#তুমি এলে তাই ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১২
.
গুঞ্জনকে একপ্রকার জোর করে টেনে গাড়িতে তুলল স্পন্দন। গুঞ্জন বেড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই স্পন্দন ওকে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা লক করে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। গুঞ্জন তো কিছুই বুঝতে পারছেনা। ওর জানা মতে ও তো এখন এমন কিছুই করেনি যার জন্যে স্পন্দন রেগে যেতে পারে। হচ্ছেটা কী? স্পন্দন গাড়ি স্টার্ট দিতেই গুঞ্জন বেশ রেগে গিয়ে বলল,
— ” আজবতো? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
স্পন্দন সেদিকে পাত্তা দিয়ে একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। গুঞ্জনের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছে না। গুঞ্জন এবার বেশ জোরে চেঁচিয়ে বলল,
— ” ওহ হ্যালো?”
স্পন্দন এবার বিরক্ত হলো। এতো চেঁচাচ্ছে কেনো মেয়েটা? একটা মিনিট চুপ করে বসা যায় না? ওর কানের বারোটা বেজে যাচ্ছে। ও ভ্রু কুচকে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” সমস্যাটা কী? একটু শান্ত হয়ে বসতে পারছোনা? দেখতেই পাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি। আমাকে দেখে কী বাচ্চাচোর মনে হচ্ছে যে তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবো?”
গুঞ্জন বিড়বিড় করে বলল,
— ” তারচেয়ে কম কিছুও নন।”
স্পন্দন ড্রাইভ করতে করতে বলল,
— ” কিছু বললে নাকি?”
গুঞ্জন বিরক্ত হয়ে হাত ভাজ করে বলল,
— ” নাহ কিছু না।”
হঠাৎ স্পন্দনের আগের কথাটা ভাবতেই গুঞ্জন স্পন্দনের দিকে টার্ন নিয়ে বলল,
— ” ওয়ান মিনিট? বাচ্চাচুরি মানে কী হ্যাঁ? আপনি কী আমাকে বাচ্চা বলছেন নাকি?”
স্পন্দন সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বলল,
— ” ইউ নো কেউ বলেছিলো বুদ্ধিমানদের জন্যে ইশারাই যথেষ্ট।”
স্পন্দনের কথাটা শুনে এখন গুঞ্জনের ইচ্ছে করছে ওকে আচ্ছা মতো কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু এই লোকটার সাথে বেশি কথা বাড়াতে চাইছেনা ও তাই মুখ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর স্পন্দনও ড্রাইভিং এর কাজে মন দিচ্ছে। বেশ অনেক্ষণ দুজনেই চুপ করে বসে ছিলো। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে গাড়িটা থামলো। গুঞ্জন ভ্রু কুচকে একবার চারপাশে তাকিয়ে তারপর স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” আমরা এখানে কেনো এসছি?”
স্পন্দন কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ওপাশে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “বেড় হও।”
গুঞ্জন বেশ বিরক্তি নিয়েই বের হলো। গুঞ্জন বের হতেই স্পন্দন ওর হাত ধরে হাটা দিলো। গুঞ্জন এবার আর কিছু বললনা। পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করতে চায়না ও। তাছাড়া ও জানতে চায় স্পন্দন কী করতে চাইছে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে গুঞ্জন খুব অবাক হলো কারণ পুরো রেস্টুরেন্টটাই ফাঁকা। ও ভ্রু কুচকে আশপাশটা দেখে চলেছে। আর স্পন্দন ওর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। স্পন্দন ওকে নিয়ে কর্ণারের একটা টেবিলের সামনে নিয়ে যেতেই ও অবাক হয়ে গেলো কারণ টেবিলটা যে দেয়ালের সাথে লাগানো সেখানে বিভিন্ন রঙ এর ইংলিশ অ্যালফাবেট দিয়ে সরি লেখা আছে আর তার চারপাশে ছোট ছোট বেলুন, স্টিকার ফুল, বিভিন্ন কিছু দিয়ে সুন্দর করে সাজানো চমৎকার লাগছে দেখতে। গুঞ্জন ভাবছে স্পন্দন ওকে সরি কেনো বলছে? তাও এভাবে? মনে মনে বেশ খুশিই হলো কারণ যা যা দিয়ে সাজিয়েছে এইসব কিছুই খুব পছন্দ ওর। তবুও নিজের খুশিটাকে পাত্তা না দিয়ে স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” এসব কী?”
স্পন্দন জবাব না দিয়ে গুঞ্জনের হাত ধরে ওকে বসিয়ে দিয়ে বলল,
— ” এতো প্রশ্ন না করে চুপচাপ বসো।”
তারপর স্পন্দন ওর বরাবর সামনে বসে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে দেয়ালের দিকে ইশারা করে বলল,
— ” তো এটা কেমন লেগেছে?”
গুঞ্জন একবার দেয়ালের দিকে তাকিয়ে তারপর আবার স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” নট ব্যাড। বাট এসব কেনো?”
