তুমি এলে তাই পর্ব-১০

0
3568

#তুমি এলে তাই ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১০
.
স্পন্দনের মনে হচ্ছে ওর দ্বারা একটা বড়সর ভুল হয়ে গেছে। দুহাতে নিজের কপালের চুল উল্টে ধরে নিচেল ঠোট কামড়ে ধরলো। তারপর বিড়বিড় করে বলল,

— ” এটা আগে কেনো মাথায় আসেনি আমার যে লাইটার ও অন্য কারণেও চাইতে পারে? উফফ মাঝে কী হয় আমার কে জানে। মেয়েটা তো পাত্তা না দিয়ে চলে গেলো। অবশ্য কালকের পর ওর এরকম করাটা খুব অস্বাভাবিক কিছু না। ”

এসব বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো স্পন্দন। আজ কেনো জানি আর অফিস যেতে ইচ্ছে করলো না, তাই নিজের ম্যানেজারকে ফোন করলো। ম্যানেজার ফোন রিসিভ করতেই স্পন্দন বলল,

— ” শুনুন আজ আমি আজ আসছি না। আমার নিউ পিএ যাকে এপোয়েন্ট করা হয়েছে কী জেনো নাম মেয়েটার?”

ম্যানেজার তাড়াতাড়ি বললেন,

— ” হ্যাঁ স্যার মেয়েটার নাম মেঘলা।”

স্পন্দন গাড়িতে গাড়িতে হেলাম দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” সে যাই হোক। মিস মেঘলাকে অফিসিয়াল কাজ গুলো বুঝিয়ে দিয়ে, ওনাকে চলে যেতে বলুন। আজ আর বিশেষ কোনো কাজ নেই ওনার।”

ম্যানেজার একটু ইতস্তত করে বলল,

— ” আচ্ছা স্যার। আসলে বলছিলাম কী? আপনার শরীর ঠিক আছে?”

স্পন্দন ভ্রু কুচকে বলল
— ” আমার আবার কী হবে?”

ম্যানেজার একটু অবাক হলো। এতোদিন ধরে স্পন্দনের সাথে কাজ করছে কিন্তু অকারণেই এভাবে অফিসে না আসতে কখনো দেখেনি। বরং সে সারা দিনরাত অফিসেই পরে থাকে নিজের কাজ নিয়ে। তবুও নিজেকে সামলে একটু হেসে বলল,

— ” না স্যার কিছুনা।”

স্পন্দন ফোন কেটে দিলো। এরপর সারার বেরোনোর জন্যে অপেক্ষা করতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সারাও চলে এলো। এসে স্পন্দনকে দেখে বেশ অবাক হলো তারপর খুশি হয়ে দৌড়ে ওর ভাইয়ার কাছে গিয়ে বলল,

— ” কীরে ভাইয়া? তুই এখানে? আসবি বলিস নি তো?”

স্পন্দন মুচকি হেসে বলল,

— ” এখানেই এসছিলাম ভাবলাম তোকে নিয়ে যাই।”

সারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কিন্তু এখানে কেনো এসছিলি?”

স্পন্দন কী বলবে বুঝতে পারছেনা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা হালকা চুলকে ইতস্তত করে বলল,

— ” আসলে গুঞ্জনকে সরি বলতে এসছিলাম।”

সারা অবাক হয়ে তাকালো স্পন্দনের দিকে তারপর দুষ্টু হেসে বলল,

— ” ও হো হো.. গুঞ্জনকে সরি বলতে এসছিলাম? মানে দা গ্রেট স্পন্দন চৌধুরী কাউকে সরি বলছে? ওয়াও। আচ্ছা ভাইয়া লাস্ট কবে কাউকে সরি বলেছিলি বলতো?”

স্পন্দন বিরক্ত হয়ে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” লেগপুল করছিস?”

সারা সাথেসাথেই হাসি থামিয়ে দিয়ে বলল,

— ” নানা একদম না। আমি কী তা করতে পারি বল? তা বলেছিস সরি।”

স্পন্দন কফাল কুচকে হাত ভাজ করে বলল,

— ” ম্যাডাম তো ঘুরেও দেখলো না। এটিটিউড দেখিয়ে চলে গেলো।”

স্নিগ্ধা অনেক আফসোস করার ভান করে বলল,

— ” অঅঅঅ সোওও স্যাড।”

স্পন্দন চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই সারা সাথে সাথে মুখটা সিরিয়াস করে তুতলিয়ে বলল,

— ” অ বব চ্ চল তাহলে? বাড়ি য্ যাই।”

স্পন্দন একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে বসলো। সারাও বসে পড়লো। এরপর দুজনেই রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। তবে স্পন্দন মনে মনে ভাবছে যে অকারণে একটা মেয়েকে এতো কথা শুনিয়েছে, তারওপর গায়ে হাত তুলেছে। সো যেকরেই হোক সরি তো বলতেই হবে। তখন রাগের মাথায় কাজট করে ফেললেও। এখন অকারণে একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে ভাবলেও কেমন লাগছে এখন ওর।

_______________________

আজ গুঞ্জন বিকেলেই বাড়ি চলে এলো। এসেই সোজা মেঘলার ঘরে চলে গেলো। গিয়ে দেখে মেঘলা কানে ইয়ারফোনে লাগিয়ে গান শুনছে। গুঞ্জন গিয়ে মেঘলার পাশে বসতেই মেঘলা গুঞ্জনকে দেখে কান থেকে ইয়ারফোন নামিয়ে বলল,

— ” বাব্বাহ আজ এতো তাড়াতাড়ি?”

গুঞ্জন হালকা হেসে বলল,

— ” আমিতো এরকমি, ছন্নছাড়া। না আছে তাল আর না আছে ছন্দ। তুমি তোমারটা বলো? আজতো অফিসের ফার্স্ট ডে ছিলো? কেমন গেলো।”

মেঘলা ইয়ারফোনটা হালকা করে ছুড়ে বেডে রেখে বলল,

— ” দূর। আজতো স্যার এলোই না। ম্যানেজা আমাকে কাজটা বুঝিয়ে দিয়ে আজকের মতো ছেড়ে দিয়েছে। কতো এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম সব ফ্লপ।”

গুঞ্জন একটু রেগে যাওয়ার ভান করে বলল,

— ” ঐ স্পন্দন চৌধুরীর জন্যে আমার মেঘুদি মন খারাপ করেছে। আসলেই লোকটা খবিশ, আচ্চা ধোলাই দিয়ে দেবো হুমম?”

মেঘলা গুঞ্জনের দিকে একটা বালিশ ছুড়ে দিয়ে বলল,

— ” থামতো ড্রামাকুইন একটা।”

এরপর দুজনেই একদফা হেসে নিলো এই কথার ওপর। মেঘলা হাসি থামিয়ে বলল,

— ” বল স্নাক্সে কী খাবি? অনেক দিন যাবত একসাথে স্নাক্স করা হয়না।”

গুঞ্জন বেডে হেলান দিয়ে একটা হাই তুলে বলল,

— ” যা খুশি করো, আমিই সবিই খাই। খুব ঘুম পাচ্ছে আমার খেয়ে একটা ঘুম দেবো।”

মেঘলা চলে গেলো কিচেনে আর গুঞ্জন কানে ইয়ারফোন গুজে চোখ বন্ধ করে মেঘলার ফোন থেকে গান শুনতে লাগলো।

_______________________

পরের দিন স্পন্দন সকালেই চলে এলো ভার্সিটিতে কারণ কালকে ও ভেবে রেখেছে যে ছুটির পরে না ক্লাস শুরুর আগেই যাবে যাতে করে গুঞ্জন চলে যেতে না পারে। স্পন্দন ভার্সিটির ভেতরে গিয়ে দেখে গুঞ্জন ওরা সিড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছে। গুঞ্জনের দিকে ওর চোখ পড়তেই দেখতে পেলো যে কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছে আর মাঝে মাঝে কথা বলছে। একটু বিরক্ত হলো ও, পড়াশোনা করতে এসে কেউ এভাবে গান শোনে? তবুও রাগ না করে নিজেকে বুঝিয়ে নিলো যে ও এরকমি। তারপর সোজা গুঞ্জনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” হ্যালো?”

গুঞ্জন আজকে চোখ বন্ধ করে ছিলোনা। তাই স্পন্দনকে দেখতে পেলো। স্পন্দনকে দেখেই গুঞ্জন ভ্রু কুচকে ফেলল। কান থেকে হেডফোন নামিয়ে গলায় ঝুলিয়ে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যেতে নিলেই স্পন্দন দ্রুত গঞ্জনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। গুঞ্জন ভ্রু কুচকে বেশ বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” আজকে আবার থাপ্পড় টাপ্পড় মারার শখ হয়েছে নাকি? দেখুন আপনি সেদিন যা খুশি বলেছেন কিছু বলিনি এরপর চেষ্টাও করবেননা হ্যাঁ? আমি কিন্তু অতোটাও ভালো না।”

স্পন্দন এতোক্ষণ কপাল কুচকে গুঞ্জনের কথাগুলো শুনছিলো। কিন্তু গুঞ্জনের আপনি বলাটা ওকে অবাক বেশ করলো। প্রথম দেখা থেকেই তুমি করে বলে। হঠাৎ আপনি ডাকটা কেনো জানিনা ভালো লাগলোনা স্পন্দনের। কারণটা হয়তো ওর নিজেরও অজানা। যেই গুঞ্জন থামলো ও একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

— ” এবার আমি বলি?”

