তুমি রবে নীরবে পর্ব-০৪

0
1880

#তুমি_রবে_নীরবে
#পর্ব_৪
#সাদিয়া_ইসলাম_ইকরা

আমার হাতের একটা আঙ্গুল স্পর্শ করে হাতটা উপরের দিকে তুলে অন্যহাতে চুড়িগুলো শক্ত করে ধরে আমার চোখে চোখ রেখে আদিব ভাইয়া বলছে

–আমি জানতাম তুই চুড়ি গুলো পড়বি।কম দামি হলেও তোর হাতে এত সুন্দর মানিয়েছে যেকোনো হীরার অলংকারকে যেনো হার মানাবে!

আমি তখন আয়নার সামনে বসে ছিলাম।তনুকে চুল বেঁধে দিয়ে রুমে এসে চুুড়িগুলো পড়ছিলাম আর তখনই আদিব ভাইয়া রুমে চলে আসে।আদিব ভাইয়া এই মুহূর্তে আমার হাতটা এত যত্ন করে ধরেছে মনে হচ্ছে জীবনে প্রথম কোনো পুরুষ মানুষ পবিত্রতা নিয়ে আমাকে স্পর্শ করছে।আমি জোর দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম!

–এইভাবে হুটহাট আমার হাত ধরবে না তুমি!
–তোর হাত ধরার পুরোপুরি অধিকার আমার আছে।
–অধিকার কিসের?আমি যখন মানা করেছি তখন আমার কথায় শেষ কথা। তুমি যাও।আমাদেরকে এইভাবে একা কথা বলতে দেখলে পরে অনেক ঝামেলা হবে।
–তোর সাথে আমার এইভাবে কথা বলার অনুমতি আছে বলেই বলছি।
–অধিকার,অনুমতি এইসব কি বলছ!হেয়ালি করে কথা না বলে যা বলার সরাসরি বলো।জানোই তো আমি এইসব পছন্দ করি না।

আদিব ভাইয়ার মনে কি এসেছে বুঝতে পারলাম না হঠাৎ আমার কানের পাশে চুল গুলো সরিয়ে কানের নিচে যত্ন করে হাতটা দিয়েছে।মনে হচ্ছে কিছু একটা বলবে এমন সময় ফেলুদা হাজির!ফেলুদাকে দেখে আদিব ভাইয়া তাড়াতাড়ি করে আমার কানের পাশ থেকে হাত সরিয়ে নিল।

ফেলুদা রুমেও ঢুকেনি এত ব্যস্ততা তার মধ্যে।রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বলছে

–আপু তোরা এইখানে?এদিকে সবাই তোদের জন্য অপেক্ষা করছে।কনের বাড়িতে যাওয়ার জন্য সবাই তৈরি।তাড়াতাড়ি আয়।

এই কথা বলে তনু চলে গেল।মেয়েটা এমনই।বড় হচ্ছে ঠিকই বুদ্ধি এখনো হাটুর নিচে পড়ে আছে।তনু যাওয়ার পর আমি অভিমান জড়ানো কণ্ঠে আদিব ভাইয়াকে বলছি

–তনুর জায়গায় অন্য কেউ চলে আসলে ব্যাপারটা কেমন হতো বুঝতে পারছো তো?যাও তুমি এইখান থেকে।
–রাগ করছিস কেনো?
–রাগ করার জন্য বিশেষ মানুষ হতে হয়!
–আমি বিশেষ মানুষ না বলছিস?
–উফ!যাও তো ভাই।কথা বলতে ভালো লাগছে না।
–আচ্ছা আমি যাচ্ছি।তুই তাড়াতাড়ি আয়।আর হ্যাঁ গাড়িতে আমার পাশে বসবি।

আদিব ভাইয়া চলে গেলো।আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে চুল ঠিক করতে করতে ভাবছি চুড়িগুলো খুলে রাখব।আবার ভাবলাম না থাক!অন্য কোনো উপহার হলে আমি কখনো নিতাম না।চুড়ি বলেই নিয়েছি।প্রিয় জিনিস কখনো ফিরিয়ে দিতে নেই!আয়নায় নিজেকে দেখলাম।সব ঠিক আছে।রুমের দরজাটা বন্ধ করে বের হলাম।বাসা থেকে বের হতে হতে ভাবছি

আদিব ভাইয়া তখন কিসের অনুমতির কথা বলছে?গভীর কিছু নয় তো!না এই মুহূর্তে আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।আকাশকুসুম কল্পনা করতে করতে গাড়িটা যেখানে রাখা আছে সেখানে গেলাম।আমি আসতে দেরি হওয়ায় যে যার সিটে বসে পড়েছে।আদিব ভাইয়ার পাশে মাত্র একটা সিট খালি দেখে তনুকে বললাম

–তুই এই খালি সিটটাতে বস।আমি তোর সিটে বসবো।
–পড়ালেখা নিয়ে তো খুব অহংকার তোমার।বসো এইবার তোমার সিটে আমি আমার জায়গাতেই বসবো।
–কি আশ্চর্য!এইখানে পড়ালেখা আসছে কেন?দেখ!বড়দের কথা শুনতে হয়।
–আসছে কত বড় হতে।যখন কোনো কাজ করে দিতে বলি তখন কই থাকো?

এত একঘেয়েমি মেয়ে আমি জীবনে দেখি নাই।আদিব ভাইয়া আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।আমার এত রাগ লাগছিলো।ইচ্ছে হচ্ছিলো ফেলুদার গালে কষে কয়েকটা বসিয়ে দিই।আর না পারতে আদিব ভাইয়ার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম।আদিব ভাইয়ার পাশে বসার পর আমার কানের খুব কাছে এসে চুপি চুপি বলছে

–আমি মনে করেছি চুড়িগুলো খুলে ফেলবি।
–তুমি যা মনে করবে সেটাই হতে হবে?
–এইভাবে বলছিস কেন?
–চুপ!একদম চুপ!খবরদার!আর একটা কথা বললে আমি গাড়ি থেকে নেমে যাব!

আদিব ভাইয়া মুখ কালো করে মাথা ঝুকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।বাচ্চাদের মত আচরণ করছে।মনে হচ্ছে আমার বকায় কাজ হয়েছে।আমিও চুপচাপ বসে আছি।কিছুক্ষণ পর আমরা কনের বাড়িতে পৌঁছলাম।সেখানে আদিব ভাইয়া আমার সাথে কথা বলছে না ঠিকই কিন্তু সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু হাঁটছে।এই ছেলেকে নিয়ে আর পারা গেলো না!

গায়ে হলুদের যত আনুষ্ঠানিকতা আছে সব কিছু শেষ করে বাসায় ফিরলাম।কনে পক্ষ থেকেও মেহমান আসলো।তারাও সবধরণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে চলে গেলো।রাত প্রায় অনেক হয়ে গেল রাত বললে ভুল হবে প্রায় ভোর হতে চলেছে।

সবাই যে যার মত ঘুমিয়ে পড়েছে।এর মধ্যে আবিরের সাথে আর কথা হয়নি।ঝামেলায় ছিলাম তাই।তাছাড়া আমি আবিরকে মানা করেছিলাম কল না দিতে।কেউ যদি দেখে কথা বলছি আর মাকে বলে দেয় আমি তো শেষ!

আমি একবার ভাবলাম কল একটা দিয়ে দেখি আবিরকে।আবার ভাবলাম না থাক!শুধু শুধু কল দিয়ে এত রাতে বিরক্ত করব না।আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।ঘন্টা দুয়েক পর আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো।সকাল হয়ে গেছে।পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই।বাইরে পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি।দিনের শুরুর ভাগটা একনজরে দেখে নেওয়া যাক।জানালার পর্দাটা সরালাম।জানালার গ্রিল ছুঁয়ে সূর্যের প্রথম স্নিগ্ধ কিরণ আমার মুখ ছুঁয়েছে।হালকা বাতাস,অন্য রকম অনুভূতি।চা খেতে খেতে সকালটা দেখলে মন্দ হয়না।

হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে গেলাম ছাদে।আকাশ আমার খুব পছন্দ।ছাদে খালি পায়ে হাটছি আর চায়ের কাপে একবার দুইবার করে চুমুক দিচ্ছি।

ছাদে গেলে আমার অন্য রকম ভালো লাগে।আমার বাবা চাচারা নতুন করে কোনো ঘর বাঁধেনি।দাদু ভাইয়ের বেঁধে দেওয়া সেই পুরনো ঘরেই আছি।বিশাল জায়গা নিয়ে আমাদের ঘরটা।অনেকটা পুরনো জমিদার বাড়ির মত দেখতে।ঘরটা যেনো পুরনো ঐতিহ্যের নিদর্শন।

ছাদ থেকে নেমেই দেখছি সবাই ঘুম থেকে উঠে গেল।যে যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।মা চাচী আর ফুফুরা উপহার গুলো ঠিক করে নিচ্ছে বাবা আর চাচা রা সবাই কনের বাড়িতে কি কি পাঠাতে হবে এইসব নিয়ে আলোচনা করছে।আর দাদিরা এক পাশে বসে পান চিবাচ্ছে।কাজিনরা তো আছে আজকে কোন ড্রেসটা পড়বে সেই গবেষনায়।

দুপুর হতে না হতেই সবাই তৈরি।বরযাত্রী বলে কথা।এইটাই চাচ্চুদের দিক থেকে আমাদের বাসায় শেষ বিয়ে।তাই সবাই এত আনন্দ করছে।সবাই চলে গেলাম নতুন চাচীকে আনতে।আদিব ভাইয়া যদিও আজকে আমাদের সাথে যেতে চেয়েছে।আমার এক চাচাতো ভাই আদিব ভাইয়াকে তার সাথে যাওয়ার জন্য জোর করাতে আর আমাদের সাথে যেতে পারেনি।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই বউ নিয়ে ঘরে ঢুকলাম।সবাই জনে জনে নতুন বউকে দেখতে আসছে হৈ-হুল্লোড় একটা ব্যাপার।

বিয়ের দিনটাও ভালোই ভালোই কেটে গেলো।এর মধ্যে আদিব ভাইয়া আমার সাথে আর কথা বলেনি।সেই যে গাড়িতে ধমক দিয়েছি!এর পর থেকে কথা বন্ধ!

বউ নিয়ে আসার পর আবিরের সাথে একটু কথা হয়েছিল ফোনে।মা খাবার খেতে ডাক দেওয়াই আর পারিনি কথা বলতে।আবিরের মুখে একটাই কথা কখন আবার কলেজ যাবো!আমাকে ছাড়া নাকি তার ভালো লাগে না।আমারো আবিরকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে সেই যে দেখেছি আর তো দেখাই হয়নি।

রাতের খাবারটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।দুইদিন যা ধকল গেল।খুব ক্লান্ত তার উপর ঘুম হয়নি ভালো করে।সব কিছু সামলে যে যার মত ঘুমিয়ে পড়েছে।

বেলা হয়ে গেছে অনেক্ষণ।মাত্র আমার ঘুমটা ভাঙলো।আজকে বেশ ভালো ঘুম হয়েছে।দুইদিনের ঘুম পুষিয়ে নিয়েছি।সবাই নাস্তা করছে।এতদিন এত মজা করেছি যে সবার কথা খুব মনে পড়বে।খারাপ লাগবে।একটু বেলা হতেই একে একে অনেক মেহমান যার যার বাসায় চলে গেল।তবে কাজিনরা সবাই আছে।তারা আগামীকাল চলে যাবে।ফুফাতো ভাই বোন মামাতো ভাই বোন সবাই।আদিব ভাইয়ারাও কালকে চলে যাবে।

খালা আমাকে বলেছে আদিব ভাইয়ার ছোট বোন শান্তার পরীক্ষা সামনে।আর বেশিদিন থাকতে পারবে না এখানে।

দুপুরের খাবারটা শেষ করে দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি সময়ে সবাই একসাথে বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।শেষ আড্ডা।কালকে তো সবাই চলে যাবে!

আড্ডায় সবাই গোল করে বসেছে।আড্ডার আসর থেকে কিছুদূরে জানালার পাশে একটা গল্পের বই নিয়ে চেয়ার পেতে আমি বসলাম।সবাই আড্ডায় ব্যস্ত আর আমি গল্পের বই পড়ছি।আদিব ভাইয়াকে সবাই বলছে একটা গান ধরতে।

আমি একটা বিষয় খেয়াল করেছি ভাইয়াকে বকা দেওয়ার পর থেকে কেমন যেনো মনমরা হয়ে আছে।হোক মনমরা।তাতে আমার কি!

ভাইয়া বলছে আজকে তোদের গান শুনাবো না।আজকে সবাইকে আমার একটা পছন্দের কবিতা শুনাবো।সবাই তো মহা খুশি!এতদিন গান শুনেছে আজকে শুনবে কবিতা আবৃত্তি।

ভাইয়া নিচু গলায় আবৃত্তি শুরু করলো

“নিথর দিঘির পাড়ে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক?
আমি কি দেখিনি কোনো মন্থর বিকেলে
শিমুল তুলোর ওড়াউড়ি?”

এইটুকু বলে চুপ হয়ে গেল।আমার চোখ বই থেকে সরে গেল আদিব ভাইয়ার দিকে তাকাতে দেখি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে।যদিও আমি বই পড়ছিলাম না।মন দিয়ে ভাইয়ার আবৃত্তিই শুনছিলাম।

আমার দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বলতে লাগলো

“এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো”

আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাইয়া আমার দিকে।আমি যতদূর জানি কবিতাটা অন্য রকম কিন্তু ভাইয়া এই ক’টা লাইনই বেছে বেছে বলল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে