#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৫৩
Writer তানিয়া শেখ
ড্যামিয়ানই প্রথমে শত্রুতার সূচনা করেছিল। ফাদার জালোনভকে ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করত। পিশাচ কমিউনিটির অনেক পিশাচকে কৌশলে শেষ করেছে৷ নোভাকে একবার বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ওকে খুব নির্যাতন করেছিল ড্যামিয়ান। নিজেকে মুক্ত করতে খুব লড়েছিল নোভা। নিকোলাসের সঙ্গী মার্গারেটাকে বধেও পরোক্ষভাবে ড্যামিয়ানের হাত ছিল। এই সত্যটা মাত্র কয়েক মাস আগে জেনেছে নিকোলাস। ইসাবেলা সেদিন ড্যামিয়ানের আসল পরিচয় প্রকাশ না করলে এই শত্রুতার মূল কারণ খুঁজে পেত না ও। বুঝত না ড্যামিয়ানের অভিসন্ধি। কমিউনিটির সকলের ধারণা নিকোলাস প্রেমে মজে সব ভুলে আছে। আগে পিছে ভাবছে না। ওকে মারা শত্রু পক্ষের জন্য তুড়ি বাজানোর মতো সহজ। ওদের ধারণা নিকোলাসকে হাসায়। প্রেমে ও ঠিকই মজেছে কিন্তু প্রেমে বোকা হয়নি, অন্ধও না। বরং প্রেম ওর অন্ধকারে আলোর স্ফূরণ।
ম্যাক্সওয়েলের বংশধরদের সাথে বহু বছরের শত্রুতা নিকোলাসের। এরা একে অপরের প্রাণ নিতে দু’বার ভাবে না। ম্যাক্সের বড়ো ছেলে ইগো নিকোলাসকে মারার পণ করেছিল। ইগোর মতে নিকোলাস ওর পিতৃহন্তারক। বেশ অবাক হয়েছিল ওর অভিযোগ শুনে নিকোলাস। ম্যাক্স মরেছে তা ও জানত না। ম্যাক্সের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ওই গুহার মধ্যে। যেদিন ম্যাক্স স্ত্রী হত্যার প্রতিশোধ নিতে ওর বুকে তলোয়ার বসিয়েছিল। এরপর তো নিকোলাসের জীবন আর জীবন থাকেনি। নরককুণ্ডে পরিণত হয়েছিল। একজন নির্দোষী নারী এবং তার অনাগত সন্তানকে হত্যা করে পাপের আগুনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়। এক পাপ ভুলতে আরো পাপ করে। শান্ত মন অশান্ত হয়। কিছুতেই আর শান্তি পায় না। মনের অশান্তিতে উন্মাদের মতো মাটিতে গড়াগড়ি করে। চোখের সামনে আলো দেখতে পায় না৷ পাপ আলো দেখায় না। রাতের ঘুম হারাম হয়, মুখে খাবার যায় না। ভদ্র ছেলেটি দুধের গ্লাস ছেড়ে মদের বোতল ধরে। কলম ছেড়ে তলোয়ার হাতে নেয়। যে হাতে কোনোদিন বাইবেল ধরেছিল, সেই হাত শত শত নিষ্পাপ প্রাণ কেড়ে নেয়৷ নিষ্পাপ, সরল হৃদয় পাপের ভারে ক্রমে ক্রমে পাথরে রূপ নিলো। সেই পাথর গলে দুচোখ ফেটে জল পড়েছিল ম্যাক্স আর নেই জেনে। কিন্তু ইগোর চোখ ওই অশ্রু দেখেনি৷ নিকোলাসকে মেরেই সে দম নেবে। আত্মরক্ষার্থে নিকোলাস ইগোকে হত্যা করে। যুদ্ধের ময়দানে আপন পর থাকে না। হয় মরো নয় মারো। সেই থেকে নিকোলাস ম্যাক্সওয়েলদের দুশমন। বংশপরম্পরায় এই শত্রুতা এখনো চলে আসছে। নিকোলাস ভেবেছিল সিস্টার ভ্যালেরিয়া হয়তো বর্তমানে সেই পরম্পরা রক্ষা করছে। ভুল ছিল ও। সিস্টার ভ্যালেরিয়া তো সামান্য একজন পেয়াদা। আসল শত্রু হলো ড্যামিয়ান। যে বড়ো কৌশলে নিকোলাসকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কী ভেবেছে ও? নিকোলাস চিনতে পারবে না ওকে? এত সহজ নিকোলাসকে হারানো? কাষ্ঠ হাসি দেখা দিলো ওর ঠোঁটে।
“ড্যামিয়ান, ড্যামিয়ান, তোর সাথে বহু হিসেব বাকি আমার। অনেক লুকাচুরি হয়েছে। এবার মুখোমুখি হওয়ার পালা। শীঘ্রই দেখা হবে আমাদের।”
মাতভেই সাদা খাতা আর পেন্সিলে আঁকিবুঁকি করছিল। আজ বাইরেটা রৌদ্রস্নাত। বরফের ওপরে মিহি মিহি রোদ চিকমিক করছে। মাতভেই তাই আঁকছিল খাতার ওপরে। এর আগে কয়েক পাতা সাদা পৃষ্ঠা ভরে তাতিয়ানার পোট্রের্ট এঁকেছে। কত ভাবে যে প্রিয়াকে ও কল্পনা করে!
“মাতভেই জানো কী হয়েছে?” ইসাবেলা দরজা খুলে খিলখিল করে হেসে ওর সামনে বসলো। হাতের সিরামিকের প্লেটে দুটো আপেল আর ছুরি।
“না বললে জানব কী করে?”
“সেটাও কথা। আচ্ছা শোনো, গতকাল ভিক্টোরিজাকে তার কোনো এক প্রাক্তন একটা বিড়াল আর কিছু লাল গোলাপ পাঠিয়েছিল। বিড়ালটা ভীষণ কিউট বুঝলে? ভিক্টোরিজার বেজায় পছন্দ হয়ে গেল। জুজানির ওপর ভার পড়ল সারাদিন বিড়ালটাকে কোলে করে রাখার। খুব সমাদর চললো বিড়ালের। রাতে ভিক্টোরিজার ঘরের এককোনে তার ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হলো। তুমি তো জানোই জুজানি ভিক্টোরিজার ঘরের মেঝেতে বিছানা করে শোয়। ভোরের দিকে হঠাৎ চোখে মুখে পানির ছিটা টের পেতে ঘুম ভেঙে গেল জুজানির। চোখ মেলতেই দেখল পানির ছিটা না বিড়ালটা ওর মুখে হিসু করে দিয়েছে।”
ইসাবেলা হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরে। গল্প শুনে নয় ওর হাসি দেখে মাতভেই মুচকি হাসল। ওকে দেখতে দেখতে কী ভেবে পেন্সিলটা হাতে তুলে নেয়। এই প্রাণ খুলে হাসি মুখটা ও ধরে রাখতে চায়। হাসি সামলাতে বেগ পেতে হয় ইসাবেলাকে। তবুও নিজেকে কিছুটা সামলে নিলো। হাসি কিন্তু তখনও ঠোঁটে লেগে আছে। জুজানির চুমসে যাওয়া মুখটা যতবার ভাবছে না হেসে পারছেই না। ভিক্টোরিজার আদেশে এখনো গাল ফুলিয়ে বিড়ালটা কোলে করে ঘুরছে ও। ইসাবেলা নিশ্চিত জানে, বিড়ালটাকে ও পৃথিবীর বিশ্রী, উদ্ভট সব শব্দে বকছে। আর ম্যাঁও ম্যাঁও করে প্রতিবাদ করছে বিড়ালটা। প্রাণীরা মানুষের মুখ দেখলে অনেক কিছু বুঝতে পারে।
মাতভেই দিকে তাকাতেই ভুরু কুঁচকে গেল। হাসতে হাসতে ওর পেট ব্যথা হওয়ার উপক্রম আর মাতভেই হাসলোই না। গল্পটা কি হাসির ছিল না? তাহলে ওর এত হাসি পেল কেন?
“তুই বেকুব বলে।” ভেতরের জন বলে উঠতে ইসাবেলা ধমক দিলো,
“হুশ! মোটেও না। হয়তো আমার বলাটা হাস্যকর ছিল না।”
আপেল কেটে দু টুকরো মুখে পুড়ে মাতভেইকে বলল,
“কী আঁকছ?” মুখ এগিয়ে নিতে খাতাটা সরিয়ে নিলো মাতভেই। বলল,
“এখন না। চুপ করে বসো তো।”
“এ মা! তুমি আমার আপেল খাওয়ার ছবি আঁকছ?” নাক কুঁচকে বলল ইসাবেলা। মাতভেই বলল,
“না।”
“তবে দেখাও।”
“বলেছি তো এখন না।”
“কখন?”
“শেষ হোক তারপরে।”
“কিন্তু আমার এখনই যে দেখা লাগবে।”
“উফ! ইসাবেল, তুমি এমন কেন?”
“কেমন?”
“জেদি, অবাধ্য।”
“নিকোলাসও তাই বলে।”
ইসাবেলা লাজুক মুখে হাসল আনত মুখে। ওর ফর্সা গাল দুটো ক্রমশ লাল হয়ে ওঠে। মাতভেই মুচকি হেসে বলে,
“আহ! নিকোলাস। এই এক নাম বেলকে লজ্জায় লাল করে দিলো দেখছি। মানুষটাকে দেখার খুব ইচ্ছে আমার। কবে দেখাবে বলো তো।”
ইসাবেলা দুদিকে মাথা নাড়ায়। মাতভেই বলল,
“দেখাবে না? কেন?”
“এমনি।”
“বেল?”
“না, না।”
মাতভেই নাখোশ হতে ইসাবেলা উঠে দাঁড়ায়। লজ্জা লজ্জা মুখে বলে,
“শীঘ্রই দেখা করাবো। এবার খুশি তো?”
মাতভেই মৃদু হাসল। তারপর স্কেচ তুলে দেয় ইসাবেলার হাতে।
“ওয়াও! হাসলে আমায় এত সুন্দর লাগে মাতভেই?”
“তুমি সবসময়ই সুন্দর, আমার খরগোশ।” ইসাবেলার এক গাল টেনে হেসে বলল মাতভেই। গাল টানলে ভীষণ রাগ হয় ইসাবেলার। খরগোশ বলাতে আরো ক্ষেপে গেল।
“মাতভেই!”
প্রতিদিনের মতো আজ রাতেও সবাই ঘুমিয়ে পড়তে ইসাবেলা বেরিয়ে এলো। মাতভেই আজ ঘুমায়নি। চোখ বন্ধ করে ছিল। ইসাবেলা বেরোতেই চোখ খুললো ও। একটু পরে জানালার বাইরে পায়ের শব্দ শুনতে পায়। ক্রাচটা পাশেই ছিল। ওটাতে ভর করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালার বাইরের কাঁচে বরফ জমে আছে। বাইরেটা দেখা যাচ্ছে না। কৌতূহল দমাতে জানালাটা সামান্য খুললো। এদিক ওদিক দেখার চেষ্টা করে। ক্ষীণ চাঁদের আলোতে অদূরে ইসাবেলার ছায়া দেখতে পায়। এই ঠাণ্ডার মাঝে এত রাতে মেয়েটা বাইরে কী করছে? তখনই ইসাবেলার গলা শুনতে পেল।
“নিকোলাস!”
“বেলা, আমার বেলা।”
ভরাট পুরুষালি গলার স্বর শুনে কিছুটা বিস্মিত হলো মাতভেই। সরে এলো জানালা থেকে। ইসাবেলা এত রাতে নিকোলাসের সাথে দেখা করতে গিয়েছে? কে এই নিকোলাস? কীভাবে পরিচয় ওর সাথে ইসাবেলার? ছেলেটা কী ভালো? ক্ষতি করবে না তো ইসাবেলার সরলতার সুযোগ নিয়ে! ইসাবেলার মুখ থেকে নিকোলাস সম্পর্কে ওই কথাগুলো শোনার পর থেকে নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সামনা-সামনি একবার ছেলেটাকে না দেখে মনে শান্তি পাচ্ছে না মাতভেই। আগের মতো বিছানায় শুয়ে পড়ল। এক মাথা চিন্তা নিয়ে ইসাবেলার ফেরার অপেক্ষা করে।
পাহাড়ি সেই বাড়ির ভেতরে একই কম্বল গায়ে জড়িয়ে নিকোলাসের কোলে ওপর বসে আছে ইসাবেলা। মাথাটা নিকোলাসের কাঁধে। এক হাত নিকোলাসের বুক ছেড়ে বিরতি নিয়ে ওঠা নামা করা গলার অ্যাডাম’স আপেলটা স্পর্শ করে। আঙুল দিয়ে ওটার চারপাশে ঘুরাতে লাগল৷ নিকোলাস খপ হাতটা ধরে বলে,
“কী করছ?”
“আদর করছি।”
“হঠাৎ এটার ওপর আদর করতে ইচ্ছে হলো যে?”
“আমার ভালো লাগল তাই।”
মুখ তুলে নিকোলাসের গলা জড়িয়ে রইল। ইসাবেলার কপালে উড়ে আসা চুলটাকে কানে গুঁজে দিলো। ওর চোখে চেয়ে নিকোলাস বলল,
“আমার আর কিছু ভালো লাগে না?”
“লাগে।” চোখ নামি নিলো ইসাবেলা। নিকোলাস মুচকি হাসল। বলল,
“চলো আজ একটা খেলা খেলি। তুমি বলবে আমার কী কী ভালো লাগে তোমার, আর আমি বলব তোমার কী কী ভালো লাগে আমার। দেখব কার ভালোলাগা বেশি।”
“আমি জিতব।” বিড়বিড় করে বললেও নিকোলাস শুনতে পেল। ভুরু তুলে বলল,
“এত কনফিডেন্স?”
“হুঁ।”
“দেখা যাবে। ওহ! গেমের মূল নিয়মই তো বলতে ভুলে গেছি।”
ইসাবেলার প্রশ্নাতুর দৃষ্টি চেয়ে মুখটা কানের কাছে এনে বলল,
“যার যেটা ভালো লাগবে সেটাকে আদর করে চুমো খেতে হবে।”
“জি, না।” কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে বসে ইসাবেলা। নিকোলাস জোর করে পুনরায় কোলে বসিয়ে বলে,
“জি, হ্যাঁ।”
“এই পঁচা গেম আমি খেলব না। একদম না।”
“তুমি না খেললে নাই। আমি খেলব। অবশ্যই খেলব। ওকে রেডি, ওয়ান, টু__”
ইসাবেলা নিকোলাসের ঠোঁটে হাত চেপে ধরে রুষ্ট মুখে বলে,
“নিকোলাস ভালো হবে না কিন্তু।”
নিকোলাসের দৃষ্টির মাদকতায় ফের চোখ নামিয়ে নেয় ইসাবেলা। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল। নিকোলাস ঠোঁটের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে ওর থুতনি তুলে বলল,
“তোমার ঠোঁট আমার ভীষণ পছন্দ, বেলা। উঁহু শুধু পছন্দ নয়, আই লাভ দেম। তোমার দু’জোড়া ঠোঁট যেন শরতের আকাশে গোধূলির লালিমা, তুষারে জড়ানো রক্তিমা বেরি। আমি আপন ঠোঁটে সেই রঙ ধারণ করতে চাই, আস্বাদন করতে চাই অমৃতের মতো।”
ইসাবেলার বিমোহিত স্থির চোখে চেয়ে দুগালে হাত রেখে ঠোঁটে গভীর চুম্বন দিলো নিকোলাস।
চলবে,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৫৪
Writer তানিয়া শেখ
হাই তুলে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল পল। পেছন ফিরে পাশে শায়িত মেয়েটাকে দেখল। মেয়েটির সোনালি চুল বালিশে ছড়িয়ে আছে। ঘুমন্ত মুখটি গুঁজে রয়েছে বালিশে। কম্বলটা সরে পিঠের খানিক নিচে নেমে গেছে। ফর্সা দেহের লাল ছোপ ছোপ দাগগুলো দেখে মুচকি হাসল পল। এই দাগ ওই দিয়েছে, আদর করে। আজ ভোরে বারে গিয়েছিল। মেয়েটি নাচছিল ওই বারে। বারের এককোণে বসে গলায় মদ ঢালতে ঢালতে নৃত্য উপভোগ করছিল পল। মেয়েটির সাথে চোখাচোখি হতে মুচকি হাসে। নাচ শেষে মেয়েটিই এগিয়ে এলো। ড্রিংক কিনে দেওয়ার অফার করে। এমন অফার মানা করে না পল। দুজনের নেশা একটু গাঢ় হতে চলে এলো পলের পুরোনো এই বাড়িটিতে। আদিম উন্মত্ততায় কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায় টেরই পায়নি ওরা। ক্লান্ত হয়ে দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছিল একসময়।
নগ্ন দেহে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ালো পল। গা টা কেমন চিটচিট করছে। গোসল না করলেই না। তার আগে মেয়েটাকে বিদায় করতে হবে।
“অ্যাই ছেমরি, অ্যাই, ওঠ।” নিরস গলায় ডাকল মেয়েটাকে পল। মেয়েটা ঘুম ঘুম চোখে আড়মোড়া তুলে সোজা হতে ওর নগ্ন বুকে দৃষ্টি স্থির হয় পলের। মেয়েটা কোনোরকম ঢাকার চেষ্টা না করে বিগলিত গলায় বলে,
“আরেকটু ঘুমাতে দাও না গো।”
“না, এখনই যা।”
মেঝেতে পড়ে থাকা মেয়েটির গতরাতের পোশাক তুলে ছুঁড়ে দিলো ওর মুখের ওপর। তারপর টাউজার পরে কিচেনে ঢুকলো পানি গরম করতে। স্টোভে পানি বসিয়ে রুমে ফিরে এসে দেখল মেয়েটি উঠে বসে আছে খাটের ওপর। চাদরটা বুকে জড়ানো। পলকে রুমে ঢুকতে দেখে হাসল। পলের বিরক্তিভরা মুখ সে হাসি ম্লান করে দেয়। গত রাতের কথা ভাবে মেয়েটি। কত ভালোবাসা দেখিয়েছিল এই লোক আর আজ! পুরুষ জাতটাই এমন। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে বিরক্তি দেখায়। মেয়েটার কাছে এসব আর নতুন না। অভ্যাস হয়ে গেছে পুরুষদের এমন আচরণে। চাদর সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নগ্ন দেহে এগিয়ে আসে পলের সামনে। আড়চোখে মেয়েটাকে দেখছিল পল। মেয়েটা মুখোমুখি এসে গলা জড়িয়ে মিশে দাঁড়িয়ে বলল,
“সত্যি কি চলে যাব?”
পলের এক হাত মেয়েটার কোমর ছাড়িয়ে নিচে নামে। অন্য হাতে গলা ধরলো, খুব জোরে নয়। তারপর বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বলে,
“এখনই না।”
মেয়েটার ঠোঁটে বিজয়িনী হাসি। পল পরনের টাউজারটা খুলবে সেই মুহূর্তে বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনে থমকে যায়। দ্রুত পায়ে জানালার কাছে এলো। এই বাড়ির সামনের সরু পাকা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে কালো ফিটন। একটু পরে সেখান থেকে নামল নোভালি। পলের গলা শুকিয়ে চৈত্রের খরা নামে৷ আতঙ্কিত মুখে ফিরে এলো ঘরের ভেতর। বিছানায় আয়েশে শুয়ে থাকা মেয়েটার বাহু টেনে ধরে বলে,
“দ্রুত কেটে পড়।” মেয়েটা নড়ে না। ভুরু কুঁচকে ওর ভীত মুখে চেয়ে রইল। নোভার পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে নিকটে আসছে। মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে ধমকে উঠল পল,
“যেতে বলেছি না? যা!”
মেয়েটি কপট রাগে গজগজ করতে করতে কাপড় পড়ছে৷ ওর ঢিলেমি পলকে রাগিয়ে দেয়। তাড়া দেয় তাড়াতাড়ি কাপড় পড়তে। মেয়েটি এবার ঝাঁজ গলায় বলে,
“বউকে যখন এত ভয় তবে আমাকে আনলি কেন? রাতে বিছানায় আনার সময় বউয়ের কথা মনে ছিল না?”
পল রেগে তাকাতে হঠাৎ পেছন থেকে শোনে,
“বউ?”
পলের সর্ব শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সাহস হয় না নোভালির দিকে ফিরে তাকানোর। নোভালি এগিয়ে এলো মেয়েটি সামনে।
“কার বউ?”
“এই মরদের।”
পলের ফ্যাকাশে মুখে চেয়ে চোয়াল শক্ত করল নোভালি। তারপর হেসে বলল,
“ভুল বললে৷ ওর মতো পতিতা পুরুষের যোগ্যতা কী আমার স্বামী হবে?”
পলের খারাপ লাগলেও নীরবেই রইল। মেয়েটা নোভালির কথা বিশ্বাস করল না। বলল,
“বউ নও তবে নিশ্চয়ই প্রেমিকা হবে। এই মরদের মুখ দেখেই বোঝা যায় এমনই কিছু তুমি। দেখো কেমন ভয়ে মুখ একটুখানি হয়ে আছে। কিছুই যদি না হও তবে ভয় পাবে কেন?”
“কিছুই হই না আমি ওর। ও আমার ভাইয়ের চাকরমাত্র।”
“আর যা তা বুঝাতে এসো না তো। আমি কচি খুকি নই। লজ্জা হওয়া উচিত তোমার। নিজের পুরুষকে যখন তৃপ্ত করতে না পারো ছেড়ে দিলেই হয়। কাল রাতে বিছানায় আমাকে যেভাবে ধরল তাতে বুঝায় যায় তোমার সাথে ও সুখী না। সুখী হলে কি আর আমাকে নিয়ে আসত ঘরে? আমি বাপু তোমাদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করতে চাই না। কিন্তু যা সত্যি তা বলতে বাধে না আমার। তুমি ওকে ভয় দেখি কাছে রেখে নির্যাতন করছ। এ ঠিক নয়। দেখো কেমন চুপসে আছে তোমার ভয়ে। দেখতে শুনতে তো তুমি মন্দ নও, দুর্বলতা কীসের গো তোমার? একটা পুরুষ তৃপ্ত করতে পারো না কেমন তরো মেয়েলোক তুমি?”
“থাম বলছি।”
ধমক দিলো পল। ওর অগ্নিদৃষ্টি দেখে মেয়েটা ভড়কে যায়। মেয়েটার হাত সজোরে টেনে ধরে সদর দরজার বাইরে বের করে দিতে উদ্যোত হয়। বাধা দেয় নোভালি।
“হাত ছাড়ো ওর।” শীতল কণ্ঠে বলল নোভালি। পল হাত ছাড়ে না।
“পল!”
মেয়েটার হাত ছেড়ে দেয় পল। ওর বুক কাঁপছে। কর্ণকুহরে বিকট শব্দ হয়ে এসে বাজছে হৃৎস্পন্দন। এই কনকনে ঠাণ্ডাতে ঘামছে ও।
নোভালি মেয়েটির বিদ্রুপাত্মক হাসির দিকে শান্ত চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মৃদু হেসে বলল,
“দুর্বলতা? আমার?” ঘুরে তাকায় পলের নত মুখের দিকে। তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
“আমি কি দুর্বল পল?”
“ও আপনার সম্পর্কে না জেনে কথাগুলো বলেছে। আমি ক্ষমা চাচ্ছি, রাজকুমারী।”
মুহূর্তে হিংস্র হয়ে ওঠে নোভালির দৃষ্টি। পলের গলা চেপে ধরে বলে,
“কতবার বলেছি আমাকে রাজকুমারী বলবি না? কতবার?”
পলের দমবন্ধ হয়ে আসে, কিন্তু টু শব্দটি করে না। মেয়েটি নোভালির এই রূপ দেখে ভয় পেয়ে যায়। এখন এখানে থাকা সুবিধাজনক নয়। দরজার দিকে পা বাড়ায় ও। বেশিদূর যেতে পারে না। পলকে সামনের দেওয়ালের ঠেলে মেয়েটির চুলের মুঠি চেপে ধরে।
“আমি যে কতটা সবল আজ তোকে হাড়ে হাড়ে বুঝাব।”
নেহাৎ মানুষের রক্ত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে বলে মেয়েটিকে ও সঙ্গে সঙ্গে মারল না। এত তাড়াতাড়ি মারলে শান্তিও যে পাবে না। দেওয়ালে বার কয়েক বাবারের বলে মতো ছুঁড়ে রক্তাক্ত করল মেয়েটাকে। পল চুপচাপ বসে বসে দেখল। মেয়েটা সাহায্যের জন্য ডাকলেও সাড়া দেয় না। সেই সাহস নেই ওর। নোভালির রাগকে ও ভয় পায়। মেয়েটা ওসব বলে মৃত্যু ডেকে এনেছে। খামোখা বাজে কথা কেন বলল? চাকরকে জড়িয়ে ওমন কথা কোন মনিবই সহ্য করবে? তা ছাড়া নোভালি ওকে ঘৃণা করে। আর বোকা মেয়ে কি না ওকে বউ বানিয়ে দিয়েছে। নোভালি আর বউ। পল প্রহসন মনে করে হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না। আড়চোখে নোভালির কুপিত মুখে তাকাল৷ এই মেয়ে ওকে পতিতা পুরুষ বলেছে। তেমনই তো সে। তবে নোভালির মুখ থেকে শুনে এত খারাপ কেন লাগল? মেয়েটার আর্তনাদে সামনে তাকাল। আহত মেয়েটির দিকে আঙুল তুলে নোভালি পলকে বলল,
“তোমার প্রেমিকাকে এক্ষুনি প্রাসাদে নিয়ে চলো, পল। বেশ সমাদরের সাথে ওর আতিথেয়তা করব আজ আমি।”
“ও আমার প্রেমিকা_” পলকে কথা শেষ করতে দেয় না নোভালি। এক হাতে ওর মাথার পেছনের চুল টেনে ধরে অন্য হাতে চোয়াল সজোরে চেপে ধরলো। ব্যথা গিললো দাঁতে দাঁত কামড়ে। চোখে চোখ রাখতে বাধ্য করে নোভালি। পলের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ নোভালির চোখে রাখা। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। নোভালি মুখটা খুব কাছে এনে পৈশাচিক হাসি হেসে বলে,
“কথা দিচ্ছি, তোমার প্রেমিকার আতিথেয়তা খুব উপভোগ্য করে তুলব তোমার সামনে। এতটা যে যতবার প্রেমিকাকে স্মরণ করবে শিওরে উঠবে তুমি, পল। শিওরে উঠবে।”
গোপন খবর মোতাবেক ড্যামিয়ানের আসার কথা ছিল আজ। নিকোলাস ওকে বন্দি করার সকল প্রস্তুতি শেষ করেছে। ওঁৎ পেতে ছিল ওকে সুযোগমতো আক্রমণ করার। কিন্তু আসেনি ড্যামিয়ান। বোধহয় বিপদ টের পেয়ে গেছে। নিকোলাস খবর পেয়েছে সে আবার ফিরে গেছে সুইডেন। প্লান ভেস্তে যাওয়ায় মেজাজ চড়ে গেল নিকোলাসের। এত নিখুঁত প্লান ভেস্তে যাওয়ার কথা তো নয়! আন্দ্রেই, পল আর নোভা ছাড়া এই প্লান সম্পর্কে কেউ জানে না৷ আন্দ্রেই আর নোভা ওকে ধোঁকা দেবে না৷ বাকি থাকল পল। পলকে সন্দেহ করার মতো কিছু খুঁজে পেল না। সে মনিবের বিশ্বস্ত। নিকোলাসের এক কথায় প্রাণটা দিতেও কুণ্ঠা করবে না। ড্যামিয়ান কারণ ছাড়া ভিক্টোরিজার সাথে দেখা না করে সুইডেন ফিরে গেছে এটা মানতে পারছে না নিকোলাস। নিশ্চয়ই ও কিছু টের পেয়েছে। আর যদি নিকোলাসের সন্দেহ সঠিক হয় তবে চিন্তার বিষয় ওর জন্য। বিপদ আশেপাশে ঘাপটি মেরে আছে। সুযোগ খুঁজছে ওকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার। ড্যামিয়ানকে সিরিয়াসভাবে না নেওয়ার উপযুক্ত শিক্ষা নিকোলাস পাচ্ছে এখন। শত্রুকে কখনো ছোটো করে দেখতে নেই। বিপদ উপেক্ষা করলে আরো বাড়ে। বাড়তে বাড়তে একসময় এতটা প্রভাবশালী হয় যে দমানো অসাধ্য হয়ে যায়। বিপদ বাড়তে দেবে না নিকোলাস। প্রথমে খুঁজে বের করবে ঘরের শত্রু বিভীষণকে। ধোঁকাবাজ, বিশ্বাসঘাতকদের ঘৃণা করে ও। কার এত সাহস ওকে ধোঁকা দেয়? কে সে? মগজ টগবগ করে ফুটছে এই মুহূর্তে। নীল চোখজোড়া লাল বর্ণ ধারণ করেছে৷ হিংস্র হয়ে উঠেছে মুখ।
“আন্দ্রেই, আন্দ্রেই।”
গর্জন করে ওঠে নিকোলাস। নিমেষে নিকোলাসের সামনে এসে হাজির হয় আন্দ্রেই।
“ভাই?”
“বেনাসের বাড়ির সবকটাকে আজ শেষ করব। কমিউনিটির সকলকে জানিয়ে দে কথাটা।”
আন্দ্রেই মাথা নাড়িয়ে বলে,
“ঠিক আছে।”
হঠাৎ কী ভেবে আবার বলল,
“ইসাবেলাকে কি করবে?”
নিকোলাসের রাগ এই এক নাম শুনতে পড়ে যায়। রাগের মাথায় ভুলেই বসেছিল ও বাড়িতে ইসাবেলাও আছে। ওর প্রিয়তমা। রক্তিম চোখজোড়া শান্ত নীল সমুদ্রে পরিবর্তন হয়। গলা ঝেড়ে বলে,
“আজ তবে থাক। আমি পরে তোকে জানাচ্ছি।”
ইসাবেলার নাম শুনে নিকোলাস এতবড়ো সিদ্ধান্ত এক মুহূর্তে বদলে ফেললো! এই মেয়ের কারণে পরে কত কী না বদলাবে। এত গুরুত্বপূর্ণ কেন হয়ে উঠল এই মানবী ওর ভাইয়ের কাছে? আন্দ্রেইর মোটেও ভালো লাগল না। সে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল,
“ইসাবেলা তোমাকে বদলে দিচ্ছে। নরম হচ্ছো তুমি। পিশাচদের নরম হতে নেই ভাই।”
“আমি নরম হইনি আন্দ্রেই। না আমি বদলেছি।”
“ভুল। ওই তুচ্ছ মানবী তোমাকে বদলে দিচ্ছে। যে তুমি কোনোদিন কারো পরোয়া করোনি, আজ সেই তুমি ওই তুচ্ছ মানবীর কথা ভেবে এতবড়ো সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছ। ওই মেয়ে তোমার জন্য ভালো নয় ভাই। বিপদে পড়বে ওর কারণে তুমি। ও এক মোহমায়া, ফাঁদ। ভুলে যেয়ো না ওর দেহে কার রক্ত বইছে। শত্রুর বংশধরকে ভালোবেসে মহা ভুল করছো তুমি। নিজের ধ্বংস নিজে ডেকে আনছো। দুর্বলতায় আমাদের ধ্বংসের কারণ। ওই মেয়ে তোমার দুর্বলতা হয়ে উঠছে। একদিন তোমার ধ্বংসের কারণ হবে ও।”
নিকোলাসের সহ্যাতীত হয়ে যায় কথাগুলো। আন্দ্রেইর গলা চেপে ধরে। তারপর ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে। চোখের পলকে ওর কাছে গিয়ে মাথাটা মেঝেতে ঠেসে ধরে। মেঝেতে ফাটল দেখা দেয়। আন্দ্রেইর মনে হয় মাথাটা বুঝি ধড় থেকে আলাদা হওয়ার পথে। একটা সামান্য মানবীর জন্য ভাইয়ের এই আচরণে ভীষণ কষ্ট পায় সে। মানুষ হলে হয়তো ওর চোখে জলের ফোঁটা পড়ত।
“তুই যাকে তুচ্ছ মানবী বলে অপমান করছিস তাকে আমি ভালোবাসি আন্দ্রেই। ওর সম্পর্কে কোনো বাজে কথা আমি সহ্য করব না। শেষবার সতর্ক করছি তোকে। এরপর ওকে নিয়ে অসম্মানজনক কথা বললে আমি ভুলে যাব আমাদের সম্পর্ক। কথাটা মনে রাখিস।”
আন্দ্রেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
“আমাদের সম্পর্ক! হাসালে তুমি। ইসাবেলা ছাড়া আর কেউ তো কিছু হয় না তোমার। যদি হতো তবে তাদের আঘাত দিতে দু’বার ভাবতে।” গলা থেকে জোর করে নিকোলাসের হাত ছাড়িয়ে মেঝের গর্ত থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“আমার মা ঠিকই বলেছিল, তুমি আমাদের কোনোদিন আপন ছিলে না, হবে না। তোমার কাছে আমি কিছু না। বার বার নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি মায়ের কথা ভুল। আজ আর প্রবোধ দিতে পারছি না। দুদিনের চেনা এক মানবীর সম্মানের জন্য তুমি আমাকেই অপমান করলে আজ। বুঝিয়ে দিলে আমার মায়ের কথা ঠিক। আমি তোমার কাছে কমিউনিটির আর পাঁচ জনের মতো ছাড়া কিছু না। পস্তাছছি আজ আমি। পস্তাছছি তোমার জন্য এই অভিশপ্ত জীবন বেছে নিয়েছি বলে।”
“আন্দ্রেই!” বিস্ময়াহত হয়ে চেয়ে আছে নিকোলাস। আন্দ্রেই ঘুরে দাঁড়ায়।
“তুমি আমায় যা শাস্তি চাও দাও। কিন্তু সত্যি আমি বলবোই। ওই মেয়ের মায়াজালে তুমি ভুল করছো। ভুলে যাচ্ছো পিশাচ আর মানুষে কেবল শত্রুতা হয়, প্রেম না। সময় থাকতে সজাগ হও ভাই। নয়তো চরম মাশুল গুনতে হবে একদিন তোমাকে, সাথে আমাদেরও। মনে রেখো কথাগুলো। চলি।”
নিকোলাস বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। আন্দ্রেই ওর কাছে আর সবার মতো নয়। বড়ো আপন ও। মুখ ফুটে হয়তো কোনোদিন আন্দ্রেইকে বলা হয়নি,”তুই আমার বড়ো আপন রে আন্দ্রেই, বড়ো কাছের।” মুখ ফুটে বলেনি বলে কী আজ আন্দ্রেই এত সহজে পর বলতে পারল? রাগের বশে আগেও তো কত কী বলেছে। কই তখন তো এমন কঠিন কথা শুনিয়ে যায়নি। আন্দ্রেই কেন বোঝে না নিকোলাসের ভালোবাসা! কেন আস্থা নেই ওর ওপর? কেন সবাই বিপক্ষে যাচ্ছে ওদের? ইসাবেলা মানুষ বলে? ওরা বলে, পিশাচ ভালোবাসতে পারে না, মানুষের সাথে পিশাচের প্রেম হয় না। তবে নিকোলাসের কেন হলো? আন্দ্রেই জানে না, কতশতবার ইসাবেলাকে, ওর প্রতি ভালোবাসাকে নিকোলাস অস্বীকার করেছে। আঘাতের পর আঘাত করেছে মেয়েটার মনটাকে। দূরে ঠেলে দিয়েছিল। এত কিছু করেও প্রেমটা ওর হয়েই গেল। ইসাবেলাকে কাছে টানতেই হলো। স্বীকার করতে হয়, সে ভালোবাসে। আন্দ্রেই জানে না, ভালোবাসা দুর্বলতা নয় দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী। দুর্দমনীয় এক অনুভূতি। নিকোলাস আজ চাইছে, আন্দ্রেই প্রেমে পড়ুক, কোনো এক মানবীর প্রেমে পড়ুক। প্রমাণিত হোক আরেকবার, প্রেম সবার হয়, পিশাচেরও।
সেদিন ও উপলব্ধি করবে ইসাবেলা মায়াজাল না। প্রেম মায়াজাল না। প্রেম শত্রু মিত্র দেখে না। ইসাবেলাকে নিকোলাস বিশ্বাস করে। সমস্ত পৃথিবী ওর বিপক্ষে গেলেও ইসাবেলা যাবে না।
“আর যদি যায়?” পিশাচ সত্ত্বা প্রশ্ন তোলে। নিকোলাস মাথা নাড়ায়। পিশাচ সত্ত্বা তবুও একই কথা বলে,
“আর যদি যায়?”
“যাবে না।”
“যদি যায়?”
“কোনোদিন না।”
“যদি যায়?”
পিশাচসত্ত্বার একই প্রশ্নে তিক্ত হয়ে ওঠে নিকোলাস। চোখ বন্ধ করে। কপালে দপদপ করে ফুলে উঠেছে রগ। অস্ফুটে বলে,
“পুরো পৃথিবী বিনাশ করে ফেলব আমি, ইসাবেলাকেও, প্রেমকেও।”
চলবে,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৫৫
Writer তানিয়া শেখ
দাঁতে দাঁত কামড়ে বিছানার কোণায় বসে আছে ভিক্টোরিজা। ড্যামিয়ান এবারো কথা দিয়ে কথা রাখেনি। ওর পাঠানো ফুল ফলদানিতে সাজানো ছিল। রাগ করে সেগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছে ভিক্টোরিজা। বিড়ালটাকে দু-চোখ সহ্য হচ্ছে না এখন আর। জুজানিকে আদেশ করেছে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলতে। শুধু ড্যামিয়ান নয়, ভিক্টোরিজার বর্তমান ক্ষোভের কারণ কিছুটা নিকোলাসও। এই পুরুষ ওকে আরো বেশি ক্ষিপ্ত করছে। নিকোলাসকে যত পেতে চায়, ও যেন ততই দূরে চলে যায়। নিজের সুডৌল দেহ নিয়ে গর্ব করে ভিক্টোরিজা। যে কোনো পুরুষই আকৃষ্ট হবে। চাতক হয়ে থাকবে একটুখানি ইশারার। অথচ, নিকোলাসের সামনে নিজেকে মেলে ধরলেও আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছে না। অজুহাত দেখিয়ে বার বার প্রত্যাখ্যান করছে ওকে এবং ওর চাহিদাকে। প্রত্যাখ্যানে অভ্যস্ত নয় ভিক্টোরিজা। নিকোলাসকে এখন ওর যে কোনোভাবেই হোক চায়। নিজের ইগোকে কিছুতেই ছোটো হতে দেবে না। জেদ চেপে বসল। আসুক এবার নিকোলাস।
দৈহিক সম্পর্ক করা ভিক্টোরিজার প্রাত্যহিক রুটিন। ও জানে আর সবার মতো স্বাভাবিক নয় ওর দৈহিক চাহিদা। এ নিয়ে একসময় খারাপ লাগত। নিজেকে পতিতার সাথে তুলনা করে কত কেঁদেছে। সময়ের সাথে এখন সবটা মানিয়ে নিয়েছে। খুব বেশি মাথা ঘামায় না এ নিয়ে আর। নিত্য নতুন পুরুষের সাথে কাটানো সময় উপভোগ করে৷ দেহ আর মন ভিন্ন জিনিস ওর কাছে। দেহ যাকে তাকে দেওয়া যায়, কিন্তু মন হয় বিশেষ একজনের। ভিক্টোরিজার চাহিদা নিকোলাস হতে পারে, কিন্তু ওর চাওয়া ড্যামিয়ান। ড্যামিয়ানকে ও ভালোবাসে। এই একটা পুরুষের বিরহ ওকে রাতের পর রাত কাঁদায়। সিগারেট, মদের নেশায় ভুলতে চায় সেই বিরহ ব্যথা৷ তবুও যে ভুলতে পারে না। হয়ে ওঠে লাগামহীন ব্যভিচারিনী।
পরনের নাইটির রোবটা খুলে ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে ভিক্টোরিজা। জানুয়ারি মাসের ২৯ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ঠাণ্ডা এই ঘরে এসে মিইয়ে গেছে ফায়ারপ্লেসের আগুনের তাপে। দেহের তাপটাও ক্ষোভ আর ব্যর্থতায় তিরতির করে বেড়ে যাচ্ছে। টেবিলের ওপর থেকে ভদকার বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে গলায় ঢাললো। অর্ধেকটা সাবার করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“মিথ্যুক, মিথ্যুক।”
এই তিরস্কারের তির বর্ষিত হয় ড্যামিয়ানের নামে। তারপর ধীরে ধীরে নিকোলাস হয়ে সমস্ত পুরুষজাতির দিকে ধেয়ে যায়। মনের বিরহে ক্রমশ যেন দুর্বল হয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে। চাদরে মুখ গুঁজে খুব কাঁদে। এই কান্নার কারণ ড্যামিয়ান, ওর দুর্দমনীয় কামুক স্বভাব আর নিকোলাসের প্রত্যাখ্যান। কিছুক্ষণ কেঁদে থম মেরে যায়। বহুক্ষণ একনাগাড়ে বৃষ্টি শেষে প্রকৃতি যেমন হয় তেমনই। তারপর উঠে বসে জানালার বাইরে তাকায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। যুদ্ধের এই সময়ে আশেপাশের কোনো বার কি খোলা আছে? বাইরেটা এখন অনিরাপদ। কিন্তু আর যে থাকতে পারছে না ভিক্টোরিজা। আজ রাতে একটা সঙ্গী ওর ভীষণ প্রয়োজন, নিজের দেহটাকে শান্ত করতে, মনের ব্যথা ভুলতে । সিল্কের অফ সোল্ডার লাল ফ্রক পরে নিলো। ফ্রকটা হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে আছে। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, কানে একজোড়া সাদা দামি পাথরের দুল, গলায় চিকন সাদা মতির মালা। সুগন্ধির মাখল অঙ্গে। চুলটা খোলা ছেড়ে দেয় পিঠের ওপর। আয়নায় শেষবার নিজের যৌবনের জৌলুশ দেখে নিলো।পশমি সোয়েটার ফ্রকের ওপর জড়িয়ে বুট জুতো পরে বেরিয়ে এলো রুমের বাইরে। নিচতলায় নামতে মায়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। মেয়ের আপাদমস্তক দেখে জাস্টিনা বেনাস নীলসন বললেন,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“হুম।”
পঞ্চাশবর্ষীয়া জাস্টিনা লক্ষ্য করলেন ভিক্টোরিজা ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। মায়ের প্রশ্ন ও বুঝতে পারেনি কিংবা মনোযোগ দেয়নি। মেয়েকে আরো কিছু বলবেন তার পূর্বে সে সদর দরজার কাছে চলে গেল। দেশের পরিস্থিতি সুবিধার নয়। বাইরে যখন তখন বেরোতে নিষেধ করেছেন বেনাস। জাস্টিনা মেয়েকে সেকথা স্মরণ করানোর আগেই ভিক্টোরিজা বাড়ির বাইরে চলে গেল। মেয়ের এহেন ঔদ্ধত্য আর বেয়াদবি মোটেও পছন্দ করেন না তিনি। রেগে দ্রুত পদে সদর দরজার বাইরে এলেন। ভিক্টোরিজা ততক্ষণে গাড়িতে উঠে বসেছে। জাস্টিনা মেয়েকে কড়া গলায় নিষেধ করলেন বাড়ির বাইরে যেতে। ভিক্টোরিজা মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে রাস্তায় নামল। পেছনে মায়ের চিৎকার শুনতে পাচ্ছে। চাকরদের আদেশ করছেন গাড়ি ঠেকাতে। গাড়ির গতির সাথে চাকরগুলো পেরে উঠল না। ভদকা একটু বেশিই খেয়েছে বোধহয়৷ চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসছে। রাস্তা একেবারে অন্ধকার আর জনমানবশূন্য। নেশার ঘোরে ভয় টয় পেল না অবশ্য। কাছাকাছি বারটাতে যেতে পনেরো মিনিট লাগে৷ ভিক্টোরিজা বেরিয়েছে দশমিনিট হলো। একটা আর্মির গাড়ি পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে নজরে এলো না। একটু যেন অবাক হলো ও। পরক্ষণেই ভাবনাটা ঝেড়ে ফেললো। আর্মি নেই তাতে ভালোই হয়েছে। যাত্রাপথে বাধা পায়নি। এই নির্বিঘ্নতায় মুচকি হাসল। হাসিটুকু দীর্ঘস্থায়ী হলো না। আচমকা কোথা থেকে একটা কালো বড়ো বাদুড় এসে আছড়ে পড়ল গাড়ির সামনের কাচে। ব্রেক ফেল করল ভিক্টোরিজা। গাড়ি রাস্তার পাশের খাদে গিয়ে পড়ে। খাদটা খুব বেশি বিপজ্জনক ছিল না। ঝোপঝাড় আর নর্দমায় ভরা। মাথায় আঘাত পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য অচেতন হয়ে পড়ল। জ্ঞান ফিরল ঘাড়ের ত্বকের কাছে সূচলো কিছুর স্পর্শে। আস্তে আস্তে চোখ মেলে দেখল গাড়ির অর্ধেক ডুবে আছে খাদের নর্দমায়। ভিক্টোরিজা পাশ ফিরতেই চমকে উঠল। সুদর্শন এক যুবক বসে আছে পাশের সিটে। পরনে সাদা শার্ট আর কালো টাউজার। গলায় প্যাঁচানো সাদা হোয়াইট জাবত। ঠোঁটের কোণে সম্মোহনী হাসি। হাসিটা চেনা লাগল। কার সাথে মিল আছে এই মুখ। ভিক্টোরিজার দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এলো। সামনের যুবকের মুখটাও। তবুও বুঝতে পারে যুবক ঝুঁকে আসছে ওর দিকে। গালের দু’পাশে যুবকের হাত টের পেল। ব্যথায় উহু করে উঠল সাথে সাথে। শুধু গাল নয় সর্ব শরীরের ব্যথা তখন উপলব্ধি করে ভিক্টোরিজা।
“একটু পরে সব ব্যথা চলে যাবে, রিজ। সকল জরা, ব্যথা থেকে মুক্তি পাবে তুমি।”
“কে,,কে তুমি?” ভয়ার্ত গলায় বলল ভিক্টোরিজা। যুবক হাসল সামান্য শব্দ করে। হাসিটা শুনতে চমৎকার লাগল। যুবক কানের কাছে মুখ এনে বলল,
“আমি?”
“হুম, তুমি। কে তুমি?”
“আন্দ্রেই।” গলার একপাশে যুবক আলতো করে চুমো দিতে শিওরে ওঠে ভিক্টোরিজা। ঢোক গিলে বলে,
“আন্দ্রেই?”
“হুম, আন্দ্রেই। তোমার আন্দ্রেই। আমাকে তুমি চাও না রিজ? বলো?”
ভিক্টোরিজার মস্তিষ্ক নয় নম্বর মহা বিপদ সংকেত জানান দেয়। কিন্তু ওর লোভী দেহটা সব উপেক্ষা করে। জোর করল ভিক্টোরিজাকে হ্যাঁ বলতে। ও বলে,
“হ্যাঁ, চাই।”
“গুড, গার্ল।”
“আমি গার্ল নই। আহ!”
গলার কাছের ত্বক ছিদ্র করে সূচালো কিছু ঢুকে যেতে ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল। ছাড়াতে চাইল যুবককে৷ কিন্তু পারল না। অসুরের মতো শক্তি যুবকের গায়ে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। ভিক্টোরিজার দেহ একসময় নিস্তেজ হয়ে এলো। দেহটা মরণ যন্ত্রণা কাতরাচ্ছে। ঝাপসা সিক্ত চোখে যুবকের মুখ দেখল। এই মুখের আদল ও চিনেছে। নিকোলাসের সাথে ভীষণ মিল এই মুখের। এখন এই মুখ সুন্দর নয়, ভয়ংকর বিভৎস লাগছে। মুখে লেগে আছে রক্ত। মৃত্যু ভয়ে কাঁদতে লাগল ভিক্টোরিজা। যুবক ওর গালের একপাশে হাত রেখে বলল,
“হুশ, কাঁদে না বেবি। এখনই সব ব্যথা চলে যাবে। তাই তো চাও তুমি, হুম?”
“প্লিজ মেরো না আমায়।”
“বাঁচতে চাও?”
“হ্যাঁ।”
যুবকের হাসির শব্দ আবার শুনতে পেল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ভিক্টোরিজার। চোখ বন্ধ করে ফেললো। হঠাৎ ঠোঁটের কাছে নোনতা ভেজা কিছু টের পায়।
“ঠোঁট আলগা করো, রিজ। পান করো অমৃতসুধা। এই তোমাকে সকল ব্যথা থেকে মুক্তি দেবে। আর আমাকে চিন্তা থেকে।”
ভিক্টোরিজা কিছু বুঝল না। বুঝার মতো অবস্থাতেও নেই এই মুহূর্তে। ঠোঁট আলগা করে জিহবা দিয়ে গিলে ফেললো আঠালো ভেজা জিনিসটা। তারপর একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
মেয়ের ওপরের রাগ বাড়ির চাকরদের ওপর উসুল করলেন জাস্টিনা। সবগুলোকে বকেঝকে কাঁদিয়ে ছাড়লেন। মাতভেইর পায়ের জন্য স্থানীয় এক কবিরাজের কাছে গিয়েছেন মাদাম আদলৌনা। রান্নাঘরে ইসাবেলা একা ছিল। জাস্টিনা এসে অকারণে ওকে বকতে আরম্ভ করলেন। ওর নীরবতা দেখে পাশে রাখা পানি ভর্তি জগটা ছুঁড়ে মারলেন। সারা গা ভিজল সাথে গলার কাছটা জগের কোণাতে খোচা লেগে কেটে গেল। এত অপমানে কেঁদেই ফেললো ইসাবেলা। জাস্টিনার বিন্দুমাত্র মায়া হলো না। কান্না শুনে কঠিন মুখে ধমকাতে লাগলেন। বাইরে গাড়ির হর্ণ বাজতে বেরিয়ে গেলেন কিচেন ছেড়ে। ইসাবেলা দুহাতে মুখ ঢেকে এক ছুটে চলে এলো ওদের থাকার রুমের সামনে। দরজা কাছে এসে থেমে যায়। ওকে কাঁদতে দেখলে মাতভেই কষ্ট পাবে। ইসাবেলা রুমে ঢুকলো না। ফুপাতে ফুপাতে একটু দূরের অন্ধকারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইল। দুহাতে মুখ ঢেকে খুব কাঁদল। ইচ্ছে করলে জাস্টিনার অপমানের প্রতিবাদ করতে পারত, কিন্তু পরে কী হতো? এ বাড়ি থেকে ওদের বের করে দিতেন বেনাস। ইসাবেলার ভয় মাতভেইকে নিয়ে। ও বেচারা এ বাড়ি ছেড়ে কোথায় গিয়ে উঠবে! কাছের মানুষদের জন্য কত কী সইতে হয় মানুষকে।
“বেলা!”
ইসাবেলার গলায় কান্না আঁটকে গেল নিকোলাসের গলা শুনে। চোখ তুলতে সামনে দৃশ্যমান হলো নিকোলাস। হাঁটু ভেঙে বসল ওর সামনে। আঁজলা ভরে ওর মুখটা তুলে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“কী হয়েছে?”
ইসাবেলা মুখ সরিয়ে নেয় ওর আঁজলা থেকে। গত দুইদিন নিকোলাস ওর সাথে দেখা করতে আসেনি। পলকে দিয়ে গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিল, জরুরি কাজে আটকা পড়েছে তাই আসতে পারবে না। ইসাবেলার কেন যেন বিশ্বাস হয়নি চিঠির কথাগুলো। ওর মন বলেছে ইচ্ছে করে আসেনি নিকোলাস। নিকোলাস হাঁপ ছেড়ে বলে,
“আ’ম সরি।”
“কেন? আমাকে এখন আর ভালো লাগছে না বলে?”
“বেলা!”
“ডাকবে না ওই নামে। তুমি ভেবেছো আমি বোকা? কিছু বুঝি না? পলকে চিঠি লিখলে সত্য গোপন করতে পারবে? ভুল তুমি। আমি তোমায় মন দিয়েছি। আমার সেই মন সব বলে দিতে পারে। তুমি দূরে সরে যেতে চাচ্ছো, তাই না?”
নিকোলাসের নীরবতায় ইসাবেলার বুকের বা’পাশে চিনচিনে ব্যথার উদ্রেক হয়। আহত মুখে চেয়ে বলল,
“সত্যি তুমি দূরে সরে যেতে চাইছ, নিকোলাস?”
“এটাই হয়তো আমাদের জন্য ভালো, বেলা।”
স্তব্ধ হয়ে গেল ইসাবেলা। নিকোলাসের মুখের ভাষা বোঝা দায়। দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছে। ইসাবেলা আর সহ্য করতে পারল না। কষে চড় দিলো নিকোলাসের চোয়ালে।
“দূরে সরে যাবি? এত সোজা? তবে কাছে কেন এসেছিলি? আমাকে ব্যবহার করতে? চুমো খেতে? চুমো খাওয়া শেষ এখন মন উঠে গেছে? পিশাচ, জানোয়ার। এই ছিল তোর মনে?”
নিকোলাসের বুকে আঘাত করে কান্নাসিক্ত গলায় বলল। ওর হাত ধরে ফেলে নিকোলাস। রেগে বলে,
“কী বললে? আবার বলো?”
“কেন বলব? বলব না। ছাড় আমার হাত।”
“যা বলেছে আবার বলো বেলা।”
“না বললে কী করবি? রক্ত খাবি? খা।”
নিকোলাসের মুখের সামনে উন্মুক্ত গলা বাড়িয়ে দেয় ইসাবেলা। গলার কাটা স্থানের রক্ত নিকোলাসের পিশাচটাকে উন্মাদ করে তোলে। রাগে ইসাবেলার কোনোদিকে খেয়াল নেই। দুচোখ বন্ধ করল নিকোলাস। নিজেকে সংযত করতে বিড়বিড় করে বলে,
“ঘাড় সরাও বেলা, ঘাড় সরাও।”
“কী হলো খা। মেরে ফেল আমাকে। একেবারে শেষ করে ফেল, প্রতারক, মিথ্যাবাদী।”
শেষ শব্দ দুটো শুনে রেগে তাকায় নিকোলাস। কিন্তু রাগটা পড়ে যায় ওর রক্তনেশার স্বভাবের দৌরাত্ম্যে। ইসাবেলা রাগের বশে গলা একেবারে মুখের কাছে এনেছে। নিকোলাসের দু’ঠোঁটের পাশ দিয়ে সাদা শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। নিজেকে সংযত করার আগেই দাঁত দুটো বসিয়ে দিলো ইসাবেলার গলায়। ব্যথা হিসহিসিয়ে ওঠে ইসাবেলা। পরক্ষণেই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। নিকোলাস যখন বুঝতে পারল কী করেছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। রক্তমাখা মুখে ইসাবেলার গলা থেকে মুখ তুলে অস্ফুটে বলল,
“এ আমি কী করলাম! বেলা!”
ইসাবেলা নিশ্চুপ হয়ে আছে। ওর দু-চোখে জল। নিকোলাস হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁতে গেলে আঁতকে ওঠে। ছিটকে সরে যায় দূরে।
“স্বার্থপর, রক্তপিশাচ, স্পর্শ করবে না আমাকে তুমি। ঘৃণা করি তোমাকে আমি, ঘৃণা করি।”
ইসাবেলা ঘাড় চেপে উঠে দাঁড়িয়ে এক ছুটে নিকোলাসের চোখের সামনে থেকে পালিয়ে গেল। অসহায়ের মতো সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল নিকোলাস। তারপর হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে চলে এলো পাহাড়ের সেই বাড়িটাতে। দুহাতের মুষ্টিতে কাঠের দেওয়ালে একটার পর একটা আঘাত করে৷ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় কাঠের দেওয়াল। বাড়ির ভেতরের সবকিছু ভেঙে তছনছ করে। ধারালো নখে দেহে আঘাত করল, কিন্তু কোনো ব্যথাবোধ নেই। একটু পর সব আগের মতো। আঘাতের চিহ্ন পর্যন্ত নেই কোথাও। পিশাচরা ব্যথা, জরা, মৃত্যু সব থেকে মুক্ত। নিকোলাস আজ মাথা কোটে মেঝেতে। ঘৃণার সাথে উচ্চারণ করে,
“পিশাচ, পিশাচ। বেলার ঘৃণার আগুনে পুড়ে ছাই হ তুই। ধ্বংস হ।”
চলবে,,,