তোমাকে বলার ছিল…
দ্বিতীয় পর্ব
-ঠিক আছে আমি উঠলাম
– এই না
হিয়া দুই হাতে শক্ত করে তৃণার হাত চেপে ধরলো I একদম যাবি না এখন I বসে থাক চুপচাপ আমি খাবার নিয়ে আসছি I
– আমি এখন খাব না
– একশোবার খাবি I তুই সকালেও কিছু খাস নি
– তুই যদি সুজনের সঙ্গে ওই রকম করিস তাহলে তোর সঙ্গে আমি আর কথাই বলব না খাওয়া তো দূরের কথা
– কোথাকার কোন সুজন তার জন্য তুই আমাদের এত দিনের বন্ধুত্ব নষ্ট করে দিবি ?
– আচ্ছা ! সে এখন কোথাকার কোন সুজন হয়ে গেল ? ওর জন্যই না তুই একদিন মরতে বসেছিলি ডেটল ফেটল খেয়ে কি অবস্থা I
হিয়া হাসতে হাসতে বলল
– আরে ধুর I আমি ডেটল খেয়েছিলাম নাকি I এক ঢোক খেয়ে দুবার বমি করেছিলাম তারপর সবটা কমোডে ফেলে দিয়েছি I আরেকটু আশেপাশে ছড়িয়ে তোদের ভয় দেখিয়েছিলাম I
– কি ? সত্যি ?
– তো তুই কি ভেবেছিস ? আমি ওই বোরিং সুজনের জন্য মরতে যাব ?
– আচ্ছা সে এখন আবার বোরিং ও ? এত রাগ এর মধ্যেও তৃণা হেসে ফেলে
-দাঁড়া খাবারটা আগে নিয়ে আসি তারপর বলছি
হিয়া ক্যান্টিন থেকে দুটো ভুনা খিচুড়ি প্যাকেট নিয়ে এলো I একটা তৃণার হাতে দিয়ে আরেকটা নিজে নিয়ে বসলো পা ছড়িয়ে আরাম করে I তারপর বলল
– আরাম করে খা I এরপর চা আনছি
-এটা কি ঘুষ ?
– কি বাজে কথা বলিস I শোন এতদিন পর এই কথাটা থেকে বলতে পেরে খুব ফ্রি লাগছে I এতদিন মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে মরে যাব I
– কেন ?
– এসব কবিতার ভ্যানতারা আমাকে দিয়ে আর হবে না
– তোর এটা আগে ভাবা উচিত ছিল
– সেসময় একটা জেদ চেপে গিয়েছিলো
– তার মানে তুই ওকে ভালবাসিস না
– কি যন্ত্রণা I ভালো লেগেছিলো একটু কিন্তু ও ঠিক প্রেম করা টাইপের না
– তাহলে কি টাইপের ?
– কী টাইপের আল্লাই জানে I হাত ধরতে গেলে চমকে ওঠে I সেদিন চুমু খেতে গেলাম এমন ভাব করলো যেন আমি ওকে রেপ করছি I
এত ঝামেলার মধ্যেও তৃণা না হেসে পারল না I হাসতে হাসতে বলল
– তা এই চেষ্টাটা তুই কখন করলি ?
– কদিন আগে
– কোন জায়গায় ?
– এখানেই, ক্যাম্পাসে
– তোর কি মাথা খারাপ ? এই জায়গায় কেউ এমন কাজ করে ?
– করবে না কেন ? আর তাছাড়া আমরা তো প্রেম করছি তাই না ? একটু-আধটু তো চলতেই পারে
– তুই একটা ইম্পসিবল I এটাই কি তোর সমস্যা ?
– আরে না I এটা কোন সমস্যাই না I ও আমি ঠিকই সাইজ করে নিতাম I সমস্যা বেধেছে অন্য জায়গায়
– কোথায় ?
– বলছি আগে একটু খেতে দে আরাম করে
তৃণা ঘড়ি দেখল I বাসের সময় প্রায় হয়ে এসেছে I এখনই না উঠলে ঝামেলায় পড়ে যাবে I তৃণা বললো
– আমাকে যেতে হবে রে I রাতে ফোনে কথা বলছি I আর শোন এর আগে সুজানের সঙ্গে কোন কথা বলবি না I এসব ব্রেকআপের চিন্তা মাথা থেকে বের করে ফেল I
হিয়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তৃণা ওকে থামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল I হিয়া আপন মনেই বিড় বিড় করে বললো
কিন্তু এখনতো অনেক দেরী হয়ে গেছে I আমি তো অলরেডি ওকে বলে ফেলেছি I
টিউশনি সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তৃণার সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল I ভেবেছিল আজ বেতনের টাকাটা পাবে I কিন্তু আন্টি বাড়ি ছিল না I মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল I টাকাটা ভীষণ দরকার ছিল I নানা ঝামেলায় হিয়ার কথা মনে ছিল না তৃণার I সাড়ে নয়টা বাজায় খেয়াল হলো I তৃণা ফোন চেক করে দেখলো হিয়া কল করেনি I অগত্যা তৃণাই কল দিল I কল ওয়েটিং এ দেখাচ্ছে কেন ? তৃণা হাত মুখ ধুয়ে আধা ঘন্টা পরে আবার কল দিল I এখনো ওয়েটিং এ I কি অদ্ভুত I সুজনের সঙ্গে আবার ভাব হয়ে গেল নাকি I তৃণা মনে মনে একটু খুশি হলো I আরো অনেকক্ষণ পর তৃণা যখন শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন হিয়ার কল এলো
– হ্যালো তৃণা
– কি ? সুজনের সঙ্গে আবার ভাব হয়ে গেছে তাইনা ? আমি জানতাম
– কচু জানতি তুই
তৃণা একটু গম্ভীর হলো I
– তাহলে এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
– হিয়া ভয়ে ভয়ে বলল রাতিনের সঙ্গে
তৃণা থমথমে গলায় বলল
– কোন রাতিন ?
-কয়টা রাতিন কে চিনিস তুই ?
-আমিতো একটাকেই চিনি I অ্যাপ্লাইড ফিজিকস এর I বদমাইশের হাড্ডি একটা
– যা এভাবে বলিস না I খুবই চার্মিং ছেলে
-তুই কি এখন আবার ওর সঙ্গে প্রেম করার ধান্দা করছিস ?
– আরে না I আর করলেই বা সমস্যা কি ? I am a free bird now
-মানে ? তুই কি সুজন কে মানা করে দিয়েছিস
– হ্যাঁ
– কবে ?
– দুই দিন হয়ে গেল
-ও তোকে মেসেজ পাঠাচ্ছে না ?
– কি জানি I পাঠাচ্ছে হয়তো I আমি আইডি চেঞ্জ করে ফেলেছি I ওর ফোন নাম্বার ব্লক করে দিয়েছি
তৃণার আগুন ধরে গেল I মনে হল হিয়া ওর সামনে থাকলে ওকে টেনে দুটো চড় বসিয়ে দিত I রেগেমেগে ফোন রেখে দিল তৃণা I
তৃণা ঘড়ি দেখল I প্রায় এগারোটা বাজে I ইস সুজন নিশ্চয়ই মেসেজের জন্য অপেক্ষা করছে I একটা পাতলা শাল জড়িয়ে ছাদে চলে গেল তৃণা I তৃণাদেরএই বাড়িটা অনেক পুরনো I তৃণার দাদা কিনেছিলেন অনেক বছর আগে I তখন এই অঞ্চলটা তেমন ডেভলপড হয়নি I ওর দাদা বাড়ি চট্টগ্রামে I ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ওখানেই ছিল I দাদির কাছে I ক্লাস ফাইভে যখন ও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় দাদি ওকে ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বড় চাচার কাছে , যাতে এখানে থেকে ভালো স্কুলে পড়তে পারে I যদিও খুব একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করা হয়নি I সরকারি স্কুলে ই পড়েছো I তবু আগাগোড়াই ওর রেজাল্ট ভালো I
তৃণার বাবা-মা নেই I আসলে থেকেও নেই I এখন তো ওর বাবা মায়ের মুখ ও মনে পড়ে না I বাবা কখনো ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি I এতগুলো বছর হয়ে গেল I তবে বাবার প্রতি ওর কেন জানি কোন রাগ নেই I তবে মায়ের প্রতি খুব অভিমান হয় I এখানে আসার তিন বছর পর ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষার আগে ওকে কিছুতেই কোচিং করতে দেওয়া হচ্ছিল না I তৃণা তখন গোপনে ওর মাকে একটা চিঠি লিখেছিল I একবার দেখা করতে চেয়েছিল I মা দেখা করেনি I কিন্তু চিঠির জবাব দিয়েছিল খুব দ্রুতই I তা ও পোস্টে না I স্কুলের দারোয়ান এর কাছে দিয়ে গিয়েছিল ওর জন্য I চিঠির কয়েকটা লাইন আজও ভুলতে পারেনা তৃণা I মা লিখেছিলেন
তুমি নিশ্চয়ই চাও না তোমার জন্য আমার সংসারটা ভেঙে যাক I আমার স্বামী জানেন না যে আমার একটা মেয়ে আছে I যদি এখন জানতে পারেন তাহলে ঘাড় ধাক্কা দিয়া আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন I আমার যাবার মত আর কোন জায়গা নেই I আমার কাছ থেকে কোনো আশা রেখো না I ওনারা যেভাবে বলে এভাবেই চল I এটাই তোমার জীবন I যার বাপ তাকে পেটে রেখে পালিয়ে যায় অন্য মহিলার সঙ্গে তার এত বড় বড় স্বপ্ন দেখা মানায় না I
তখন তৃণার বয়স কত হবে তেরো বড়জোর I চিঠিটা পেয়ে অনেক কেঁদেছিল তৃণা I ওই বয়সেও একটা কথা খুব ভালো করে বুঝে ছিল তৃণা I এই পৃথিবীতে ভালোবাসা বলে কিছু নেই I শুনেছে ওর বাবা-মা ভালবেসে বিয়ে করেছিল I এই যদি হয় ভালোবাসার নমুনা তবে তৃণা কোনদিনও কাউকে ভালোবাসবে না, কোনদিনও না I
নাদিয়া ম্যাডাম ওদের বাংলা পড়াতেন I তৃণা কে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন উনি I তৃণার এই পর্যন্ত উঠে আসতে উনার অবদান অনেক I আরেকজনের অবদান ও আছে I তাই আজও তার যেকোনো আবদার তৃণা ফেলতে পারেনা I
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদ থেকে নেমে গেল তৃণা I আগামীকাল একটা আবৃত্তি প্রোগ্রাম আছে I সকালে ক্লাস আছে দুপুরে ল্যাব I তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া দরকার I সিঁড়ির কাছাকাছি এসে দেখলো ফোনে একটা মেসেজ এসেছে I আশ্চর্য খেয়াল করেনি কেন ? অন্যমনস্ক ছিল হয়তো I মেসেজটা পড়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেল তৃণার I
চলবে……..
লেখনীতে
অনিমা হাসান