তিলোত্তমা
পর্বঃ ১১-খ (শেষ পর্ব, ২য়খন্ড)
★
-‘আমি জানি, আপনি ভাবছেন শুধু শুধু এইরকম বিচ্ছিরি নাটকের কী মানে ছিলো। সব বলছি, তার আগে ধন্যবাদ জানিয়ে নিই, তখন এতকিছুর পরেও আমার কথা বিশ্বাস করে বিয়েতে মত দেবার জন্যে! বলেছিলাম সব গুনে গুনে খুলে বলবো, গুনে গুনেই বলছি- ঠিক দুইটা কারণে এই বিতিকিচ্ছিরি নাটকটা করার সিদ্ধান্ত নিই আমি!’
ঘন্টা চারেক আগে বিয়েটা হয়ে গেছে শেষমেশ। আমাদের সেই পুরনো বাড়িটার দরজার সামনে ঝোলানো Ratri weds Dibosh লেখাটাকে সত্যি করে দিয়ে সত্যি সত্যিই এই বিয়েটা হয়ে গেছে! এই মুহূর্তে সেই পুরনো বাড়িটা থেকে আমি অনেকখানি দূরে, একটা ঝাঁ চকচকে এপার্টমেন্টের ঝকঝকে, তকতকে আয়তাকার ঘরে বসে আছি। বেশ ফুল-টুল দিয়ে সাজানো হয়েছে ঘরটা, বাসর ঘর বলে কথা! এই রাতটা নিয়ে কত্তো কী ভেবে টেবে রেখেছিলাম! সেই সমস্ত ভাবনার ঊর্ধে যেয়ে কী ভীষণ অদ্ভুতভাবেই না সেটা শুরু হতে যাচ্ছে!
পানি খাওয়ার জন্য খানিক থেমেছিলেন দিবস। আবার বলতে আরম্ভ করলেন-
-‘প্রথম কারণটা বলছি। আপনার মনে আছে? সেদিন ফোনে বলেছিলেন আমায়- সবাই খালি বদলে যায়। ঘনিষ্ঠ মানুষদের ক্রমাগত বদলে যাওয়া আচরণে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য লাগে আপনার। তখন কথা দিয়েছিলাম, ধ্রুবতারার মত হয়ে বাকি জীবনের জন্য দিক-বেদিকের দিশা খুঁজে দেবো আপনাকে- মনে আছে নিশ্চয়ই? আমি চেয়েছিলাম শেষবারের মত কাছের মানুষগুলির স্বরূপটা আরেকবার দেখে নিন আপনি, যাতে পরবর্তীতে আর কারো বদলে যাওয়া নিয়ে কোনোরকম কনফিউশনে না পরেন। ধ্রুবতারা যখন নাবিককে দিক চিনিয়ে দেয় তখন চারটি দিকই একবারে চিনিয়ে দেয়। আমিও চেয়েছিলাম, আপনার জীবনে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলির ভাল-মন্দ সবগুলি দিক ক্লিয়ারলি আপনার জানা থাকুক। আচ্ছা, ঠিকঠাক মনে করে বলতে পারবেন- আমাদের বিয়েটা ভেঙে গেছে এটা শুনে কয়জন খুশি হয়েছিলো? কিংবা, নতুন গল্পের রসদ পেয়েছে ভেবে আমোদ পাচ্ছিলো?’
-‘প্রায় সবাইই!’
-‘এ তো বাঙালির স্বভাব ই। পরের আনন্দে আমাদের হিংসে হয় আর পরের দুঃখে হয় সুখ! আর, এর উলটো ছিলো কতজন? মানে, সবকিছুর পরেও আপনার পাশে ছিলো…’
-‘আমার বাবা, ছোটোখালা আর নিশিতা… ওহ আর আমার বড়মামী! মামীর সাথে তেমন কথাবার্তা হয়নি কখনোই আমার কিন্তু আজকে আমার হয়ে বলতে যেয়ে রীতিমত ডাইনি হয়ে গেছেন অনেকের কাছে!’