গুঞ্জন কিছু বলল না কিন্তু এখনো ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে স্পন্দনের দিকে। স্পন্দন এবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনের সাথে অনেক্ষণ যুদ্ধ করে বলল,

— ” এক্চুয়ালি….”

ও কী দিয়ে শুরু করবে কীভাবে কী বলবে কছুই বুঝতে পারছেনা তাই আবারো বলল,

— ” এক্চুয়ালি…

গুঞ্জন বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” এক্চুয়ালি শুনেছি এরপর কী?”

স্পন্দন হালকা গলা ঝেড়ে একটু ঠিক হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” এক্চুয়ালি আ’ম..”

এটুকু বলেই থেমে গেলো ও। গুঞ্জন হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,

— ” এক্চুয়ালি ইউ আর?”

স্পন্দন এর মুখ দিয়ে সরি শব্দটা বের হচ্ছেনা। আসলে সরি শব্দটা সচরাচর বলার অভ্যেস নেই ওর। সবসময় মাথা উচু করে চলেছে। যদিও এরআগে কাউকে সরি বলার কোনো কারণ তৈরী হয়নি ওর জন্যে। অনেকক্ষণ মনকে মানিয়ে ও বলল,

— ” এক্চুয়ালি আ’ম স..”

এবার স্পন্দনের নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে। সামন্য একটা সরি বলতে পারছেনা ও। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা শব্দটা কিছুতেই বের হচ্ছেনা ওর মুখ দিয়ে। হাউ সেইমফুল।গুঞ্জন বিরক্ত হয়ে পাশ কাটিয়ে হনহনে পায়ে ভেতরে চলে গেলো। ওর সব বন্ধুরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সাথে স্পন্দনও। ওর বন্ধুরা উঠে ওর পেছন পেছন চলে গেলো। কিছু একটা ভেবে স্পন্দন দ্রুতপদে গুঞ্জনের পেছন পেছন যেতে নিলেই ওর পরিচিত একজন ওকে ডাকল যার ফলে ওকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলতে হলো। কথা শেষ করে গুঞ্জন যেদিকে গেছে সেদিকে কিছুদূর যেতেই দেখলো গুঞ্জন হকিস্টিক দিয়ে দুটো ছেলেকে ইচ্ছেমতো মারছে। খুব বেশি রেগে গেছে গুঞ্জন। ওকে ভয়েও কেউ থামাতে যাচ্ছেনা। স্পন্দন যেতে যেতে ছেলেদুটো একপ্রকার দৌড়ে পালালো ওখান থেকে। গুঞ্জনের পিঠে কেউ হাত রাখতে গুঞ্জন ‘ কে বে?” বলে হকিস্টিক দিয়ে মারতে নিলেই স্পন্দনকে দেখে থেমে গেলো। হকিস্টিকটা ছুড়ে ফেলে নাকের নিচের ঘামটা মুছলো। স্পন্দন কিছু বলতে নিলেই গুঞ্জন হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,

— ” আমি খুব অসভ্য একটা মেয়ে, খুবই উশৃঙ্খল । ভার্সিটিতে কীকরে আসতে হয় সেটা জানিনা, ভার্সিটিতে পড়তে এসে গুন্ডামো করে বেড়াই, মিনিমান ভদ্রতা নেই আমার। বাচ্চা বাচ্চা দুধের শিশু গুলোকে সুযোগ বুঝে পেটাই। আমার মতো খারাপ মেয়ে দুনিয়াতে দুটো নেই।”

এটুকু বলে একটা শ্বাস নিলো। স্পন্দন তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। গুঞ্জন স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” এগুলোই বলতেন তো? আপনাকে আর কষ্ট করতে হলোনা আপনার হয়ে আমিই বলে দিলাম। আর ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমি এরকমই থাকবো। কী করবো? কোয়ালিটি ছাড়া মেয়েরা এসবই করে। আ’ম হেল্পলেস।”

এটুকু বলে দ্রুতপদে নিজের ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে গেলো গুঞ্জন। সবাই মোটামুটি অবাক হয়ে গেছে। স্পন্দন আহম্মকের মতো কিছুক্ষণ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর মুখে হালকা একটু হাসি ফুটিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,

— ” এক্কেবারে ঝাসির রাণী।”

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে