#তুমি এলে তাই ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৩
.
গুঞ্জনের দিকে তাকাতেই ওর অবাক দৃষ্টি দেখে হুশ এলো স্পন্দনের। এতক্ষণে বুঝতে পারলো যে ও কী করেছে। নিজের কাজে নিজেই অবাক হলো। ও যে এরকম কিছু করতে পারে সেটা ওর নিজের কল্পনাতেও ছিলো নাহ। তারপর হালকা গলা ঝেড়ে ঠিকঠাক হয়ে বসে গুঞ্জনের দিকে তাকাতেই গুঞ্জন ভ্রু নাচিয়ে বলল,
— ” এটা কী হলো?”
স্পন্দন কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইতস্তত করে বলল,
— ” এক্চুয়ালি তোমার নাকের নিচে কফির ক্রিম লেগে ছিলো তাই..”
এটুকু বলেই স্পন্দন চুপ হয়ে গেলো। আসলে আর কী বলবে? গুঞ্জন কফির কাপটা আবার হাতে নিয়ে বলল,
— ” তা সেটা বললেই তো হতো।”
স্পন্দন একটু অবাক হলো, ও যা করেছে তাতে অন্যসব মেয়ে হলেতো লজ্জায় কুকড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু গুঞ্জনের মধ্যে সেরকম কোনো লক্ষণ নেই, ও নিজের মতো করেই আবার কফি খেতে শুরু করল। স্পন্দন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল যে গুঞ্জন কিছু মনে করেনি। আর নিজের ওপর একটু রাগও হলো ওর যে হঠাৎ এরকম কেনো করলো ও? দুজনেই করার পর স্পন্দন গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বলল কেকটা খেতে। গুঞ্জন কেকের দিকে তাকিয়ে বল,
— ” ওকে..”
তারপর পাশ থেকে নাইফটা নিয়ে কেকটা কেটে একটা পিস নিয়ে সেটা পুরোটাই মুখে পুরে নিলো। এরপর নিজে নিজেই কেকটা কেটে খেতে শুরু করলো। স্পন্দন একগালে হাত দিয়ে গুঞ্জনকে দেখছে আর ভাবছে ও একটা জলজ্যান্ত মানুষ এখানে বসে আছে অথচ একবার জিজ্ঞেস ও করলোনা ও খাবে কী না বা খেতে চায় কী না? শুধু চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। গুঞ্জন কেক খেতে খেতে হঠাৎ স্পন্দনের দিকে তাকাতেই দেখলো স্পন্দন গালে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গুঞ্জন ভ্রু কুচকে ফেলল। তারপর কিছু একটা ভেবে একপিস কেক কেটে স্পন্দের দিকে এগিয়ে দিলো। স্পন্দন একটু হেসে বলল,
— ” যাক দয়া হলো তাহলে আমার ওপর।?”
গুঞ্জন হেসে দিলো স্পন্দনের কথায়। তারপর চোখ দিয়ে ইশারা করতেই স্পন্দন গুঞ্জনের হাত থেকেই কেক খেয়ে নিলো। স্পন্দন একটু অবাক ও হলো এই ভেবে যে মেয়েটা আসলেই অন্যরকম। অন্যকোনো মেয়ে হলে এতোক্ষণে কতো রকমের নাটক দেখাতো, কখনো লজ্জা পেতোনা, কখনো মাথা নিচু করে মুচকি হাসতো। অথচ এই মেয়েটা কতোটা নরমাল আর ইজি। এসব ভাবতে ভাবতেই গুঞ্জন আবারও একটু কেক এগিয়ে দিলো স্পন্দনের দিকে স্পন্দন মাথা নেড়ে না করতেই গুঞ্জন নিজেই খাওয়া কম্প্লিট করল। গুঞ্জন খাওয়া শেষ করতেই স্পন্দন বলল,
— ” তো এবার ওঠা যাক?”
গুঞ্জন এবার টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
— ” হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনি যান আমিও যাচ্ছি।”
স্পন্দন ভ্রু কুচকে বলল,
— ” আপনি যান আমিও যাচ্ছি মানে কী? সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সো তুমি আমার সাথেই যাচ্ছ।”
গুঞ্জন টিস্যুটা রেখে হেসে বলল,
— ” আপনার কী মনে হয়? রাত দিন আমার কাছে মেটার করে?”
স্পন্দন একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
— ” আমি জানি ম্যাডাম। আপনি খুব সাহসী। একাই চলতে পারেন। বাট, আমি তোমাকে নিয়ে এসছি এন্ড তোমার বাইক ও আমিই তোমাকে বাড়ি পৌছে দেবো।”
গুঞ্জন কিছু বলবে তার আগেই স্পন্দন ওকে থামিয়ে ফলে উঠলো,
— ” এন্ড এটা নিয়ে আর কোনো কথা আমি শুনছি না।”
গুঞ্জন কিছু না বলে একটা ছোট্ট শ্বাস নিলো। কী আর বলবে? স্পন্দনই তো সব বলে দিয়েছে। তারপর দুজনেই একসাথে বাইরে গেলো। গাড়িতে তেমন কোনো কথা হয়নি ওদের মধ্যে। গুঞ্জনদের বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামতেই গুঞ্জন সিট বেল্ট খুলে স্পন্দনের দিয়ে তাকিয়ে বলল,
— ” থ্যাংকস।”
স্পন্দন মুচকি হেসে বলল,
— ” বাই।”
গুঞ্জনও বাই বলে গাড়ি থেকে নেমে চলে গেলো। আর স্পন্দনও গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেলো বাড়ির দিকে।
____________________
রাতে ডিনারের পর মেঘলা নিজের রুমে বসে অফিসের কিছু ফাইল চেক করছে ওর ল্যাপটপে। হঠাৎ গুঞ্জন এসে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে বলল,
— ” কী দেখছো?”
মেঘলা ল্যাপটপে চোখ রেখেই একটু হেসে বলল,
— “একটু অফিসের কাজ করছি। তুই তোরটা বল আজ এতো তাড়াতাড়ি?”
গুঞ্জন বেডে হেলান দিয়ে বলল,
— ” ওই কিছু করার ছিলোনা তাই চলে এলাম। এবার তুমি বলো তোমার কেমন চলছে নতুন অফিস।”
মেঘলা টাইপ করা থামিয়ে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” বেশ ভালো। বস যদিও একটু স্ট্রিক্ট টাইপ। বাট এমনিতে ভালো।”
গুঞ্জন একটু খোঁচা মেরে বলল,
— ” হ্যাঁ সেই তোমার তো আবার ক্রাশ তাইনা? ক্রাশের সবকিছুই ভালোলাগে। স্বাভাবিক।”
মেঘলা গুঞ্জনের মাথায় একটা চাটা মেরে বলল,
— ” ফাজিল মেয়ে। তবে আজ সকালে স্যারের ব্যবহারে খুব অবাক হয়েছে। কাউকে সরি কীকরে বলবে সেই টিপস চাইলো আমার কাছে ভাবা যায়? আমি আর কী বলবো? তোর মান ভাঙ্গানোর উপায়গুলো বলে দিয়েছি। কে জানে কার ওপর এপ্লাই করবে! ”
গুঞ্জন এবার বুঝতে পারলো যে কীকরে ঐ লোকটা ওর সকল পছন্দের জিনিস দিয়ে ওকে সরি প্লাস থ্যাংক ইউ বলল। গুঞ্জনকে চুপ থাকতে দেখে মেঘলা খোঁচা মেরে বলল,
— ” কী রে কী ভাবছিস?”
গুঞ্জন নিজেকে সামলে একটু বায়না করে বলল,
— ” এই মেঘুদি আমার একটুও ঘুম আসছেনা চলোনা লুডো খেলি?”
মেঘলা বেশ অবাক হয়েই বলল,
— ” এখন?”
গুঞ্জন আবারো বায়না ধরেই বলল,
— ” হ্যাঁ প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
মেঘলা হেসে দিয়ে বলল,
— ” আচ্ছা চল আনছি।”
মেঘলা উঠে গিয়ে সব নিয়ে আসলো। যেই ওরি খেলা শুরু করবে তখনি দরজা থেকে কেউ বলে উঠলো,
— ” আমাকে কী খেলতে নেওয়া যাবে?”
গুঞ্জন আর মেঘলা দুজনেই তাকিয়ে দেখলো যে আবির দাড়িয়ে আছে। আবিরকে দেখে গুঞ্জন বেশ অবাক হলো। আবির ভেতরে এসে বেডে বসে বলল,
— ” কীরে? চুপ করে আছিস কেনো তোরা? আমিও খেলবো।”
মেঘলা হেসে দিয়ে বলল,
— ” তুই সত্যিই খেলবি?”
আবির ভ্রু কুচকে বলল,
— ” কেনো আমি খেলতে পারিনা নাকি? বাকি কিন্তু নীল গুটি নেবো।”
হুট করেই গুঞ্জন বলে উঠল,
— ” মোটেই না। নীল গুটি আমি আগে সিলেক্ট করেছি তাই আমিই নেবো। ”
আবির বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” আজব। আমি বড় তাই আমি যা বলবো তাই হবে।”
গুঞ্জন রেগে গিয়ে বলল,
— ” ভাইয়া এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছেনা। ”
আবির নীল গুটিগুলো হাতে নিয়ে বলল,
— ” এটাই ঠিক।”
গুঞ্জন হাতে একটা বালিশ নিয়ে আবিরকে মারতে গিয়ে গুঞ্জন থেমে গেলো। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও নিজের শৈশবে ফিরে চলে গেছিলো ও। ছোটবেলায় দুজনে এসব নিয়ে কত্তো দুষ্টুমি করতো, ঝগড়া করতো। এসব ভেবেই বুকটা ভার হয়ে আসছে ওর। তবুও নিজেকে সামলে চুপচাপ লাল গুটিগুলো নিয়ে বসে পরলো। আবির একটু হেসে নীল গুটিগুলো গুঞ্জনের হাতে দিয়ে লাল গুটিগুলো গেলো। গুঞ্জন শুধু একবার তাকালো আবিরের দিকে কিন্তু কিছু বললোনা। এরপর তিনজনে মিলেই লুডু খেলা শুরু করলো খেলার মধ্যে আবির বারবার চিটিং করে আর গুঞ্জন না চাইতেও রেগে ছোট বেলার মতো রিয়াক্ট করছে। যেটা আবির আর মেঘলা মনে মনে খুব ইনজয় করছে ওর সেই ছোট্ট গুটিকে দেখার জন্যে। আসলে আবির ইচ্ছে করেই এসব করছে। শৈশবের কিছু কিছু স্মৃতি এমনই হয় মনে দাগ কেটে রেখে দেয়। বড় হওয়ার সাথে সাথে হয়তো সব বদলে যায়, মানুষের মন, পরিবেশ, পরিস্হিতি । কিন্তু এইসব স্মৃতিগুলো ঠিক মনের কোণ এক কোণে রয়েই যায়
____________________
সকাল বেলা স্পন্দন নিচে নেমে সোফায় বসে কফি খাচ্ছে আর নিউসপেপার পড়ছে। তখন সারা আস্তে আস্তে ওর পাশে বসলো কিন্তু স্পন্দন কোনো রিয়াক্ট না করে নিজের মতো নিউসপেপার পড়ে যাচ্ছে। সেটা দেখে সারা একটু কাশল কিন্তু স্পন্দন তাকালো না ওর চোখ পেপারে। সারা এবার একটু জোরেই কাশি দিলো। স্পন্দন এবার পেপার নামিয়ে বিরক্ত হয়ে সারার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” কী হয়েছে? এভাবে কাশিস কেনো? যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়েস নাকি?”
সারা এবার একটু মেকি হেসে বলল,
— ” হ্যাঁ আমি ঠিক আছি তুই ঠিক আছিস তো?”
স্পন্দন আবারও পেপারে চোখ দিয়ে বলল,
— ” মানে?”
সারা একটু হেসে বলল,
— ” শুনলাম কাল নাকি গুঞ্জনকে গাড়িতে করে কোথাও নিয়ে গেছিলি? কোথায় নিয়ে গেছিলি রে?”
স্পন্দন পেপারে তাকিয়েই ভ্রু কুচকে বলল,
— ” সেটা এখন তোকে বলতে হবে নাকি?”
সারা একটু গলা ঝেড়ে বলল,
— ” নাহ আমাকে বলতে কেনো হবে? শুধু এটা বল। সব সেট হয়ে গেছে তো?”
স্পন্দন এবারেও ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
— ” সেট হওয়ার তো কিছু নেই? সরি বলার দরকার ছিলো বলে দিয়েছি। দ্যাটস ইট। এখন বকবক করে আমার মাথা খাসনা যা এখান থেকে।”
সারা মুখ ফুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চলে গেলো। এমন কেনো ওর ভাইটা? একটু রোমান্টিক হতে দোষ কি? এতোবছরে না প্রেম করেছে আর না কোনো মেয়ের প্রতি ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে। কোথায় ভাবলো যে গুঞ্জনের প্রতি হয়তো একটু উইক হবে। বাট এতো পুরো বেকে আছে। আর স্পন্দন পেপারটা নামিয়ে সারার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবল। মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ভুল করেছে তাই সরি বলেছে। দ্যাটস ইনাফ। এখন ও ওর রাস্তায় আর গুঞ্জন ওর নিজের রাস্তায়। ওদের দুজনের জীবণ আলাদা, পথ আলাদা, গন্তব্যও আলাদা। তাই পুরোপুরি ভিন্ন দুইরকম দুটি পথ কোনোদিন এক হতে পারেনা সেটা সম্ভব নয়।
#চলবে…