তুমি এলে তাই পর্ব-২৯

0
2804

#তুমি এলে তাই ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৯
.
মেঘলা দাঁত করমর করে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” ‘আব মেরা কেয়া হোগা মেঘু দি?’ এখন আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেনো যে তোর কী হবে? এতো বড় একটা কান্ড ঘটানোর আগে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিস?”

গুঞ্জন মুখটা কাচুমাচু করে বলল,

— ” আমিতো ভেবেছিলাম তুমি চৌধুরীকে ভালোবাসো। এখন তোমার কাছে এসে এসব বললে তো তুমি তো কষ্ট পেতে। তাই..”

মেঘরা এবার রাগে গজগজ করে বলল,

— ” আহা। কী সুন্দর কথা… আমি কষ্ট পাবো তাই উনি মহান সেজে আমার পথ থেকে নিরবে সরে যাচ্ছিলো। ইচ্ছে করছে আরো কয়েকটা থাপ্পড় মারি তোকে।”

গুঞ্জন মিনমিনে গলায় বলল,

— ” মারলেতো একটা।”

মেঘলা হালকা ধমকের সুরে বলল,

— ” আরো কয়েকটা মারতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা যদি এরকম কিছু হতোও তাহলেই বা তুই এরকম করবি? তুই স্যারকে ভালোবাসিস। আর তারচেয়েও বড় কথা স্যার তোকে ভালোবাসে। যেখানে স্যার নিজে তোকে ভালোবাসে সেখানে আমি স্যারকে ভালোবাসলেও সেই ভালোবাসার কোনো দাম নেই। স্যার যদি আমাকে মেনেও নিতো ওনার মনে তো শুধু তুই থাকতি তাইনা? এটুকু বোঝার বুদ্ধি নেই তোর? তুই আমাকে কষ্ট দিতে চাস না বলে সেই মানুষটাকে কষ্ট দিলি যে তোকে এতো ভালোবেসেছে। কেনো?”

গুঞ্জন মাথা নিচু করে আছে। মেঘলা কিছু একটা ভেবে বলল,

— ” এই একমিনিট এক মিনিট। তুই এখনো মনে করিস যে দুই বছর আগে আহিল আমার সাথে যা করেছে তার জন্যে তুই দ্বায়ী? আর সেইজন্যেই তুই এসব করেছিস?”

গুঞ্জন করুণ চোখে একবার তাকালো মেঘলার দিকে। মেঘলা এবার আরো রেগে গিয়ে বলল,

— ” যা খুশি কর আমার কী? আমি গেলাম।”

এটুকু বলে মেঘলা দরজা খুলে বেড়িয়ে যেতে নেবে তখনি গুঞ্জন দৌড়ে গিয়ে মেঘলাকে টেনে ভেতরে আনতে আনতে বলল,

— ” মেঘুদি! মেঘুদি! এমন করছো কেনো? সরি বলছি তো।”

মেঘলা বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” এভাবে সরি সরি আমাকে না বলে যাকে বলার তাকে বল প্লিজ।”

গুঞ্জন কিছু বলবে তার আগেই আবির এসে বলল,

— ” কী হয়েছে বলতো? বাইরে থেকে এসেই দুই বোন কী এতো কথা করছিস?”

মেঘলা বিরক্ত হয়ে হাত ভাজ করে বসে বলল,

— ” সেটা তোর বোনকে জিজ্ঞেস কর। কী ঘটিয়ে এসছে।”

আবির জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো গুঞ্জনের দিকে আর গুঞ্জন অসহায় মুখ করে তাকালো আবিরের দিকে। আবির সন্দিহান দৃষ্টিতেই দুজনের দিকে তাকিয়ে বেডে বসে ভ্রু নাচালো অর্থাৎ কী হয়েছে একটু বলা যাবে কী? মেঘলা এরপর সব কথা আবিরকে খুলে বলল। আবির ভ্রু কুচকে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে ওর মাথায় একটা চাটা মেরে বলল,

— ” লিমিট আছে সবকিছুর। সব উনি নিজেই বুঝবে, নিজেই শুনবে, নিজেই করবে। আজব!”

গুঞ্জন এবার নিজের মাথা হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে মুখ ফলিয়ে বলল,

— ” বললাম তো ভুল হয়ে গেছে। সবাই মিলে বকছিস কেনো?”

মেঘলা কিছু একটা ভেবে বলল,

— ” কাল আমার সাথেই তোকে অফিসে নিয়ে যাবো। ওখানে গিয়েই তুই স্যারের সাথে কথা বলবি ঠিকাছে?”

গুঞ্জন মাথা নাড়ল। আবির কিছুক্ষণ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে দিয়ে বলল,

— ” তো আমার সেই পিচ্ছি গুটিটা এতো বড় হয়ে গেছে? একজনকে ভালোবেসে তার জন্যে নিজেকেই বদলে ফেলল?”

গুঞ্জন কিছু না বলে মিষ্টি হেসে আবিরকে জরিয়ে ধরল। আবির গুঞ্জনের মাথায় হাত রাখল। মেঘলাও পেছন থেকে ওদের দুজনকেই জরিয়ে ধরল।

______________________

স্পন্দনরা সবাই মিলে রাতে ডিনার করছে। মিসেস চৌধুরী বললেন,

— ” গুঞ্জনের এখন কী অবস্থা রে? ভালো আছে?”

সারা একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” দেখেতো মনে হচ্ছেনা মা। কেমন বদলে গেছে। ড্রেসআপ বদলে গেছে আচার আচরণও বদলে গেছে।”

মিস্টার চৌধুরী বললেন,

— ” কেনো কী হয়েছে?”

সারা হতাশ কন্ঠে বলল,

— ” জানিনা কী হয়েছে বাট ঠিক নেই কিছু। ভাইয়া তুই কিছু জানিস গুঞ্জনেল কী হয়েছে? মানে তোর সাথে কথা হয়েছে?”

স্পন্দন এতোক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো, সারার প্রশ্ন শুনে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলল,

— ” আমাকে দেখে কী তোর গুঞ্জনের পার্সোনাল স্যাকরেটারি মনে হচ্ছে নাকি? আমি কীকরে জানবো?”

সবাই বেশ অবাক হলো স্পন্দনের কথায় বেশ অনেকটা অবাক হলো সবাই। মিস্টার চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন,

— ” এভাবে বলছো কেনো? ও জাস্ট জিজ্ঞেস করেছে।”

স্পন্দন বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” এসব অবান্তর প্রশ্ন আমাকে আর না করলেই ভালো হয়।”

কেউ অার কিছু বলল না। সারা জানতো যে স্পন্দনকে গুঞ্জন রিজেক্ট করেছে। কিন্তু এই কারণে এভাবে কথা তো স্পন্দন বলবেনা তাহলে কী হয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে খেতে থাকল। স্পন্দন কোনোরকম খেয়ে উঠে চলে গেলো রুমে।

______________________

প্রায় একঘন্টা যাবত রেহানের কেবিনে বসে আছে গুঞ্জন আর মেঘলা। গুঞ্জন স্পন্দনের সাথে কথা বলতেই এসছে কিন্তু কিছুতেই ওর স্পন্দনের কেবিনে যাওয়ার সাহস হচ্ছেনা। এই প্রথম কিছু করতে ভয় পাচ্ছে ও। রেহান বলল,

— ” গুঞ্জন এভাবে ভয় পেলে হবে। না গেলে সবটা ঠিক করবে কীকরে?”

মেঘলাও বলল,

—- ” সেটাই কখন থেকে বলছি। তুই কবে থেকে কিছুকে ভয় পেতে শুরু করলি রে?

গুঞ্জন কী বলবে বুঝতে পারছেনা শুধু অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

— “জিজু আপনার ভাই যা জিনিস, কী করবে আমাকে কে জানে?”

মেঘলা এবার ওকে ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,

— ” একটাও কথা না এবার চুপচাপ চল।”

গুঞ্জনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টেনে নিয়ে গেলো মেঘলা। পেছন পেছন রেহান ও গেলো। স্পন্দনের কেবিনের সামনে গিয়ে মেঘলা বলল,

— ” যা ভেতরে যা।”

গুঞ্জন করুনভাবে তাকিয়ে বলল,

— “কিন্তু মেঘুদি…”

রেহান গুঞ্জনের কাধে হাত রেখে বলল,

— ” বাবু যেতে তো হবে না? না গেলে কেসটা সলভ হবে কীকরে? যাও?”

গুঞ্জন কিছু বলতে নেবে মেঘলা তার আগেই ধাক্কা দিয়ে কেবিনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। স্পন্দন নিজের চেয়ারে বসে কাজ করছিল। এমন হুড়মুড় করে কেউ ভেতরে ঢোকার আলাপ পেয়ে ভ্রু কুচকে তাকালো। তাকিয়ে তো ও অবাকের শেষ পর্যায়ে, দেখে গুঞ্জন নিজেকে সামলে দাঁড়িয়ে চুলগূলো কানের পিঠে গুজছে। গুঞ্জনকে দেখে কিছুক্ষণের জন্যে স্পন্দনের চোখ স্হির হয়ে গেলো। গুঞ্জনকে এমনিতেও সুন্দর লাগে কিন্তু লং গ্রাউন্ড আর ওরনাতে খুব বেশিই ভালো লাগে ওকে। কতোদিন পর দেখছে গুঞ্জনকে তাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছৈ। হঠাৎ করেই গুঞ্জনের ওসব ব্যবহারের কথা মনে পরতেই স্পন্দনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। ও দাঁড়িয়ে বলল,

— ” হোয়াট দা হেল? কারো কেবিনে তার পার্মিশন ছাড়া ঢোকাটা যে অসভ্যতামি সেটা জানা নেই?”

গুঞ্জন মনে মনে ভাবল, এই রে মশাই তো খুব রেগে আছেন। একে মানাতে ওর জীবণ কয়লা হয়ে যাবে ফর সিউর। গুঞ্জন এসব ভাবতে ভাবতেই স্পন্দন ধমক দিয়ে বলল,

— ” কী হলো কেনো এসছেন?”

গুঞ্জনের মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেড়োচ্ছেনা ও শুধু ইতস্তত করে যাচ্ছে। ও খুবই ফ্রাঙ্ক স্পিকার কিন্তু আজকের মতো এরকম হয়নি কখনো ওর। এতো ভয়, জড়তা ওর মধ্যে কখনো কাজ করেনি। স্পন্দন গুঞ্জনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

— ” আমার মতো ক্যারেক্টারলেস, গায়ে পরা ছেলের কাছে তো আপনার আসার কথা না। হঠাৎ কী হলো?”

গুঞ্জন এবার মনে অনেকটা সাহস সঞ্চার করে বলল,

— ” তোমার সাথে আমার একটু কথা ছিলো।”

স্পন্দন ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কীসের কথা? আপনার সাথেতো আমার সব কথা সেদিনই শেষ হয়ে গেছে রাইট?”

গুঞ্জন এবার স্পন্দনের কাছে গিয়ে বলল,

— ” দেখো একদম আমার ডায়লগ আমাকে মারতে আসবে না। বলেছিতো তোমার সাথে আমার কথা বলতে হবে। এসো?”

বলে স্পন্দনের হাত ধরতেই স্পন্দন ঝাড়া দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

— ” হোয়াট রাবিশ? আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি? একেতো আমার কেবিনে আমার পার্মিশন ছাড়াই ঢুকে পরেছেন। তারওপর তখন তখন ‘তুমি’ ‘তুমি’ করে যাচ্ছেন? আবার গায়ে হাত দিচ্ছেন? নূন্যতম শিক্ষা বা ভদ্রতাটুকু নেই? এমনিতেতো ভদ্র বাড়ির মেয়ে বলেই জানি। স্বভাবেও একটু ভদ্রতাবোধ রাখুন নইলে লোকে আপনার পারিবারিক শিক্ষায় আঙ্গুল তুলবে। ”

স্পন্দনের কথায় গুঞ্জন একটু কষ্ট পেলো। স্পন্দন ওকে এভাবে বলবে ও ভাবেইনি। গুঞ্জন এমনিতে শক্ত হলেও কাছের মানুষদের কাছে খুবই দুর্বল তাই কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,

— ” এর আগেও তোমার কেবিনে আমি পার্মিশ ছাড়া ঢুকেছি, তোমাকে তুমি করেও বলেছি আর গায়েও হাত দিয়েছি। এগুলো করার পার্মিশন তুমিই দিয়েছিলে তখনতো বারণ করোনি?”

স্পন্দন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

— ” আপনার প্রশ্নেই আপনার উত্তর আছে। দিয়েছিলাম, পাস্ট মানে অতীত। সেই অতীত আমাদের বর্তমানে যার কোনো জায়গা নেই।”

গুঞ্জন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো স্পন্দনের দিকে। এই কয়েকদিনে ওর প্রতি এতোটা নিষ্ঠুর হয়ে গেছে লোকটা? গুঞ্জন এবার গিয়ে স্পন্দনের কলার ধরে বলল,

— ” অতীত মানে কী হ্যাঁ? তুমি ভালোবাসোনা আমায়? সেটাও কী অতীত? পাস্ট? আমার প্রতি ভালোবাসাটাও শেষ হয়ে গেছে?”

স্পন্দন গুঞ্জনের হাত ধরে বলল,

— ” আমার ভালোবাসা এতোটা ঠুংক নয় যে শেষ হয়ে যাবে। আমি আপনাকে ভালোবাসতাম, ভালোবাসি, আর ভবিষ্যতেও ভালোবাসবো। কিন্তু পার্থক্য এটাই যে আগে আপনাকে পাগলের মতো চাইতাম কিন্তু এখন আর সেটা চাইনা। আপনাকে কোনোমতেই আর চাই না আমি।”

এটুকু বলে কলারটা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বলল,

— ” প্রথমবার তাই ক্ষমা করলাম। নেক্সট টাইম আমার কলার ধরার সাহস করবেন না। নাউ জাস্ট গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার।”

এটুকু বলে স্পন্দন একটু দূরে সরে উল্টো ঘুরে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। গুঞ্জন স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পন্দনের দিকে, ও না চাইতেও ওর চোখ দিয়ে একফোটা জল গড়িয়ে পরলো।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে