তুমি রবে নীরবে শেষ পর্ব

0
2617

#তুমি_রবে_নীরবে
#শেষপর্ব
#সাদিয়া_ইসলাম_ইকরা

ঠিক নয় দিন পর অয়ন ভাইয়ার বিয়ে।এর মধ্যে আমাকে যা করার করতে হবে!দরকার হলে পালিয়ে যাব।দরকার হলে এই বিষয়ে আদিব ভাইয়ার সাথে কথা বলব।

তবে এখন না একটু সময় নিয়ে দেখি!সময় নিলেও বা আর কি এমন হবে!যা হওয়ার তাই তো হবে। কয়েকটা রাত প্রায় না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি।যেতে যেতে প্রায় সাতটা দিন চলে গেল আমি মনে মনে ভাবলাম না আর দেরি করা যাবে না।আমাকে একবার আদিব ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে।

রুমে বসে আছি।তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে।আদিব ভাইয়াকে এইবার কলটা দিয়েই দিই।কিন্তু রুমে যদি কথা বলি তাহলে কেউ শুনে নিবে।ছাদে গিয়ে বললে ভালো হবে।মোবাইলটা নিয়ে ছাদে গেলাম

ছাদে আসার আগে একবার দেখে নিয়েছিলাম কে কোন রুমে আছে আদিব ভাইয়ার দিয়ে যাওয়া চিরকুট টাও সাথে করে নিয়ে এসেছি।সেখান থেকে নম্বরটা মোবাইলে তোলে ভাইয়াকে কল দিলাম

–হ্যালো চিনতে পেরেছ?
–হৈমু!তোর ফোনের অপেক্ষাতেই দিন গুনছিলাম আর তুই এখন দিলি কল?
–তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিল।
–হ্যাঁ বল!তার আগে বল তুই কেমন আছিস?
–আমি ভালো নেই।তুমি একবার আমার সাথে দেখা করতে পারবে?
–পারবো!কখন আসব বল?
–কাল দেখা করো আমি ঠিকানা তোমাকে টেক্সট করে দিব।
–ঠিকানা কেন!বাসায় গেলে কি হবে?
–বাসায় আসা যাবেনা।খুব জরুরী কথা তাই। আর হ্যাঁ তুমি যে আমার সাথে দেখা করবে সে কথা যেন কেউ জানতে না পারে।জানলে আমার সমস্যা হবে।
–সিরিয়াস কিছু?
–আসলেই জানবে।
–আচ্ছা!

আমি এপাশ থেকে লাইনটা কেটে দিলাম আদিব ভাইয়াকে একটা কঠিন সত্যের মুখোমুখি করতে যাচ্ছি আমি।কখনো চাইনি এমন কিছু হোক।

পরিবারের গুরুজনরা যে আমার বিয়ে নিয়ে সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ভাববে আমার জানা ছিল না যদি আমি আগে থেকে জানতাম তাহলে কখনো এমনটা হতে দিতাম না।সবটা হয়তো….!

যাইহোক আদিব ভাইয়াকে একটা ঠিকানা দিলাম।যে জায়গায় আসতে বলেছি জায়গাটা অনেকটা পার্কের মতো দেখতে।যদিও খুব বেশি মানুষের আনাগোনা নেই সেখানে।মাঝে মধ্যে কয়েকজনকে আসতে দেখা যায়।আগে অনেক প্রাণবন্ত ছিল।এখন অনেকটা শান্ত। আমার মন যখন খুব খারাপ থাকে সেখানে গিয়ে বসি।পরিবেশটা এত সুন্দর নিজের সাথে নিজে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে আসি ভিতরের কষ্ট গুলো হালকা হয়।

এই প্রথম কারো সাথে সেখানে কথা বলব।

পরের দিন বিকালে আদিব ভাইয়াকে যে সময়ে আসতে বলেছি ঠিক তার ২০মিনিট আগেই বাসা থেকে বের হলাম।মাকে বলেছি অবনীর বাসায় যাচ্ছি।যদিও মা এভাবে কখনো একা বের হতে দেয় না।অবনীর বাসায় বললে রাজি হয়।

