তুমি রবে ৪৬
.
.
একটা মিষ্টি সকাল, জানালার কাচ ভেদ করে কয়েক পশলা সোনালী মিষ্টি রোদ, পাশের সেন্টার টেবিলটাতে এক মগ ধোঁয়া তোলা কফি। আর তার সাথে আজ থেকে যুক্ত হলো রোজ সকালে স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ প্রিয় একটি মুখ। বেলা সাড়ে দশটার সময় ঘুমকে ছুটি দিয়ে চোখ মেলে তাকাল আশফি। জানালার ওপর থেকে পর্দাটা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শীতের সকালের রৌদ্রস্নাত প্রকৃতি আজ বেশিই মনকাড়া লাগছে তার। গোলাপি বর্ণের জামদানি শাড়ি পরিহিতা তার রমণী বাবার বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশে তার লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত বিছানার এক কোণে বসে।
ঘুম ভেঙে উঠে বসতেই তার সেই রমণীই তার নজরে আগে পড়ল। মাহি একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখল আশফিকে। নজর ফিরিয়ে আনতে গিয়ে দ্বিতীয়বারের সময় তার ওপর আবার আটকে গেল সেই নজর। হাঁটু উঁচু করে তার ওপর হাত ঝুলিয়ে বসে আছে আশফি। চেয়ে দেখছে সে তার স্ত্রীর কার্যকলাপ। নিজের দিকে এভাবে নিষ্পলক চোখে মাহিকে চেয়ে থাকতে দেখে এবার সেও পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল তার চোখের দিকে। কী দেখছে সে তার দিকে চেয়ে তা আশফি বুঝতে পারছে না। তবে চেয়ে যে আছে তার ওই সুন্দর চোখদুটো মেলে, সেটাই আশফির খুব ভালো লাগছে।
নজর ফিরিয়ে নেওয়ার মুহূর্তে মাহি গম্ভীর সুরে তাকে বলল,
– “আমি এগারোটার সময় বের হবো।”
আশফির কিছু বলার পূর্বেই মাহি উঠে রুমের বাহিরে চলে গেল। বসে থেকে চুলগুলোর মাঝে কিছুক্ষণ আঙুল চালিয়ে বাথরুমে যাওয়ার উদ্দেশে উঠতেই মাহির ফোন বেজে উঠল। দরজার দিকে একবার তাকাল মাহি আসছে কি না। তা দেখতেই দেখতেই তার ফোনটা বেজে কেটে গেল। এরপর আবার বেজে উঠল। এবার আশফি ফোনটার কাছে এগিয়ে এসে দেখতে পেলো সোম নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। মুহূর্তেই আশফির শান্ত মেজাজ বিশ্রী হয়ে উঠল কেমন। শুধু চেয়ে থাকল সে ফোনটার দিকে। কেটে যেতেই দেখল সে দুটো মেসেজও করেছে। এবার সে ফোন তুলে মেসেজ দুটো ওপেন করে দেখল মাহিকে সে ফোন রিসিভ করতে বলেছে বারবার। কল লিস্টও চেক করল আশফি। কাল রাত থেকে অনেকবার সে কল করে যাচ্ছে মাহিকে। এই মুহূর্তে মেজাজ শান্ত করার জন্য সে ফোন থেকে সিমকার্ড খুলে নিয়ে বাথরুমে গিয়ে তা ফ্ল্যাশ করে দিলো। বাথরুম থেকে বের হতেই বাথরুমের দরজার সামনে দুজন মুখোমুখি হলো। এত সময় বাদে আশফি খেয়াল করল মাহি নাকে ফলস্ নোজপনি পরেছে। যা তার সঙ্গে একটুও মানাচ্ছে না। আর মাহি এবারও তার নীরব চাহনি মেলে দেখতে থাকল আশফিকে। ভারী পুরুষালী কণ্ঠে আশফি বলে উঠল,
– “এটা কে দিয়েছে?”
– “কোনটা?”
আশফি তার নাকে ইশারা করল। মাহি জবাব দিলো,
– “দাদীবু দিয়েছেন। বললেন আজকের দিনটার জন্য পরতে।”
– “আজকের দিনটাতে কী?”
– “জানি না। আমাকে দেখে নাকি বিবাহিত মনে হচ্ছে না। তাই পরতে বলেছেন।”
– “বিয়ে করলে বিবাহিত দেখাতে হবে এমন কোনো কথা আছে?”
– “না নেই। আর আমার এটা পরে খুব অস্বস্তি লাগছে। বাড়িতে যাওয়ার পর খুলে ফেলব।”
আশফি এবার কোনো কথা ছাড়াই মাহির নাক থেকে ওটা খুলে নিয়ে বলল,
– “বিয়ের দিন পরলেন না তো বিয়ের পর ঘরের মধ্যে পরে বিবাহিত দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এগুলো আর পরবেন না। একদমই যায় না আপনার সঙ্গে।”
আশফি নোজপিনটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গোসলের জন্য বাথরুমে ঢুকে গেল। আর মাহি এই মুহূর্তে তাকে নিয়ে ভাবতে থাকল,
– “সব মুহূর্তেই কি এই মানুষটা এত সুন্দর? ঘুমাতে যাওয়ার আগেও সে নির্মল আর ঘুম থেকে ওঠার পরেও।”
গোসল করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মাহি একবার ভ্রু কুচকে তাকাল তার দিকে। এখন তারা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। আশফি মাথা মুছে আয়নার ভেতরেই মাহিকে চোখের ইশারাতে জিজ্ঞাসা করল কিছু। মাহি তার কোনো উত্তর না দিয়ে চুল খোঁপা করতে ব্যস্ত হলো আবার। আশফি খেয়াল করল মাহির গম্ভীর মুখটা আরও বেশি ভার হয়ে আছে। ব্রাশটা হাতে নেওয়ার মুহূর্তে আশফি সেই বক্সটা দেখতে পেলো যেখানে সেই নীল বর্ণের হীরার আংটি জ্বলজ্বল করছে। এর মাঝে ঐন্দ্রী শাওনের হাত দিয়ে আংটিটা পাঠিয়ে দিয়েছে। মাহির দিকে তাকাতেই মাহির দৃষ্টি তার ওপর দেখে আশফি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কারণ তার আগেই মাহি বলল,
– “এই জিনিসটাতে আর কখনোই আমাকে ফোর্স করতে পারবেন না আপনি।”
– “এটার উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র আমার স্ত্রী।”
– “যেই হোক। আমার কাছে এটা চিরকালই অগ্রহণযোগ্য রবে।”
– “আমি কিন্তু একবারও বলিনি এটা তোমাকে ব্যবহারের করার জন্য। ”
– “আগামীতেও কখনো যেন আর না বলেন তাই বলে রাখলাম।”
আশফি তার কাছে কিছুটা এগিয়ে এসে তার কপালের এক পাশের ছোট চুলগুলো তার কানের পিঠ থেকে বের করে এনে তা ছেড়ে দিলো। তারপর বলল,
– “সবসময়ই স্বামী স্ত্রীর বিশেষরাতে যে স্বামীর তরফ থেকেই গিফ্টটা আসবে এমন কোনো আইন আছে? ওটা ছিল আমার জীবনে আপনার আগমনের আহ্বান জানানোর প্রস্তাবস্বরূপ। তাই ওটা বাদেই নিয়মে আমার থেকে তোমার কিছু পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই নিয়মটা শুধু আমার বেলাতে কেন? আমার বউয়ের বেলাতে কেন নয়?”
মাহি একটু সময় চুপ থেকে কেমন মিইয়ে পড়া কণ্ঠে বলল,
– “আমি তেমন কোনো প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি কাল।”
– “কালই যে দিতে হবে এমনটা তো নয়।”
– “ঠিক আছে পরে কখনো দেবো।”
– “অবশ্যই এক্সপেন্সিভ কিছু চায় আমার।”
– “মানে গিফ্ট তো গিফ্ট। এখানে এক্সপেন্সিভ…”
কথাটা বলতে গিয়েও পুরোপুরি বলল না সে। কারণ গিফ্টটা আশফির তরফ থেকে আসলে তা যে কতটা দামী হতো সে বিষয়ে মাহির আন্দাজ হয়ে গেছে। কিন্তু তার চিন্তার বিষয় তার মতো দামী কিছু কেনার সামর্থ্য যে তার নেই। তাহলে কীভাবে সে এই গিফ্টের ঝামেলা চোকাবে? এদিকে না দিতে চাইলেও ব্যাপারটা ভালো দেখায় না এখানে।
বেলা বারোটার মধ্যে আশফি মাহিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তার বাবার বাড়ির উদ্দেশে। গাড়িতে বসার পর বেশ কিছু দূর আসতেই আশফি বলল,
– “থাকতে হবে কতদিন?”
মাহি চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকাল তার দিকে। আশফি তার চাউনিতেই বুঝতে পারল বেশ অর্থহীন একটা প্রশ্ন করে ফেলেছে সে। পরিস্থিতি কিছুটা সামলে নিয়ে বলল,
– “না মানে জিজ্ঞেস করছি বউদের থাকার নিয়ম কতদিন বাবার বাড়িতে?”
– “জানি না। কেন আপনি যাবেন না?”
– “আমি যাব কেন?”
– “যেতে হয় জানি।”
– “মানে এটা কি নিয়ম? আমার অফিসের জন্য সমস্যা হবে।”
– “আমি তো জানি আপনি বেশ সোজাসাপ্টা ধরনের।”
আশফি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
– “হ্যাঁ আমার আসলেই যাওয়ার ইচ্ছা নেই।”
– “ধন্যবাদ।”
– “ধন্যবাদ কেন? মানে আমি না গেলে তুমি ওখানে থেকে যেতে পারবে।তাই ভাবছো?”
– “হয়তো। আপনার না থাকাটা আমার কাছে খুব স্বস্তির কিনা, তাই।”
আশফি গাড়িটা থামিয়ে ফেলল জ্যামে পড়ে। আশফি তার সে কথার জবাব এড়িয়ে বলল,
– “পরশুদিন নিতে আসব তোমাকে। তুমি পৌঁছানোর পর শায়খ যাবে একটা সিমকার্ড দিতে। ওটা ফোনে ওপেন করে নিও। আর সেই নম্বরটা যেন কোনোক্রমেই কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে না পৌঁছায়।”
– “বুঝতে পারলাম না। নতুন সিমকার্ড কেন?”
– “পুরোনোটা আমি ফেলে দিয়েছি।”
মাহির প্রশ্ন করার পূর্বেই আশফি তাকে বলল,
– “আমি আবারও বলছি, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে যেন বর্তমান নম্বর কোনোক্রমেই না পৌঁছায়।”
.
.
ঘুম থেকে জাগতে জাগতে বেলা বারোটা বেজে গেছে ঐন্দ্রীর। উঠেই সে তড়িঘড়ি করে সব কিছু গুছিয়ে নিতে আরম্ভ করল। সকালের নাস্তা করতেও সে নিচে গেল না। জেবা এসে কতবার ডেকে গেছে তাকে। নানারকম অজুহাত দেখিয়ে নাস্তা সে স্কিপ করেছে। দিশান আর শায়খ এক সঙ্গে উঠেছে আশফির ফোন পেয়ে। ফ্রেশ হওয়ার জন্য রুমে আসতেই ঐন্দ্রীকে রেডি হতে দেখে সে জিজ্ঞেস করল,
– “কোথাও কি যাবে?”
ঐন্দ্রী দ্রুত চোখদুটো মুছে নিয়ে বলল,
– “আরে ভুলে গেলে না কি? বাড়ি যাব না আজ?”
– “ও আচ্ছা। দাঁড়াও আমি পাঁচ মিনিটে রেডি হচ্ছি।”
দিশান বাথরুমের দিকে পা বাড়াতেই ঐন্দ্রী তার হাত টেনে ধরে বলল,
– “তুমি কোথায় যাবে?”
– “আমি যাব না? তুমি একা যাবে না কি? দাঁড়াও আমি দ্রুত শাওয়ার নিচ্ছি।”
– “তোমাকে যেতে হবে না দিশান। এমনিতেই অনেক ঝামেলায় ফেলেছি তোমাকে। আবার দাদা, দাদীবু সবাইকেও ম্যানেজ করতে হবে তোমাকেই।”
– “এভাবে কেন বলছো তুমি? আজকের এই সম্পর্কটা ছাড়াও আরও একটা সম্পর্ক আছে আমাদের মাঝে। সেটা কি ভুলে গেলে?”
– “কিছুইনি ভুলিনি। তারপরও আর কষ্ট করতে হবে না তোমাকে।”
– “কষ্ট? জামাই আদর পাওয়া কষ্ট? হলাম না হয় হালকা জামাই। জামাই তো না কি? তাই বলে এভাবে অবজ্ঞা করতে পারো না।”
– “দিশান!”
ঐন্দ্রী মৃদু হেসে কপট ধমকের সুরে বলল। দিশান হাসতে হাসতে বাথরুমে ঢুকে বলল,
– “পাঁচ মিনিট বসো।”
.
আজ ভারী নিঃশ্বাসও পড়তে চাইছে না ঐন্দ্রীর। একটা ভুল আর সেই ভুলের কারণে জিদ তার জীবনের মোড়ই ঘুরিয়ে দিলো। ভুলটা তো তার ছিল না। কিন্তু জিদটা তার ছিল। আর সেই জিদ আজ তাকে কোথায় দাঁড় করায় তা দেখার অপেক্ষাতে সে। তবে সে আর ভয় পাবে না। তার জীবনের ভুল সিদ্ধান্ত আর সেই ভুলের মাশুলও তাকেই গুণতে হবে। তাই সে ভেঙেও পড়বে না। কিন্তু এই যে এতবার সে নিজেকে বোঝাচ্ছে ভেঙে পড়বে না বলে, তবুও তো চোখদুটো বারবার ভিজে উঠছে। কী করে দাঁড়াবে আজ সে বাবা-মায়ের সামনে? কী করে বলবে সে আজ তার পরিস্থিতিগুলো?
– “ঐন্দ্রী?”
দিশানের ডাকে চমকে পিছে তাকাল সে। তাদের বিদায় জানাতে সবাই বাইরে চলে এসেছে। এক কৃত্তিম হাসি মুখে ফুটিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠল সে। বহুদূর চলে এলো তারা বাড়িটাকে পেছনে ফেলে। কয়েকবার আশফির মুখটাও ভেসে উঠল তার চোখের পর্দায়। কিন্তু আজকের পর তাকে নিয়ে ভাবনাটা যে পাপ। সে আজ বিবাহিত পুরুষ আর সম্পূর্ণই সে অন্য কারো। দিশান ড্রাইভিং সিটে। আর সে পিছে। অনেকবার বলার পরও সে সামনে এসে বসেনি। না হলে যে তার কান্না দেখে ফেলবে দিশান। আর তাহলে সে মনে করবে ঐন্দ্রী তাদের কাছে করুণা চাইছে আবারও। কিন্তু সে আর করুণা নিতে চায় না।
মনের আকাশ আর চোখের আকাশে বৃষ্টি বহু আগে থেকেই ঝরছে। এর মাঝে ধরনীর বুকের আকাশ কালো হয়ে উঠল। মিনিট পাঁচেক সময় নিলো মেঘগুলো সেই ধরনীকে ভিজিয়ে দিতে। অসময়ের বৃষ্টির স্থায়িত্ব খুব কম। কিন্তু ঐন্দ্রী আজ চাইছে সারাটা সময় যেন এই পৃথিবীটা বৃষ্টিমুখর হয়ে থাকে। মনকে শান্তনা দেওয়ার মতো একটা জায়গা পাবে তো সে। তার কষ্টে হয়তো এই সবুজে ঘেরা প্রকৃতিও কাঁদছে!
– “ঐন্দ্রী কাচটা লাগিয়ে দাও। বৃষ্টি আসছে ভেতরে।”
– “থাক না দিশান।”
দিশান একবার ভিউ মিরোরে ঐন্দ্রীকে দেখল। জানালার মুখে তার মাথাটা। আজ তার ভেতরে কী চলছে এটুকু বুঝতে তার বাকি নেই। কিন্তু এখানেও সে অক্ষম। কিছু করার ক্ষমতা নেই তার। তাকে ধরে রাখার ক্ষমতাও নেই আর সেই ইচ্ছাও নেই। বাধ্য হয়েই হোক, তাকে ধরে রাখার জন্যই সে এই বিয়েটা করেছিল। কিন্তু আজ সে-ই এই বাধ্য হয়ে করা বিয়ে নামক সম্পর্ক থেকে ছুটি চাইছে। এখানে তাকে ধরে রাখার মতো কোনো ক্ষমতাই যে সে রাখে না।
রাস্তার কিনার ঘেষে তার সেই চিরচেনা মানুষটা কেমন তড়িঘড়ি করে হেঁটে যাচ্ছে। কিছু দূর আসতেই খুব সুক্ষ্ম দৃষ্টি পড়ল সেদিকে দিশানের।
আশেপাশে ফাঁকা ট্যাক্সি অহরহভাবে যাতায়াত করছে। কিন্তু সে এভাবে কোথায় চলেছে? পেছন থেকে ঐন্দ্রীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরে শুনতে পেলো,
– “ওটা দিয়া না? দিশান দেখতে পাচ্ছো?”
দিশানের নজর আগেই গেঁথে আছে সেদিকে। গাড়িটা সাইড করে দাঁড় করিয়ে সে বৃষ্টির মধ্যেই নেমে গেল। হাঁক ছেড়ে পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকল সে দিয়াকে। কিন্তু তার কান অবধি সে ডাক পৌঁছায়নি সম্ভবত।
আচমকা কেউ টেনে ধরাতে চমকে ফিরে তাকাল দিয়া। দিশানকে দেখতেই দিশান চেঁচিয়ে উঠে বলল,
– “বধির হয়ে গেছো? ডাকছি কতক্ষণ ধরে শুনতে পাওনি? এমন আনমাইন্ডফুল হয়ে কোন রাজকার্য উদ্ধার করতে যাচ্ছো?”
– “যাচ্ছি একটা কাজে। তুমি কী করছো এখানে?”
এর মাঝে ঐন্দ্রী ডেকে উঠল দিশানকে। চেঁচিয়ে বলল,
– “তোমরা দুজন বাইরে দাঁড়িয়ে না ভিজে গাড়িতে উঠে এসো।”
দিশান দিয়ার হাত ধরে রাখা অবস্থাতেই বলল,
– “তাড়াতাড়ি চলো। ছাতা না থাকলে, ট্যাক্সিতে ওঠার টাকা না থাকলে বাসা থেকে বের হতে বলে কে?”
দিয়া তার হাত থেকে নিজের হাত টেনে নিয়ে বলল,
– “আমি যাব না। টাকা আছে আমার কাছে। ট্যাক্সি করে চলে যাব।”
দিশান এবার রেগে গিয়ে বলল,
– “আমাকে ফোর্স করতে বাধ্য করো না আর ক্ষেপিয়েও তুলো না।”
এরপর দিয়ার হাত ধরে একরকম টেনে এনে তাকে গাড়িতে তুলে দিলো সে। ঐন্দ্রী দিয়াকে বলল,
– “পাগলের মতো কোথায় দোঁড়াচ্ছিলি এমন বৃষ্টির মধ্যে?”