-‘কী জানেন তো রাত্রি! এই মানুষগুলি একেকজন হচ্ছেন ধ্রুবতারার মতো! রাত বাড়ার সাথে সাথে আকাশের দৃশ্যমান সব তারা তাদের অবস্থান বদল করে, ঠিক আপনার আশেপাশের ঐ বদলে বদলে যাওয়া মানুষগুলির মতন। কিন্তু শুধুমাত্র একটা তারা সবসময় একই জায়গায় চুপটি করে বসে থাকে, সেটা হচ্ছে ধ্রুবতারা। এই তারাটার ভরসাতেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা অথৈ সমুদ্রে জাহাজ ভাসিয়েছিলেন, ওনারা জানতেন কোনদিন পথ হারালেও এই তারাটা ঠিকঠাক পথ চিনিয়ে দেবে আবার। এই মাত্র যে চারজনের কথা বললেন আপনি, আপনার জীবনে এরা হচ্ছে সেই তারাটার মতো। একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনটুকু কী জানেন? এই ধ্রুবতারা মানুষগুলিকে চিনতে পারা! আপনার খুব বিপদে যখন সবাই বদলে বদলে যাবে, মুখ ফিরিয়ে নেবে তখনও এই চিরন্তন মানুষগুলিকেই আপনি একইভাবে পাশে পাবেন। পথহারা নাবিক যেমন পথ খুঁজে পাওয়ার জন্যে দূর আকাশের ছোট্ট একটা তারাকে পাশে পায়- ঠিক সেরকম! জীবনে যখনই কোনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবেন, চোখ বন্ধ করে এই মানুষগুলির কাছে সাহায্য চাইতে যাবেন, কারণ অন্যদের মতো এরা কোনোদিন আপনার বিপদে আত্নতৃপ্তি পাবেনা,কারণ এরা সত্যি সত্যিই আপনার ভালো চায়! জীবনটাকে সহজ করে বাঁচতে হলে যে মানুষগুলির ওপর ভরসা করতে হবে, আমি চেয়েছিলাম সেই মানুষগুলিকে আপনি চিনে নিন! সেজন্যে নিজেকে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছিলাম, যেন বাকি ধ্রুবতারাগুলির আলো আপনার চোখে পরে!
রাত্রি, আমাকে আপনার জীবনের পঞ্চম ধ্রুবতারার জায়গাটা দেবেন?’
সমস্ত অন্তরাত্মা একযোগে চিৎকার করে বলছে- ‘একশোবার দেবো, হাজারবার দেবো!’ অথচ বাহিরে কেবল নির্নিমেষ চেয়ে আছি তাঁর দিকে! কী ভয়ঙ্কর সুন্দর করে কথা বলে এই লোকটা! কী ভয়ঙ্কর সুন্দর!
-‘আর দ্বিতীয় কারণটা একটু অদ্ভুত।’- চোখজোড়া টেপার ভঙ্গি করে অল্প হাসেন দিবস।
-‘আপনি বলেছিলেন না, একদমই পার্লারে সেজেগুজে বিয়ে করতে চান না আপনি? ঐদিকে আপনার মা চাচ্ছেন সাজতেই হবে! আমি ভাবলাম- দু’জনের দিকটাই থাকুক! প্রথমে সেজেগুজে দুইচারটা ছবি তোলা হোক এরপর সব সাজ ধুয়ে মুছে একদম সত্যিকারের রাত্রি বিয়ের পিঁড়িতে বসুক! হয়ত আমি বলেকয়ে আন্টিকে রাজি করাতে পারতাম, কিন্তু তাতে যেটা হতো- আন্টি আজীবন আফসোস করে যেতেন! আর এখন যা হলো, তাতে তো বিয়েটা মিটেছে এই খুশিতে আর ঐ সাজ ফাজের কথা মাথাতেই আসেনি তাঁর! কীসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে যে আমরা মন খারাপ করে বসে থাকি, বড় বিপদ না আসা পর্যন্ত টের ই পাইনা। অনেক আগে মোল্লা নাসিরউদ্দিনের একটা গল্প পড়েছিলাম, সারমর্মটা এরকমই অনেকটা।’
-‘গল্পটা জানি আমি। দুঃখী লোক আর তার পোঁটলার গল্প…’
-‘এইতো ধরে ফেলেছেন! বেসিক্যালি এই দুইটা কারণেই হুট করে এই বিদ্ধংসী সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম আমি। সকালে যখন পার্লারে যেতে চান না বলে জানালেন তখনই মনে মনে প্ল্যানটা করেছিলাম। নিশিতাকে ফোন করে আগেভাগেই সব জানিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে এদিকে কোনো বিপদ আপদ হলে সামলে নেওয়া যায়। এইতো গুনে গুনে সব বলা শেষ, আর কোনো প্রশ্ন আছে?’
এরপরেও বুঝি আর প্রশ্ন বাকি থাকে! একেবারে ভালো ছাত্রটির মত গুনে গুনে সবক’টা প্রশ্নের উত্তর যে দিয়েই দিলেন!
-‘চুপ করে আছেন যখন, তখন ধরে নিলাম আর প্রশ্ন-ট্রশ্ন নেই! আমার অবশ্য একটা শেষ কথা বলার আছে… আজকে আমার জন্যে বেশ অনেকটা সময় দুর্বিষহ কেটেছে আপনার। আমি সেজন্যে দুঃখি…’
-‘মোটেও সেজন্যে দুঃখিত হবার কিছু নেই! এসব কথা আমার গা সওয়া, সেই জন্মের পর থেকেই তো শুনে আসছি! আপনার জন্যে নতুন করে কিছুই হয়নি, বিশ্বাস করুন! আমি শুধু ভেঙে পরেছিলাম ভুল মানুষকে বিশ্বাস করেছি এই ভেবে…’
-‘এখনো তাই-ই ভাবছেন?’- দিবস চোখ মটকায়।
-‘আপনার তাই মনে হয় বুঝি?’
-‘আমার তো কত কিছুই মনে হয়! এই যেমন, একটা রাত কারো হাত ধরে পূর্ণিমা দেখতে দেখতে কাটিয়ে দেবো মনে হয়।’
-‘আজ কিন্তু পূর্ণিমা!’
-‘সে জানি বলেই তো ইঙ্গিতকু দিলাম। আমার কাছে ছাদের চাবিও আছে!’- দিবসের চোখজোড়া ছেলেমানুষের মত চকচক করে ওঠে।
বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। আত্নীয়-পরিজনের ভিড় সামলাতে মেঝে জুড়ে বড় বড় চাদর পেতে শুতে দেয়া হয়েছে সকলকে। এর ভেতরেই পা টিপে টিপে দিবসের পেছন পেছন সিঁড়ি অব্দি পৌঁছে গেলাম। তারপর সোজা ছাদে! বুকের ভেতর থেকে মিছিমিছি তখন মাথা নেড়ে নেড়ে বলছিলো- ‘তোর অনেকগুলি কল্পনার মধ্যে পূর্ণিমা ভরা ছাদে বসে বাসর রাত পার করার কল্পনাটাও ছিলো। আমি কিন্তু সেটা জানি!’
‘চুপ মিছিমিছি! একদম চুপ! তোর জ্বালায় নিজের মনেমনেও কিছু ভেবে শান্তি নেই নাকি!’
-‘হ্যাঁ এখন তো আমায় চুপ করিয়েই দেবে! এখন কত সঙ্গী-সাথী পেয়ে গেছো!’
-‘না মিছিমিছি! তুই ভুল ভাবছিস। আজকে থেকে তোর নাম ধ্রুবতারা! কেউ জানেনা, তুই আমার সেই বালিকাবেলায় খুঁজে পাওয়া ধ্রুবতারা!’
★
সমাপ্ত।
(কপি বা শেয়ার না করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে)
গল্পের নাম তিলোত্তমা কেন, এই প্রশ্ন অনেকে করেছেন। উত্তর নিচে দিয়ে দিলাম।
তিলোত্তমা শব্দের উৎপত্তি হিন্দু পুরাণ থেকে। সুন্দ আর উপসুন্দ নামের দুই অসুর ভাই এই বর পায় যে, তারা কেবল পরষ্পরের হাতেই মরতে পারে, তৃতীয় কোনো পক্ষ এদের মারতে পারবে না। পরে এদের হয়রানিতে বাধ্য হয়ে জগতের সমস্ত সৌন্দর্যকে তিল তিল করে আহরণ করে এক অপরূপা নারীকে তৈরি করেন বিশ্বকর্মা, যার নাম তিলোত্তমা। পরে একে নিয়েই দুই ভাইয়ের যুদ্ধ লাগে এবং একে অন্যের হাতে নিহত হয়। তো যাই হোক, পুরাণের এই কাহিনী থেকেই তিলোত্তমার অর্থ পাওয়া যায়- তিল তিল করে সমস্ত উৎকৃষ্টতা যার মধ্যে রয়েছে, সেই তিলোত্তমা।
এবারে পাঠকেরা বলেন, এই গল্পে প্রকৃত অর্থে তিলোত্তমা কে? যে নাম বদলে নিজেকে ‘তিলোত্তমা’ দাবি করছে (মানে, তিষমা তিলোত্তমা আরকি) নাকি আমাদের রাত্রি? কালো বলে যার নাম রাখা হয়েছিল রাতের নামে। এই প্রশ্নটা পাঠকের মাথায় আসবে ভেবেই এই নামকরণ। গাত্রবরণ ভেদ করে লোকে সত্যিকারের তিলোত্তম/ তিলোত্তমাদের চিনতে পারুক, তবেই গল্পটার নামকরণ সার্থকতা পাবে।