আদিব ভাইয়াকে দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছাতে আমার পাঁচ মিনিট বা সাত মিনিট সময় লাগে।আমি গিয়ে একা একা বসে আছি নিজের সাথে নিজেই মনে মনে কথা বলছি! দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি আদিব ভাইয়া এক পা দু’পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে অনেকটা কাছে এসে বলল

–কেমন আছিস?জরুরি তলব কেন?
–ভালো আছি।তুমি?
–যেমন থাকার কথা তেমনই আছি।কি জন্য ডেকেছিস বল!
–তুমি জানতে তোমার আর আমার বিয়ের কথা চলছে।তাই না?
–হুম!জানতাম।
–তাহলে আমাকে জানাওনি কেন?
–আমি মনে করেছি তুই ও জানিস।তাছাড়া আমি তোর উপর জোর দিতে চাইনি।আমি চেয়েছি তোর মনের এক কোণে একটা জায়গা করে নিতে যেখানে আর কেউ কোনোদিন প্রবেশ করতে পারবে না।চেয়েছি তুই নিজে থেকে আমাকে ভালবাসবি জোর করলে হয়তো তোর মনোযোগ পাবো!কিন্তু ভালোবাসা?সেটা আদৌ সম্ভব না!
–তোমাকে আমি কেন ডেকেছি জানো?
–জানি না!তবে কেন জানি না মনে হচ্ছে তোর হৃদপিন্ড অবধি যেতে পারলেও তোর হৃদয়ের স্পন্দন অবধি আমি পৌঁছাতে পারেনি।
–আমি ভালোবাসি!
–নাম?
–আবির!

নামটা শোনার পর আদিব ভাইয়া অন্য পাশে ঘুরে গেল একেবারে চুপচাপ কোন কথাই বলছে না।

–কি হলো?কিছু বলছো না যে?
–এখন আমার কি করতে হবে?
–পরিবারকে কিছু একটা বলে বিয়েটা ভেঙে দাও।মা বলেছে অয়ন ভাইয়ার বিয়েতে আমাদের জোড়াটা দিয়ে দিবে।প্লিজ!দেখো আমি আবিরকে ছাড়া কোন ভাবেই থাকতে পারবো না।

আমি বলেই যাচ্ছি আদিব ভাইয়া কিছুই বলছে না।আমি জানি আবিরের কথা শোনার পর ভাইয়ার খুব কষ্ট হচ্ছে।আমি এটাও জানি ভাইয়া নিরবে আর্তনাদ করছে।এদিকে আমিও যে অপারগ!

আদিব ভাইয়া কিছু না বলেই চলে গেল। একটা বারের জন্যও পিছনে ফিরে তাকালো না!আমার খুব ভয় করছে।বিয়েটা আদৌ ভাঙ্গাবে তো!

দেখতে দেখতে অয়ন ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে গেল।ভাইয়ার বিয়েতে তেমন করে মজা করা হয়নি।আমি শুধুমাত্র বিয়ের দিন গিয়েছি।তবে আদিব ভাইয়ার সাথে আমার দেখা হয়নি।বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিল তাই।যদিও মনে মনে অনেক খুঁজেছি!কেন খুঁজেছি নিজেও জানিনা।

এর মধ্যে আবির আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যদি আদিব ভাইয়া বিয়ে ভেঙ্গে না দেয় আমরা পালিয়ে যাব কোথায় যাবো কি করবো আপাতত কিছুই জানিনা।

অয়ন ভাইয়ার বিয়ের প্রায় সপ্তাহ খানেক পর আদিব ভাইয়া খালাকে জানিয়ে দিয়েছে যে সে এই বিয়েটা করতে পারবেনা।আদিব ভাইয়ার ইচ্ছে ছিল দেশের বাইরে গিয়ে পড়ালেখা করবে।এই বছরটা শেষ করে পরের বছর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সে বাইরে চলে যেতে চায়।আর এটাও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে।আমাকে তার পছন্দ না। ছোটবেলা থেকে বিয়ে ঠিক করে রাখলেই করতে হবে এমন কোন কথা নেই।আর বিয়েটা যেহেতু সে করবে সিদ্ধান্তও তার হওয়া উচিত।

আদিব ভাইয়া আগে কখনো খালার কথার অমান্য করেছে বলে আমার মনে পড়ছে না।
ভাইয়া ছোটবেলা থেকে তার বাবা মায়ের বাধ্য সন্তান।কখনো মুখের উপর কথা বলতে দেখিনি তাকে।

এই বিয়েটা সে কেন ভাঙছে কেউ না জানলেও আমি আর আদিব ভাইয়া খুব ভালো করেই জানি।যাইহোক বিয়েটা যেহেতু সে নিজেই ভেঙ্গে দিচ্ছে সেখানে অন্য কেউ কিছু বলার অধিকার রাখে না।

শেষমেশ বিয়েটা ভেঙেই গেল আমিও মনে মনে আদিব ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ!যাক এইবার তাহলে আবিরকে আমার পাওয়া হবে।

তারপর অনেকটা সময় কেটে গেল।দেখতে দেখতে বছর দুয়েক প্রায়।আদিব ভাইয়া বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার পর থেকে মা আর খালার মধ্যে আমাদের বিয়ে নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক হয়েছিল! তাদের মধ্যে এখন যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ।যদিও মাঝে মাঝে শান্তা কল দিয়ে তনুর সাথে কথা বলে।

তনু এখন ইন্টারে পড়ছে আর আমি অনার্সে। তনুর কাছে শুনেছি আদিব ভাইয়া নাকি কিছুদিন আগেই দেশের বাইরে চলে গেছে। শুনেছি অয়ন ভাইয়ার নাকি ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে!

এভাবে দেখতে দেখতে আরও একটা বছর কেটেছে।বুঝার ক্ষমতাও একটু বেড়েছে।আবিরের সাথে কথা হয় ঠিক তবে আগের মত আর প্রাণ খুঁজে পাই না!ভার্সিটিতে গেলে রোজ দেখা হয়।কিন্তু কেন জানি না এখন আর আগের মতো দেখার আকুতি কাজ করে না।কোথাও যেন একটা শুন্যতা কাজ করে। মাঝে মাঝে মনের অজান্তে অকারণে কলিজায় মোচড় দেয়।

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন বাবা আর চাচ্চুকে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুনি।যদিও আড়াল থেকে শুনেছি কথাগুলো।শুনার পর থেকে কেমন যেন একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল।সবকিছুর মাঝে থেকেও এতদিন শূন্যতা অনুভব করতাম কিন্তু বাবা আর চাচ্চুর কথা গুলো শুনে শূন্যতা আরো বেশি করে আমাকে কামড়ে ধরেছে।

মাঝে আরো ৪টা বছর কেটে গেল। এর মধ্যে আমার বিয়েটাও হয়ে গেল।আকাশ আমার পুরনো পছন্দ।সকালবেলা ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ না হাঁটলে দিন টা যেনো শুরুই হতে চায় না।

এই মুহূর্তে পাশে ঘুমিয়ে থাকা দুইটা মানুষের দিকে মায়ায় জড়ানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। দুই জনের শরীর থেকে চাদর সরে গেছে। আস্তে করে চাদরটা দুইজনের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আমি ছাদে এসে হাঁটছি।ঝিরি ঝিরি বাতাস সূর্যের নতুন আভা অন্যরকম পুরনো অনুভূতি!ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। পুরনো কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে আবিরের সাথে দেখা করার স্মৃতি।লুকিয়ে প্রেম।একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম!

হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন এসে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় সুর তুলেছে

ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো-তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো-তোমার
চরণমঞ্জীরে।।
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি – তোমার
প্রাসাদপ্রাঙ্গণে।
মনে ক’রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী – তোমার
কনককঙ্কণে।।
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো – তোমার
অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণ-শুভ-সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো-তোমার
ললাটচন্দনে।
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো-তোমার…..

এত সুন্দর গান আদিব ছাড়া আর কে বা গাইতে পারে!

গান শুনতে শুনতে ভাবছি,
বাবা আর চাচ্চুকে সেদিন বলতে শুনেছিলাম আমার আর আদিবের বিয়েটা আমার দাদা ভাই ঠিক করেছিলেন।উনি মারা যাওয়ার আগে সবাইকে বলেছিল আমাদের বিয়েটা যেন হয়।আজ দাদা ভাই বেঁচে নেই।বেঁচে থাকলে হয়তো উনিও খুব করে চাইতেন আমাদের বিয়েটা হোক।

বাবা আর চাচ্চুর কথাগুলো শুনে আমি মাকে বলেছিলাম যেন খালাকে আবার বিয়েটার কথা বলে।

আর মাকে সবটা খুলে বলেছি।সবটা মানে আবিরের কথা বলিনি,মাকে শুধু বলেছি আমি চেয়েছি বলেই আদিব ভাইয়া বিয়েটা ভেঙেছে। আমি না চাইলে আদিব ভাইয়া বিয়েটা ভাঙতো না।

সবকিছু জানার পর আমি আবিরের সাথে দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছি।নিজেই তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকছি।মোট কথা সবদিক থেকেই এড়িয়ে চলছি।আবিরের সাথে অনেকটা পথ চলেও কোথাও না কোথাও আদিবের পথ চেয়ে ছিলাম।আবিরের সাথে থাকলেও কোথায় যেনো শূন্যতা কাজ করতো।কিন্তু আদিবের সাথে না থেকেও সে যখন আশেপাশে থাকতো সব কিছু কেমন যেনো পূর্ণতা পেতো। আবিরের কয়েক বছরের শিহরণ জাগানো অনুভূতি আর অপরিপক্ক ভালোবাসা আদিবের গভীর আর পরিপক্ক ভালোবাসার কাছে হার মেনে নিল।

শেষবার যেদিন আবিরকে পাকাপাকিভাবে ছেড়ে এসেছি সেদিন আবির অশ্রু জড়ানো কণ্ঠে বলছিল

–হৈমন্তীরা!তুমি আমার মনের খুব গোপনে রয়ে যাবে।একেবারেই নীরবে,নিস্তব্ধে!

আমিও মনে মনে বলছিলাম “তুমিও রয়ে যাবে নীরবে হৃদয়ে মম!

বিয়েটা যেহেতু আদিবের সাথে হয়েছে দুই পরিবারের মধ্যে দূরত্ব ঘুচে গেল।

আদিব গান গাইছে আর আমি পুরনো দিনগুলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি

একটু পর ছোট ছোট পায়ে হেঁটে মেয়েটা এসে মা বলে ডাক দিল।ছোট ছোট হাতে তার বাবার এক হাত ধরেছে আর আমার এক হাত ধরেছে।সে জানে আমি এই সময়ে ছাদে থাকি তাই চোখ কচলাতে কচলাতে চলে এসেছে।

মেয়েটাও হয়েছে তার খালার মত কিছু বললে তার ছোট বালিশটা নিয়ে রাগ করে অন্য পাশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়বে!

আদিব আদিরাকে কোলে নিয়ে আদর করছে।আমি মুচকি মুচকি হাসছি আর ভাবছি সেদিন আমাদের ভাগ্য চেয়েছিল একজোড়া মন দুইজোড়া চোখ কখনো আলাদা না হোক!

সমাপ্ত

(বানান ভুল ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।এত সময় নিয়ে পুরো গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ?)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে