#দ্বিতীয় জীবন (২)
দুই বছর পর
রাহেলা বেগম বড় ছেলে আদিলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছেন। এমনি একদিন একজন এক মেয়ের ছবি দেখালেন। রাহেলা বেগম ছবি দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। ছবির মেয়েটি আর কেউ নয় ওনার অতি আদরের তিন্নি। দুই বছর আগে যার কথা উনি ছোট ছেলে শুভকে বলেছিলেন। শুভ উনাকে সরাসরি কিছু না বললেও কেবল এইটুকু বলেছিল “কি যে বলনা মা তুমি!”
পরদিন রাতে শুভর রুমের সামনে দিয়ে যাবার সময় উনি তিন্নির সাথে শুভর কথোপকথন শুনতে পান। সব শুনার পর ওনার নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে। ওনার কেবল মনে হতে থাকে ওনার জন্যই মেয়েটা কষ্ট পেল।
পাত্রী হিসেবে তিন্নির ছবি দেখা মাত্রই বুঝতে পারলেন এই প্রস্তাবে তিন্নি মত দিবে না। তারপরেও নিজের মনকে বুঝাতে পারলেন না। যদি তিন্নি রাজী হয়, তাই সামান্য চেষ্টা রাহেলা বেগম ছাড়তে নারাজ। পাত্র শুভর বড় ভাই জানা মাত্রই তিন্নি প্রস্তাব নাকচ করে দিল।
এর কিছুদিন পর তিন্নিকে আদিল ফোন দিয়ে বলে
-আমাকে না করার অন্য কোন কারন যদি থাকে তাহলে আমি কিছু বলব না। কিন্তু কারন যদি আমি শুভর বড় ভাই সেটা হয়ে থাকে তাহলে বলব আমাকে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ দাও। তুমি তো আমাকে না জেনেই প্রস্তাব না করে দিলে।
তিন্নিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আদিল বলতেই থাকল
-দেখ তিন্নি তোমাকে আমার সেই ছোটবেলা থেকে ভাল লাগে। তোমার সেই দুই বেনী বা দুই ঝুঁটি করার সময় থেকে। তারপর যখন বড়বেলায় তোমাকে দেখেছি, বিশ্বাস কর আমার ভাললাগা এক বিন্দু পরিমাণ ও কমে নি বরং বেড়েছে। সুযোগ পেলেই লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখতাম। কিন্তু শুভর কথা ভেবে আমি আর আগাই নি। মা আমাকে সব বলেছেন। আমার আসলে আরো আগে শুভর সাথে কথা বলা উচিৎ ছিল।
একটু থেমে আদিল আবার বলল
-যা হবার হয়ে গেছে। তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও। আমার সাথে মেলামেশা করে দেখ। তারপর যদি মনে হয় তোমার আমাকে ভাল লাগছে না বা তুমি আমার সাথে জীবন কাটাতে পারবে না তাহলে আমি তোমাকে কোন প্রকার জোর করব না কথা দিচ্ছি।
তিন্নি চুপ করে সব শুনে গেল। আদিলকে সে ছোটবেলা থেকে চিনে। সব কিছু জেনে আদিল ওর সাথে সম্পর্ক করতে আগ্রহী। সব কিছু ওকে ভাবিয়ে তুলল। আর আদিল ছেলে হিসেবে যে খারাপ সেটা নয়, তাহলে কি করবে? কেবল শুভর ভাই এইজন্য আদিল কে না করার কোন যৌক্তিকতা নেই। শুভর পরিবারের কারো এই সম্পর্কে কোন সমস্যা নেই। তাহলে তিন্নির কি করা উচিৎ?
অনেক ভেবে সে আদিলের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিল।
দুইদিন না যেতেই আবার আদিলের ফোন
-কি চিন্তা করলে?
সত্যি বলতে কি তিন্নি এই ব্যাপারটার কোন সমাধান পেল না। দুএকজন কাছের বন্ধুর সাথে যে আলাপ করেনি এই বিষয় নিয়ে এমনটা নয়। সবার একই কথা সুযোগ দিয়ে দেখতে পারিস অসুবিধা কি? অগত্যা তিন্নি আদিল কে বলল
-আপনার কথা মেনে নিলাম। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
তিন্নির কথা শেষ না হতেই আদিল খুব তাড়াহুড়ো করে উত্তর দিল, যেন দেরী করলে তিন্নি যদি মত পাল্টায়
-তোমার সব শর্তে আমি রাজী।
তিন্নি না হেসে পারল না এবার। ছেলেটা আসলেই একটু পাগলাটে। হাসতে হাসতেই বলল
-আমার শর্ত হল, এখন কেবল ফোনে কথা হবে। দেখাটেকা করতে চাইবেন না।
-মাত্র এইটুকু!
-হ্যাঁ।
-জো হুকুম।
এই বলে দুই জনে হেসে দিল।
এর পর ওদের কথা বার্তা চলতে থাকে মোবাইল ফোনে। আদিল ধীরে ধীরে তিন্নির নির্ভরতায় পরিনত হয়। এমন সময় একদিন আদিল বলে
-অনেক তো কথা হল, চল এবার দেখা করি।
তিন্নিও আর দ্বিমত পোষণ করেনি। দুরুদুরু বুকে হাজির হয় নির্ধারিত জায়গায়। আদিলের মাঝে অবশ্য কোন নার্ভাসনেস কাজ করছে না। ও নিশ্চিত তিন্নি ওকে ভালবেসে ফেলেছে।
এভাবে চলতে থাকে ওদের মেলামেশা। কিছুদিন পর আদিল তিন্নিকে নিয়ে সরাসরি রাহেলা বেগমের সামনে উপস্থিত। রাহেলা বেগম তিন্নিকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন। পাশে বসিয়ে বার বার ছুঁয়ে দেখছেন আর বলছেন
-কতদিন পর তোকে দেখলাম!
এক পর্যায়ে আদিল মাকে বলে
-এখন থেকে সবসময় যেন দেখতে পাও সেই ব্যবস্থা কর।
রাহেলা বেগম ছেলের কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন
-কিভাবে?
এবার আদিল হেসে দিল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল
-কিভাবে আর মা, তিন্নিদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও। তুমি আমার সাথে তিন্নিকে দেখে কিছু বুঝতে পারনি?
রাহেলা বেগম জিজ্ঞাসু চোখে তিন্নির দিকে তাকাতেই তিন্নি লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। এই মেয়েটার এই জিনিসটা রাহেলা বেগমের খুব পছন্দ।
তিন মাস পর
আজ তিন্নি আর আদিলের বিয়ে। রাহেলা বেগম এবং আদিল শুরুতে শুভকে জিজ্ঞেস করেছিল এই বিয়েতে ওর কোন আপত্তি আছে কিনা। শুভ হেসেই উড়িয়ে দিয়ে বলে
-তোমরা এমন করে বলছ যেন তিন্নির সাথে আমার সম্পর্ক আছে। তিন্নির সাথে তোমার বিয়ে হলে আমার চেয়ে বেশী খুশী আর কেউ হবে না।
শুভর এই কথায় দুজনই স্বস্তি পেল। শুভ ও খুব উৎসাহের সাথে বিয়ের সব আয়োজন করল। কিন্তু বিয়ের দিন তিন্নিকে বধুর বেশে দেখে শুভর সেই মূহুর্তে কি যেন হয়ে গেল। ও তিন্নির দিকে অপলক চেয়ে রইল আর বারবার মনে হতে লাগল আজ এই বেশে তিন্নি তো ওর বউ হতে পারত! শুধু শুভ যদি একবার চাইত।
শুভ নিজের এইরুপ ভাবনার সাথে মোটেও পরিচিত নয়। তাই হঠাৎ করে নিজেকে সামলাতে পারল না। ঠিক ঐ মুহুর্তে কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে হনহন করে হাঁটা শুরু করল। যখন একটু স্বাভাবিক হল তখন নিজেকে আবিষ্কার করল পার্কিং এ গাছের নীচে বসা অবস্থায়।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে প্রবেশ করল। নিজের ভেতরে যে প্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে সবার সাথে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু সবার চোখ এড়িয়ে গেলেও একজন মানুষের চোখ শুভ হাজার চেষ্টা করেও এড়াতে পারল না।
তিন্নি সবসময় শুভর চোখে ওর জন্য যেই অনুভুতিটুকু দেখতে চাইত আজ বিয়ের আসরে সেটা দেখে খুব অবাক হল। যদিও শুভ ওর অতীত, বর্তমানে আদিল কে ভালবাসে। কিন্তু শুভকে তিন্নি কি কোনদিন চাইলেও ভুলতে পারবে? মনের কোন এক কোন শুভর প্রতি ভালবাসাটা ঠিকই জমা হয়ে আছে ধুলো পড়া কোন বইয়ের মত। তিন্নি চায় না ধুলোটুকু মুছে সেই বইটা হাতে নিয়ে পড়তে।
বেশ কয়দিন ধরে শুভ খুব অদ্ভুত আচরণ করতে লাগল। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে পার্কে গিয়ে বসে থাকে আর রাতে ফিরে। তিন্নির সামনে পরলে যদি নিজেকে সামলাতে না পারে তাই রাতটুকু ছাড়া বাসায় থাকত না। তিন্নিকে যে সে কতটা ভালবাসত সেটা তিন্নিকে হারিয়ে বুঝতে পেরেছিল। একদিন বাসায় কেউ ছিলনা এমন সময় তিন্নিকে বলে বসে
-যা হবার হয়ে গেছে চল আমরা পালিয়ে দূরে কোথাও চলে যাই। কেউ যেন খুঁজে না পায় আমাদের।
তিন্নি শুভর পরিবর্তিত আচরণ বুঝতে পারছিল বেশ কয়দিন ধরে। তারপরেও শুভকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বলল
-কি বলছিস তুই এইসব। মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোর?
-না আমার মাথা খারাপ হয়নি এখনো, কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে খুব শিগগিরি খারাপ হয়ে যাবে। আমি বুঝতে পারিনিরে তুই আমার কতটা জুড়ে আছিস।
তিন্নি এবার একটু বিরক্তি নিয়ে বলে
-ওসব কিছু না। বিয়েশাদি কর সব ঠিক হয়ে যাবে।
শুভ কাতর ভাবে বলল
-এড়িয়ে যেতে চাইছিস?
তিন্নি কিছু না বলে চলে যেতে চাইলে শুভ তিন্নির হাত ধরে আটকায়। তিন্নি শীতল চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে বলে
-ভালবাসিস সেটা বুঝতে পারিস নি, কিন্তু আমি সম্পর্কে তোর বড়ভাবী হই সেটা তো বুঝিস?
শুভ আর কিছু না বলে তিন্নির হাত ছেড়ে দেয়। তিন্নি ঠিক যে ভয়ে প্রথমে বিয়েতে না করেছিল, এখন সেসব ঘটছে।
চলবে