#বছর_শেষের_গল্প
মাস্টার্সের পরে খুশির হাতে কাজ কর্ম খুব একটা ছিলো না। বাসা থেকে পাত্র দেখছে বিয়ের জন্য, খুশি চাকরি খুঁজছে, বিয়ে হয়ে গেলেই বাঁচি, এমন ভাবনাও না।
তবে একটু সময় প্রয়োজন।
কানের কাছে রোজ রোজ ঘ্যান ঘ্যান এই ছেলে ভালো ওই ছেলে ভালো, দেখা কর, এগুলো বিরক্ত লাগছিলো।
সকাল সাতটায় বাসায় প্রথম আলো চলে আসে।
খুশি দেরী করে ঘুম থেকে ওঠে।
বাসি পেপার পড়তে ভালো লাগে না।
তাই পড়াও হয় না।
সেদিন সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো, ডাইনিং এ গিয়ে দেখলো পেপারটা কেউ খোলেনি এখনো।
খুশি এক মগ পানি নিয়ে পেপার টা মেলে ধরলো!
কিভাবে যেন বিজ্ঞাপন এর পেজে নজর চলে গেলো।
পাত্রী চাই– পাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বয়স ৩৮৷
লম্বা, সুদর্শন।
তবে আশ্চর্য বিষয় হলো, পাত্রীর বর্ননা।
সাধাসিধা, সুন্দরী, সংসারী, নামাজী হতে হবে।
কোথাও শিক্ষা টিক্ষা লেখা নেই।
খুশির বিরক্ত লাগলো, মনে হলো ফোন করে দু কথা শুনিয়ে দিই।
দুটো ফোন নম্বর দেওয়া আছে।
খুশি রুমে গিয়ে ফোন করে ফেললো!
ভারিক্কী গলার এক মহিলা ফোন তুললো, হ্যালো, কাকে চাই?
খুশি বললো, বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করেছি, পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন।
মহিলা বললো, আচ্ছা, মেয়ে আপনার কি হয়!
খুশি জানালো, কেউ না।
পরিচিত।
আচ্ছা, মেয়ে রাঁধতে জানে তো?
খুশি ফোন রেখে দিলো।
এর সাথে কথা বলে বিশেষ লাভ নেই, মেন্টালিটিই ভালো না!
কিন্তু মনটা খচখচ করতে লাগলো।
এবারে দ্বিতীয় নম্বরটায় ফোন করলো খুশি।
লেখা আছে, জামান, জামানটা কে, পাত্র নিজে নাকি!
খুব রাশভারি কণ্ঠস্বর, কে বলছেন প্লিজ?
খুশির কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো, খুশি বললো, আমি খুশি।
-কে খুশি? কোন ইয়ার?
আচ্ছা, বেচারা খুশিকে ছাত্রী মনে করেছে।
খুশির একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হলো, বললো, থার্ড ইয়ার।
-থার্ড ইয়ারের সাথে তো আমার কোন কোর্স নেই, আপনি আমাকে ফোন করেছেন, কোন প্রয়োজন?
-জি, একটু প্রয়োজন।
–আচ্ছা তাহলে আমার অফিসে চলে আসুন।
আমি রুমেই আছি!
-মানে, আমি আজ ভার্সিটি আসিনি!
–ওহ, তাহলে তো খুব সমস্যা হয়ে গেলো!
আচ্ছা কাল আসুন, এগারোটায়।
–না না, আমি অফিসে আসবো না।
আপনি কি আমার সাথে একটু দেখা করবেন?
–কি আশ্চর্য! প্রয়োজনটা আপনার, তাহলে আমি কেন দেখা করবো!
–মানে প্রয়োজনটা আপনারো, খুশি চোখ বন্ধ করে বলে ফেললো, আমি বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করেছি!
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
তারপর বললেন, আচ্ছা, আজ আবার বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
আপনি মায়ের সাথে কথা বলুন!
নম্বর দেওয়াই আছে।
-বলেছিলাম, কিন্তু বিয়ে তো আপনি করবেন, আপনার সাথে দেখা করতে চাই।
–আচ্ছা, কোথায় আসতে চান বলুন?
–ধানমন্ডি কোথাও?
–আচ্ছা, আজই আসতে হবে?
–আসুন সময় থাকলে!
জামান নামে ভদ্রলোক একটা রেস্টুরেন্টের নাম বললেন।
খুশি রাজী হয়ে গেলো!
কি আশ্চর্য, এটা খুশি কি করছে, কেন এই ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে!
অদ্ভুতভাবে, খুশির একবারো মনে হচ্ছে না যে না যাই!
খুশির বয়স চব্বিশ, মাস্টার্সের রেজাল্ট হয়নি এখনো।
এই লোক তার চাইতে চৌদ্দ বছরের বড়, বিয়ের তো প্রশ্নই আসেনা।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে খুশি ধানমন্ডি লেকের পাড় ঘেষে একটা একটা রেস্তোরাঁয় এসে বসলো!
ভদ্রলোক এলেন দশ মিনিটেই, বেশ ঘড়ি ধরে চলে।
খুশি একটু আড়ালে বসেছে।
ভদ্রলোক ঢুকে ফোন করছেন।
খুশির ফোন সাইলেন্ট করা, ও ভাবছে, লোকটাকে দেখে ভাল লাগলে কথা বলবে, না হলে চলে যাবে।
কিন্তু লোকটিকে দেখামাত্র খুশির কেমন একটা লাগলো, মনে হলো, এই তো সেই, যার জন্য অপেক্ষা করে আছি!
মনে হয়, বাজিলো বুকে সুখের মতন ব্যাথা!
গাঢ় নীল রঙের শার্ট, কালো ফর্মাল প্যন্ট পরে আছেন , চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
চেহারায় বুদ্ধিদীপ্ততার ছাপ স্পষ্ট।
কাঁধে ব্যাগ, মনে হয় ইউনিভার্সিটি থেকে সরাসরি এসেছেন।
বয়সটা বোঝা যাচ্ছে না, আসলেই কি ৩৮!
এই লোকের অনেক ছাত্রী ফ্যান থাকার কথা।
কিন্তু এর জন্য এমন অদ্ভুত বিজ্ঞাপন কেন!
খুশি ফোন হাতে নিলো, তাই লুকাতে পারলো না নিজেকে !
ভদ্রলোক এসে বসলেন খুশির টেবিলে।
বললেন, হ্যালো, আপনি খুশি, আপনার সাথে সকালে কথা হয়েছে আমার।
সরি, জ্যামের কারনে দশ মিনিট দেরী হলো, আমি কোথাও দেরী করে যাই না।
একটানা কথা বলে গেলো জামান নামের ভদ্রলোক।
খুশির কেমন যেন লাগছে! ও একটু হাসার চেষ্টা করলো!
লোকটি বললো, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি খুব অস্বস্তিতে আছেন!
অস্বস্তির কিছু নেই, অপরিচিত একজন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া দোষের কিছু নয়।
এখন বলুন, কি বলতে চান!
খুশি বললো, আমি আসলে বিজ্ঞাপন নিয়ে একটু কনফিউজড!
আপনাকে দেখে বা আপনার সম্পর্কে তথ্য দেখে একটু অদ্ভুত লাগছে!
জামান হাসলো।
বললো, এটা মা আর ফুপুর কাজ।
অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে বিশেষ লাভ নেই!
আমার প্রথম স্ত্রী নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল, যে কারনে আমার ছেলে আর আমাকে ফেলে চলে গেছে!
তাই আমার গার্ডিয়ান বলতে যারা আছেন, তারা চান যেন সংসারী মেয়ে আসে।
এক রকমের পুতুল ধরনের।
-আচ্ছা আপনি কি চান?
সেরকমই?
–আমার আসলে বিয়ে নিয়ে কোন চাওয়া নেই, পরিবার চাইছে তাই বিজ্ঞাপন দিয়েছে!
বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি এজন্য আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন? এটা জানতে?
খুশি কোন কথা বললো না।
জামান বললো, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না আপনি পাত্রী হিসেবে দেখা করতে এসেছেন, কয়েকবার বিজ্ঞাপন এ আমার আজব আজব অভিজ্ঞতা হয়েছে।
একবার এক পাত্রী মায়ের সাথে এসেছে, পার্লার থেকে ফুল মেকাপ করে।
চেহারাই বুঝতে পারছি না, সরি মেকাপকে খাটো করছি না, কিন্তু সব কিছুরই উপযুক্ত জায়গা আছে।
আর একজন এসেছে ষোল বছরের এক মেয়েকে নিয়ে, সংসারি মেয়ে।
খুশি হেসে ফেললো।
এই লোকের কথা শুনে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু খুশির চাওয়াটাই তো সব নয়।
সব বয়সের পছন্দ আছে, এই বয়সে এমন ম্যানলি ছেলেই ভালো লাগবে, টিন এজে পাড়ার গিটার হাতে নিয়ে ঘোরা ছেলেকে ভালো লাগবে।
তাও বিস্তর সমস্যা, ছেলে ডিভোর্সি, তার আবার ছেলে আছে!
খুশির বাসা থেকে মানবে না! এক কথায় না করে দিবে!
কিছুক্ষণ কথা বলার পরে, খুশি বলল, আচ্ছা উঠতে হবে আমাকে।
জামান বললো, খুশি এক কাপ কফি খাও!
তারপরে যাও!
জামান কফি অর্ডার করলো!
তারপর বললো, খুশি তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, তুমি আমার প্রেমে পড়েছো, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বিষয়টা হতে পারে। তরুণীর চোখ দেখে প্রেমে পড়ার সময় বা বয়স আমার নেই।
তবে তুমি চাইলে আমি তোমার পরিবারে কথা বলতে পারি! তোমাকে আমার ভালো লেগেছে।
খুশি মাথা নিচু করে ফেললো, এভাবে ধরা পড়ে যাবে বোঝেনি!
অনেকটা সময় চুপচাপ কেটে গেলো, কফি চলে এলো!
জামান কফি এগিয়ে দিলো খুশির দিকে, দিয়ে বললো, তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলাম,
আচ্ছা একটা কাজ করি, আমি কফি শেষ করে চলে যাই।
তুমি পরে জানিও আমাকে।
কফি শেষ করে জামান উঠলো!
জামান রেস্তোরাঁর দরজা ঠেলে বের হয়ে যাচ্ছে, খুশিকে কেউ যেন বললো, আরে চলে যাচ্ছে তো!
তুই যা, বসে আছিস কেন!
খুশি দ্রুত উঠে যেতে গিয়ে কফির মগ টেবিলে ফেলে দিলো!
তাও দ্রুত বের হয়ে গেলো!
কি আশ্চর্য, জামান কোথাও নেই, খুশির এত মন খারাপ লাগছে কেন! চোখ ভিজে আসছে।
খুশি এদিক সেদিক তাকাচ্ছে!
জামান পেছন থেকে এসে খুশির হাত ধরে বললো, তুমি কি আমাকে খুঁজছো??
খুশি এবার হাসলো!
কি অদ্ভুত, চোখ ভরা জলে কাজল ভাসছে, অথচ মুখে হাসি!