প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-১৪+১৫

0
520

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_১৪
,
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে আরো দুটো মাস, সেদিন ইমেইল পাওয়ার পরেরদিনই সমুদ্র চলে গেছে তার কাজের জায়গায়। বাড়িতে শুধু শশী শাহানারা এবং জয়। শশীর পরিক্ষা চলছে এই জন্য শশীও গ্রামে চলে গেছে। আজকে শশীর শেষ পরিক্ষা আর দুইদিন থেকেই আবার শহরে ফিরে যাওয়া লাগবে। ফাইল হাতে গাড়ি থেকে নেমে মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। চাইলে মেইন রাস্তা থেকে ভ্যানে একেবারে বাড়ির সামনে নামা যায় তবে শশী সেটা করেনি। অনেকদিন নিজের বাড়ি থেকে গ্রাম থেকে দূরে থাকায় যেনো মায়াটা আরো বেশি পড়ে গেছে। দুইদিন পরতো আবার চলে যাওয়া লাগবে এইজন্য পরিবেশটা উপভোগ করার জন্য এইটা করলো। শশী হাঁটতে হাঁটতে সেই পেয়ারা গাছের নিচে এসে থেমে গেলো আজ থেকে কয়েকমাস আগে ঠিক এই জায়গাটায় সমুদ্রের সাথে ওর প্রথম দেখা হয়েছিলো। একটা উঁচু পাহাড়ের মতো লোক গম্ভীর স্বরে শশীকে জিগাস করেছিলো, এই মেয়ে জামশেদ মাস্টার এর বাড়ি কোনটা চিনো? শশী সমুদ্রের মতো বলার চেষ্টা করে নিজে নিজেই হেসে ফেললো। তখন ওই লোকটাকে একদম পছন্দ হয়নি কিন্তু এই কয়েকটা মাসে ওই লোকটার সম্মন্ধে যতটা জেনেছি যেনো ততই ওই লোকটার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। আসলেই লোকটার নামের মতো সেও অনেক গহীন ওনার গভীরে যেতে গেলে ডুবে যেতে হবে। সমুদ্র যাওয়ার পর শশীই ওই ঘরটাকে পরিষ্কার রাখতো কেনো জানি বেশ টানতো ঘরটা। প্রথমে অবুঝ মন কিছু বুঝতে না পারলেও আস্তে আস্তে ঠিক বুঝে গেছে আসলে টানটা কিসের জন্য ছিলো। হাতের ছোট্ট ঘড়ির দিকে তাকাতেই শশীর টনক নড়ল ভাবতে ভাবতে এখানেই বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছে। তড়িঘড়ি করে সামনে এগোতেই দেখলো শাহিন তার দুজন সাঙ্গদের নিয়ে ওর দিকেই আসছে। শশী দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটাতে গেলে শাহিন সামনে দাঁড়িয়ে বলল।

কিরে শহরে গিয়াতো দেহি আরো বেশি সুন্দর হইয়া গেছোস। তা ওই সমুদ্র বুঝি বেশ আদর করে? আচ্ছা আমার একটা প্রশ্ন তোদের কি আদেও বিয়েটা হইছে? নাকি এমনে এমনেই ওরে মজা দিতাছোস।

দেখ শাহিন তোর সাথে এসব ফালতু কথা বলার সময় আমার নাই রাস্তা ছাড় দেরি হচ্ছে আমার।

হ রাস্তাতো ছাড়বোই তবে আমি কিন্তু একটা গোপন কথা জানি যেইটা গ্রামের কেউ জানে নাহ। ওই সমুদ্রের লগে তোর বিয়া হইনাই তুই আর তোর বাপ গ্রামের সবাইরে বোকা বানাতে পারলেও আমারে পারবি নাহ। তা বিয়া ছাড়াইতো তুই ওরে সব দিচ্ছিস বলি আমারেও একটু ছিটেফোঁটা দে আমরাও খুশি থাকি কি বলিস তোরা। কথাগুলো বলেই শাহিনসহ সবাই হাসাহাসি শুরু করল। ওদের কথায় শশীর রাগে লজ্জায় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গাল বেঁয়ে পড়ল। কথাটা তো সত্যিই বিয়ে ছাড়া এভাবে আরেকজন এর বাড়িতে থাকলে মানুষ তো আজেবাজে কথা বলবেই। শশী কিছু না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলো শাহিন শশীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হেসে কমর থেকে ফোনটা বের করে কারো কাছে ফোন দিলো।

হ আম্মা আপনার কাজ শ্যাষ এখন দেখি ওই শশী কেমনে আমারে ছাইড়া সমুদ্রের কাছে যায়। আপনার কথা মতোই সব হচ্ছে তবে দিন শেষে কিন্তু শশীকে আমার চাই।

ওপাশ থেকে কি বলল সেটা বোঝা গেলো নাহ তবে শাহিনের মুখে হাসি ফুঁটে উঠল। হয়ত ওপাশের থাকা ব্যাক্তি শাহিনের মন মতোই উত্তর দিয়েছে।
,,,,,,,,,,
মাস্টার বাড়ির সামনেই সাদা রঙের গাড়িটা এসে থামল জয় গাড়ি থেকে নিচে নেমে একবার বাড়িটার দিকে তাকালো। তারপর আবার ভিতরে গিয়ে মায়ের হাত ধরে সাবধানে মাকে নিচে নামিয়ে আনলো। তার বরাবরই ইচ্ছে ও ওর বড় ভাইয়ার মতো হবে। সেই জন্যই তো ওর বড় ভাইয়া যাওয়ার সময় ওকে দুটো দায়িত্ব দিয়ে গেছে সেই দায়িত্বই ও এখন পালন করছে। গাড়ির দরজা বন্ধ করে মাকে নিয়ে গেট দিয়ে ভিতরে গেলো, এক হাতে মাকে ধরে রাখলেও তার দু চোখ অন্য কাউকে খুঁজতে ব্যাস্ত। কারণ সব খবর যদি ঠিকঠাক ভাবে তার বড় ভাইয়াকে না দিতে পারে তাহলে সে কীভাবে একজন বড় অফিসার হবে। বাড়ির মধ্যে থেকে একে একে সবাই বেরিয়ে আসলো, শশী এসে শাহানারা কে জড়িয়ে ধরতেই শাহানারা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

কি হয়েছে তোর এতো করে ফোন করে বললাম জামশেদ ভাই এর সাথে চলে আয় কিন্তু মেয়ের সেই এক কথা যাবো নাহ। তাইতো বাধ্য হয়ে আমাকেই আসতে হলো এখন বল কি হয়েছে যাবি না কেনো?

শশী কিছু বললো নাহ চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, আমি আর ওবাড়ি যাবো নাহ।

ওদিকে জয় শশীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে সব নোট করছে। বাড়ি আসার এক মাসের মধ্যে আগের থেকে একটু চিকন হয়েছে, আগের মতো আর দুষ্টুমি করে নাহ। বেশ খানিকটা ফর্সা হয়েছে আর আরো বেশি সুন্দরী হয়ে গেছে। এই কথাগুলো মনের খাতায় নোট করে রাখল। পারভীন এগিয়ে এসে শাহানারার পাশে দাঁড়িয়ে বলল।

আরে আপা এসব কথা পরে হবে আপনি আগে ভিতরে চলেন তো। এতো দূর থেকে এসেছেন আপনি তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

সবাই ভিতরে চলে গেলো জয় পিছন পিছন যেতে গিয়েও থেমে গেলো সামনে তাকিয়ে দেখে জোনাকি দুহাত পিছনে দিয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে ঢুলছে আর মিটমিট করে হাসছে। জয় সমুদ্রের মতো ভাব নিয়ে ওর মতো হাঁটা চেষ্টা করে হেলেদুলে জোনাকির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি এভাবে আমাকে দেখে হাসতেছো কেনো?