– “একটা কাজ ছিল। দেরি হয়ে গেছে খুব।”
– “তাই বলে এভাবে ভিজে যাবি!”
ভিউ মিরোরে দিশান চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে দিয়াকে। দিয়ার চোখে চোখ পড়লেও সে নজর না ফিরিয়ে আরও গাঢ় চাহনিতে তাকিয়ে থাকে। দিয়ার হাতে একটা ফাইল দেখল ঐন্দ্রী। যেটার ভেতরের কাগজগুলো দেখেই ঐন্দ্রী বুঝতে পারল দিয়া দেশের বাইরে কোথাও ঢুকছে। সে জিজ্ঞেসও করে ফেলল তাকে,
– “কোনো জব পেয়েছিস অস্ট্রেলিয়াতে?”
– “তুই কী করে জানলি?”
– “তোর ফাইলের ভেতরের কাগজ দেখেই জানলাম।”
– “হ্যাঁ, আমার খালামনির হাজবেন্ডের মাধ্যমে একটা জব অফার পেয়েছি।”
– “গ্রাফিক্সে, না?”
এটা শুনতেই দিশান আবার তাকাল দিয়ার দিকে। দিয়াও এবার তাকাল দিশানের দৃষ্টিতে। এই স্বপ্নটা তাকে দিশানই দেখিয়েছিল এই কাজের প্রতি তার আগ্রহ দেখে৷ কথা ছিল তা পূরণের দায়িত্বও দিশান নেবে। কিন্তু আজ তার স্বপ্নপূরণ ঠিকই হচ্ছে। শুধু সেই মানুষটা থাকছে না। ঐন্দ্রী তাকে জিজ্ঞেস করল,
– “যেতে হবে কবে?”
– “এ মাসেই।”
এরপর কিছুক্ষণ স্তব্ধ গাড়ির ভেতরে। দিশান এবার এক সেকেন্ডের জন্যও চোখ সরাতে পারছে না দিয়ার থেকে। ঐন্দ্রী তা খেয়াল করে বলতে চাইল গাড়ি দেখে চালাতে তাকে। কিন্তু সে কথা মুখে থাকতেই বিপদটা ঘটে গেল। একটা বাইকের সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলল সে। বাইকারকে সেফ করতে গিয়ে বড় আঘাতটা পেলো দিশান। দুর্ভাগ্য বলে আজ সে সিটবেল্টও বাঁধেনি৷ স্টিয়ারিংয়ের সঙ্গে মাথা বেশ জোরে ধাক্কা খেয়ে খানিকটা রক্তাক্ত হলো তার কপাল। পেছনের সিটে দিয়া আর ঐন্দ্রীও ঝাঁকি খেলেও তারা ঠিক আছে। মুহূর্তে দিয়া চিল্লিয়ে উঠে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত দিশানের কাছে চলে এলো। চারপাশে লোক জড়ো হলেও কাউকে সাহায্য করার জন্য পেলো না ঐন্দ্রী। তারা বাইকারকে নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত। ঐন্দ্রী দিয়াকে বলল,
– “ওকে কষ্ট করে পেছনের সিটে নিয়ে আয় দিয়া।”
দিয়া কান্না থামিয়ে দিশানকে কয়েকবার ডাকল। তার সেন্স যায় যায় অবস্থা। খুব কষ্টে সে দিয়ার ডাকে চোখ মেলে তাকিয়ে তার সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে পেছনের সিটে এসে বসলো। দিয়ার নীল বর্ণের জামা তার কপালের রক্তে কাঁধের এক পাশ ভিজে গেছে। অতি দ্রুত ঐন্দ্রী গাড়ি নিয়ে চলে এলো হসপিটাল।
.
দুটো স্টিচ লাগল তার কপালে। পাশে দিয়া, ঐন্দ্রী দুজনেই ছিল। ডক্টর যেতেই ঐন্দ্রী তাকে বলল,
– “ভাগ্য ভালো বড় কিছু ঘটেনি।”
দিশান জিজ্ঞেস করল,
– “ডক্টর কী বলে গেল? থাকতে হবে না কি?”
– “জিজ্ঞেস করিনি। আমি কথা বলে আসি।”
ঐন্দ্রী যেতেই দিশান উঠে বসলো। দিয়া তখনো পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। দিশান একবার চোখের ইশারায় তাকে কাছে ডাকল। দিয়া একটুও নড়ল না। মাথাটা নিচু করে সে কাঁদতেই থাকল। দিশান এবার বলল,
– “আমাকেই উঠতে হবে তাহলে।”
কথাটা বলে সে নামতে গেলেই দিয়া দ্রুত ছুটে এলো তার কাছে। কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সে দিশানের বুকে। দিশান তাকে জড়িয়ে ধরে হেসে উঠল। মাথার এক পাশে একটা চুমু খেয়ে সে বলল,
– “বুঝতে পেরেছো কিছু? শুধু যাওয়ার কথা বলেছো তাতেই কী অবস্থা হলো! আর আমাকে রেখে চলে গেলে এরপর যে কবরস্থান যেতে হবে তোমাকে তা নিশ্চয় বুঝেছো?”
– “একেবারে ফালতু কথা বলবে না।”
– “তো আমাকে রেখে যাওয়ার প্ল্যান করলে কেন?”
– “তো কী করব আমি এখানে থেকে?”
– “করার মতো কিছু নেই তো আমাকে তা বলবে তো।”
কথাটা বলেই মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে দিয়াকে বাহুবন্ধ রেখেই তার অধরপল্লবও দিশান বদ্ধ করে নিলো নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে।
ঐন্দ্রী ডক্টরের সঙ্গে কথা বলে দিশানকে একটা মেসেজ করে দিয়ে চলে গেল। কারণ পিছে ফিরে এসে ওই মানুষ দুটোর মাঝে নিজেকে আর কাঁটা বানাতে চায় না সে। তবে আজ সে সত্যিই খুব ভয় পাচ্ছে। আজকের পর কোথায় এগোবে তার জীবন তা সে ধারণা করতে পারছে না।
.
.
চোখদুটোর চাউনিতেই প্রমাণ মেলে যে সে কতটা চায় তাকে। আজ সকাল থেকে এখন অবধি মাহির দৃষ্টি বারবার ঘুরছে ফিরছে আশফির দিকে। আশফি তা বুঝতে পেরেও এড়িয়ে চলছে ব্যাপারটা। মাহিকে সে অপ্রস্তুত করতে চাইছে না আপাতত। কিন্তু তার খুব জানতে ইচ্ছা করছে। এই চাউনির উদ্দেশ্য কি তাকে চিরকাল ফেলে যাওয়ার পূর্বে একবার প্রাণভরে দেখে নেওয়া? না কি এত কালের তৃষ্ণার্ত আঁখির তৃষ্ণা নিবারণ করা?
– “সবাই জিজ্ঞেস করলে কী বলব?”
মাহির প্রশ্নে আশফি বেশ নির্বিকার ভঙ্গীতে জবাব দিলো,
– “ফেলে চলে এসেছি।”
মাহি ভ্রুজোড়ার মাঝভাগ কুচকে ফেলে তাকাল তার দিকে। আশফি তা দেখেও বলল,
– “এটাই বলতে পারো।”
– “তা-ই বলব।”
– “বলবে।”
একদম বাড়ির মূল ফটকে এসে দাঁড়াল তাদের গাড়ি। গাড়িটা দাঁড়াতেই আশেপাশের কয়েকজন প্রতিবেশী তাদের নিজেদের বাসার গেটের কাছে এসে দাঁড়াল মাহির জামাই দেখার উদ্দেশে। কেউ বা ব্যালকনিতে এসেও দাঁড়িয়ে দেখছে তাদের। মাহির বিয়ের কাহিনী একটা দুর্দান্তকর আলোচনার বিষয়বস্তু তাদের মহল্লাতে। সবার মাঝে কৌতূহলের শেষ নেই এ নিয়ে। মাহি গাড়ি থেকে নামল কোনো কথা ছাড়াই। কিন্তু গাড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কিছু বলার জন্য তাকাল আশফির দিকে। আশফি তার ভাব বুঝতে পেরে বলল,
– “সমস্যা নেই, শ্বশুড় বাড়িতে কফি খেতে না পারলেও নিজের বাড়িতে কফি করে খাওয়ালেই হবে।”
মেজাজটা পুরোই খিঁচে উঠল মাহির। যতটুতু বলার ইচ্ছা ছিল তাকে ভেতরে আসতে বলার জন্য। তার পুরোটাই মাটি করে দিলো লোকটা। আর একটা কথা না বলেও মাহি গটগট করে হেঁটে চলে গেল। ভেতরে না ঢোকা অবধি তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে গাড়িটা টেনে সামনে চলে এলো আশফি। আর সে সামনে যেতেই সোমের বাইক এসে থামল সেখানে। সামনে এগোতেই আশফি ভিউ মিরোরে সোমকে দেখল সে তার মা’কে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির সামনে। মুহূর্তেই ওখানে ব্রেক কষল সে। এতদিন ধৈর্য বেঁধে রাখতে পারলেও আজ এর একটা শেষ পরিণতি করেই ছাড়বে সে। মাহির বেলাতে অন্তত আর সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না।
……………………………..
(চলবে)
– Israt Jahan Sobrin
অগোছালো পর্বের ভুল-ত্রুটিগুলোকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। আশা করতে পারি কি পাঠকদের থেকে কিছু গঠনমূলক মন্তব্য?
We use cookies on our website to give you the most relevant experience by remembering your preferences and repeat visits. By clicking “Accept All”, you consent to the use of ALL the cookies. However, you may visit "Cookie Settings" to provide a controlled consent.
This website uses cookies to improve your experience while you navigate through the website. Out of these, the cookies that are categorized as necessary are stored on your browser as they are essential for the working of basic functionalities of the website. We also use third-party cookies that help us analyze and understand how you use this website. These cookies will be stored in your browser only with your consent. You also have the option to opt-out of these cookies. But opting out of some of these cookies may affect your browsing experience.
Necessary cookies are absolutely essential for the website to function properly. These cookies ensure basic functionalities and security features of the website, anonymously.
Cookie
Duration
Description
cookielawinfo-checkbox-analytics
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Analytics".
cookielawinfo-checkbox-functional
11 months
The cookie is set by GDPR cookie consent to record the user consent for the cookies in the category "Functional".
cookielawinfo-checkbox-necessary
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookies is used to store the user consent for the cookies in the category "Necessary".
cookielawinfo-checkbox-others
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Other.
cookielawinfo-checkbox-performance
11 months
This cookie is set by GDPR Cookie Consent plugin. The cookie is used to store the user consent for the cookies in the category "Performance".
viewed_cookie_policy
11 months
The cookie is set by the GDPR Cookie Consent plugin and is used to store whether or not user has consented to the use of cookies. It does not store any personal data.
Functional cookies help to perform certain functionalities like sharing the content of the website on social media platforms, collect feedbacks, and other third-party features.
Performance cookies are used to understand and analyze the key performance indexes of the website which helps in delivering a better user experience for the visitors.
Analytical cookies are used to understand how visitors interact with the website. These cookies help provide information on metrics the number of visitors, bounce rate, traffic source, etc.
Advertisement cookies are used to provide visitors with relevant ads and marketing campaigns. These cookies track visitors across websites and collect information to provide customized ads.