নতুন জীবন পার্ট-০৪

0
1296

নতুন জীবন
_________________
লেখিকা:বাবুনি
__________________
(পার্ট:৪)

“ফারজানা বেগম, তানছিয়া কি করছিস মা_! আমি কি আসবো_!”
“তানছিয়া, এইতো মা শুয়ে আছি। আসোই না ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন_!”
ফারজানা বেগম এবার মেয়ের পাশে গিয়ে বসলেন বিছানায়।
“ফারজানা বেগম, তানছিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে, তানছিয়া তর আব্বু বিয়ে ঠিক করেছেন।”
“তানছিয়া চোখ গুলো বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, কার বিয়ে_!”
“ফারজানা বেগম, তর বিয়ে মা।”
“তানছিয়া, হুটহাট বিয়ে কেন_! আমাকে কি তোমাদের সহ্য হচ্ছে না আর।যার কারণে বিদায় করে দিতে চাচ্ছো।”
“ফারজানা বেগম, দেখ মা কোনো বাবা মার কাছে তার সন্তান কখনো অসহ্যকর হয় না।
সন্তান যতোই অপরাধ করুক বাবা মায়ের কাছে সে ভালো। তুই আমাদের ভুল বুঝিস না।
তর বাবা বুঝে শুনেই ঠিক করেছে এই বিয়ে।আর ফ্যামেলি টা ও খুব ভালো, তার চাইতে ভালো ফ্যামেলির মানুষ গুলো। তুই সুখি হবি মা। তুই তো ছোট থেকে যা চেয়েছিস তাই হয়েছে তর কথা মতো।এবার তর আব্বু আর আমার এই ইচ্ছা টা পূর্ণ কর প্লিজ।না করিস না মা ,তর বাবা খুব কষ্ট পাবে।”

আগের মতো থাকলে হয়তো এতক্ষণে সে ঘর মাথায় তুলে ফেলতো, চিৎকার চেঁচামেচি করে। কিন্তু আজ কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। কেমন যেনো নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে নিজের মাঝে। অতীতের সব ঘটনা মুহূর্তে বিলীন করে দিচ্ছে তার সব অহংকার।
কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে বলল।
“তানছিয়া, মা আমি বিয়েটা এখন না করলে কি হয় না _! আসলে আমার আরো পড়ালেখা করার ইচ্ছে আছে।”
“ফারজানা বেগম, সমস্যা নেই তুই চিন্তা করিস না এসব নিয়ে, বিয়ের পর পড়তে পারবি। ওদের সাথে কথা বলতে বলবো এই বিষয়ে তর আব্বুকে ওকে। তবে____”
“তানছিয়া,তবে কি মা_!”
“ফারজানা বেগম, তকে পর্দা করে চলাফেরা করতে হবে।”
তানছিয়ার মেজাজ বিগড়ে গেলো এবার। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বলল।
“তানছিয়া, মানে কি মা__! তোমরা কি আমাকে কোনো হুজুরের সাথে বিয়ে দিতে চাইছো না কি_!”
“ফারজানা বেগম, হুজুর না তবে হুজুরের থেকে কম না ঐরকম ই।”
“তানছিয়া, জোরে চিৎকার দিয়ে বলল , না আমি এই বিয়ে করতে পারবো না মা। তুমি আব্বুকে বলো অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করতে তাতে আমি রাজি থাকবো। তবুও এই বিয়ে ভেঙে দিতে বলো।”
“ফারজানা বেগম, কেন এই বিয়েতে সমস্যা কি_! তর কি ছেলেটা মোল্লা টাইপের শুনে বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না_! যদি ছেলেটা তকে তর মর্ডান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে দেয় না।এসব ভেবে না করছিস_!”
“তানছিয়া, চুপ করে আছে।”
“ফারজানা বেগম, তর বাবার শেষ কথা এই বিয়ে হবে, এবং এই ছেলের সাথে ই‌।কারণ তর বাবা এই ছেলেকে এবং তার মাকে কথা দিয়ে আসছেন। এবং বিয়ে ঠিক করে ও এসেছেন।”
“তানছিয়া, বাহ্ মা বাহ্ বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। তাহলে আর কি দরকার ছিল এখন আমাকে জানানোর।হোঠ করে তুলে দিলেই তো পারতে ঐ ছেলের হাতে।”
“ফারজানা বেগম, এতো কথা বলিস না, মা বাবা যা করে সন্তানের ভালোর জন্য ই করে। আগামী সপ্তাহে তর বিয়ে, মানুষিক ভাবে তৈরি হয়ে নে বিয়ের জন্য।”

এই বলে ওর মা চলে গেলেন রুম থেকে।
তানছিয়া, চিন্তায় পড়ে গেল। শেষমেশ একটা গাইয়া ছেলেকে না তার বিয়ে করতে হয়_! খুব কান্না পাচ্ছে ওর।
কলিকে কল দিল। সব কিছু খুলে বলল।
কলিও একি পরামর্শ দিল, বিয়ে টা করে নেওয়ার জন্য।
তানছিয়া, ফোন কেটে ছুঁড়ে ফেলে দিল বিছানায়। তারপর মুখ ঢেকে কান্না করতে করতে বিড়বিড় করে বলল,পৃথিবীটা এতো নিষ্ঠুর কেন_! কারো চাওয়া পাওয়ার মূল্য নেই কেন_! কেন ই বা এসব অদ্ভুত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়, মানুষের সাথে। তানছিয়ার ইচ্ছে করছে রুমের সবকিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে। কিন্তু সে এটা করলো না, চুপচাপ দরজা বন্ধ করে এসে শুয়ে পড়লো।


মতিন সাহেব, বেলকোনিতে বসে আছেন চেয়ারে। হাতে চায়ের কাপ,একটু পর পর চুমুক দিচ্ছেন আর কিছু একটা ভাবছেন। হঠাৎ আগমন ঘটে ফারজানা বেগমের।
“ফারজানা বেগম, শুনছো_!”
“মতিন সাহেব, চিন্তার জগত থেকে বেরিয়ে বললেন, শুনছি বল।”
“ফারজানা বেগম, তানছিয়া বোধহয় এই বিয়েতে রাজি নয়।”
“মতিন সাহেব, কেন_!”
“ফারজানা বেগম, সব খুলে বললেন।”
“মতিন সাহেব, সব শুনে বললেন।ওর রাজি হওয়া না হওয়ায় কিছু যায় আসে না।কারণ আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওর ভালোর জন্য ই নিয়েছি। তাছাড়া আমি ওনাদের কথা দিয়ে আসছি।”
“ফারজানা বেগম, তবুও দেখো না ওনাদের সাথে কথা বলে।তানছিয়ার মতের বিরুদ্ধে যাওয়া টা কি ঠিক হবে_!”
“মতিন সাহেব, শুনো আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। আমি যা বলছি তাই হবে। তোমার এই অবাধ্য মেয়েকে বাধ্য করার এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
“ফারজানা বেগম, ঠিক আছে তোমার যা ভালো লাগে তাই করো। আমি আর কিচ্ছু বলবো না।”
ফারজানা বেগম রাগ করে চলে গেলেন।
মতিন সাহেব, আনমনে হেসে উঠে মনে মনে বললেন। ফারজানা তোমার মেয়েকে সঠিক জায়গায় ই পাঠাচ্ছি‌।ও সুখেই থাকবে,আর তোমাকেও এতো টেনশন করতে হবে না।

দেখতে দেখতে, আরো ৪দিন চলে গেল।পুরো বাড়ি জুড়ে মেহমানদের আনাগোনা।
দুতলা ফ্ল্যাট টা খুব সুন্দর করে লাইটিং করা হয়েছে রংবেরংয়ের ছোট ছোট লাইট দিয়ে। গেইটের সামন টা অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।ওপরে বড় করে লাইটিং করে লেখা রয়েছে ‘ওয়েল কাম’। সব মিলিয়ে অসাধারণ লাগছে বাড়িটা। একটা বড়লোকের বিয়েবাড়িতে যা যা থাকা প্রয়োজন তার সব ই রয়েছে।এক মাত্র মেয়ের বিয়েতে কোনো কমতি রাখছেন না মতিন সাহেব।তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে টাকা পয়সা খরচ করছেন ইচ্ছে মতো। মেহমানদের আনাগোনা এবং বিয়ের টুকটাক কাজ করতে করতেই পেরিয়ে গেছে আরো দুদিন।

‘ আজ তানছিয়ার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয়ে গেছে হৈচৈ।তানছিয়া ওর রুমে বসে আছে,আর তাকে ঘিরে চারপাশে আত্মীয় স্বজনরা বসে আছেন।
তানছিয়ার খুব কষ্ট হচ্ছে,কাল তার বিয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে পারি জমাতে হবে অপরিচিত একটা লোকের সাথে। অপরিচিত বাড়িতে, অপরিচিত পরিবেশে।
অনেক কষ্টে কান্না আটকে বসে আছে সে।
হঠাৎ কলির আগমন ঘটলো।

“তানছিয়া, বিছানা ছেড়ে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।”
“কলি, এই পাগলি কান্না করছিস কেন_!”
“তানছিয়া, এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো।”
“কলি,দেখো এইভাবে কান্না করে না কি কেউ এখনকার যুগে।সব মেয়েকেই তো বাবার বাড়ি ছেড়ে যেতে হয় কোনো না কোনোদিন। কান্না করে আর কি হবে বল_! তাছাড়া আংকেল আন্টি যা করছেন তর ভালোর জন্য ই তো করছেন।”
“তানছিয়া, কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওনারা আমাকে পর করে দিচ্ছে। ওনারা আমাকে সহ্য করতে পারছে না তাই তো দূরে ঠেলে দিচ্ছে।এসব বলে আবারও শব্দ করে কান্না শুরু করলো।”
“কলি, দূর পাগলি কান্না থামা তো ।বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে কি একবারে চলে যাচ্ছিস না কি। আবার আসবি বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে।”
“তানছিয়া, তখন তো বেড়াতে আসবো। যদি ওরা এখানে থাকতে না দেয়। এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ”
“কলি, দূর কান্নাকাটি থামা তো। এইভাবে কাঁদলে কাল মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে। তখন কিন্তু তকে বিশ্রী দেখাবে। চোখের নিচে কালি পড়ে যাবে। আর তর বর তকে পছন্দ না করে আমাকে পছন্দ করে ফেলবে‌। হা হা হা__”
“তানছিয়া, কলির কথা শুনে না হেসে পাড়লো না।”

‘ এদিকে বরের বাড়ি থেকে কাপড়চোপড় সব পাঠিয়ে দিয়েছে। ৮ টার দিকে তানছিয়াকে সাজানো হলো। কিন্তু হঠাৎ ওর আম্মু রুমে এসে বললেন, অনুষ্ঠান যা হবে ঘরের মধ্যে হবে।
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন।এটা না কি বর বলেছে।
তানছিয়ার তো রাগে মাথার চুল সব ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।কত স্বপ্ন ছিল ওর বিয়ে নিয়ে।কোনো স্বপ্ন ই আজ পূর্ণ হচ্ছে না।
কলি ওকে বুঝালো ,শান্তনা দিল।
যে আল্লাহ যা করেন বান্দার ভালোর জন্যই করেন।
রাতে খাওয়া দাওয়া করে নিয়েছে সবাই।তানছিয়া ও কলি খায় নি।
ওর আম্মু হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে আসলেন রুমে।
নিজের হাতে শেষ বারের মতো মেয়েকে আদর করে খাইয়ে দিচ্ছেন।আর নিরবে চোখের জল শাড়ির আঁচলে মুছে চলেছেন।
তানছিয়ার চোখেও জল স্পষ্ট।
“কলি গলা ঝেড়ে বলল, আমাকেও কি একটু খাইয়ে দিবেন আন্টি_!”
“ফারজানা বেগম, হেসে বললেন, কেন নয় পাগলি মেয়ে। তুমিও তো আমার আরেক মেয়ে। হাঁ করো দেখি।”

খাওয়া দাওয়া শেষ করে,সবাই যে যার রুমে ঘুমাতে চলে গেল।
তানছিয়ার রুমে কলি আর ও ঘুমিয়ে আছে।
হঠাৎ মাঝরাতে তানছিয়ার ফোন বেজে উঠলো।
সে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রং নাম্বার।
কি করবে বুঝতে পারছে না।এই মুহূর্তে তার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
বেশ কয়েকবার কল আসছে ,তানছিয়া বিরক্ত হয়ে নাম্বার টা ব্লক করে দিল। ব্লক করার ৫মিনিট পর মেসেজ আসলো ঐ নাম্বারে।
তানছিয়া, মেসেজ অপশনে গিয়ে পড়তে লাগলো।
( কি ভেবেছো আমাকে তোমার জীবন থেকে সরিয়ে দিয়ে,সুখী হয়ে যাবে__! বিয়ে করতে যাচ্ছো যাও বিয়ে করে নাও আমার আশা পূর্ণ হয় নি। আমি ও তোমাকে সুখী হতে দিবো না।আর হে পুরোনো নাম্বার ব্লক দিয়ে রাখছো। নতুন এইটা ব্লক দেয়ার চেষ্টা করো না। ব্লক খুলে ফেলো তা না হলে খুব খারাপ হবে।
ইতি,
তোমার বেড বয়ফ্রেন্ড তামিন।)
মেসেজ পড়া শেষ হলে ওর বুকটা ধুকধুক শব্দ করে উঠলো।কি হবে এখন,ও তো তামিনের সব নাম্বার ব্লক করে দিয়েছিল।এখন নতুন নাম্বার দিয়ে ডিস্টার্ব করছে।যদি কাল বিয়েতে এসে আজেবাজে কিছু বলে।আর বিয়ে যদি ভেঙ্গে যায় তাহলে তো মহা কেলেংকারি হয়ে যাবে। কি করবো এখন_!
তানছিয়া, কলিকে ঘুম থেকে তুলে সব খুলে বলল।
“কলি, তুই এতো টেনশন নিস না তুই ফোন অফ করে রেখে দে।আর শুন এতো চিন্তার কিছু নেই, রাইফ ভাইয়া সব সামলে নিবে দেখিস।”
“তানছিয়া, কলির কথা মতো ফোন অফ করে রাখলো। আচ্ছা এই রাইফ টা কে রে_!”
“কলি, হা হা হা নিজের বরের নাম টা ও জানিস না এখনো,অথচ কাল ওর সাথে তর বিয়ে।”
“তানছিয়া, মুখ টা মলিন করে বলল, জানবো কিভাবে সব তো আব্বুর ইচ্ছায় হচ্ছে।”
“কলি, হয়েছে আর মন খারাপ করিস না যা হবার তো হয়ে গেছে।চল এবার ঘুমিয়ে পড়।”
দুজন ঘুমিয়ে পড়লো।

‘ সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে তানছিয়া কেঁদেই চলেছে ,রাগে দুঃখে অভিমানে।
কলি পাশে বসে শান্তনা দিচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার তানছিয়ার আম্মু এবং ওর ভাই তামিম এসে কান্না করছে পাশে বসে।
পার্লার থেকে দুটোমেয়ে এসে গেছে তানছিয়াকে সাজানোর জন্য।
বিয়ে বাড়িতেই হবে কোনো সেন্টারে না এটাই বর পক্ষের চাওয়া।

অবশেষে তানছিয়াকে কনের সাজে সাজানো হয়েছে। খুব সুন্দর লাগছে ওকে লাল বেনারসী শাড়িতে। তবে কপালে কোনো টিপ দেয়া হয় নি। তানছিয়া বিছানার মাঝখানে বসে আছে,তার চারপাশে আত্মীয় স্বজন ঘিরে বসেছে।কলি মাঝেমধ্যে ওকে হাসানোর চেষ্টা করছে এইটা ঐটা বলে।
তানছিয়ার খুব অস্বস্তি লাগছে,এসি রুমে ও তার গরম লাগছে।এতো মানুষের ভিড়ে নিজেকে এইভাবে উপস্থাপন করে নি সে কখনো। প্রথম তো তাই হয়তো এরকম লাগছে।
হঠাৎ কে যেনো এসে বলল, বর এসেছে। ওমনি সবাই ওর রুম ছেড়ে চলে গেল বরকে বরণ করতে।
তানছিয়া চুপচাপ বসে আছে।

হঠাৎ বাইরে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ কানে ভেসে আসলো ওর।
বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে যা দেখলো।তাতে খুশি হবে না কি কষ্ট পাবে বুঝতে পারছে না সে।

চলবে_!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে