তুমি এলে তাই পর্ব-২১

0
2773

#তুমি এলে তাই ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২১
.
স্পন্দন সকাল বেলা রোজাকার মতো অফিসের জন্যে রেডি হয়ে নিচে থেমে ডাইনিং এ বসলো। যেই খাওয়া শুরু করতে যাবে ওর চোখ ওর বাবা মা আর বোনের দিকে গেলো। ওরা সবাই অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে স্পন্দনের দিকে। স্পন্দন ভ্রু কুচকে বলল,

— ” হোয়াট হ্যাপেন্ড?”

ওরা তিনজনেই একসাথে মাথা নেড়ে খাওয়ায় মন দিলো। স্পন্দনও ভ্রু কুচকে খেতে নিলেই সারা একটু গলা ঝেড়ে বলল,

— ” কী হয়েছে বলতো ভাইয়া? আজকাল তুই একটু বেশিই ঘোরাঘুরি করছিস? মাঝেমাঝে তোর গাড়িটি কলেজের সামনে দিয়ে যাওয়া আশা করছে আজকাল?”

মিস্টার আর মিসেস চৌধুরী মুখ টিপে টিপে হাসছেন। স্পন্দন একটু চমকে গেলো তারপর একটু ইতস্তত করে বলল,

— ” মানে কী?”

সারা চামচ নাড়াতে নাড়াতে বলল,

— ” নাহ মানে। আজকাল তোকে একটু বেশি ভার্সিটির আশেপাশে দেখছিতো তাই আর কী।”

স্পন্দন বিরক্ত হওয়ার ভান করে বলল,

— ” আরে আমি কী ঘুরতে যাই নাকি ওদিকে? কাজ থাকে তাই যাই।”

মিস্টার চৌধুরীও স্পন্দনের সাথে তাল মিলিয়ে বলল,

— ” হ্যাঁ তাইতো? ও গেলে তো কাজেই যায় তাই না স্পন্দন?”

সারা মুখটা চিন্তিত করার ভান করে বলল,

— ” হ্যাঁ? তাইতো? বাট তোর কী আজকাল গুঞ্জনের সাথেও বিজনেস মিটিং হচ্ছে?”

স্পন্দন এবার একটু হকচকিয়ে গেলো। একবার মিস্টার এন্ড মিসেস আবরারের দিকে তাকিয়ে তারপর সারার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল,

— ” এই আজকাল খুব বেশিই কথা বলছিস তুই। চুপ থাকতে পারিসনা”

সারা চামচটা প্লেটে রেখে বলল,

— ” নাহ ভাইয়া মানে তুই গুঞ্জনকে নিয়ে ঘুরে বেড়াস ভালো কথা। কিন্তু মাঝেমাঝে তো একটু আমাকেও নিয়ে যেতে পারিস নাকি? ও না হয় বউ হে সেটা মেনে নিলাম কিন্তু আমিতো বোন তাইনা?”

স্পন্দন কিছু না বলে হেসে দিলো। স্পন্দন এর হাসি দেখে সবাই অবাকের শেষ পর্যায়ে। স্পন্দনের ধীরে ধীরে এমন ওদেরকে চমকে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্পন্দন হাসি থামিয়ে দিলো। ওরা সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। স্পন্দনের এবার একটু অস্বস্তি হচ্ছে তাই কোনোরকমে খেয়ে উঠে চলে গেলো। মিস্টার চৌধুরী মিসেস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” ছেলেটার হঠাৎ কতো পরিবর্তন হয়ে গেছে। আর ওর মুখের হাসি দেখা হ্যালির ধুমকেতু দেখার মতো মনে হতো। আর এখন মাঝেমাঝেই ওকে হাসতে দেখা যায়।”

সারা হেসে বলল,

— ” জানো বাবা তোমার ছেলে প্রায় ঘুরতে চায় গুঞ্জনকে নিয়ে। বেশ ভাব হয়ে গেছে দুজনের।”

মিসেস চৌধুরী একটা শ্বাস ফেলে বললেন,

— ” অথচ এই মেয়েটাকে কয়েকমাস আগেও সহ্য করতে পারতোনা ও। সত্যি মেয়েটার মধ্যে জাদু আছে। এখন শুধু সেই শুভ দিনটার অপেক্ষা। ”

ওরা তিনজনেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে খাওয়াতে মনোযোগ দিলো।

______________________

গুঞ্জন মেঘলা আর আবির তিনজনেই টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছে আর গল্প করছে। মেঘলা খেতে খেতে বলল,

— ” আমিতো ভাবতেও পারিনি যে আমার বস তোর পরিচিত তাও আমার বস হওয়ার আগে থেকেই। আর তোরা দুজন এতো ভালো বন্ধু।”

গুঞ্জন হালকা হেসে বলল,

— ” হুমম সেটা ঠিক। বাট বন্ধুতো এখন। প্রথম যখন দেখা হয়েছিল তখন ওনার ব্যবহারগুলোতে ইচ্ছে হতো মাথা ফাটিয়ে দেই। যদিও ওনার দোষও দেওয়া যায়না। সেগুলো তো শুনেছোই।”

মেঘলা হাসতে হাসতে বলল,

— ” হ্যাঁ বাট যতো শুনি ততোই শুনতে ইচ্ছে করে।”

আবির খাবার চিবোতে চিবোতে বলল,

— ” হ্যাঁ বাট যাই হোক স্পন্দন ছেলেটা কিন্তু বেশ ভালো।”

মেঘলা বলল,

— ” হ্যাঁ এমনিতে রাগী। অফিস টাইমে কম করে হলেও দশ বারোটা ধমক খাই ওনার। তবে লোকটা খুব ভালো।”

এসব বিভিন্ন কথা বলতে বলতে আবিরের খাওয়া কম্প্লিট করে চলে গেলো। এরপর গুঞ্জন আর মেঘলা কফি খেতে খেতেই স্পন্দের টপিক নিয়েই আলোচনা করতে শুরু করলো। যদিও টপিকগুলো মেঘলাই ওঠাচ্ছে গুঞ্জন শুধু উত্তল দিচ্ছে। গুঞ্জনের কাকী সোফায় বসে চা খাচ্ছিলেন এরমধ্যেই উনি বলে উঠলেন,

— ” হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো আর কোনো ছেলে পাচ্ছেনা তাই আমার মেয়ের বসের ঘাড়ে গিয়ে চাপার শখ হয়েছ।”

গুঞ্জন একটু হেসে কফির কাপ এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,

— ” কী করবো বলো। ছেলে জুটছেনা কপালে। বাই দা ওয়ে আমি বাড়ি থেকে বিদায় হলে তো তোমাদেরই সুবিধা তাইনা? তাহলে এতোচাপ নিচ্ছো কেনো? চিল ডিউড।”

গুঞ্জনের কাকী এবার মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন। মেঘলা বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” কেনো এভাবে নিজেকে হাসির পাত্র বানাও বলোতো? তুমি জানো গুঞ্জন ওনার ভালো বন্ধু তবুও। আর হ্যাঁ আবির আমি তোমাকে এতো কিছু বলি। কয়েক মাস আগে স্পন্দন স্যারও তোমাদের এভাবে বলে গেলো তবুও মিনিমান লজ্জা নেই না?”

গুঞ্জন ঊঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” মেঘুদি কথা বাড়িয়োনা তো চলো! অফিস আছেতো তোমার?”

এরপর দুজনেই বেড়িয়ে গেলো অফিসের উদ্দেশ্যে। গুঞ্জনের কাকী মুখ বাকিয়ে বসে রইলেন। নিজের মেয়েই যখন তার পক্ষে কোনো কথা বলতে নারাজ তখন আর কথা বলে টিকবেন কীকরে?

________________________

স্পন্দন ল্যাপটপে কাজ করছে আর মেঘলা ওনার কেবিনে বসেই কাজ করছে। কারণ ছোট্ট একটু কাজ আছে তাই সেটুকু এখানে বসে করেই রেখে যেতে বলেছে স্পন্দন। ফাইল কম্প্লিট হয়েছে কী না জানার জন্যে স্পন্দন মেঘলার দিকে তাকাতেই দেখলো মেঘলা মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। স্পন্দন ভ্রু কুচকে বলল,

— ” মিস মেঘলা?”

কিন্তু মেঘলার হুস নেই ও মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে। স্পন্দন এবার একটু জোরেই বলল,

— ” মেঘলা?”.

মেঘলা হকচকিয়ে তাকালো স্পন্দনের দিকে। স্পন্দন রাগী কন্ঠে বলল,

— ” ফাইলে এমন কী মজার জিনিস ছিলো যে হেসেই যাচ্ছেন? আমাকেও বলুন আমিও একটু হাসি?”

মেঘলা এবার ইতস্তত করে বলল,

— ” না স্যার আসলে..”

স্পন্দন হালকা ধমকে বলল,

— ” আসলে নকলে শোনার সময় নেই আমার। ফাইল কম্প্লিট?”

মেঘলা তাড়াহুড়ো কন্ঠে বলল,

— ” ইয়েস স্যার আর পাঁচ মিনিট লাগবে। ”

স্পন্দন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” কম্প্লিট করে পাশের কেবিনে দিয়ে এসো। আমি আজ আসছি।”

বলে স্পন্দন অফিস থেকে বেড়িয়ে গেলো। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে হঠাৎ গুঞ্জনের কথা মনে পরলো তাই ব্লুটুথ কানেক্ট করেই গুঞ্জনকে কল করলো। কল করার একটু পরেই গুঞ্জন ফোন তুলে বলল,

— ” হ্যাঁ বলো?”

— ” কোথায় আছো?”

গঞ্জন বাইকে হেলান দিয়ে বলল,

— ” আমি ক্লাবে যাচ্ছিলাম কিন্তু তোমার কল পেয়ে সাইডে পার্ক করে কথা বলছি।”

স্পন্দন একটু চুপ থেকে বলল,

— ” আচ্ছা রোজ ক্লাবে যাওয়া কী জরুরি? আর গেলেও এতো রাত করে থাকার কী দরকার? না এটা ভেবোনা তুমি মেয়ে বলে এসব বলছি। আমার মতে ছেলে হোক বা মেয়ে সবার জন্যই তো এটা খারাপ। রাইট?”

গুঞ্জন একটু হেসে বলল,

— ” একটা খারাপ মেয়ে এর চেয়ে ভালো কিছু কীকরে করবে বলো?”

স্পন্দন একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলল,

— ” তুমি খারাপ নও গুঞ্জন। আর যেটা তুমি নও সেটা জোর করে হওয়ার বা অন্যকে সেটা মনে করানোর কী খুব দরকার আছে?

গুঞ্জন এবার আর কিছু বললোনা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

— ” বাদ দিন এসব। কিছু দরকার ছিলো?”

স্পন্দন মুখে মুচকি একটু হাসি ফুটিয়ে বলল,

— ” কালকে বিকেলের দিকে ফ্রি আছো? ফ্রাইডে আছে?”

গুঞ্জন দু-সেকেন্ড ভেবে বলল,

— ” হ্যাঁ বিশেষ কোনো কাজ নেই।”

স্পন্দন একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” চলো তাহলে কাল বিকেলে এসেপিক করবো তোমাকে ?

গুঞ্জন ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কিন্তু কেনো?”

স্পন্দন একটু বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” আরে দেখতেই তো পাবে। আচ্ছা রাখছি।”

বলে স্পন্দন ফোনটা রেখে দিলো। গুঞ্জনও একটু অবাক হয়েই ফোনটা রাখলো আর ভাবতে শুরু করলো।

_______________________

গুঞ্জন আর স্পন্দন নিরব একটা রাস্তার পাশ দিয়ে হাটছে। এতোক্ষণ গাড়িতেই এদিক ওদিক ঘুরেছে ওরা। গাড়ি একটু পেছনেই পার্ক করে এসছে এদিকে । চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এসছে। হাটতে হাটতে স্পন্দন বলল,

— ” অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করছি কিছু খাওয়া তো হয়নি কী খাবে?”

গুঞ্জন একটু ভেবে বলল,

— ” কোলড্রিংকস আর অন্যকিছু একটা নিয়ে নিন খাওয়ার মতো?”

স্পন্দন একটু বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” আচ্ছা একটা কথা বলোতো। সবসময় এরকম গম্ভীর গম্ভীর চাহিদা কেনো তোমার?”

গুঞ্জন অবাক হয়ে বলল,

— ” মানে?”

স্পন্দন বিরক্তি নিয়েই বলল,

— ” তোমার জায়গায় অন্যকেউ হলে এতোক্ষণে ফুচকা, চকলেট,আইস্ক্রিম এসব চাইতো?”

গুঞ্জন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,

— ” আমি ওসব খাইনা।”

— ” আজ খাবে চলো।”

বলে গুঞ্জনের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে নিলেই গুঞ্জন দাঁড়িয়ে বলল,

— ” আমি এসব খাইনি আগে কখনো?”

স্পন্দন হাত ধরে হাটা শুরু করতে করতে বলল,

— ” সেতো আমিও কখনো খাইনি। তবে আজ খাবো। লেটস গো।”

স্পন্দন ফুচকারওয়ালার কাছে গিয়ে গুঞ্জনকে বলল,

— ” ঝাল কেমন খাও?”

গুঞ্জন ভাবলেশহীনভাবে বলল,

— ” মিডিয়াম।”

স্পন্দন ফুচকাওয়ালাকে মিডিয়াম ঝাল দিয়ে দুপ্লেট ফুচকা দিতে বলল। প্রথম প্লেট টা গুঞ্জনকে দিলো। এরপর ফুচকাওয়ালাকে বলল কীভাবে খায় দেখিয়ে দিতে। ফুচকাওয়াল একবার দেখিয়ে দিতেই ওরা বুঝে গেলো। স্পন্দন খেতে ইশারা করতেই গুঞ্জন নাক কুচকে মুখে দিয়ে চিবোতে শুরু করলো কিন্তু খেতে ওর কাছে বেশ ভালো লাগলো। তারপর স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে এক্সপ্রেশন দিলো যে ওর বেশ ভালো লেগেছে। তারপর ও ওর মতো খেতে শুরু করলো। স্পন্দনও ফুচকা নিয়েমুখে দিয়ে চিবোতে শুরু করলো এবার হলো আরেক ঝামেলা। স্পন্দন জাল খেতে পারেনা। অথচ গুঞ্জনের দেখাদিখি ফুচকাতে মিডিয়াম ঝাল দিতে বলেছে। তাই এমনিতে ভালো লাখলেও বেশ ঝাল লাগলো। ঝালে হাফাতে হাফাতে পানি নিতে খেতে শুরু করলো। সেটা দেখে গুঞ্জন এবার শব্দ করে হেসে দিলো। আর স্পন্দন ভ্রু কুচকে তাকাতেই ওর হাসি দেখে চোখ আটকে গেলো। একদৃষ্টিতে গুঞ্জনের হাসি দেখছে ও। গুঞ্জনের হাসির দিকে তাকিয়েই মনে মনে বলল, তুমি যেমন আছো তেমনই ভালোবেসেছি আমি তোমাকে। আমি তোমাকে চেঞ্জ করতে চাইনা শুধু ভেতরের তুমিটাকে বাইরে আনতে চাই যেটা তুমি কিছু মানুষের ওপর অভিমান আর জেদের বসে চেপে রেখেছো। প্রাণখুলে বাঁচার স্বাদটাই জানোনা তুমি তবে এবার জানবে। তোমাকে শ্বাসন করে ঠিক করা সম্ভব নয়। বলেনা তীব্র স্রোতের সাথে তাল মেলাতে গেলে স্রোতের দিকেই চলতে হয়। তবেই নদী পার হওয়া যায়। তাই শুধুমাত্র তোমার জন্যে আমি নিজেকে সেভাবেই প্রেসেন্ট করছি যেটা আমি নই। এটাই হয়তো ভালোবাসা। তোমাকে তোমার আসল রঙে রাঙাতে যদি আমায়ও সেই রঙে একটু রঙিন হতে হয় তাহলে ক্ষতি কোথায়? রঙ তো তোমারই।

#চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে