#তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে
মৌলী আখন্দ
পর্ব-৩
আজকে এলিনার বিয়ে, লোকজন জানিয়ে ঘটা করে বিয়ে নয়, শুধু সই করে বিয়ে। লাল রঙের একটা ক্রপ টপের সাথে কালো গ্যাভার্ডিন প্যান্ট পরে অফিসে এসেছে এলিনা।
সাথে ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে লাল পেটিকোট জামদানি আর একটা বক্সে কাঁচের চুড়ি আর টিপ। অফিস ফেরত পার্লার হয়ে যাবে।
বিয়ে তো, সে যেরকম বিয়েই হোক। বিয়ের দিন লাল শাড়ি না পরলে হয়!
আজকে সবার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়েই বেড়াচ্ছে এলিনা, কোন কুক্ষণে যে মন চেয়েছিল টপসের সাথে ম্যাচিং করে ক্রিমসন রেড লিপস্টিক দিতে। অফিসের সবার মন মেজাজ খারাপ, এর মধ্যে এলিনার দুই চোখে গাঢ় করে টানা কাজল রেখা আর টকটকে লাল লিপস্টিক দেখলে বস তাকে আজ জানালা দিয়ে ছুঁড়েই ফেলে দেবেন ছয়তলা থেকে, নয়ত বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে এমন সব কথা বলবেন যে এলিনার নিজেরই ইচ্ছা করবে জানালা দিয়ে নিচে কংক্রিটের ওপরে ঝাঁপ দিতে।
এখন পর্যন্ত যে সমাধান বের হয়েছে সেটা হলো তরল নাইট্রোজেন। কিন্তু কস্টিং এর সমস্যাটা রয়েই যাচ্ছে।
তিন হাজার স্কয়ার ফিটের ল্যাব রুম জুড়ে যে পরিমাণ নাইট্রোজেন সরবরাহ প্রয়োজন সেজন্য যে খরচটুকু হবে তাতে বাজারে প্রচলিত কাপড়ের চেয়ে দাম বেশি হয়ে যাচ্ছে। মার্কেটে মার খেয়ে যাবে তারা।
যদিও এলিনা আজকে এই সমস্যা নিয়ে মোটেই ভাবছে না। অফিসের রুটিন কাজটুকু করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যই ছটফট করছে।
গত কয়েক দিন ধরেই এলিনা ধীরে ধীরে তার জিনিসপত্র শিফট করেছে রাইয়ানের ফ্ল্যাটে। বিয়ে উপলক্ষ্যে এ মাসেই ছোট্ট নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে রাইয়ান।
গতকাল হোস্টেল রুম ছেড়ে দিয়েছে এলিনা। রুমমেটদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে।
যদিও নতুন বাসার ঠিকানা দেয়নি। বলেছে একটু গুছিয়ে বসে ফোনে দাওয়াত দেবে।
মুখে মুখে বললেও এলিনার আসলে সেরকম কোনো ইচ্ছে নেই। অনাথাশ্রমে বড় হওয়ায় কোনো সম্পর্কের শিকড় গজাতে দেয় না ও।
খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে, নিজের প্রাপ্যটুকু আদায় করে নিতে পারে তারপর আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সম্পর্ক ছেঁটেও ফেলতে পারে অনায়াসে। হোস্টেলে যতদিন ছিল, রুমমেটদের প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন কারণে।
নিজের সংসারে যাচ্ছে, প্রয়োজন শেষ, এখন আর তাদের কথা না ভাবলেও চলবে।
কোনো মতে অফিস আওয়ারটুকু পার করে নিজের ডেস্কের ড্রয়ার লক করতে করতে এলিনা লক্ষ্য করল অল্প অল্প কাঁপছে তার হাত। উত্তেজনায়?
কষে নিজেকে ধমক লাগাল এলিনা। এতদিন মেলামেশার পরও কীসের এত এক্সাইটমেন্ট?
অফিস থেকে মাথা নিচু করে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এল এলিনা। বাইক থাকুক গ্যারেজে।
এত করেও শেষ রক্ষা হলো না। রাস্তার কোণায় রিকশা স্ট্যাণ্ডে এসে পার্লার যাওয়ার জন্য রিকশায় উঠে কী মনে করে মাথা তুলে দেখল মামুন স্যারের গাড়িটা জ্যামে আটকে আছে, আর সেই জানালা থেকে স্যারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ।
মনে মনে একটা কঠিন গালি দিল এলিনা, কার উদ্দেশ্যে কে জানে। তবে গালি দিলে শরীরের আরাম হয়।
পার্লারে সাজতেই যেটুকু সময় লাগল, মূল বিয়ের ব্যাপারটা ফুরিয়ে গেল খুব সংক্ষেপে। পার্লারের গেট থেকেই এলিনাকে তুলে নিল রাইয়ান।
ফ্ল্যাট সাজাতে গিয়ে টাকা ফুরিয়ে গেছে অজুহাত দিয়ে সাক্ষীসাবুদ শেষ করে সাথে আসা বন্ধুদের চা নাস্তা সিগারেট খাইয়ে কাটিয়ে দিল রাইয়ান। নতুন বাসায় ট্রিট পাওনা থাকল ওদের, পরে হবে অন্য কোনো দিন।
রাইয়ান এলিনাকে নিয়ে গেল একটা রেস্টুরেন্টে। সন্ধ্যা মিলিয়েছে অনেক আগেই, ব্যস্ত শহরে তারার জায়গা নিয়েছে স্ট্রিট ল্যাম্প।
ওয়েটার খাবার সার্ভ করে দিয়ে যাবার পর মুখোমুখি সোফায় বসে এলিনার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচাল রাইয়ান। কেন জানা নেই লজ্জা পেয়ে পাশে জানালা দিয়ে নিচে রাস্তার দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল এলিনা।
ছাদের ওপর থেকে রাতের আলোক সজ্জা আজকে খুব ভালো লাগছে এলিনার। পুরো শহর যেন আজকে ওদের জন্যই সেজেছে।
নিচে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে আছে গাড়ি, কত কত মানুষ। কেউ কি আজকে ওর মত সুখী?
আচমকা নিজের সোফা থেকে উঠে এলিনার পাশে এসে বসল রাইয়ান। খুলে দিল ওর খোঁপা করা চুল।
“এই সব কী?” কৃত্রিম রাগে চোখ পাকাল এলিনা।
“তাড়াতাড়ি শেষ কর।“ খাবারের দিকে ইশারা করল রাইয়ান। “বাসায় চলো। আজকে…”
ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসতে লাগল এলিনা। “এতদিন পরও এই অবস্থা?”
ওকে ছেড়ে দিয়ে নিজের সিটে ফিরে গিয়ে হাত ইশারায় ওয়েটারকে ডাকল রাইয়ান। “আমাদের একটু ইমার্জেন্সি আছে, খাবারগুলো প্যাক করে দিন!”
“সে কী! মাত্রই তো বসলাম!” প্রতিবাদ করল এলিনা।
“কথা কম বল।“
অধীর হয়ে উঠেছে রাইয়ান। এলিনার কেন যেন খুব হাসি পাচ্ছে।
চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাসায় ঢুকে রাজকীয় ভঙ্গিতে এলিনাকে আমন্ত্রণ জানাল রাইয়ান। “ওয়েলকাম, মাই কুইন!”
রাইয়ানের হাতে হাত রেখে রাণির মতই হাসিমুখে বাসায় পা রাখল এলিনা। নতুন বউদের মত গা ভরা গয়না নেই, প্রতিদিনের মত গলায় ছোট্ট চেন, কানে রুবির ছোট দুল আর হাতে সেদিনের পরিয়ে দেওয়া পার্লের আংটি, তবুও তো নতুন বউ, লাল জামদানি আর চুলে বেলির মালা জড়ানো।
খাবারের প্যাকেট ডাইনিং এ রেখে ভেতরে ঢুকে গেল রাইয়ান। “তোমার তো মেক আপ তুলতে বেশি সময় লাগবে, আমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসি!”
প্রতিবাদ করল না এলিনা। রাইয়ান ওয়াশ রুমে ঢুকতেই ডাইনিং এর টেবিলে বসেই অভ্যাস বশত ফোনে মেইল চেক করতে শুরু করল।
রাইয়ান আজ সারা দিন বাইরে ছিল, সেই সকালে গোসল করে সাইটে গিয়েছিল। আবার গোসল করে বের হলো সে।
এসে অবাক হয়ে দেখল এলিনা বিরক্ত মুখে বসে ট্যাবে এন্ট্রি দিচ্ছে। সামনে এক তাড়া কাগজ রাখা।
রাইয়ান এসে কাগজের গোছা টেনে সরিয়ে নিল ওর সামনে থেকে। এলিনা প্রায় চিৎকার করে উঠল।
“এই প্লিজ জান, জাস্ট দশ মিনিটের কাজ আমার! প্লিজ গিভ মি টেন মিনিটস!”
রাইয়ান বিরক্ত হলেও প্রকাশ করল না মুখে। “ওকে, জাস্ট টেন মিনিটস! আমি ততক্ষণ একটু শুয়ে নিচ্ছি।“
“প্লিজ!”
এই জিনিস কাল সকালে অফিসে গিয়ে করবে ভেবেছিল এলিনা। কিন্তু আর্জেন্ট মেইল এসেছে এখনই করে পাঠাতে হবে।
এরকম ইমার্জেন্সি কাজ এর আগেও করে দিয়েছে সে, কাজেই এবার না করার কোনো যুক্তি নেই। রাইয়ানকে মিথ্যা বলেছে সে, এটা মিনিমাম এক ঘন্টার কাজ।
এখনো খাট কেনেনি ওরা, স্রেফ একটা ম্যাট্রেস তার ওপরে এলিনার পছন্দে কেনা চাদর বিছিয়ে শোবার ব্যবস্থা। কাজ শেষ করে শাড়ি বদলে খাবার গরম করে বিছানায় গিয়ে রাইয়ানকে ডাকল এলিনা। কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে রাইয়ান তখন তলিয়ে গেছে গভীর ঘুমে।
দুই একবার উহ আহ করে ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেল রাইয়ান। নিজের সংসারে ডাইনিং এ বসে প্রথম রাতের খাবার একা একাই খেল এলিনা।
তারপর বাকি খাবারটুকু ফ্রিজে তুলে রেখে সেও ঘুমিয়ে পড়ল রাইয়ানের পাশে শুয়ে। এলিনা ভেবেছিল আজ রাতে তার ঘুম আসবে না।
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রাইয়ানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠে নাক ডুবিয়ে শোবার প্রায় সাথে সাথেই ঘুমে জড়িয়ে এল তার দুচোখ। যেন অনেক দিন পর গভীর শান্তিতে ঘুমাল এলিনা।
চলবে,,