নতুন জীবন
__________________
লেখিকা:বাবুনি
_________________
(পার্ট:৩)
বাইরে দাঁড়িয়ে আল্লাহ কে ডাকছেন ফারজানা বেগম। তামিম ও অসহায়দের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাশে। মতিন সাহেব ও নিস্তেজ হয়ে গেছেন, প্রাণহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
হঠাৎ “ডাক্তার সাহেব বেড়িয়ে এসে বললেন।
মতিন সাহেব, আরেকটু দেরি করে আসলে হয়তো ,আপনার মেয়েকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। আল্লাহর অশেষ কৃপায় আপনার মেয়ে এই যাত্রায় বেঁচে গেল।”
“মতিন সাহেব , একটু চিন্তা মুক্ত হয়ে বললেন, থ্যাংকস ডাক্তার।”
“ডাক্তার সাহেব, থ্যাংকস আমাকে না আল্লাহ কে দেন। আর হ্যাঁ মেয়েকে কোনো রকম টেনশন দিবেন না। সবসময় ওর সাথে ভালো আচরণ করতে চেষ্টা করবেন।কারণ এইরকম পেশেন্ট দ্বিতীয় বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে একটু কষ্ট পেলেই। ওকে সবসময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করবেন।আর যতটা সম্ভব ওর বিষন্নতা দূর করতে সাহায্য করবেন। নয়তো এমন ও হতে পারে, অতিরিক্ত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে।ও পাগল ও হয়ে যেতে পারে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে।”
“মতিন সাহেব, মাথা নাড়লেন।”
‘
‘
ডাক্তারের মুখে এরকম কথা শুনে বুকটা ধুকধুক করে উঠলো ফারজানা বেগমের।
“ফারজানা বেগম, ডাক্তার আমরা কি ওর সাথে দেখা করতে পারি এখন_!”
“ডাক্তার সাহেব, না ওর এখন রেস্টের প্রয়োজন। আপনারা বরং ওর ঘুম ভাঙ্গার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।ভালো ভাবে ঔষধের রিয়েকশন গুলো যাক। পর্যাপ্ত ঘুম হলে সব নরমাল হয়ে যাবে।”
“মতিন সাহেব, ঠিক আছে।”
ডাক্তার সাহেব, দ্রুত পায়ে চলে গেলেন।
হসপিটালের বারান্দায় বসে আছেন ফারজানা বেগম ও মতিন সাহেব। সাথে তামিম ও ফারজানা বেগমের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে।
সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে এতক্ষণে।
“ফারজানা বেগম, এই শুনছো__!”
“মতিন সাহেব, বল।”
“ফারজানা বেগম, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তামিমকে বাসায় রেখে আসো জরির কাছে। আর জরিকে বলো আজ বাসায় ফিরবো না।ও যেনো তোমাকে খাবার দেয় আর তামিম কে খাইয়ে, নিজে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।”
“মতিন সাহেব, ঠিক আছে আমি তাহলে ওকে নিয়ে গেলাম তুমি থাকো। তানছিয়া সজাগ হলে ওর পাশে গিয়ে বসো ওকে।”
“ফারজানা বেগম, আচ্ছা।”
মতিন সাহেব, চলে গেলেন তামিম কে কাঁধে তুলে নিয়ে। ফারজানা বেগম, লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসে রইলেন।
হঠাৎ করে ওনার পাশে একটা ছেলে এসে বসলো, সাথে তার মধ্যবয়স্ক মা ও। তাদের সাথে আলাপ করে জানতে পারলেন। তাঁরা পাশের কেভিনের , ভদ্রমহিলার ছেলের বউকে ভর্তি করা হয়েছে। ছেলের বউয়ের বাচ্চা হবে।
‘
‘ মতিন সাহেব, তামিমকে রেখে,বাসা থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলেন।
“মতিন সাহেব, এই নাও তোমার আর তানছিয়ার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।”
“ফারজানা বেগম, টিফিন বক্স টা হাত থেকে নিতে নিতে বললেন। তুমি খেয়েছো তো__!”
“মতিন সাহেব, চুপ করে রইলেন।”
“ফারজানা বেগম, স্বামীর নিরবতায় বুঝতে পারলেন ওনি খান নি টেনশনে। চলো একসাথে খাই।”
“মতিন সাহেব, তানছিয়ার ঘুম ভাঙ্গে নি এখনো__!”
“ফারজানা বেগম, না আজ মনে হয় আর সজাগ হবে না।আসো খেয়ে নেই দুজন মিলে।”
“মতিন সাহেব, ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হুমমম চলো।”
খাওয়া শেষে, দুজন মিলে হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছেন। এইভাবে ই রাত পার করে দিলেন দু’জন মানুষ মেয়ের জন্য, হাসপাতালের বারান্দায়।
সকাল ৬টা বাজতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল ফারজানা বেগমের, কাল কখন যে চোখ বন্ধ হয়েছে জানা নেই।হবে হয়তো শেষ রাতের দিকে।পাশেই বসে বসে ঝিমুতে দেখলেন মতিন সাহেব কে। মনে হয় সারা রাত ঘুমান নি ওনি। ইতিমধ্যে তানছিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল,সে আস্তে আস্তে ডাক দিলো আম্মু। কিন্তু ফারজানা বেগমের কানে সেই ডাক পৌঁছে গেল।
“ফারজানা বেগম, এই যে শুনছো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠো নাস্তা নিয়ে আসো।তানছিয়া সজাগ হয়েছে।”
“মতিন সাহেব , বসা থেকে উঠে গেলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা তুমি তাহলে ওর পাশে যাও। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।”
“ফারজানা বেগম, ঠিক আছে।”
ফারজানা বেগম, তানছিয়ার পাশে এসে বসলেন। তানছিয়া মৃদু মৃদু চোখ খুলে তাকিয়ে আছে।
“ফারজানা বেগম, তুই আর কতো আমাদের কষ্ট দিবি বল_? তকে জন্মদিতে গিয়ে কত কষ্ট ই না সহ্য করতে হয়েছে আমাকে।তর বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এতো কিছু কেন করছেন_! তোদের কোনো অসুবিধা যাতে না হয়। তোদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজের খেয়াল না রেখে ,আয়রোজগার করছেন। যখন যা চাইছিস তাই পাচ্ছিস। কিন্তু এই সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে তুই বাসা ছেড়ে চলে গেলি।তাও তো আমরা মেনে নিচ্ছি তাহলে কেন তুই আত্মহত্যার পথ বেছে নিলি!
তর কি একবারও আমাদের কথা মনে পড়লো না__! ( আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না করতে করতে কথা গুলো বলছেন।) তুই আর কত কষ্ট দিবি আমাদের_! তকে কি এতো বড় করেছি আমাদের এইভাবে কষ্ট দেয়ার জন্য_!
তুই বল তুই তো সব ই বুঝিস কম বেশি।কোনো মা বাবা কি সন্তানের অমঙ্গল কামনা করে_!”
ইতিমধ্যে মতিন সাহেব, খাবার নিয়ে চলে এসেছেন। এতোক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর কথা শুনছিলেন ।আর নিরবে চোখের জল ফেলছিলেন।
” মতিন সাহেব,এবার সামনে এগিয়ে বললেন, কি ব্যাপার তুমি ওকে এতো জেরা করছো কেন_! কাল থেকে তো ও কিছুই খায় নি।নাও আগে খাইয়ে দাও। ”
খাবারের প্যাকেট টা বাড়িয়ে দিলেন ফারজানা বেগমের হাতে।
” ফারজানা বেগম, তানছিয়াকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন।”
পাশেই মতিন সাহেব বসে আছেন।
‘
‘ তানছিয়ার চোখের কোণে জল চলে আসলো। মা-বাবার ওর প্রতি ভালোবাসা দেখে। এতো ভালোবাসেন ওনারা আমাকে। আর আমি কি না ওনাদের উপর অভিমান করে মরতে গেছিলাম।
“তানছিয়া, নিজের ভুল বুঝতে পারলো। এবং চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে , ফারজানা বেগম কে জরিয়ে ধরলো। আম্মু আব্বু আমি আর কখনো এরকম ভুল করবো না। আমি তোমাদের সব কথা শুনবো। কখনো তোমাদের ভুল বুঝবো না। আমাকে তোমরা মাফ করে দাও। প্লিজ, তোমাদের পাল্টে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলাম না তাই আত্মহত্যার চেষ্টা করছিলাম। আমি বুঝিনি তোমরা আমাকে সত্যি অনেক ভালোবাস। তোমাদের ভালোবাসা পেলে দেখে নিও আমি নিজেকে পাল্টে ফেলবো। কখনো আর এরকম ভুল পথে পা বাড়াবো না।”
ফারজানা বেগম,ও মতিন সাহেব ও এবার কান্না করে দিলেন। আসলেই তো ওনাদের উচিত হয়নি ঐ সময়টাতে এরকম আচরণ করা। এতোটা কঠোর না হয়ে বুঝিয়ে বললে ই পারতেন। যাইহোক ও যে ওর ভুল বুঝতে পেরেছে এটাই অনেক।
”
” সন্ধ্যায় সিট কেটে হসপিটাল থেকে বাসায় চলে আসলেন তানছিয়াকে নিয়ে।
এখন খুব ভালো ভাবেই দিন কাটছে তানছিয়ার। মা বাবা সবাই ওর সাথে আগের মতো ভালো ভাবে কথা বলেন।
‘
‘অনেক দিন হলো কলেজে যাওয়া হয় না।তানছিয়া ভাবছে আজ কলেজে যাবে। একটা শাড়ি পরে রেডি হয়ে নিলো সে। তারপর ব্যাগ হাতে নিয়ে, বাসা থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলো। বাসার সামনে রাস্তায় এসে একটা রিকশা ঠিক করে উঠে বসলো। রিকশা চলছে তার আপন গতিতে। অনেক দিন পর বাসা ছেড়ে বের হয়েছে। বাইরের বাতাস এবং চারপাশের পরিবেশ নতুন মনে হচ্ছে।
কলেজের সামনে এসে রিকশা থেকে নামতেই।
“কয়েক টা ছেলে বলল, দেখ দেখ বড়লোকের বেটি আজ রিকশা করে আসছে। গায়ে শাড়ি ও পরেছে।”
“আরেকজন বলল, হ্যাঁ ভাই মনে হয় বাবার টাকা শেষ হয়ে গেছে।”
তারপর দুজন মিলে হাসিতে ফেটে পরলো।
তানছিয়া কোনো কথা না বলে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে। ক্লাসে রুমের দিকে রওনা দিলো।
ক্লাসে ঢুকতেই শুরু হয়ে গেলো,মেয়েদের কান ঘষাঘষি। ওকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করছে সবাই।
তানছিয়া লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, মানুষ বড়ই অদ্ভুত। নিজের খেয়ে অন্যের সমালোচনা করতে, কেন যে এতো আনন্দ পায় আল্লাহ ই জানেন।
আসলেই আমাদের সমাজে এমন মানুষের অভাব নেই। যে একজন মানুষ ভুল করলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে না।
অভাব এরকম মানুষের পাশে থেকে ভুল গুলো শুধরে দেয়ার। ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনার।
আজ কেন যেনো তানছিয়ার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে। ‘ শুধু দৃষ্টিভঙ্গি না, মনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাও সমাজ এমনিতেই বদলে যাবে।’
ক্লাস রুম থেকে হতাশ হয়ে বেরিয়ে পড়লো সে ক্যাম্পাসের দিকে। উদ্দেশ্য কলি কে পাওয়া যায় যদি।
একটু এগিয়ে যেতেই কলি এগিয়ে আসলো।
‘
‘
“কলি, আরে তানছিয়া তুই আসছিস_!”
“তানছিয়া, হুমমম।”
“কলি, কেমন আছিস এখন। আমি যেতে পারিনি রে তকে দেখতে। কারণ ঐদিন আমার এক্সাম ছিল প্রাইভেটের। ভাবছিলাম পরে যাবো, পরে খুঁজ নিয়ে শুনলাম তোরা বাসায় চলে গেছিস।”
“তানছিয়া, ভালো আছি, হয়েছে বাদ দে এসব কথা। আমার ভালো লাগছে না আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। আমি বাসায় গেলাম, তুই একটু চল আমার সাথে পারলে।”
“কলি, কি হয়েছে তর , বেশি সমস্যা করছে নাকি_! আচ্ছা চল তকে বাসায় দিয়ে আসি।”
কলি, একটা রিকশা ঠিক করে তানছিয়াকে ধরে উঠালো রিকশায়। তারপর দুজন বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
‘
‘এদিকে মতিন সাহেব, সেই কখন থেকে বলে যাচ্ছেন ওনি যা ভাবছেন তাই হবে।
আর ফারজানা বেগম, বলেছেন ওকে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন।
“মতিন সাহেব, আমি যা বলেছি তাই ফাইনাল ওকে।”
“ফারজানা বেগম, কিন্তু ওকে জিজ্ঞেস করা ও তো প্রয়োজন।”
“মতিন সাহেব, এতে জিজ্ঞেস করা না করার কোনো কিছু নেই।”
“ফারজানা বেগম, তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো ওকে।”
কিছু টা রাগি কন্ঠে কথা টা বললেন।
ইতিমধ্যে তানছিয়া ও কলির আগমন ঘটলো। তানছিয়া কলির কাঁধে মাথা রেখে আছে দেখে।
“ফারজানা বেগম , এগিয়ে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ওর কি হয়েছে।”
“কলি, সব কিছু খুলে বলল।”তারপর কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেল কলি।
‘
‘ তানছিয়া, সন্ধ্যায় শুয়ে আছে নিজের রুমে।
ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ঐ ছেলে দুটোর বলা কথা গুলো।
আসলেই তো সে এরকম কিছু ভেবে দেখেনি।
সে তো কোনো দিন শাড়ি পরে কলেজে যায় নি। রিকশায় করে কলেজে যায়নি।বাবার গাড়ি ও বাইক ছাড়া কলেজে যায় নি। জিন্স প্যান্ট ও ট্রাইট টপস ছাড়া কলেজে যায় নি। তাহলে কেনোই বা ঐ ছেলে দুটো এসব বলার সুযোগ পাবে না।
সুযোগ টা তো ও নিজেই করে দিয়েছে কথা গুলো বলার।
এসব ভাবছিল, এরমধ্যেই ওর আম্মু আসলেন।
এসে যা বললেন তা শুনে ওর মুখের ভাষা হারিয়ে গেলো।
চলবে__?