স্পন্দন এই প্রশ্নেরও উত্তর না দিয়ে ওয়েটারকে ডেকে বলল,
— ” যা বলেছিলাম রেডি হয়েছে?”
ওয়েটার একটু হেসে বলল,
— ” জ্বী স্যার হয়ে গেছে। আমি নিয়ে আসছি।”
বলে যেতে নিলে স্পন্দন ডেকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
— ” আমার জন্যে একটা ব্লাক কফি।”
ওয়েটার মাথা নেড়ে চলে গেলো। গুঞ্জন এখনো ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। কী হচ্ছে কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না। দুজনেই চুপচাপ বসে আছে।গুঞ্জন বিরক্তিমিশ্রিত দৃষ্টিতে স্পন্দনকে দেখছে আর স্পন্দন নিজের মতো ফোন স্ক্রল করে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়েটার একটা ট্রে নিয়ে টেবিলে রাখলো। ট্রে থেকে ব্লাক কফিটা স্পন্দনের সামনে দিলো। আরেকটা জিনিস আছে যেটা ঢাকা গুঞ্জন বুঝতে পারছেনা। স্পন্দন ট্রেটা গুঞ্জনের সামনে দিয়ে আস্তে করে ওপর থেকে ঢাকনাটা সরিয়ে দিলো। গুঞ্জন বিরক্তি নিয়ে ট্রের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে থমকে গেলো, তারপর আবার আস্তে আস্তে ট্রেটার দিকে তাকালো। এককাপ ক্যাপাচিনো কফি রাখা আছে। যেটা গুঞ্জনের আলটাইম ফ্যাবরেট। খুব বেশিই ভালোবাসে কফিটা খেতে ও। তবে অবাক হলো এটা দেখে যে কফিটার ওপর চকলেট পাউডার দিয়ে খুব সুন্দর করে ইংলিশে সরি লেখা। তবে কফিটা দেখে না ও না চাইতেও ওর ঠোটের কোণে ছোট্ট একটু হাসি ফুটে উঠলো। কারণ এই কফিটার প্রতি একটু বেশিই দুর্বল ও। ও স্পন্দনের দিকে তাকাতেই স্পন্দন একটা প্যাকেট বক্স বের করলো। গুঞ্জনের সামনে রেখে প্যাকেট বক্সটা খুলল। কিন্তু গুঞ্জন স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে আছে স্পন্দন চোখের ইশারায় বলল টেবিলে দেখতে, নিচে তাকিয়ে গুঞ্জন আবারো অবাক হলো কারণ বক্সটাতে একটি গোল ছোট সাইজের চকলেট কেক রাখা আছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেকটা খুব বেশি ক্রিমি এন্ড চকলেটি। যার ওপর খুব সুন্দর করে ইংলশেই থ্যাংক ইউ লেখা। এই কেকটাও গুঞ্জনের খুব বেশি ফ্যাবরেট। অন্যসময় হলে গুঞ্জন এতোক্ষণে খাওয়া শুরু করে দিতো কিন্তু এখন অনেক কনফিউশনে আছে তাই কিছু বলতে পারছেনা। তবে ও এটা ভেবে অবাক হলো যে ওর যে এগুলো পছন্দ তা স্পন্দন কীকরে জানলো? তবে এটা ঠিক যে এই দুটোই গুঞ্জনের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে যথেষ্ট ছিলো। স্পন্দন গুঞ্জনের মুখে ওই ছোট্ট হাসিটা দেখেও স্বস্তি পেলো। গুঞ্জন ঠোঁটে হালকা হাসি রেখেই স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে চোখ আর ভ্রু জোড়ার ইশারায় জিজ্ঞেস করলো এসব কী? স্পন্দন একটু গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসে কফিটার দিকে ইশারা করে বলল,
— ” এটা বেশ কয়েকবার তোমার সাথে মিসবিহেভ করে ফেলেছি। কারণ আমি বারবারই ভুল বুঝে এসছি। প্রথমদিন স্মোক করো ভেবে মিসবিহেভ করেছি, বাট সিগারেটের ধোয়ায় তোমাকে কাশতে দেখে বুঝলাম যে তুমি স্মোক করোনা । আর তারপর ঐদিন আমি ভেবেছিলাম তোমরাই সারাকে র্যাগ করছো তাই রাগের মাথায় ওসব বলে ফেলেছি ওসব তারজন্যেও। আর সেদিন রাতে কিছু ঠিক করে না জেনেই তোমার গায়ে হাত তুলে ঠিক করিনি, আসলে সারাকে ওভাবে দেখে মাথা ঠিক ছিলোনা আমার। সো এসবের জন্যেই এটা।”
গুঞ্জনের এবার খুব হাসি পাচ্ছে। ও ভালোই বুঝতে পেরেছে যে স্পন্দন ওকে মুখে সরি বলতে পারছেনা তাই এভাবে বলছে। এইকয়দিন যে বাবু এই চেষ্টাই করছিলো সেটাও বুঝতে পারছে। গুঞ্জনও এতো সহজে ছাড়বেনা তাই স্পন্দনকে একটু জ্বালানোর জন্যে মুচকি হেসে একটু সুর টেনে বলল,
— ” কোনটা?”
স্পন্দন একটু ইতস্তত করে কফিটার দিকে দেখিয়ে বলল,
— ” কফিটা।”
গুঞ্জন একটু হেসে বলল,
— ” আজকাল কারো সাথে মিসবিহেভ করলে পরে তাকে কফি দেয় বুঝি?”
স্পন্দন কী বলবে বুঝতে পারছেনা। কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
— ” নাহ ঐ যে কফির ওপরে লেখাটা?”
গুঞ্জন মনে মনে ভাবলো। আমাকে তুমি চেনোনা স্পন্দন চৌধুরী । যতো যাই করো তোমার মুখ দিয়েতো আমি সরি শব্দটা বের করবোই। এবারের দুষ্টুমি করে টেনে টেনে বলল,
— ” কী লেখা আছে?”
স্পন্দন এবার বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে বলল,
— ” তুমি ইংলিশ পড়তে পারোনা না কী হ্যাঁ?”
গুঞ্জন কিছু একটা ভেবে মুখটা গোমড়া করে বলল,
— ” লে। কীকরে পড়বো লেখাই তো ঠিক করে বোঝা যাচ্ছেনা।”
স্পন্দন এবার বেশ রেগে গিয়ে বলল,
— ” কানা নাকি তুমি? বোঝা যাচ্ছেনা মানে কী? এখানে স্পষ্ট লেখা আছে যে সরি।”
গুঞ্জন জেনো এটারই অপেক্ষা করছিলো। ও সাথে সাথেই বলল,
— ” কী? কী লেখা আছে?”
স্পন্দনও সোজা ভাবেই বলে দিলো,
— ” সরি।”
গুঞ্জন বিজয়ের একটা হাসি দিয়ে বলল,
— ” ইটস ওকে। চালতা হ্যাঁ বস।”
স্পন্দন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। এবার বুঝতে পারলো যে ও নিজের মুখ দিয়েই সরি বলে ফেলেছে। স্পন্দন চোখ ছোট করে গুঞ্জনের দিকে তাকাতেই গুঞ্জন ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিলো। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে কেকটার দিকে তাকিয়ে স্পন্দনকে বলল,
— ” আর এটা?”
স্পন্দন একটা লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
— ” সেদিন কলেজে ঐ ছেলেগুলার কাছ থেকে আমার বোনকে বাঁচানোর জন্যে। সেদিন ক্লাবের যতটা সম্ভব ওর খেয়াল রাখার জন্যে। এন্ড আমার সরি এক্সেপ্ট করার জন্যে।”
স্পন্দনের কথা শুনে গুঞ্জন একটু হাসলো তারপর কফিটার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” ক্যান আই স্টার্ট?”
স্পন্দন একবার কফি আরেকবার গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” ইয়াহ শিউর।”
স্পন্দন আর দুজনেই কফি খাওয়া স্টার্ট করলো। কফি খেতে খেতে একটু কথাবার্তাও হলো। স্পন্দন এটুকু বুঝেছে যে মেয়েটাকে প্রথম দেখায় যতটা খারাপ ভেবেছিলো ততোটা খাবাপ ও না। এসব ভাবতে ভাবতে স্পন্দন গুঞ্জনকে দেখছে আর কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। হঠাৎ স্পন্দন খেয়াল করলো কফির ক্রিম গুঞ্জনের নাকের নিচে লেগে আছে। সেটা দেখে স্পন্দন কফিতে চুমক দিতে গিয়েও থেমে গেলো। গুঞ্জনের চোখ স্পনদনের দিকে পরতেই স্পন্দনকে ওর দিকে এমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলল। কাপটা টেবিলে রেখে ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করলো কী হয়েছে? স্পন্দনের কী হলো ও নিজেও জানেনা ও কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। গুঞ্জন এখনো ভ্রু কুচকে দেখছে। স্পন্দন আস্তে আস্তে গিয়ে গুঞ্জনের পাশের চেয়ারটাতে বসলো। গুঞ্জন কিছু বলতে যাচ্ছিলো ঠিক তখনি স্পন্দন নিজের হাত এগিয়ে নিয়ে গুঞ্জের নাকের নিচে লেগে থাকা ক্রিমটা আঙ্গুল দিয়ে মুছে দিলো। গুঞ্জনতো পুরো বোকা বনে গেলো। হঠাৎ করে ব্যাপারটা কী হলো সেটাই বুঝতে পারলোনা। হঠাৎ এমন অদ্ভুত আচরণের মানে কী? ও শুধু অবাক দৃষ্টিতে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে স্পন্দনের দিকে।
#চলবে…