Monday, October 6, 2025







বাড়িতিলোত্তমাতিলেত্তমা পর্ব ১০

তিলেত্তমা পর্ব ১০

তিলোত্তমা
পর্বঃ ১০

দিবস বোধহয় তখনো তার সেই ভাইয়ের কথাই বলে যাচ্ছিলেন, আমার কানে ঢোকেনি সেসব। বুকের ভেতর সব ভেঙেচুরে যাক, এই পাবলিক প্লেস-এ, এত এত মানুষের মাঝখানে সেটা প্রকাশ করার তো আর কোনো মানে হয়না! টেবিলে রাখা টিস্যুতে চোখজোড়া মুছে নিয়ে তাই মনোযোগ দিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকার ভান করি। অভিনয়টা বোধহয় আজও রপ্ত করতে পারিনি, কয়েক মুহূর্ত বাদেই ধরা পড়ে যেতে হয়।

-‘কী হলো? are you feeling sick, রাত্রি?’- দিবসের প্রশ্নাকুল চোখজোড়া আমার মুখের ওপর স্থির নিবদ্ধ হয়ে আছে।

-‘ন…না, না! ডিউটি শেষে এলাম তো, তাই…’

-‘ওহ! আচ্ছা দিব্য আসতে আসতে আমরা কোল্ড ড্রিংকস অর্ডার করি তাহলে? ফোনটাও তুলছে না, কখন আসবে তাও জানার উপায় নেই!’

আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে দুটো কোল্ড ড্রিংকসের অর্ডার করেন দিবস। তারপর নিতান্ত সহজ গলাতেই প্রশ্ন করেন-

-‘আচ্ছা, সেদিন নিশার কথার তোড়ে তো আর আপনাকে সব খুলে বলাই হয়নি! আমরা দুই ভাই, এক বোন। দিনা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। আর, দিব্য আমার বছর দুয়েকের ছোট… পেশায় আইনজীবি। উম..ম দেখতে টেখতে এই আমারই মত হবে ধরুন। আমি তো ছবি দিয়েছিলাম আন্টিকে, দেখেছেন নিশ্চয়ই?’

মনে মনে আরেকজনের ছবি এঁকে রেখেছি বলে সে ছবি আর দেখা হয়ে ওঠেনি। মুখ ফুটে এই কথাটুকু বলতেও বাঁধছে। তাই ঘাড় নেড়ে মিথ্যে সম্মতি জানালাম কেবল।

-‘ওহ, তাহলে তো দেখেছেন ই! আপনার কথা ওকে গতকাল ই বলেছি কেবল, বুঝলেন? ছোটবেলায় খুবই দুষ্টু ছিলো ছেলেটা, বড় হয়ে কেমন নিজের ভেতর গুটিয়ে গেছে! একলা একলাই থাকে, কারো সাথে খুব একটা মেশে-টেশে না। তবে আমায় খুব মানে! আসলে বাবা মারা যাবার পর খুব কষ্ট করে ওদের পড়ালেখাটা চালাতে হয়েছে আমাকে… তখন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। টিউশন আর পার্টটাইম জব করে কোনোমতে সংসারটা চালাতে হয়েছে, এর মধ্যেও ওদের পড়ালেখার ওপর এতটুকু আঁচ লাগতে দিইনি আমি আর মা। সেই তখন থেকেই দিব্যটা আমার খুব ভক্ত, বুঝলেন! আমার কোনো কথা কোনোদিন অমান্য করে না ছেলেটা…’

একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখজোড়া জ্বালা করছিলো আমার। বুকের ভেতর মরুভূমির হাহাকার, চোখ জুড়ে অনল দহন আর মন গহীনে ‘মিছিমিছি’র ক্রমাগত তাড়না- ‘বলে দে রাত্রি! এখন না বলিস তো সব ঘেঁটে যাবে… বলে দে সব!’ আমায় আর স্থির থাকতে দিলো না। দিবসের কথা শেষ না হতেই ফস করে বলে বসলাম-

-‘সেজন্যেই বুঝি আপনার ভাইয়ের ঘাড়ে আমায় গছিয়ে দিচ্ছেন? আপনার কথা ফেলতে পারবেনা, তাই না চাইলেও বাধ্য হয়েই আমায় ঘাড়ে করে নিয়ে ঘুরতে হবে!’

হঠাৎ ব্রেক কষা একটা গাড়ির মত থেমে গেলেন দিবস। চশমার আড়াল থেকে পিটপিটিয়ে চেয়ে রইলেন খানিক, বোধহয় কিছু ভাবলেন। তারপর ধীর গলায় বললেন-

-‘গছিয়ে দিচ্ছি মানে? রাত্রি, আপনি কোনো জড়বস্তু নন যে আপনাকে যার ঘাড়ে খুশি গছিয়ে দেয়া যাবে!’

-‘তাই? এ কথাও আপনারা জানেন? অথচ একেকসময় নিজেকে একটা লাথি খাওয়া ফুটবল বলে মনে হয় আমার, বুঝলেন! ৯০ মিনিট জুড়ে বেচারি বলটা কেমন পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে, কেউই ওটাকে নিজের কাছে একদণ্ড রাখতে চায়না। ঠিক আমার মতন। যত দ্রুত সম্ভব আমায় হাত বদল করতে পারলে মা শান্তি পান, তাই কোত্থেকে ধরেপেড়ে ঐ কাউসারালীকে নিয়ে এলেন! আবার নিশার জন্যে করছি বলে সে ঋণ মেটাতে এবারে আপনি নিজের ভাইটাকে বলির পাঁঠা করলেন! আমায় চেনেনা-জানেনা অথচ আপনার একটা কথাতেই আপনার বাধ্যগত ভাইটি দিব্যি আমায় বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন! স্বেচ্ছায় নয়, কেবল আপনার কথায়। না সে আমায় চেনে না আমি তাকে চিনি-জানি, ঐ বেচারার গলায় কেনো আমাকে ঝুলিয়ে দেবার মতলব করছেন বলুন তো? যেনো মাঠে ফেলে রাখা একটা ফুটবল আমি, যে যেভাবে পারছে, যাকে পারছে ball pass করছে… অথচ মা চাইলেই আমায় দুদণ্ড শান্তি দিতে পারতেন! আর আপনিও হয়তো…’

কথা আর কী বলব ছাই, নাকের জল চোখের জলে মাখামাখি হয়ে বসে আছি! দিবস সম্ভবত হতবাক হয়ে আমার দিকে দেখছেন, এক-দু’বার চোখ পড়েছিলো ওঁর দিকে। নাহ, শুধু শুধু এভাবে সিন ক্রিয়েট করার মানে নেই। ওড়না চেপে মুখটা মুছে উঠে দাঁড়ালাম-

-‘যাই হোক! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমার একটা গতি করতে চাইবার জন্যে। কিন্তু, এই বিয়েটায় আমার মত নেই… কিছু মনে করবেন না। অকারণে একজনের ঘাড়ের বোঝা হয়ে থাকবার চেয়ে এই এখনই বেশ ভালো আছি! আসছি…’

বাসায় ফেরার আর কণামাত্র ইচ্ছে অবশিষ্ট ছিলোনা। বাসা ভর্তি মানুষজন গিজগিজ করছে। এই বিয়েটা ভেঙে গেছে শুনলে বড়খালা, ফুপু আর মা মিলে আরেক গজব নামিয়ে আনবে। এই বিদ্ধস্ত মনটা এসব আর সহ্য করতে পারছে না! জন্ম জন্মান্তর ধরে কেবল সয়েই যাচ্ছি… আর কতো?

নিশিতাকে ফোন দিয়ে ওর হোস্টেলে যেয়ে উঠলাম ক’দিনের জন্যে। মেডিকেলে আমার ঠিক পরের রোলটাই ছিলো নিশিতার, সেই সূত্রে মোটামোটি একটা ভাল বন্ধুত্ব রয়েছে আমাদের। মা’কে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম কাজের প্রচণ্ড চাপের কারণে সপ্তাহখানেকের মত বাসায় যেতে পারবোনা, বিয়ের আলাপটা ততদিন পিছিয়ে থাকুক। ফোনেই ব্যাপক হম্বিতম্বি করছিলেন মা, পারেন তো তখনি দিবসকে ফোন দিয়ে বসেন! পরে বাবাকে দিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মা’কে থামানো গেছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে বড়খালা আর ফুপু চলে গেলে পরে সবটা খুলে বলতে হবে বাসায়, তার আগ পর্যন্ত এই হাতেগোনা পাঁচ-ছয়টা দিন কেবল আমার একলার, একটু নিশ্চন্তে নিঃশ্বাস ফেলবার!

ছোটোখাটো আঘাত আজকাল মনটাকে কাবু করেনা আর, সইতে সইতে সয়ে গেছে সেসব। কিন্তু, আজকে ভীষণ মন খারাপের মেঘ জমেছে বুকের ভেতর। একটু একলা থাকা খুব জরুরি… দু’দিনের জন্যে ছুটি নিয়ে নিলাম হসপিটাল থেকে। এই দু’দিন কেবল মন ভালো করার দিন। যা ইচ্ছে, যা খুশি করবার দিন!

-‘রাত্রি! অ্যাই রাত্রি! ওঠ… দেখতো কে এসেছে! নিচ থেকে সিকিউরিটি ইন্টারকমে কল করেছে, কে এসেছে তোর কাছে!’- গুনে গুনে দুইটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে মরার মত ঘুমিয়ে গেছিলাম গতকাল রাতে। যা খুশি করার দুই দিনের মধ্যে একদিন পার হয়ে গেছে কেবল কী করবো কী করবো ভাবতে ভাবতেই। মন খারাপ ভাবটা কাটবে কী উল্টে আরও বেড়েছে! সারাদিন বেকার বসে থেকে রাতে একদমই ঘুম আসছিলো না, তাই ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলাম। এই প্রথমবার খেলাম বলেই কিনা কে জানে, একেবারে অজ্ঞানের মত ঘুমিয়ে ছিলাম গোটা রাত এমনকি পরের দিনের সকালটাও। বেলা বারোটায় নিশিতার ডাকে কোনোমতে চোখ মেলে তাকাই, এখানে আবার আমার খোঁজে কে আসবে!

-‘কে এসেছে নিশি? চলে যেতে বল গিয়ে যা… বল আমি ঘুমাবো এখন!’

-‘ধুর ছাই! আমি চিনি নাকি তোর কে এসেছে… রাইয়্যান না কি জানি নাম বললো…’

এক মুহুর্তে ঘুমটুম সব উধাও হয়ে যায় চোখ থেকে। লাফিয়ে উঠে ইন্টারকমের হ্যান্ডসেটটা কানে লাগাই-

-‘দিবস রাইয়্যান কী আফনের লোক?’- সিকিউরিটি গার্ডের কাটাকাটা কণ্ঠটা ভেসে আসে তার বেয়ে।

-‘হ্যাঁ! দিবস রাইয়্যান আমার… আমার লোক! দাঁড়াতে বলুন, আসছি আমি!’

ধুপধাপ করে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে, গায়ে কোনোমতে একটা ওড়না জড়িয়েই সিঁড়ি বেয়ে দৌড় লাগালাম। টের পেলাম- বুকের ভেতরের দ্রিমদ্রিম বেজে চলা ঢাকের ডাকটার সাথে সাথে মনটাও তাল দিয়ে নাচতে চাইছে!

মন কি তবে এই আশাতেই বসে ছিলো? একজনের আগমনে বৃষ্টি ঝরাবে বলে সেই অপেক্ষাতেই মেঘ জমিয়ে রেখেছিলো নিজের ভেতর?

-‘নিশা বারবার আপনার খোঁজ করছিলো…’

নিচে নামতেই দিবসের দেখা পাই, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে। পাশে যেয়ে দাঁড়াতেই চমকে তাকিয়ে একটা সরলরৈখিক হাসি দিয়ে চট করে মাথাটা নামিয়ে নিলেন। এরপর থেকে কেবল হেঁঁটে চলেছি নির্বিকার দু’জনে। কারো মুখে কোনো কথা নেই! বেশ অনেকদূর আসবার পর এই মহামূল্যবান বাক্যখানার বিচ্ছুরণ হলো দিবসের কণ্ঠনালী বেয়ে।

ওহ! তবে এই কথা! নিশা খোঁজ করছে বলে নিশার বাবার আজ এখানে আগমন! আর কিছু নয়… কিচ্ছুনা!

-‘বেশ তো! সে তো ফোনে বললেই পারতেন…’

-‘ফোন তুলছিলেন না আপনি, বেশ ক’বার রিং হবার পর আপনার বান্ধবী ফোনটা তোলেন। উনার থেকেই ঠিকানাটা পেলাম…’

-‘ওহ! ঘুমিয়ে ছিলাম আসলে। আচ্ছা, এবারে তো জানলাম, কাল আসবো বলে দিয়েন নিশাকে।’

এরপর আবার নিস্তব্ধতা। যেন দু’জন অচেনা মানুষ হেঁটে চলেছে কেবল, কারো কিছু বলবার নেই। প্রবল আশায় মনটা জেগে উঠলেও টের পাচ্ছি শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি এখনো সজাগ হয়ে ওঠেনি পুরোপুরি। আরো খানিকটা ঘুমের প্রয়োজন। নীরবতা ভাঙার দায়িত্বটা অবশেষে তাই আমি ই নিলাম-

-‘আমার ঘুম পুরো হয়নি বুঝলেন! আরেকটু বোধহয় ঘুমানো দরকার… আসছি তবে?’

হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কের মত জায়গায় এসে থেমেছি। লাল লাল ফুলে ছেয়ে যাওয়া একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের ঠিক তলাটায় দাঁড়িয়েছেন দিবস। ফ্রেমলেস চশমাটা হাতে নিয়ে অকারণেই শার্টের কোনা দিয়ে ঘষাঘষি করে ওটার ছাল-চামড়া একেবারে তুলে ফেলছেন। চিরাচরিত চশমার আবরণহীন চোখজোড়া দিয়ে সরাসরি আমার চোখ বরাবর তাকিয়ে আবৃত্তির মত সুরে প্রশ্ন করলেন-

-‘দুইটা মিনিট সময় হবে? Just two minutes?’

আমার বোধহয় ঘুমের তোড়ে মাথার ভেতর সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নেশাগ্রস্থের মত ঐ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম-

‘তোমার জন্যে অনন্তকাল সময় হবে আমার’
অ-ন-ন্তকাল… বোঝো?’

এতকাল এরকম কতশত কথা মনে মনে বলে গেছি একা একা! কোনোদিন মুখ ফুটে বলবার সাহস হয়নি। আজকে নিশ্চিত কোথাও কিছু একটা ওলট-পালট হয়ে গেছে!

দিবস সেকথা শুনতে পেলেন কী না কে জানে! একদিকে সর্বশক্তি দিয়ে মনটা জেগে থাকার তোড়জোর করছে অন্যদিকে প্রচণ্ড ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে বারবার। দুইয়ের মাঝামাঝি কিছু একটা বেছে নিতে হবে তাই ধপ করে গাছের নিচে বসে পরলাম। দিবসও উপায়ন্তর না দেখে পাশে এসে বসলেন। তারপর ধীর গলার মেঘ গমগম কণ্ঠটা ভেসে এলো কানে-

-‘না জেনে-বুঝে অযথাই আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি, রাত্রি! আপনি যেরকম ভাবছেন ব্যপারটা আসলে সেরকম না, তবুও কোনোভাবেই আপনাকে না জানিয়ে দিব্যর সাথে আপনার বিয়ের বিষয়টা নিয়ে কথা বলা আমার একদমই উচিত হয়নি। আমার নাহয় ছোট ভাই, কিন্তু আপনার কাছে তো দিব্য একেবারে অচেনা- এটা আমার বোঝা দরকার ছিলো! আমি জানিনা আমার এখন এই কথাটা বলাও উচিত হচ্ছে কি না…’

দিবস আবৃত্তির সুরে বলেই যাচ্ছিলেন। দিবসের কথার মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায় এসে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে পরি আমি। ঘন্টা পাঁচেক বাদে ঘুম ভেঙে নিশিতার ঘরে আবিষ্কার করি নিজেকে, ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এরপর অনেকবার চেষ্টা করেও মনে করতে পারিনি ঠিক কী কী বলছিলেন সেসময় দিবস। কেবল স্বপ্ন দেখার মত করে কিছু শব্দ এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভেতর, পুরো কথাটা কিছুতেই মনে করতে পারছিনা! উচিত-অনুচিত, চেনা-অচেনা, দিব্য-দিবস… ধুর ছাই! কীজানি কী বলছিলেন কে জানে! সে নাহয় নাই মনে পরলো, আমি নিজেও কীসব ছাতামাথা যেনো বলেছিলাম- সেগুলোর এক বর্ণও মনে পরছে না একদম! ঘুমের ঘোরে কী যে বলেছি, আর সেসবের কতখানিই যে দিবসের কানে গেছে খোদা জানেন! সেদিন রাতে ঘুমটা পুরোপুরি কেটে গেলে প্রায় গোটা রাতটাই মাথার ভেতর হাতড়ে হাতড়ে মরেছি, কোনোকিছুই পুরোপুরি মনে পরেনি।

আজকে দুপুরে নিশার চোখের অপারেশনটা করা হবে। সকাল থেকেই মেয়েটার পাশে বসে আছি, সে শুধু নিশা আমাকে ওর মাম্মাম ভেবে ভুল করছে বলে নয়। সত্যি বলতে এই ক’দিনে মাতৃহীন বাচ্চাটার প্রতি আমার নিজেরই কেমন একটা অদ্ভুত মায়া পরে গেছে! তাছাড়া, আর দু-একদিন বাদে তো চলেই যাবে মেয়েটা, আর হয়তো দেখা ই হবে না! পৃথিবী যতই গোল হোক, এই ছোট্ট একটা জীবনে একবার হারিয়ে ফেলা মানুষেরা আর দেখা দেয়না।

আজকেই নিশার দাদীর সাথে পরিচয় হয়েছে আমার। ভদ্রমহিলা খুবই অমায়িক এবং উনিই হচ্ছেন এই বাপ-বেটির হিজল চোখের আসল উৎস! অর্থাৎ, উনার DNA থেকে এই চোখ পেয়েছেন দিবস এবং তার থেকে পেয়েছে নিশা! কিছু কিছু মানুষ হয়না? একেবারে সরল-সোজা, একদিনের মধ্যেই যারা অন্যকে একেবারে আপন করে নেয়? উনি ঠিক ঐরকম! নিশা যখন বারবার মাম্মাম বলে ডাকছিলো আমাকে, একবার তো উনি ভুলে বলেই বসলেন- ‘তোমার সন্ধান যদি আগে পাইতাম মা, তাইলে নিশার এই ডাকটা আজকা সত্যিই হইতো!’

আমার কি তখন খানিক হৃদকম্প হয়েছিলো? মনে মনে আমি কি উত্তর করেছিলাম- ‘এখনো সময় ফুরোয়নি! এইতো সন্ধান পেলেন, এবারে সত্যি করে দিন না!’

হয়তো বলেছিলাম, নয়তো না! ইদানিং অনেক কিছু কেমন যেন ভুলে ভুলে যাই আমি। মনটা সারাদিন এত এত কিছু কল্পনা করে, এত এত কিছু ভাবে যে সত্যি মিথ্যা, বাস্তব–কল্পনা সব কেমন গুলিয়ে যায় আমার!

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই নিশার অপারেশনটা ভালয় ভালয় শেষ হয়। ঠিক তিন দিন পর, অবজারভেশন শেষে ওর চোখের ব্যান্ডেজটা খোলা হবে।

সবার কথাই তো বলছি, দিবস বাদ যাবে কেন? সেই যে সেদিন কৃষ্ণচূড়ার নিচে টুপ করে ঘুমিয়ে গেলাম, সেদিনের পরে আমি একরকম এড়িয়েই চলেছি লোকটাকে। যে সুতো ছিঁড়ে গেছে শুধু শুধু তাকে বুনে চলার তো আর মানে হয়না! নিশার অপারেশনের দিনে তো টেনশনেই সবার হ-য-ব-র-ল অবস্থা, সেদিনটা এভাবে ওভাবেই কেটে গিয়েছিলো। এরপর এই দুইদিনও একটা চাপা টেনশন কাজ করেছে সবার ভেতর, সব ঠিকঠাক থাকবে তো? ব্যান্ডেজ খোলা হলে নিশা ঠিকঠাক দেখতে পারবে তো? এর মধ্যেও যে দুই-চারবার দেখা হয়েছে দিবসের সাথে, মাথা নিচু করে ওঁকে এড়িয়ে অন্য কোথাও চলে গেছি আমি।

আজকে সকাল থেকে একটা চিন্তার পাথর চাপ দিয়ে বসে ছিলো বুকের ভেতরটায়। বিকেলে ব্যান্ডেজ খোলা হলে যখন প্রথমবারের মত স্পষ্টভাবে দুনিয়াটা দেখতে পেলো মেয়েটা, টুপ করে কোথাও হারিয়ে গেলো চিন্তাপাথরটা! কোনোদিকে না তাকিয়ে ‘মাম্মাম’ বলে সোজা আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পরলো মেয়েটা। চোখভর্তি পানি নিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম আমার কোলজুড়ে আলো করা একটা ছোট্ট মেয়ে! কী ভীষণ সুন্দর একটা অনুভূতি!

মাতৃত্বের অনুভূতি বুঝি একেই বলে?

কিন্তু তীব্র আনন্দের সাথে কি একটুখানি আফসোস আর একটুখানি অপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা মিশে নেই আমার ঐ চোখভর্তি জলে? আর তো মাত্র কয়েকটা ঘন্টা, তারপরেই নিশাকে রিলিজ দিয়ে দেবে হসপিটাল থেকে। একেবারে চিরতরে হারিয়ে যাবে এরা আমার এই ক্ষুদ্র, তুচ্ছ জীবনটা থেকে! বড় সাদাকালো এই জীবনে একমুঠো আবির ছড়িয়ে দিয়েছিলো যে মানুষগুলি, তাদের ধরে রাখবার ক্ষমতাটুকুও বুঝি বিধাতা আমায় দেন নি? হায় খোদা! কী ভীষণ নিস্তরঙ্গ, একাকী একটা জীবনগল্প লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এই দুনিয়াটার বুকে আছড়ে ফেললে তুমি আমায়! মনে মনে একশোবার অন্তরীক্ষে আবেদন করি- এ গল্পের মোড় কি ঘুরবে কোনোদিন নাকি এই প্রচণ্ড একলা জীবনটাকে বয়ে নিয়ে শেষমেশ একদিন অসীমে বিলীন হয়ে যেতে হবে আমায়- অন্তত সেটুকু তো জানিয়ে দাও! তাহলে আর মিছে আশা করে করে বারবার ঠকতে হবে না।

আমার সে আবেদনের কোনো জবাব আসে না। বুকের ভেতরে সঞ্চিত সবটুকু রঙ শুষে নিয়ে পরদিন তাই নিশা চলে যায় ওর বাপির হাত ধরে। আমার জন্যে পরে রয় হাসপাতালের রঙচটা দেয়াল, বুকভর্তি কৃষ্ণচূড়ার মত থোকা থোকা স্মৃতি আর ঘুণে খাওয়া একলা জীবন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