জোনাকি কিছু বলল না হাসতে হাসতে দৌড়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেলো। জয় কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে নিজেই নিজেকে বলল, এই মেয়ের থেকে সাবধানে থাকতে হবে মেয়েটা খুবি বিপদজনক।
,,,,,,,,,
ধান কাটা হয়েছে উঠান জুড়ে যেনো ধানের মেলা বইছে। বাড়ির মহিলারা একসাথে কাজে মগ্ন শশী উঠানের এক পাশে পেতে রাখা চড়াটের উপর বসে বসে পা দুলাচ্চে। তখনি দেখলো গেট দিয়ে শাহিনসহ গ্রামের আরো কিছু বয়স্ক লোক ওদের বাড়ির দিকেই আসছে। শশী উড়নাটা মাথায় দিয়ে দৌড়ে ঘরের ভিতর চলে গেলো, এই ভর দুপুরে এভাবে বাড়ির উপর ওনাদের আসতে দেখে জামশেদ মাস্টার বড়ই চিন্তিত মুখে সেদিকে এগিয়ে গেলো। চেয়ারম্যান বেশ ব্যাঙ্গ করেই বলল, কি মাস্টার তুমি গ্রামের মধ্যে এসব কি শুরু করেছো। নিজে মাস্টার হয়ে বাড়ির মেয়েদের দিয়ে এসব আকাম কুকাম করালে স্কুলের ছেলেমেয়ে তোমার কাছ থেকে কি শিখব?

সারাজীবন সবার সামনে মাথা উঁচু করে সম্মানের সহিত চলা জামশেদ মাস্টার হঠাৎ এই কথাটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি মনে মনে এতোদিন ধরে যেই ভয়টা পাচ্ছিলেন তাহলে কি শেষ পযন্ত সেটাই হলো? এবার ওনি কি করবেন একটা মিথ্যা ঢাকতে গিয়ে এতোগুলো মিথ্যা বলেও কোনো কাজ হলো নাহ। এই জন্যই হয়ত বলে সত্য কখনো চাপা থাকে নাহ, তবুও ভিতরে ভিতরে নিজেকে যথা সম্ভব ঠিক রেখে বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন।

মুখে লাগাম দিন চেয়ারম্যান সাহেব কোথায় দাঁড়িয়ে কি কথা বলছেন সেটা একবার ভেবে দেখুন। আপনি কিসের ভিত্তিতে আমার বাড়ির উপর এসে এভাবে আমার মেয়েকে আজেবাজে কথা বলছেন।

চোরের মায়ের বড় গলা শোনো মাস্টার আমরা সব জানি তুমি যে কত বড় চালবাজ সেটা আমরা ঠিক বুঝে গেছি। খুবতো আমাদের বোকা বানিয়ে নিজের অবিবাহিত মেয়েকে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিলে তাও আবার সেই বাড়িতে যেখানে কিনা দুটো জোয়ান জোয়ান ছেলে থাকে। ছিঃ ছিঃ মাস্টার আমরা অন্তত তোমার থেকে এমনটা আশা করেনি।

জীবনে এই শেষ বয়সটায় এসে এভাবে সবার সামনে অপমানিত হতে হবে কখনো কল্পনাও করেননি জামশেদ মাস্টার। হঠাৎই বুকের মধ্যে কেমন চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। ক্রমে ক্রমে ব্যাথাটা বেড়েই চলেছে, স্বামীর আসন্ন পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ধূলো মাথা হাতেই পারভিন তাকে ধরল। ততক্ষণে মাস্টার নিচে মাটিতে বসে পড়েছে নিশ্বাস নিতে খুবি কষ্ট হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে এই বার শ্বাস ছাড়লে বুঝি আর পরের শ্বাসটা নিতে পারবে নাহ। হাতের মুটোই থাকা ফোনের স্কিনে জামশেদ মাস্টার এর এহেন অবস্থা দেখে ইজি চেয়ারে দুলতে দুলতে মুখ দিয়ে চুঁ চুঁ শব্দ করে বাঁকা হেসে বেশ আফসোসের স্বরেই মালবিকা বলল।

আজ শুধু মাত্র তোমার জন্য একটা পরিবারের উপর এতোটা বিপদ নেমে আসলো সমুদ্র। এবার তুমি কি করবে? চাইলেও তুমি ওখানে যেতে পারবে নাহ আর বাঁচানো তো দূরে থাক। ঠিক এভাবেই তোমার কাছের মানুষগুলো কে আস্তে আস্তে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দেবো। আমি তোমার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি সমুদ্র তোমারও শেষ পরিনতি ওমনি হবে যেমনটা অভিক এর হয়েছিলো।
,,,,,,,,,
মাথায় তেল পানি বসায়ে বুকেও খানিক তেল ডলে দিলো পারভিন। খুব কমল স্বরে স্বামীকে জিগাস করলো, এখনো কি আপনার বুকের মধ্যে বেথ্যা করছে?

প্রতিউত্তরে কোনো জবাব দিলেন নাহ জামশেদ মাস্টার, শাহানারা পাশে বসে অপরাধী স্বরে বললেন, আজকে এসব আমার জন্যই হচ্ছে আমি যদি সেদিন শশীকে না নিয়ে যেতাম তাহলে এমনটা হতো নাহ।

আপা আপনি কেনো নিজেকে এভাবে বলছেন আসলে কি বলুন তো কিছু মানুষের কাজই এমন যারা শুধু একটু সুযোগ খুঁজে কীভাবে অন্যকে হেনস্তা করা যায়। জন্মেছি তো এই গ্রামে তাই প্রতিটা মানুষ কে খুব ভালো করে চিনি কে কি রকম। আপনি চিন্তা করবেন নাহ আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো দেখি ওনারা কি করতে পারে।
,,,,,,,,,
ছোট্ট টেবিলের উপর অযন্তে ফেলে রাখা ফোনটা এই নিয়ে বিশবার বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। ফোনের মালিক ফোনের কাছে না থাকায় ফোনটা এভাবে অবহেলায় পড়ে আছে। কিন্তু ওপাশ থেকে যে কল দিচ্ছে সে হয়ত বড়ই ধৈর্যশীল নয়ত বিশ বারের মাথায় কল না ধরলে পুনরায় পুরো দমে আবার সে একুশ বারের মতো কল দিতো নাহ। ক্লান্ত শরীলে তাবুর মধ্যে প্রবেশ করলো সমুদ্র ওরা একটা মিশনে আছে যার জন্য আপাতত গহীন জঙ্গলেই দিনরাত্রী যাপন করা লাগছে। পায়ের জুতোটা খুলে মোজাটা খুলতেই পায়ে ঠান্ডা বাতাস লাগতেই বেশ আরাম অনুভব করলো। আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ঘা হয়ে গেছে টানা ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতে পা ভিজিয়ে রাখা কাঁদার মধ্যে দৌড়ানো নিজের অযন্তের ফলেই এই অবস্থা। গাঁ থেকে ইউনিফর্ম টা খুলে পাশের দড়িতে ঝুলিয়ে রাখলো। পড়নে আর্মি প্যান্ট আর সাদা সেন্টু গেঞ্জি, দুহাতের কব্জিতে লম্বা লম্বা কাঁটাদাগ এগুলো জঙ্গলের মধ্যে দৌঁড়ানোর সময় লেগেছে। মাটিতে পেতে রাখা নাম মাত্র বিছানায় নিজের শরীলটা এলিয়ে দিলো। তখনি শুনতে পেলো তার সাইলেন্ট করে রাখা ছোট্ট ফোনটা বেজে চলেছে। হাত টানা করে ফোনটা সামনৈ ধরতেই কলটা কেটে গেলো, পুনরায় কল আসার আগেই সমুদ্র নিজেই কল দিলো।

#চলবে?

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_১৫
,
মাস্টার বাড়ির উঠানে আবার ও বিচার সভা বসেছে, আশেপাশের অনেক মানুষই সেখানে উপস্থিত। মূলত তারা মজা নিতে এসেছে কালকের চায়ের দোকানের গল্পের মূল মাথা এটা করার জন্য।একটা চেয়ারে জামশেদ মাস্টার ও বসে আছে বাড়ির মেয়ে বউয়েরা ঘরের সামনে মাথায় কাপড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা কাশি দিয়ে চেয়ারম্যান বলতে শুরু করলো, আমি আর কি বলবো আপনারা তো নিজের চোখেই সব দেখছেন। এই মাস্টার আমাদের সবাইকে ঠিক কীভাবে বোকাটাই না বানালো। ছিঃছিঃ গ্রামের এই প্রথম কোনো মাইয়া শহরে গিয়ে এমন আকাম কুকাম করলো। এখন আপনারাই বলেন এর কি বিচার করা যায়।

চেয়ারম্যান এর কথার সাথে সম্মতি দিলো আশেপাশের মানুষ কানাঘুষা করছে ছিঃ ছিঃ করছে। কেউ কেউ বলছে নিজে মাস্টার হয়ে বাড়ির মেয়েকে ভালো শিক্ষা দিতে পারেনি। এসব কথা জামশেদ মাস্টার চোখ বন্ধ করে হজম করছে তিনি কোনো কথাই বলছে নাহ। তখন শাহিন ভিড়ের মধ্যে থেকে একটু সামনে এগিয়ে এসে বলল, আমি একটা কথা বলতে চাই। আমি এর আগেও বলেছি আমি শশীকে বিয়ে করতে চাই কিন্তু আগের বার তো ওনারা আমাদের বোকা বানিয়ে মেয়েকে শহরে পাঠায় দিলো। কিন্তু আমার তবুও কোনো আপত্তি নাই আমি বিনা দ্বিধায় শশীরে বিয়ে করতে রাজি এখন বাকিটা আপনারা যা ভালো বোঝেন।

ছেলের কথাশুনে চেয়ারম্যান বুক ফুলিয়ে একটা হাসি দিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলল, বাহ এই হলো চেয়ারম্যান এর পোলা। আমার পরে এই পদে একমাত্র তুই বসার যোগ্য। দেখো মাস্টার দেখো এতোকিছুর পরেও আমার ছেলে তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি। এমন জামাই এই হিজলতলী খুঁজলেও একটা পাবা না তো আমার শেষ কথা হলো হয় মেয়েকে বিয়ে দেও নয়ত তোমাদের একঘরে করা হবে। কি কন আপনারা?

চেয়ারম্যান এর কথায় ওখানে থাকা সবাই সায় দিয়ে বলল, হ হ চেয়ারম্যান সাহেব একেবারে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন যদি শশীকে বিয়ে দেওয়া না হয় তাহলে ওর দেখাদেখি গ্রামের আরো সবাই সাহস পাবে এই কাজ করতে। শাহিন বাঁকা হেসে নিজের বাপের দিকে তাকালো চেয়ারম্যান ও হাসি দিয়ে বেশ আয়েশ করে চেয়ারে বসে বলল, তাহলে এই কথাই থাকলো আজকে রাতের মধ্যে বিয়া তাহলে চলেন আমরা সবাই এখন উঠি। মাস্টার তোমার তো কপাল খুলে গেলো তুমি আমার বিয়াই হতে যাচ্ছো।

এই বিয়ে হবে নাহ আপনারা যা করার করেন।

চিকন মেয়েলি গলায় এই কথাশুনে সবাই সেদিকে তাকালো, চেয়ারম্যান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো শশী উঠানের মাঝে দাঁড়িয়ে কথাটা বলেছে। কথাটা বলে শশী পিছনে থাকা তার আব্বার দিকে তাকালো মেয়ের তাকানো দেখে জামশেদ মাস্টার চোখের পাতা ফেলে মাথা নাড়িয়ে মেয়েকে ভরসা দিলো যেনো চোখের ভাষায় বলে দিচ্ছে মা তুই আজকে বল সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দে। বুঝিয়ে দে সবাইকে জামশেদ মাস্টার তার মেয়েদের সঠিক শিক্ষায় দিয়েছে। বাবার থেকে চোখ ফিরিয়ে মাথার উড়নাটা ঠিক ভাবে টেনে নিলো। চেয়ারম্যান রেগে বলে উঠল, এটা কেমন ব্যাবহার, মাস্টার তোমার মেয়েকে বলো এখান থেকে যেতে তুমি বলোনি তোমার মেয়েকে বিচার সভায় মহিলাদের এভাবে আসা সঠিক নয়।

আমার আব্বা আমাকে সঠিক শিক্ষায় দিয়েছে আমি শুধু এখানে কয়েকটা কথা বলার জন্য এসেছি বলা হয়ে গেলে চলে যাবো।

মেয়েদের এতো বেশি কথা বলা ঠিক নয়। ওখানে থাকা একজন এই কথাটা বলতেই শশী তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, হ্যাঁ ঠিকি বলেছেন মেয়েদের বেশি কথা বলা উচিত নাহ। কারণ তারা যদি মাথা তুলে উচিত কথা বলা শুরু করে তখন আপনারা তাদের উপর আধিপত্য দেখাতে পারবেন নাহ। আর চেয়ারম্যান কাকা আপনি কি বললেন আমি শহরে গিয়ে আকাম কুকাম করে বেড়াচ্ছি আচ্ছা আপনি কি আমাকে ওইসব আকাম কুকাম করার সময় দেখেছেন? নাকি হাতেনাতে ধরেছেন কোনটা? না দেখে না জেনে নিজের মতো করে বানিয়ে দিলেন একটা কথা বাহ। মানে একজনের বাড়িতে কোনো ছেলে থাকলে সেই বাড়িতে যাওয়া মানে আকাম কুকাম করা? তাহলে আপনার বাড়িতেও তো আপনার ছেলে আছে তাহলে কি আপনার বোনের মেয়ে আপনার বাড়িতে আসে নাহ? এখানে সবার বাড়িতেই তো ছেলে আছে তো আপনাদের বাড়িতে কোনো মেয়ে আসে নাহ? আর আপনি কি বললেন আমার চরিত্রের ঠিক নাই কারণ ওইদিন ক্লাবঘরে আমাকে সমুদ্রের সাথে দেখেছেন তাই। তো এখানে আমার একটা প্রশ্ন আপনারা কেউ কি আমাকে আর ওনাকে খারাপ অবস্থায় পেয়েছিলেন? শাহিন গিয়ে আপনাদের বলল আর আপনারা সেই কথা অনুযায়ী কোনো কিছু না দেখেশুনে চলে আসলেন বিচার করতে। আচ্ছা মানলাম আমি সমুদ্রের সাথে খারাপ কিছু করার উদ্দেশ্য ওই ঘরে গিয়েছিলাম আর শাহিন তা দেখেছে তাহলে শাহিন তখনি আপনাদের ডেকে আনলো না কেনো? ওতো জানতো আমার পরিবারের লোকজন আমায় খুঁজতেছে তাহলে সে তখন গিয়ে বললো না কেনো? এখানে থাকা প্রতিটা মানুষই এসেছেন মজা নিতে কেউ সঠিক বিচার করতে আসেননি।

এইটুকু বলে শশী ওর চোখের পানি মুছে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিলো এইটুকু বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। বিচার করতে আসা সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ী করছে চারপাশে শুধুই ফিসফাস কথার আওয়াজ। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে শশী আবার বলতে শুরু করলো, আমি এখন এই রাতেই শহরে যাবো এবং ওই বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করবো আপনাদের যা করার আছে আপনারা করেন। কি করবেন আমাদের একঘরে করে দিবেন তো ঠিক আছে করে দিন একঘরে, দরকার নাই এমন প্রতিবেশী যারা চোখ থাকতেও অন্ধ ঙ্গান থাকতেও নির্বোধ।

নিজের মন মতো সবটা বলা শেষে শশী দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেলো। শাহানারা কানে ফোন রেখেই মুচকি হেসে ওপাশে থাকা সমুদ্র কে বলল, আমি আজকে সত্যিই অনেক খুশি তুই এই চাকরিতে যাওয়ার পর থেকেই সব সময় ভয়ে থাকতাম তোর উপর ভীষণ অভিমান হতো। তোকে হারানোর ভয় হতো, তোর বাবাকে হারিয়েছি অভিককে হারিয়েছি আমি অনেক ক্লান্ত তোর কিছু হলে সেটা সয্য করতে পারতাম নাহ। তবে তুই আজকে যেটা করলি এখন আর কোনো অভিমান নেই তোর উপর এটা দরকার ছিলো কিছু মানুষের ভুল তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার দরকার ছিলো যেটা শশী করেছে।

আমি চাই না আমার কারণে কোনো পরিবার এভাবে হেনস্তা হোক। এখানে আমার ও ভুল ছিলো মা তাই আমার যেটা ভালো মনে হয়েছে সেটাই করেছি। এখন তাহলে রাখছি অনেক ক্লান্ত লাগছে একটু ঘুম প্রয়োজন রাতে সময় পেলে কথা বলবো।

কথাশেষ করে সমুদ্র কান থেকে ফোন নামিয়ে পাশে রেখে দুইহাত মাথার নিচে দিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো ভাবতে লাগলো। একটু আগে যখন সমুদ্র ফোন হাতে নেয় দেখে ওর মায়ের নাম্বার থেকে অনেকগুলো ফোন এসেছে। সমুদ্র কল ব্যাক করতেই জয় ফোন ধরলো, এতোক্ষণ জয়ই কল দিচ্ছিলো। সমুদ্র জিগাস করতেই জয় হরবর করে সবটা বলল সব শুনে সমুদ্র মোটেও বিচলিত না হয়ে জয়কে বলল ফোনটা নিয়ে মাকে দিতে। জয় সেই মতো ফোনটা শাহানারার কাছে দিতেই সমুদ্র কিছু না বলে শুধু বলল ফোন নিয়ে সোজা শশীর কাছে যেতে। ছেলের কথামত শাহানারাও ফোন নিয়ে শশীর কাছে গেলো। শশী তখন নিজের ঘরে বসে কান্না করতে ব্যাস্ত আব্বার এতো অপমান হচ্ছে এই সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করছে। আর যখনি মনে হচ্ছে এই সব কিছুই জন্য ও দায়ী তখনি নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। শাহানারা শশীর পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল।

সমুদ্র তোর সাথে কথা বলবে।

শশী অবাক হয়ে শাহানারার দিকে তাকালো তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিজের কানে ধরতেই ওপাশ থেকে সমুদ্র বেশ গম্ভীর স্বরে বলল, তোমাকে শুধু কয়েকটা কথা বলবো তারপর তুমি সিদ্ধান্ত নেবে যে তুমি কি করবে। এই যে তুমি এখন ঘরে বসে কোনো দোষ না করেও মুখ লুকিয়ে কান্না করছো এটা তোমার দুর্বলতা। আর কিছু মানুষ তোমার এই দুর্বলতা কেই কাজে লাগাচ্ছে। কারণ তারা জানে কাওকে ভেঙ্গে দিতে চাইলে তার দুর্বল জায়গায় আঘাত করতে হয়। আজকে তোমার জন্যই তোমার বাবাকে এতোটা অপমানিত হতে হচ্ছে।

এই কথাটা শোনার সাথে সাথে শশী কান্না করে ফেলল সমুদ্র ধমক দিয়ে বলল, এই মেয়ে কথায় কথায় এমন কান্না করো কেনো? তোমার জন্যই তো এসব হচ্ছে। তুমি চুপ করে আছো বলেই এসব হচ্ছে। তুমি চুপ করে আছো বলেই তারা তোমার বাবাকে অপমান করতে পারছে। এখন তোমার বাবার হয়ত আফসোস হতে পারে যে তার কোনো ছেলে নেই কেনো ছেলে থাকলে আজকে এই দিনে সে তার পাশে দাঁড়াতো। তুমি কিন্তু চাইলেই তোমার বাবাকে এই অপমান থেকে মুক্তি দিতে পারো, এর জন্য কি দরকার জানোত একটু সাহস কিন্তু সেটা তোমার নেই। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি তুনি জেনে বুঝে তোমার বাবাকে অপমানিত হতে দেখছো। মানুষ কি বলবে সেই ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছো। পরিশেষে একটা কথায় বলবো নিজের দুর্বলতাকে হাতিয়ার বানাও যেনো কেউ তোমার দুর্বল জায়গায় আঘাত না করতে পারে মাকে ফোনটা দাও।

শশী ফোনটা শাহানারার কাছে দিয়ে দিলো। মা তুমি রুম থেকে চলে যাও এবার যা করার ও নিজেই করবে।

তুই এসব কি বলছিস ওইটুকু একটা মেয়ে একা কি করবে?

জীবনে সামনে এগোতে হলে একাই এগোতে হয় মা সেটা তুমি ভালো করেই জানো। ও যদি এখন প্রতিবাদ না করে তাহলে সারাজীবন এটা ভেবে আফসোস করবে যে সেদিন কেনো প্রতিবাদ করলাম নাহ আর আমি চাইনা ও এই আফসোস টা করুক।

বর্তমান,

দেখলেন তো আপনারা ওইটুকু একটা পুচকি মেয়ে কত বড় বড় কথা বলে গেলো শহরে গিয়ে পাখা গজিয়েছে ওর এই পাখা যদি আমি না কাটতে পারি তো আমিও এই গ্রামের চেয়ারম্যান নাহ। ওদের এখনি একঘরে করা হোক একেতো কুকাম করবে তার উপর আবার বড় বড় কথা।

চেয়ারম্যান এর কথা শুনে এখানে থাকা সবাই দাঁড়িয়ে গেলো তারা বলল, কেনো শশী তো ঠিক কথায় বলেছে আমরা কোনো কিছু না দেখে শুধু শুধু এসব কথা বলতে পারি নাহ। আর শাহিন ওইদিন রাতে শশীকে ক্লাবঘরে দেখলে আমাদের সবাইকে তখনি না ডেকে সকালে ডাকলো কেনো? আর মাস্টার কে তো আমরা চিনি তিনি কেমন মানুষ শশীও এই গ্রামের মেয়ে ছোট বেলা থেকে চোখের সামনে ওকে বড় হতে দেখেছি। না না চেয়ারম্যান সাহেব কোনো প্রমাণ ছাড়াই আপনি এমন বলতে পারেন নাহ আমরা মানতে পারছি নাহ।

ওখানে থাকা সবাই একসাথে কথাটার সমর্থন করলো। চেয়ারম্যান আর শাহিন পড়ে গেলো বিপাকে পরিস্থিতি খারাপ দেখে ছেলেকে নিয়ে ওখান থেকে আলগোছে কেটে পড়ল। সাথে ওখানে বিচার করতে আসা সবাই জামশেদ মাস্টার এর কাছে ক্ষমা চেয়ে চলে গেলো। জামশেদ মাস্টার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সবাই শুনলে তো এই জামশেদ মাস্টার তার মেয়েকে সঠিক শিক্ষায় দিয়েছে।

#চলবে??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে