#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#নীলফড়িং
#পর্ব ২১
.
.
ফাইয়াজ পার্টি হাউজের সামনে এসে গাড়ী থামিয়ে নামল। পুস্পিতাও নেমে দাঁড়ায়, ফাইয়াজের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল পুস্পিতা। হাতে হাত রেখে এগিয়ে গেল দুজন। সেখানে গিয়ে সবার সাথে পরিচিত হতে শুরু করল। অনেকে পুস্পিতা কে চেনে না, অনেকে আবার এটা জানে না যে ফাইজের ওয়াইফ পুস্পিতা। তাই পুস্পিতা কে পরিচয় করিয়ে দিলো সবার সাথে ফাইয়াজ।
পুস্পিতা তার পরিচিত একজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, ফাইয়াজ ও অন্য কারো সাথে কথা বলছিল। তখন হঠাৎ ফাইয়াজের চোখ পড়ল, পুস্পিতার দিকে, তার চোখে আজ পুস্পিতা খুবই সুন্দর এক রমনী, যার থেকে চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না তার। ঝলমলে ব্লাক শাড়ি, চুল গুলো মুড়িয়ে বেঁধেছে, এক পাশ থেকে কয়েকটা চুল গাল ছুঁয়ে আছে, টানা টানা চোখ দুটো কাজল কালো, লাল খয়েরি রঙে ঠোঁট দুটো আরও সুন্দর দেখা যাচ্ছে, নাক ফুলটা জেনো পুস্পিতার জন্যই বানানো হয়েছে এতটা সুন্দর মানিয়েছে তাকে এই নাক ফুলে যা বলার মতো নয়। সেই বিয়েতে দেওয়া ডায়মন্ড সেট-টা পড়ে আজ পুস্পিতার সৌন্দর্য আরও দ্বিগুণ হয়েছে। তার মধ্যে ওর হেঁসে হেঁসে কথা বলা দেখলে ফাইয়াজ এমনিতেই ঘায়েল হয়ে যায়। পুস্পিতার চোখ পড়ল ফাইয়াজের দিকে, ফাইয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো যা দেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করল পুস্পিতা। কী হয়েছে? ফাইয়াজ হালকা হেঁসে মাথা নাড়িয়ে কিছু না বলল।
রাত তখন ১১ টা ফাইয়াজ ডক্টর জাফর কে বলে বিদায় নিতে গেল। কিন্তু ডক্টর জাফর এত জলদি তাদের যেতে দেবে না তাই রিকোয়েস্ট করল আর ঘন্টা খানেক থাকার জন্য। বাট ফাইয়াজ বুঝতে পারছে তার মা এখন টেনশন করবে। তাই ফাইয়াজ এগিয়ে গিয়ে তার আম্মুকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলো।
……..আসসালামু আলাইকুম আম্মু।
……ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যা ফাইয়াজ বল?
……আম্মু আসতে আর একটু দেরি হবে। তোমরা বরং খেয়ে শুয়ে পড়ো, আমরা খেয়ে আসবো।
…….বেশি দেরি হবে?
……নাহ আম্মু এই তো ঘন্টা খানেক।
…….আচ্ছা বাবা জলদি চলে আসিস, দু’জন সাবধানে থাকিস কেমন?
……জ্বি আম্মু।
ফোন রেখে এগিয়ে গেল ফাইয়াজ দেখল পুস্পিতা তাকেই হয়ত খুঁজছে, তাই পেছন থেকে গিয়ে পুস্পিতা কে জিজ্ঞেস করে উঠল।
……কাকে খুঁজছেন ম্যাডাম?
পুস্পিতা কারো কণ্ঠ শুনে পেছনে ঘুরে দেখল ফাইয়াজ দাঁড়িয়ে, চারিদিকে মাঝামাঝি শব্দে গান বাজনা হচ্ছিল যার জন্য ঠিক মতো কথা শোনা যাচ্ছে না।
…….আপনি কোথায় ছিলেন?
…….আম্মুর সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম।
……জানিয়ে দিয়েছেন আমাদের ফিরতে দেরি হবে?
……হ্যা দিয়েছি।
ওরা একে অপরের সাথে কথা বলছিল, এর মধ্যে পেছনে অনেক সোরগোল শুনে সেদিকে তাকিয়ে দেখল কেউ প্রচুর চিল্লাচিল্লি করছে তাই দুজনেই আস্তে আস্তে সেদিকে এগিয়ে গেল। কিছু দূর যেতেই পুস্পিতা, ফাইয়াজের হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরল। কারণ চারিদিকের গান বাজনা থেমে যাওয়ায় এখন কন্ঠস্বরটা খুব ভালো ভাবেই বোঝা যাচ্ছে। আর কন্ঠস্বরটা পুস্পিতার খুব চেনা মনে হচ্ছে। যা কিছু পুরানো স্মৃতি তাকে মনে করিয়ে দিতে যথেষ্ট। পুস্পিতার এমন ভয় পাওয়া দেখে ফাইয়াজ দাঁড়িয়ে গেল।
…….কী হয়েছে তোমার?
……কিছু না, চলেন এখান থেকে, আমার ভালো লাগছে না।
……বাট কী হয়েছে তা তো বলবে?
…….প্লিজ চলেন না এখান থেকে।
পুস্পিতা এই কথা বলতে বলতেই, সেই ঝামেলা করার মানুষটা সবাইকে ঠেলে বের হয়ে এলো, যা দেখে পুস্পিতা ফাইয়াজের হাত আরও শক্ত করে ধরল। ফাইয়াজ পুস্পিতা কে এতটা ভয় পেতে দেখে, ফাইয়াজ ওর চোখ অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল রাবীত এগিয়ে আসছে। সে এখন বুঝতে পারছে পুস্পিতা কেনো এমন করছে? পুস্পিতা রাবীত কে দেখে ফাইয়াজের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে গেল প্রায় ফাইয়াজের সাথে মিশে, ফাইয়াজ ও পুস্পিতা কে ধরে রেখেছে, এর মধ্যে রাবীতের নজর পড়ল ফাইয়াজের দিকে, সে পুস্পিতা কে খেয়ালই করে নি। রাবীত এসে ফাইয়াজের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আর বলে উঠল।
…….আরে স্যার যে? কেমন আছেন আপনি?
……তোমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করছি না।
……ওহ এই ব্যাপার। আচ্ছা ইনি কে? আপনার ওয়াইফ নাকি? হ্যালো ম্যাম? কেমন আছেন?
পুস্পিতা কোনো কথাই বলছিল না যা দেখে রাবীত এদিক সেদিক উঁকি ঝুঁকি মেরে তাকে দেখার চেষ্টা করছিল, বাট দেখতে পারছিল না।
…….ওহ আচ্ছা ম্যাম হয়ত লজ্জা পাচ্ছে? ওকে ম্যাম আমি চলে যাচ্ছি টাটা।
রাবীতের কন্ঠ শুনে আর হালচাল দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে নেশা করে আছে, যার জন্য সে নিজের মধ্যেই নেই। সে হেলতে দুলতে পার্টি হাউজ থেকে বেরিয়ে গেল।
…….পুস্পিতা ও চলে গেছে।
এই কথাটা শুনে পুস্পিতা অনেকটা শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু ওর চেহারা থেকে এখানো ভয়টা যায়নি। পুস্পিতা দাঁড়িয়ে তো আছে বাট ফাইয়াজের হাত খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে। তার ভয় করছে এখনো এই বুঝি রাবীত চলে আসবে।
এরপর ওরা আরও ঘন্টা খানেক সময় থেকে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।
দরজায় এসে ওরা লক খুলে দুজনে ভেতরে চলে এলো, ওদের রুমে ঢুকতে যাবে ঠিক তখনই দেখল ওদের আব্বু আম্মুর রুমের আলো জ্বলছে। তাই পুস্পিতা কে রুমে যেতে বলে ফাইয়াজ তার আব্বু আম্মুর সাথে দেখা করতে এগিয়ে গেল।
ফাইয়াজ রুমে এসে দেখল পুস্পিতা এখনো বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে, অন্যমনস্ক হয়ে। ফাইয়াজ পুস্পিতার সামনে গিয়ে বসে পুস্পিতার হাত তার হাতে নিয়ে বলে উঠল
……পুস্পিতা সে চলে গেছে।
…….বাট সে আবার কেনো আমার সামনে এলো?
…….আরে একই শহরে যখন আমরা থাকি তবে আজ না হয় কাল তো এটা হবারই ছিলো, তাতে যদি তুমি এতটা ভয় পাও তবে কী করে হয়? আচ্ছা আমি তো আছি তোমার সাথে নাকি?
…….আপনার জন্যই তো আজ আমি বেঁচে আছি। নয়ত সেই কবেই তো…….। আমি ভাবতে পারছিনা সেদিনের সেই কথা গুলো।
…….কে বলেছে তোমাকে তা ভাবতে? তুমি শুধু আমার, তাই তোমার ভাবনায় শুধু আমি থাকতে চাই আর কেউ নয়।
……কিন্তু……..।
…….আর একটা কথাও নয়। যাও অনেক রাত হয়েছে, চেঞ্জ করে এসো।
…….হুম।
পুস্পিতা চেঞ্জ করে এসে বিছানা গুছিয়ে নিলো। ততক্ষণে ফাইয়াজ ও চেঞ্জ করে চলে এলো।
পুস্পিতা, ফাইয়াজের বুকে মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে রইল। ফাইয়াজ ও পুস্পিতা কে আগলে নিলো নিজের মাঝে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট করে দুজন পুস্পিতার বাবার বাসায় গেল। আজ পুস্পিতা সারাদিন ওর বাবা মায়ের সাথেই থাকবে তাই।
বিকেল দিকে পুস্পিতা আর ফাইয়াজ তাদের বাড়ি ফিরে এসে দেখল সবাই মিলে ড্রইং রুমে বসে কথা বলছে। ফারিজ তার ভাই ভাবীকে দেখে বলে উঠল।
……খুব ভালো করেছ এখন এসে।
……কেনো?
……জানো আজ নিশা নাকি আমাদের বিকেলের নাস্তা করে খাওয়াবে।
…….ওহ এটা তো খুব ভালো কথা। তবে এতো দেরি না করে একটু জলদি জলদি করলেই তো হতো। আমরাও একটু টেস্ট করে যেতে পারতাম।
……কেনো তোমরা কোথাও বের হচ্ছ না-কি?
……হ্যা নিশা আমরা তো এখন হসপিটালে যাবো।
……আরে ভাবী ভাইকে যেতে দাও, তুমি আর দু-দিন পরে যাও।
……স্যরি মিস্টার দেবর, আমিতো আগেই জানিয়ে দিয়েছি আজ থেকে চেম্বার করব। তাই ক্যান্সেল করতে পারছি না।
……তবে আর কী করার। ওকে যাও।
……যাচ্ছি বলে এই নয় যে খেতে পারব না নিশা রেখে দিশ আমাদের দুজনের ভাগের খাবার, এসে খেয়ে নেবো।
এই বলে ওরা দু’জন রুমে চলে গেল। দুজনে রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো। সবার থেকে বিদায় নিয়ে হসপিটালের জন্য বের হয়ে গেল।
রাতে দুজন খুবই ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল, দুজনেই রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। এর মধ্যে দরজায় কড়া নড়ে উঠল। তাই পুস্পিতা গিয়ে দরজা খুলে দেখল। নিশা দাঁড়িয়ে আছে।
…….আরে নিশা তুমি?
……হ্যা ভাবী ওই বিকেলের স্ন্যাকস আপনাদের জন্য।
…….ধন্যবাদ নিশা। বাট এগুলো রুমে কেনো আনতে গেলে? তুমি ডাইনিং রুমে নিয়ে যাও, আমরা আসছি।
……ওহ আচ্ছা আমি ভাবছি হয়ত এখানে বসেও খেতে পারেন তাই।
……নাহ তুমি নিয়ে যাও।
নিশা খাবার নিয়ে চলে যেতেই, পুস্পিতা দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানা গুছিয়ে নিলো। ফাইয়াজ ফ্রেশ হয়ে আসতেই দুজনে মিলে খাবার খেতে চলে এলো।
দুজনের সামনেই নিশার বানানো খাবার রাখা আছে। যা দেখে ফাইয়াজ বলে উঠল।
……এখন পাস্তা? খেতে ইচ্ছে করছে না, তারপরও যখন এত কষ্ট করে তুই বানিয়েছিস না খেয়েও তো থাকা যায় না। পুস্পিতা দুই প্লেট নষ্ট করার প্রয়োজন নেই, এখান থেকেই নাও। আমি এতটা খাবো না এখন।
……হুম।
…….ভাইয়া আমি এগুলো এত কষ্ট করে রান্না করেছি আর তুমি এখন খেতে চাইছ না।
……তুই কী দেখছিস? খাচ্ছি তো, অল্প করে হলেও তো খাচ্ছি।
…….আরে অল্প করে কেনো খাবে? ভাবীর খাবার ভাবী খাবে তোমারটা তুমি।
…….দ্যাখ আমি এখন প্রচুর টায়ার্ড ফিল করছি, তাই এত কথা বলতে মোটেও ভালো লাগছে না।
…….আচ্ছা ও যখন এত কষ্ট করে রান্না করেছে তবে খেয়ে দেখেন না।
…….তোমার ইচ্ছে হলে তুমি সবটা খেতে পারো।
এই বলে ফাইয়াজ নিজের প্লেট থেকে বেশি অর্ধেক খাবার পুস্পিতার প্লেটে দিয়ে দিলো। এরপর নিজের প্লেট থেকে চামিচে করে কিছুটা উঠিয়ে মুখে দিয়ে চোখ মুখ কেমন করে উঠল। যা দেখে পুস্পিতাও একটু মুখে দিলো, দিতেই সে বুঝতে পারছে লবণের পরিমান একটু বেশিই হয়েছে, আর পান্সা লাগছে খেতেও, মনে হচ্ছে কিছুটা পুরেও গিয়েছিল, যার জন্য খাওয়া যাচ্ছে না।
…….নিশা তুই খেয়েছিলি?
……নাহ আসলে কাকিমা খেতে দেইনি।
……আচ্ছা এখন তবে একটু খেয়ে দ্যাখ।
……এই কী বলছেন? নিশা তোমার খেতে হবে না। তুমি বরং সবাইকে ডেকে নিয়ে আসো।
……জ্বি যাচ্ছি।
এই বলে নিশা চলে যেতেই পুস্পিতা ফাইয়াজ কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল।
……আপনি কী পাগল?
……এখানে পাগলের কী আছে? এগুলো মানুষ খেতে পারে?
……আরে ও কত আশা করে রান্না করেছে, আম্মু যার জন্য ওকে খেতে দেয়নি। এখন আপনি যদি ওকে বলেন খাবার খারাপ হয়েছে তবে ও খুব কষ্ট পাবে। ওর কিছু করার ইচ্ছে শক্তি নষ্ট হয়ে যাবে। তাই প্লিজ এমন করে বলবেন না। আচ্ছা দিন আপনার খেতে হবে না।
এই বলে পুস্পিতা খাবার গুলো ময়লার ভান্ডে ফেলে দিয়ে আবার এসে চেয়ারে বসে পড়ল। ততক্ষণে সবাই চলে এলো খাবার টেবিলে এরপর সবাই মিলে রাতের খাবার খেয়ে যার যার রুমে চলে এলো।
এভাবেই দুই-তিন দিন চলে গেলো। ওরা আগের মতই দুজন ব্যস্ত হয়ে গেল। তার মধ্যেও নিজেদের জন্য ভালোবাসার কিছুটা সময় বের করে নেয়। যতটুকু শুধু নিজেদের। ভালো আছে দুজন ভালোবেসে।
।
।
।
চলবে………….।