজাদ পকেটে হাত দেয়। বের করে আনে দুটো মাদুলি আর, একটা ছোট্ট ফুরিয়ে আসা মোমবাতি, আর গাঁদাফুলের মালা।
সাফয়াতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
আরও কয়েকটা ছিল। বালিশের নীচে রয়ে গেছে। সেখানে তেমন কিছু নেই।
সাফায়াত ফুল আর মাদুলিটা গভীর পর্যবেক্ষণ করে, নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে শুঁকতেই কেমন একটা গন্ধ নাকে এল। শেহজাদকে দেখিয়ে বলল,
ফুলগুলোতে গন্ধ নেই।
শেহজাদ মালাটা নিয়ে শুঁকলো। বলল,
হ্যা। এগুলো রেখে দাও। কাজে লাগতে পারে। সায়রাকে বলে দেখব আর কিছু পাই কিনা।
_____________
বেলা সাড়ে চারটার দিকে হাসপাতাল থেকে ফুলকলিকে আনা হয়েছে। কালু মিয়া আর মজিদ বিপদমুক্ত। ফুলকলি সবাইকে দেখার পর বিলাপ ধরে কাঁদছে। সায়রা, সোহিনী আয়শা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। অপরূপা তটিনী আর শবনমের সাথে দাঁড়িয়ে আছে এককোণায়। মহলের পুরুষ মানুষেরা আসতেই সবাই নড়েচড়ে বসলো। শেহজাদকে দেখে ফুলকলির কান্না আরও বেড়ে গেল। শেহজাদ সবার সাথে সদর ঘরের আসনে বসে পড়লো। ফুলকলিকে উদ্দেশ্য করে বলল
কি হয়েছে?
ফুলকলি তার কাছে এসে মেঝেতে বসলো। মেঝের দিকে মাথা রেখে কেঁদেকেটে বলল,
উনি আমারে আর নিকাহ করবো না ভাইজান।
মফিজ?
হ।
তোকে কে বলেছে?
আমি জানি ভাইজান। আমারে নষ্টা ডাকবো সবাই।
মফিজ আগে সুস্থ হোক। তারপর দেখা যাবে। এখন যাহ।
ফুলকলি উঠে দাঁড়ায়। কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় অন্দরমহলের ভেতর।
শেহজাদ বাকিদের দিকে চোখ তুলে তাকায়। প্রশ্ন করে,
তোমরা কিছু বলতে চাও?
তটিনী মাথা নাড়ায়।
তাহলে ভেতরে যাও।
সবাই চলে গেল।
তারা যেতেই শেহজাদ বলল,
আপনাদের একটা কথা বলা হয়নি পালার জন্য নারীশিল্পী পেয়ে গিয়েছি। কাল পালা বসছে।
ভালোই। আমরা চিন্তায় ছিলাম। এবার সাবধানে থাকবে। আবার না আক্রমণ নয়। তাহলে কিন্তু সুনামহানি ঘটবে তোমার যাত্রাপালা আর রূপনগরের।
এমন কিছুই হবে না আব্বাজান।
আর পুলিশের কি খবর?
তারা তাদের কাজ করছে। এই ডাকাত দল আবার বেরিয়েছে তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। এখন আবার রূপনগরে তাদের নজর পড়েছে। আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।
শাহজাহান সাহেব বললেন,
আমি আতঙ্কে আছি। সেই পনের বছর আগের মতো ভয় আমাকে কাবু করছে পুত্র। মনে হচ্ছে আরও বড় বিপদ আমাদের সন্নিকটে। কেমন কু ডাকছে মনটা। শান্তি পাচ্ছি না।
শেহজাদ বাবাকে আশ্বাস দেয় হাতের উপর হাত রেখে,
আপনি আমার উপর বিশ্বাস রাখুন আব্বা। এতটা নিরাশ হবেন না, সাহস হারাবেন না। আপনারা আমার শক্তি।
আমি তোমাকে নিয়ে ভয় পাই। তুমি সাবধানে থেকো।
শেরতাজ সাহেব নতবদনে বসে থাকেন। পনের বছর আগের বীভৎস সেসব ঘটনা আজও বিস্মৃতির পাতায় জীবন্ত। মনে করতে চান না। কিন্তু তারপরও মনে পড়ে। মনে পড়ে এক কুহকিনীকে ভালোবেসে নিজের সর্বস্ব হারানোর কথা, মনে পড়ে মহলের সেই দুর্দিনের কথা।
সদর দরজা দিয়ে বাগানের মালী কুদ্দুস উঁকি দিল। বলল,
হুজুর একজন ডাক্তার এসেছেন। বাইরে অপেক্ষা করছেন।
শেহজাদ বলল,
আসতে দাও।
জ্বি হুজুর।
সদর দরজা দিয়ে সদর ঘরে প্রবেশ করলো লম্বা এক মধ্যবয়স্ক ডাক্তার। আধপাকা দাঁড়ি, সাদা চুল, চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা। এসেই হাত মিলালেন সবার সাথে। শাহাজাহান সাহেব বললেন,
আপনি? চিনি কিন্তু মনে পড়ছে না।
লোকটা বললেন,
সাইক্রিয়াটিস্ট আব্দুল ফজল। রূপনগরের সম্রাটের ডাক পড়েছে, দেরীতে আসাটা বেমানান। তাই খবর পাওয়া মাত্রই রওনা দিয়েছি।
শেহজাদ প্রসন্ন হেসে বলল,
আমি খুশি হয়েছি।
মতিবানু নাশতা পানি নিয়ে এল।
খাওয়াদাওয়া, আর গল্পসল্প হওয়ার পর ফজল সাহেবকে নিয়ে মহলের ছাদে চলে গেল সাফায়াত আর শেহজাদ। সাদা পুরু রেলিঙ ঘেরা ছাদের মধ্যিখানে বসানো আরাম কেদারায় বসলো তিনজন। ছাইদানিতে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ফেলে ফজল সাহেব সামনে রাখা ফুল, মোমবাতি আর মাদুলি গুলির দিকে তাকালো। শেহজাদ বলল,
এসব পেয়েছি রূপার ঘরে। আপনাকে চিঠিতে এসব উল্লেখ করা হয়নি কারণ এসব আজ পেয়েছি। আমি যখন চিঠি লিখছিলাম তখন আমি ট্রলারে ছিলাম। সুভার কাছ থেকে সবটা শুনে মনে হয়েছিল আপনি এসবের সমাধান দিতে পারবেন।
ফজল সাহেব মনোযোগ দিয়ে মালাটা দেখেন। নেড়েচেড়ে শুঁকেন। তারপর দু’হাতের তালুতে ঘষতেই পাপড়ির সাথে সাথে সেখান হতে সাদা পাউডারের মত বস্তু ছড়িয়ে পড়ে। এতগুলো বছর ধরে মানসিক রুগী নিয়ে আদিনক্ষত্র বিচার করায় এবস্তু সাথে সাথে চিনে ফেললেন ফজলু সাহেব। বেনজয়েলমিথাইলএকজোনিন। কিছুটা অদলবদল করে যাকে সবাই কোকেইন নামে চেনে।
শেহজাদ বলল,
কি দেখলেন?
ফজলু সাহেব চশমা ঠেলে গম্ভীরমুখে বলেন,
সাদা পাউডারগুলো দেখতে পাচ্ছেন?
হ্যা।
এসব কোকেইন।
কোকেইন?
শেহজাদের কন্ঠে বিস্ময়। চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সাফায়াত বলল,
কো*কেইন? যেগুলো নাকে গেলে নেশা হয়? ফুলের মধ্যে কো*কেইন পাউডার?
হ্যা।
রূপা নামের মেয়েটাকে এইসব ফুলের মাধ্যমে কোকেইনের নেশা করতে সাহায্য করত রহমান। আর রূপার নাকের নীচে ঘা’র কথা বলেছিলেন আপনি। তাও হয়েছে এই কো*কেইন বাষ্প শুঁকার কারণে।
শেহজাদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। বলে,
আর মাথার তালু, পায়ের তালু জ্বলার কারণ?
ফজল সাহেব মাদুলির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন,
হয়ত এটাতে তার উত্তর আছে।
শেহজাদ মাদুলি হাতে নেয়। মোমবাতির মোমের সাহায্যে মাদুলির মুখ আঁটা। শেহজাদ দেশলাইকাঠি জ্বালিয়ে মোম গলিয়ে মাদুলির মুখ উন্মুক্ত করে দিতেই সেখান হতে পঁচারক্তের ঘ্রাণ টের পায় ফজল সাহেব। শেহজাদ আর সাফয়াত সইতে না পেরে সরে পড়তেই ফজল সাহেব বলেন,
অপরূপা কালাজাদুর শিকার।
শেহজাদ আর সাফায়াত পুনরায় ধাক্কা খায়। মস্তিষ্কে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করে শেহজাদ। কালাজাদু! এ তো মহলের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এক অশুভ শব্দ।
এ কি করে সম্ভব ডাক্তার!
ফজল সাহেব মাদুলিগুলো ঘেটে ঘেটে বললেন,
ব্লাক ম্যাজিক! এসব এক প্রকার নিষিদ্ধ চর্চা। ওরা বস্তুত লুসিফার নামের শয়তানের পূজা করে এবং শয়তানের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কিছু সাধারণ মানুষকে বেছে নেয়। এরা স্কপোলামিন, এসএসডি, গাজা বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্যের সাহায্যে মাধ্যমটির হ্যালোসিনেশন ঘটায়। আর তন্দ্রাচ্ছন্ন মাধ্যম তখন পরাবাস্তব জগৎ চোখের সামনে দেখতে পায় এবং তাদের বিশ্বাস মতে সাক্ষাৎ শয়তান মাধ্যমের দেহে এসে ভর করে।
শিউরে উঠার তথ্য হল, এইসব মাধ্যম কাজ করে অনেকটা দম দেওয়া পুতুলের মত। তারা যা আদেশ পায় তাই করে।
রূপা সেই মাধ্যম, রূপা-ই পুতুল। সে যা আদেশ পাচ্ছে তাই করছে।
মেয়েলী হাসির শব্দ ভেসে এল ছাদের দরজার দিক থেকে। তারা তাকাতেই দেখতে পেল মহলের মেয়েরা। সবার পেছনে অপরূপা। সে নিঃশব্দে হাসছে একদম চোখ বন্ধ করে। হাসতে হাসতে বাকিরা ঢলে পড়বে অবস্থা এমন। শেহজাদ’দের দেখে সবার হাসি থেমে গেল এক লহমায়। অপরূপার হাসিও থেমে গেল।
শেহজাদ দাঁড়িয়ে পড়লো। ফজল সাহেবও দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন
হাই লেডিস!
সাহস দেখিয়ে তটিনী হেসে এগিয়ে এল। সে এখন কলেজে পড়ছে। সে এগিয়ে গিয়ে বলল
আসসালামু আলাইকুম। আমি তটিনী।
ওয়ালাইকুমুস সালাম! আর তোমরা?
সবাই একে একে পরিচয় দিল। ফজল সাহেব অপরূপার দিকে তাকালো। আয়শা বলল,
ও রূপা। আমাদের..
অপরূপা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
না আমার নাম রূপা নয়, আমি অপা। পুরো নাম অপরূপা। আপনি আমাকে অপা নামে ডাকতে পারেন।
শেহজাদের মেজাম চড়া হয়। অপরূপার দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না সে। ছাদ থেকে দ্রুতপায়ে নেমে গেল। যে করেই হোক রহমানকে খুঁজে বের করতেই হবে।
শেহজাদের পিছুপিছু সাফায়াতও নেমে এল। ফজল সাহেব ছাদে সবার সাথে গল্প করতে লাগলেন। অপরূপার সহ্য হলো না লোকটাকে।
চারিদিকে অন্ধকার নামিয়ে সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। শেহজাদ গাড়ি নিয়ে বেরোতে যাবে তার আগেই পুলিশের গাড়ি এসে থামলো মহলের সামনে । পুলিশ অফিসার কবির বেরিয়ে এসে বলল,
শেহজাদ সাহেব! রহমানের খোঁজ পাওয়া গেছে।
কে সে? কোথায় থাকে?
তা জানিনা। তবে সে কাঁচামালের ব্যবসা করতো। তার নাম রহমান নয়। তার নাম সামাদ। তার কোনোপ্রকার নিদর্শন পাওয়া যায়নি এখনো পর্যন্ত। কিন্তু খুব শীঘ্রই আমরা সামাদকে ধরতে পারব। আপনি আমাদের উপর বিশ্বাস রাখুন।
আমার বিশ্বাস আছে আপনাদের উপর।
শেহজাদকে বিষয়টা আরও ভাবিয়ে তুললো। পুলিশরা যেতেই শেহজাদ গাড়িতে উঠতে যাবে তখনি অপরূপা মহল চত্বর পেরিয়ে ছুটে এল।
দাঁড়ান। দাঁড়ান।
শেহজাদ দাঁড়িয়ে গেল। উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলো। অপরূপা বলল,
পুলিশ কি রহমানের কোনো খবর এনেছে?
শেহজাদ মৃদু হেসে উঠলো।
উত্তর না দিয়ে হাসছেন কেন? ডাকাতের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না? ইচ্ছে না হলে বলবেন না। আমারও কোনো চোরের সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই।
শেহজাদ গাড়িতে উঠে বসলো।
অপরূপা কুপিত চোখে চেয়ে রইল তার নীরবতা।
শেহজাদ গাড়ির জানালা দিয়ে গলা বের করে অপরূপার দিকে তাকিয়ে বলল,
উত্তর পেলে সেদিন তুমি আমার সামনে আর আসবে না। তার চাইতে উত্তর না পাওয়াটাই ভালো।
গাড়ির হর্ন বেজে উঠতেই অপরূপা গাড়ির নিকটে গিয়ে বলল,
কি বলতে চাইছেন?
মানে বলতে চাইছি তুমি অসুস্থ।
এখন আমি অসুস্থ! মানে পাগল?
হ্যা।
অপরূপা রোষানলে দগ্ধ হতে হতে ফুঁসে উঠে বলল,
আপনি উন্মাদ।
হ্যা রূপার ভালোর জন্য।
আমি রূপা নই।
জানি। তুমি শতরূপা।
চলমান……