গল্পের নামঃতোমাতেই পূর্ণ আমি ❤
পর্বঃ১০
লেখিকাঃজিন্নাত চৌধুরী হাবিবা
আজ আদিলের গায়ে হলুদ।মিনি আর স্পর্শ সকালেই চলে এসেছে মিনিদের বাসায়।ওদের সাথে মাহিরা ও এসেছে।মামুন চৌধুরী আর তাহমিনা চৌধুরী বিয়ের দিন আসবেন।মিনি ছোটাছুটি করছে একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা।সবকিছুর তদারকি করছে।লাইটিং কিভাবে করবে? কোন জায়গায় কোন ফুল দিয়ে সাজাবে?সবকিছু ডেকোরেশনের লোকেদের বুঝিয়ে দিচ্ছে মিনি।
স্পর্শ ও এটা ওটা করছে।আবার একটু পর পর মিনিকে এসে দেখে যাচ্ছে।
মিনি স্পর্শকে ডেকে বলল,
এই যে শুনুন।
স্পর্শ বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।হ্রদ স্পন্দন বেড়ে গেছে।
উফ এই মেয়েটা মনে হয় আমাকে হার্ট এ্যাটাক করিয়ে মেরেই ফেলবে।এতো মিষ্টি করে কেউ ডাকে?
এর মাঝে আবারো মিনির ডাক পড়লো,,,কি হলো?শুনতে পাচ্ছেন না?সেই কখন থেকেই ডাকছি।বলছিলাম কি একটু পর তো হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।ভাইয়াকে কোথাও দেখছিনা।একটু ভাইয়াকে ডেকে বলুন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে।সাথে আপনিও রেডি হয়ে নিন।
দেখো তোমার ভাই হয়তো লুকিয়ে বউয়ের সাথে ফোনে প্রেমালাপ করছে?বলল স্পর্শ।
মিনি মুখ বাকিয়ে বলল,আমার ভাইতো প্রেমালাপ করতে পারে।আপনিতো সেটাও পারেন না।তারপর ওখান থেকে চলে যায়।
স্পর্শ কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে আনমনে বলে উঠলো, এটা কি আমাকে গ্রিন কার্ড দিয়ে গেলো নাকি।তারপর মাথা চুলকে মুচকি হেসে ওঠে।
আদিলকে রেডি করিয়ে স্টেজে নিয়ে এসেছে ওর বন্ধুরা।হলুদ পাঞ্জাবি,সাদা পায়জামা,চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা,ফর্সা গালে খোচা খোচা দাঁড়ি।অনেকটা হিরোর মতোই লাগছে।
স্পর্শ ও রেডি হয়ে নিয়েছে।ও ও আজকে হলুদ পাঞ্জাবি পড়েছে সাথে কালো প্যান্ট।মিনি এখনো আসছেনা দেখে স্পর্শ মিনির রুমের দিকে হাটা ধরলো।দরজাটা লক করা তাই স্পর্শ নক করে উঠলো।
ভেতর থেকে মিনির আওয়াজ, কে?
আমি।স্পর্শ জবাব দিলো।
মিনি বলল,আমার এখনো শাড়ি পড়া হয় নি আপনি এখন যান।
তাড়াতাড়ি আসো বলে স্পর্শ স্টেজের কাছে চলে এলো।বেহায়া মেয়ে গুলো স্পর্শকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে।কেউ কেউ তো স্পর্শের আসপাশ ঘিরে রেখেছে।
স্টেজের কাছে এসে এগুলো দেখে মিনির গা দিয়ে আগুন বের হচ্ছে।বেদ্দপ মাইয়া আমার জামাইরেই তোগো চোখে পড়ে?আর পোলা চোখে দেখচ না?কথা গুলো মনে মনেই বলল মিনি।
তারপর স্পর্শের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,আপনাকে আমি সারাবাড়ি খুজছি আর আপনি এখানে কি করছেন?
আর এই যে আপুরা অন্যের জামাইয়ের দিকে চোখ দেন কেনো?দুনিয়ায় আপনাদের জন্য ছেলের অভাব পড়েছে?একটা বিবাহিত পুরুষকে যে ভাবে ঘিরে রেখেছেন?
মেয়েগুলো মিনির কথায় বেশ লজ্জা পেল।ওরা তো আর জানতোনা স্পর্শ বিবাহিত।তারপর সবাই ওই স্থান থেকে কেটে পড়ে।
এবার মিনি স্পর্শের চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়।পাঞ্জাবির একটা বোতাম খোলা ছিলো সেটাও আটকে দিয়ে বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে স্পর্শকে বলল,এতো সুন্দর করে সেজেগুজে থাকতে কে বলেছে আপনাকে?আমি বলেছি?তারপর ওখান থেকে চলে যায়।
স্পর্শ এতোক্ষণ চুপচাপ মিনির কার্যক্রম দেখছিলো।সকাল থেকেই এরকম উদ্ভট ব্যবহারের কারন এখন উপলব্ধি করতে পারলো।তারমানে আমার বউটাও আমার প্রেমে পড়ে গেছে।এবার শুধু বলার অপেক্ষা।বলেই ঠোঁটের কোনে লম্বা হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে স্পর্শ।
একে একে সবাই হলুদ লাগাচ্ছে আদিলকে।প্রথমে আদিলের মা-বাবা পরে মুরব্বিরা হলুদ লাগিয়েছে।এখন ছোটোদের পালা।আদিলের বন্ধুরা হলুদ দিয়ে আদিলকে পুরো ভূত বানিয়ে ফেলেছে।বেচারা কিছু করতেও পারছেনা।অপেক্ষায় আছে কবে তার এরকম সময় আসবে?এখনতো পাজিলগুলো মুখে মেখেছে আদিল ডিরেক্ট গোসল করিয়ে দেবে।এবার মিনির পালা।মিনি হলুদ নিয়ে আলতো হাতে ভাইয়ের গালে হলুদ ছোঁয়ায়।তারপর স্টেজ থেকে নেমে ছাদের এক কোনে গিয়ে দাঁড়ায়।হঠাৎ কোমরে ভেজা কিছুর ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠলো মিনি।পিছনে ঘুরে স্পর্শকে দেখলো দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এবার মিনি কোমরে হাত ছুঁইয়ে সামনে এনে দেখলো হলুদ লেগে আছে।রেগে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো স্পর্শের দিকে।স্পর্শ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চলে যেতে লাগলো।মিনি পেছন থেকে স্পর্শের হাত শক্ত করে চেপে ধরে নিজের হাতে লেগে থাকা হলুদ স্পর্শের গালে,পাঞ্জাবিতে লেপ্টে দেয়।এবার মিনি ভ্রুকুটি করে ডেবিল হেসে বলল,কেমন লাগে?
স্পর্শ মিনির কোমর জড়িয়ে নিজের দিকে একটু টেনে নিয়ে বলল,এরকম করে যদি বউয়ের হাতের ছোঁয়া পাওয়া যায়।তাহলে ব্যাপারটা বেশ ভালোই লাগে।তারপর মিনির কানে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
স্পর্শের ছোঁয়াতে মিনি কেঁপে ওঠে।স্পর্শকে ধাক্কা দিয়ে কোনো মতে ওখান থেকে সরে আসে।মিনির এভাবে ছুটে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে স্পর্শ হেসে ফেলে।
এদিকে মাহিরা রিজুর সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে বলতে শেষ।বেচারা ভেবেছিলো রিজু আদিলের বিয়েতে আসবে।তখন দুজনে চুটিয়ে প্রেম করবে।বিধি বাম রিজু সিলেট তার বোনের বাসায় বেড়াতে গেছে।তাই আর বিয়েতে আসা হলো না, প্রেম ও করা হলো না।
আদিলের এক হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে মিনি,অন্য হাতে মিনির কাজিন।মিনির প্রচুর খিদে পেয়েছে।খিদেয় পেট চো চো করছে।মেহেদী লাগানো মাঝ পর্যায়ে তাই উঠতেও পারছেনা।এদিকে স্পর্শ প্লেটে খাবার নিয়ে মিনির মুখের সামনে এক লোকমা তুলে বলে,হা কর।
মিনি স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আবার চারপাশে তাকাচ্ছে।স্পর্শ বলল,এতোদিকে না তাকিয়ে খাবারটা খেয়ে নাও।আমি জানি তোমার অনেক খিদে পেয়েছে।তাই চুপচাপ খাও।
মিনিও আর দ্বিমত করলো না।এমনিতেই প্রচুর খিদে পেয়েছে।
আদিল তাকিয়ে দেখছে।স্পর্শ পরম যত্নে মিনিকে খাইয়ে দিচ্ছে।এরকম একজনকেই তো চেয়েছিলো নিজের বোনের জন্য যে কিনা তার ছোট্ট পরীর সব খেয়াল রাখবে,কেয়ার করবে।এসব ভেবেই একটা প্রশান্তির হাসি দেয় আদিল।মিনির খাওয়া শেষে স্পর্শ পরম যত্নে নিজের রুমাল দিয়ে মিনির মুখ মুছে দেয়।চলে যেতে নিলেই মিনি বলল,আপনিও এখন খেয়ে নিন।অনেক রাত হয়েছে।আর আমি মাহিরাকে খাবার দিয়ে এসেছি।
উত্তরে স্পর্শ মুচকি হেসে চলে গেলো।
“বিয়ের দিন ”
একটু পরই বরযাত্রী বেরিয়ে পড়বে মেয়েপক্ষের বাড়ির উদ্দেশ্যে।সবাই রেডি হয়ে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো।স্পর্শ আজকে একটা কালো কালার পেন্ট,গাঢ় খয়েরি রঙের টি-শার্ট, উপরে কালো ব্লেজার পড়েছে, হাতে সিলভার কালার ঘড়ি পড়েছে।চুলগুলো স্পাইক করা।গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি।
স্পর্শের চোখ পড়লো দরজা দিয়ে নেমে আসা মিনির দিকে।স্পর্শ হা করে তাকিয়ে আছে মিনির দিকে।মিনি গাঢ় খয়েরী রঙের একটি শাড়ি পরেছে।সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি,হাতে খয়েরী কাঁচের চুড়ি।চুলগুলো মাঝখানে সিতি করে পেছন দিকে একটা খোঁপা করে তাতে তিনটা তাজা গোলাপ গেঁথে দিয়েছে।মুখে হালকা মেকাপ,ঠোঁটে খয়েরী লিপস্টিক,আজ চোখে মোটা করে কাজল ও পড়েছে।স্পর্শতো ঘোরের মধ্যে চলে গেছে।
মিনিও দূর থেকে স্পর্শকে তাকিয়ে দেখছে।কি সুন্দর লাগছে স্পর্শকে।তারপর স্পর্শের সাথে চোখাচোখি হতেই নিজের চোখ নামিয়ে নেয় মিনি।
একে একে সব গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।মিনি,স্পর্শ, মাহিরা ওরা সবার শেষে স্পর্শের গাড়ি নিয়েই রওনা দেয়।মিনি ফ্রন্ট সিটে বসেছে আর মাহিরা পেছনের সিটে।স্পর্শ বারবার আড়চোখে মিনিকে দেখছে।মিনিও দেখছে স্পর্শকে।
রিয়াদের বাড়িতে এসেই গেইটে আদিলের সালিরা টাকার জন্য ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না আদিলকে।দশ হাজার টাকা দিতে হবে।আদিলও তার প্রেয়সীর থেকে দূরে থাকতে চায় না তাই টাকাটা দিয়েই ঢুকে পড়ে।মিনি এখানে এসে তাহমিনা চৌধুরী আর মামুন চৌধুরীর সাথে কথা বলে নেয়।আসার সময় তারা বরের পরের গাড়িতে আসায় মিনি তাদের সাথে কথা বলতে পারে নি।তাই এখন কথা বলে নেয়।
কাজী বিয়ে পড়াচ্ছেন।রিয়াকে কবুল বলতে বলল কাজী।রিয়া লজ্জায় চুপ করে আছে।কিছুসময় চুপ থাকার পর ওর মা যখন স্বায় দিলো তখন রিয়াও কবুল বলে দেয়।আদিলকে কবুল বলতে বললে,আদিল এক নিঃশ্বাসে তিনবার কবুল বলে দেয়।এ নিয়ে একদফা সবাই হেসে নেয়।বেচারী রিয়া লজ্জায় পড়ে গেছে।লোকটার কি একটুও লাজ লজ্জা নেই না-কি?
বিদায়ের বেলায় রিয়া বাবা মাকে জড়িয়ে অনেক কান্নাকাটি করে।আদিল রিয়ার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল টিস্যু লাগবে?নাকি শাড়ির আঁচল দিয়েই চোখের পানি মুছে নেবে।রিয়া কটমট চোখে তাকায় আদিলের দিকে।লোকটা আজ এতো বেসরম হয়ে গেলো কেনো?বিয়ে করে কি লাজ,লজ্জা বিসর্জন দিয়েছে নাকি?
আদিল বাসর ঘরে ঢোকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।কিন্তু তার বিচ্যু বোন ও কাজিনরা ঢুকতে দিচ্ছে না।তারা পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করেছে।শালিরাতো ভালোই ছিলো।এই ভাই-বোন গুলো দেখি আমাকে ফকির বানিয়ে ছাড়বে।মনে মনে বলল আদিল।তারপর নিজের ক্রেডিট কার্ডটা মিনির হাতে দিয়ে রুমে ঢুকে পড়ে।
আদিল আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে খাটের দিকে।তারপর রিয়ার ঘোমটা তুলতে গেলেই রিয়া পিছিয়ে যায়।আদিল ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,কি হলো তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো?আজ রাতের পর আর লজ্জা থাকবেনা।সব লজ্জা আমি ভেঙে দেবো বলেই ঘোমটা তুলতে য়ায়।স্পর্শ ঘোমটা খুলে এক চিৎকার দেয়।স্পর্শকে দেখে আদিল ও চিৎকার দেয়।
ভাইয়া আমার কোনো দোষ নেই।সব দোষ মিনির।মিনিই আমাকে জোর করে এখানে বসিয়ে দিয়ে গেছে।একদমে বলে শেষ করলো স্পর্শ।পরনের শাড়িটা ছুড়ে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
মিনি আর রিয়া দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।আদিল চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মিনি রিয়াকে রুমে দিয়ে বেরিয়ে যায়।বেচারা আদিল প্রচন্ড লজ্জা পেয়েছে।নিজের ছোট বোনের হাজবেন্ড কে কিনা বউ ভেবে কিসব বলেছে?ভাগ্যিস উল্টাপাল্টা কিছু করেনি।
হাসতে হাসতে মিনি রুমে এসে দেখে স্পর্শ মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।
চলবে……..