নীলফড়িং পর্ব-০১

0
720

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#নীলফড়িং
#সূচনা_পর্ব

কারো ঘনিষ্ট মূহুর্তের একটি ভিডিও দেখে, চোখ সরাতে পারলাম না। শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লাম। এমন কিছু দেখবো আশা করি নি। ফেসবুক চালাচ্ছিলাম হঠাৎ টুং করে একটা ম্যাসেজ রিকোয়েস্ট এলো ম্যাসেঞ্জারে, সেন্ট করে দেখলাম একটি ভিডিও অন করতেই দেখলাম কারো ঘনিষ্ট মূহুর্তের ভিডিও। এমন ভিডিও দেখে তার থেকে তারাহুরো করে বেড় হতে যাবো, এর মধ্যে চোখ পড়লো মানুষ দুটোর দিকে, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কারণ সেই মানুষ দু’জন আমার খুব পরিচিত ব্যক্তি। একজন আমারই বয়ফ্রেন্ড রাবীত, অন্য জন আমারই ফ্রেন্ড চৈতী। যাদের দু’জনকেই আমি প্রচুর বিশ্বাস করি। তাদের এভাবে দেখবো আশা করি নি। ভিডিও থেকে বেড় হয়ে দেখলাম একটি ফেক আইডি থেকে ম্যাসেজটা এসেছে। ফোনটা রেখে মাথা বেডের রেলিং এর সাথে ঠেকিয়ে চুপ করে বসে ছিলাম, চোখ থেকে অঝর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। এভাবেও যে কেউ কারো বিশ্বাস ভাঙতে পারে আমার জানা ছিলো না।

রাবীতের সাথে আমি রিলেশনে জড়িয়েছি মাত্র ২ মাস হলো, সম্পর্ক-টা যে শুধু দু-মাসের তা কিন্তু নয়। রাবীত প্রায় ৪ মাস ধরে আমাকে। ইমপ্রেস করার অনেক চেষ্টা করেছে, আমি এসব প্রেম ভালোবাসায় কখনোই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু রাবীত এমন একটা মানুষ ছিলো যে আমাকে প্রেমে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে। আর আজ সেই মানুষ-টাই আমাকে এত্ত বড় ধোকা দিয়েছে ভাবতেই কষ্ট গুলো আরও দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে।

আমি মেডিকেল স্টুডেন্ট, ইন্টার ডাক্তার হিসাবে ভর্তি হলাম মাত্র ৬মাস হয়েছে। রাবীত আমার সেইম ব্যাচে রয়েছে। যেদিন আমি প্রথম হসপিটালে গেলাম, সেদিন থেকেই রাবীত আমাকে ইমপ্রেস করতে ব্যস্ত, কখনো কথা বলার জন্য তার প্রচুর চেষ্টা, কখনো চিঠি, কখনো কারো হাতে ফুল পাঠানো, এভাবেই সে চেষ্টা করতে থাকে, কখনো প্রচুর রিকোয়েস্ট। একদিন হঠাৎ আমার বাড়ীর সামনে গিয়ে সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার পাগলামো গুলো আস্তে আস্তে আমাকে বাধ্য করে তোলে তার পাগলামী মেনে নিতে, তার ভালোবাসা দেখে বুঝেছি কেউ কাউকে পাওয়ার জন্য কতটা কষ্ট করতে পারে? তার এমন ভালোবাসার কাছে হার না মেনে আমি থাকতে পারিনি বেশিদিন। তার প্রেমে পড়েছি তার প্রতিটি পাগলামীতে। আজ দু-মাস তার সাথে প্রেম করছি, সে কখনো আমাকে বুঝতেই দেয়নি সে এতটা খারাপ চরিত্রের মানুষ।

আর চৈতী সে তো আমার কলেজ ফ্রেন্ড, তার সাথে তো একদম বোনের মতো সম্পর্ক ছিলো। মনের কথা সব সময় তার সাথে শেয়ার করতাম, সে যে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করবে কখনো বুঝতেই পারিনি।

আজ সারারাত আর ঘুম হলো না। চোখ মেলেই সারারাত কাঁটিয়ে দিলাম। ঘুমহীন চোখ দুটো থেকে বারবার অশ্রু গুলো গড়িয়ে পড়ছিল।

সকালে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আজ ইচ্ছে করছে না বাড়ী থেকে বেড় হতে। বলতে গেলে ভয় হচ্ছে ওদের সামনে যেতে, এমন নোংরা মনের মানুষদের চেহারা দেখতেও ইচ্ছে করছে না।

ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছিলাম। এমন সময়, স্যার ফোন দিয়ে এখনি হসপিটালে যেতে বলল। আব্বু বলে উঠলো।

…..কীরে আজ তুই হসপিটালে কখন যাচ্ছিস?

…..এত তো আব্বু এখনই যাবো।

…….ওহ আচ্ছা।

……ওকে আব্বু আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি তবে।

……হ্যা তুই রেডি হয়ে আয় আমি তোকে যাওয়ার পথে নামিয়ে দিয়ে যাবো।

…..ওকে আব্বু।

রেডি হয়ে এসে দেখলাম আব্বু দাঁড়িয়ে আছে, তাই মাকে বায় বলে দুজনেই বেড়িয়ে পড়লাম। আব্বু আমাকে হসপিটালের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমিও তাই হসপিটালের ভেতরে চলে গেলাম।

আমি ইন্টার ডাক্তার-দের ক্যাবিনে যেতেই দেখলাম যাদের ডিউটি চলছিল তারা উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।

……পুস্পিতা তুমি এসে গেছো খুব ভালো হয়েছে আসলে আমাদের একটু জরুরি কাজ ছিলো। তুমি একা কী একটু সামলে নিতে পারবে?

…….হ্যা সমস্যা নেই। তোমরা যেতে পারো বাকিরাও তো চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।

……হ্যা ঠিক আছে।

ওরা চলে গেলো। আমি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। একটা বই হাতে পড়তে নিলাম কিন্তু বইরের পাতায় মন বসছে না। বারবার রাবীতের কথা মনে করে চোখ ভিজে যাচ্ছে, হঠাৎ একজন দরজা নক করে বলে উঠলো।

…….ম্যাডাম আসতে পারি?

……ইয়েস।

একজন পুরুষ আসলো রুমে। যাকে দেখে আমি প্রশ্ন করে উঠলাম।

……জ্বি বলেন।

……ম্যাডাম আমার ওয়াইফের একটু সমস্যা হচ্ছে যদি একটু আসতেন।

……কী সমস্যা হচ্ছে?

…….ওর পেটে ব্যথা করছে।

…….সিট নাম্বার কত?

…….জ্বি ১০২

…….ওকে আপনি যান আমি আসছি।

…….জ্বি ম্যাডাম।

লোকটা চলে গেলো, আমি ফোনটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ১০২ নাম্বার সিটে গিয়ে দেখলাম লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, নার্সদের বললাম।

……ফাইল দাও।

……জ্বি ম্যাডাম, আপনাদের রিপোর্ট গুলো দিন।

রিপোর্ট গুলো তাদের থেকে নিয়ে নার্স আমার হাতে দিলো। আমি ওষুধ গুলো, সাথে রিপোর্ট গুলো চেক করে, মহিলাকে ভালো ভাবে দেখলাম। একটা ওষুধের নাম বলে নার্সকে, বাকি রুগীদের চেক করতে শুরু করলাম, সবার রিপোর্ট চেক করলাম। এক আন্টির কাছে গেলাম।

……আন্টি কেমন আছেন আপনি?

……হ মা ভালো।

……আন্টি কোনো সমস্যা আছে আপনার?

…….হ ওই হাতটায় ব্যথা রইছে, সারারাত ঘুমাইতে পারি নাই মাগো।

…….(প্রেশার মেপে) আন্টি প্রেশার তো একটু বেশি আছে ওষুধ খেয়েছেন?

……ওই তো নার্স দিয়েছে।

…….তুমি ওষুধ দিয়েছ ঠিক করে?

……জ্বি ম্যাডাম।

……কোনটা কোনটা দিয়েছো?

…….এই যে ম্যাডাম লেখা আছে।

…….আচ্ছা বিসলল ৪০ ওটা মিসিং কেনো?

……ওহ সরি ম্যাডাম খেয়াল করিনি।

নার্স-এর কথা শুনে মাথাটা গরম হয়ে গেলো, আগেই তো অনেকটা গরম ছিলো। তাই তার হাত ধরে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বললাম।

…….এটা কোনো কথা বললে তুমি? এনারা এখানে আমাদের ভরসায় আসে, আর আমরাই যদি ভুল করি তবে কীভাবে হবে? তোমার জন্য যদি ওনার কোনো সমস্যা হয়, তবে সেই রিক্স কে নিবে?

…….সরি ম্যাডাম।

…….সরি বললেই কী সব ভুলের ক্ষমা হয়ে যায়? ওনাকে ওষুধ দাও গিয়ে যাও।

……জ্বি ম্যাডাম।

আন্টির ওষুধ দিয়ে বাকি পেশেন্ট গুলো দেখতে শুরু করলাম। একটা বাচ্চার কাছে গেলাম।

……মিষ্টি আন্টি তুমি কেমন আছো?

……জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো তুমি কেমন আছো?

……একদম ভালো না।

…….কেনো?

……তোমাকে তো পাওয়াই যায়না। আমি কতবার তোমাকে খুঁজতে লোক পাঠিয়েছি।

……তাই বুঝি? কিন্তু কেনো?

……তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে, অন্য সবাই পচা, জানো তো রাতে একটা পচা আন্টি আমাকে বকে দিয়েছিল।

……তাই কিন্তু কেনো?

……আমি আইসক্রিম খেয়েছিলাম তো তাই।

…….কিন্তু আইসক্রিম কেনো খেয়েছিলে তোমার তো আইসক্রিম খাওয়া নিষেধ তাই না?

…….হুম কিন্তু আমি তো লুকিয়ে লুকিয়ে একটু খেয়েছিলাম, আর ওই পচা আন্টি আমাকে এসে ধরে ফেলেছিল।

……হুম এরপর কিন্তু আর খাবে না ঠিক আছে।

……হুম।

আমি সব পেশেন্ট দেখে ক্যাবিনে চলে এলাম, সেখানে এসে দেখলাম বাকিরাও চলে এসেছে ঘড়িতে তখন ৮;৩০ মিনিট, সবাই বসে কথা বলছে আমি বই মেলে বসে পড়লাম, ভালো লাগছে না কারো সাথে কথা বলতে। একটু পড়ে চৈতীও চলে এলো।

……কী রে পুস্পিতা, কখন এলি?

……যখন আসার কথা তখনই এসেছি। তা তোর এত লেট কেনো হলো?

…….ওই আসলে বাসায় একটু কাজ ছিলো, রাবীত আশে নি এখনো?

……তা আমি কী জানি? আমি এতক্ষণ রানিংয়ে ছিলাম।

……ওহ আচ্ছা।

আমি আবার বইয়ের পাতায় মুখ গুজে দিলাম ওর সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই নেই কিন্তু কী করবো? ওদের বুঝতে দিলে হবে না আমি সব জানি, ওদের হাতে না হাতে ধরতে হবে।

কিছুক্ষণ পরে রাবীত এলো। আমি সেদিকে খেয়াল না দিয়ে পড়ায় মন বসালাম। রাবীত কথা বলতে চাইছে বাট সবাই রুমের ভেতর তাই কথা বলতে পারছে না। শুধু জিজ্ঞেস করলো।

……কী খবর মিস পুস্পিতা, কেমন আছেন?

…….জ্বি আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ ভালোই রাখছেন।

আমি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। রাবীতের সঙ্গে আর কথা বললাম না। আমি তো আমার ডিউটি শেষ করে এলাম। যতটুকু ওয়ার্ডে ছিলো তা সম্পূর্ণ করে এলাম। এবার ওদের সবার ডিউটি ওরা পালন করতে গেলো। আমি বসে রইলাম। টুং করে একটা ম্যাসেজ এলো, তাকিয়ে দেখলাম সেই ফেক আইডি থেকে,

💌সরি মন খারাপ করার জন্য, বাট আপনার জানাটা অতি জরুরি ছিলো আপনি কাদের বিশ্বাস করছেন। 💌

💬 কে আপনি💬

💌হয়ত আপনার কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষী 💌

💬বাট সেই শুভাকাঙ্ক্ষী টা কে আমার তা তো জানার ইচ্ছে থাকতেই পারে আমার।💬

💌সময় হলে জেনে যাবেন, হয়ত হটাৎ করেই একদিন চলে আসবো সামনে💌

💬বাট আজ কেনো নয়?💬

💌আজ সময় হয়নি তাই💌

সে আর কিছু না বলে অফ লাইনে চলে গেলো। আমিও ফোন রেখে বসে রইলাম।

রাবীত অনেক চেষ্টা করলো, আমার সাথে কথা বলার ম্যাসেজ দিলো, ইশারা করলো বাট আমি তার দিকে তাকালাম না।

১২টায় ডিউটি শেষ করে বের হতে নিলাম। রাবীত বাইক নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো।

……চলো এগিয়ে দিয়ে আশি।

……নাহ প্রয়োজন নেই, আমি চলে যাবো।

……আচ্ছা কোনো কারণে রেগে আছো নাকি?

……কেনো রাগার মতো কিছু করেছেন নাকি?

…….আমার তো মনে হচ্ছে না। তারপরও হয়ত অজান্তেই কিছু ভুল করে ফেলতেই পারি।

…… না আমার জানা মতে ভুল করেন নি। যা করেছেন জেনে শুনেই করেছেন। আচ্ছা রাবীত আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে এখন আশি হ্যা (ঘড়ির দিকে তাকিয়ে)

……আরে বললাম তো আমি এগিয়ে দিয়ে আশি।

…….নাহ আসলে কেউ আমাকে আপনার সাথে দেখে ফেললে সমস্যা হবে। তাই আমি একাই যাচ্ছি।

…….পুস্পিতা শোনো?

তাকিয়ে দেখলাম সিনিয়র ডক্টর আবরার ফাইয়াজ স্যার। তাই সেদিকে এগিয়ে গেলাম স্যার প্রাইভেট কার থেকে উঁকি দিয়ে আমাকে ডাকলেন।

……আসসালামু আলাইকুম জ্বি স্যার?

……ওয়ালাইকুম আসসালাম। পুস্পিতা তুমি নিশ্চয়ই বাসায় যাচ্ছ?

…….জ্বি স্যার।

…….আমি কী লিফট দিতে পারি তোমাকে?

…….নো স্যার আমি চলে যাবো। আপনি শুধু শুধু কেনো কষ্ট করবেন?

……আরে না না আমার কোনো সমস্যা নেই। এক এলাকায়ই তো যাচ্ছি, তাই তুমি কিছু মনে না করলে যেতে পারো আমার সাথে।

স্যার এত করে বলছে না গেলেও খারাপ দেখা যায় ওদিকে রাবীত এখনো দাঁড়িয়ে, তাই তাকে দেখানোর জন্য হলেও স্যারের গাড়ীতে উঠে বসলাম।

স্যার গাড়ী ড্রাইভ করতে করতে বলে উঠলো।

……কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?

……জ্বি স্যার বলেন।

……রাবীত নামের ছেলেটা আমার কাছে তেমন সুবিধার মনে হচ্ছে না। তুমি যদি পারো ওর থেকে একটু দূরেই থেকো।

…….জ্বি ঠ্যাংস স্যার।

ডক্টর ফাইয়াজ আমাকে আমার বাড়ীর সামনে নামিয়ে দিলো। আমি গাড়ী থেকে নামার আগ মূহুর্তে স্যারকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম।

…….স্যার Thanks.

স্যার একটু মুচকি হেঁসে গাড়ী চালিয়ে তার বাড়ীর ভেতরে চলে গেলো। আমি গেইট খুলে বাড়ীর ভেতরে চলে এলাম। আমাদের পাশের বাড়ী-টা ফাইয়াজ স্যার-দের, এজন্য মাঝে মাঝেই স্যার লিফট দিয়ে দেয় যখন সামনে পড়ে যাই।



চলবে……….।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে