চোখের_বিষ – চতুর্থ_এবং_শেষ_পর্ব।

1
2914

চোখের_বিষ।চতুর্থ_এবং_শেষ_পর্ব।
#তিতিশ্মা_মুসাররাত_কুহু।

বাবা হবার থেকে তৃপ্তিকে হারানোর ভয় টা বুকের ভেতর খুব আঘাত করছে।
ধুর কি সব ভাবছি আমি,
কিচ্ছু হবেনা আমার তৃপ্তির।
কিচ্ছু হবেনা।

কিছু ক্ষণ পর নার্স এসে একটা ফুটফুটে মেয়ে বাবু আমার মায়ের কোলে তুলে দিলো।
আমি শুধু অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকিয়ে আছি।
কখন তৃপ্তিকে বের করা হবে।

-নার্স,তৃৃপ্তি?তৃপ্তি কেমন আছে?

তখনি ডাক্তার বের হয়ে এসে বললেন,
-সরি মিঃ আরাফ আমরা আপনার ওয়াইফকে বাঁচাতে পারিনি।
সিজারের সময় হঠাৎ করেই তার প্রেশার বেড়ে গিয়েছিলো।
আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও আপনার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারলাম না।সরি!

আমি সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরে বসে পড়লাম।
কিছুতেই আমার তৃপ্তির মৃত্যুর সংবাদ আমি মানতে পারছিলাম না।
আমার তৃপ্তি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে মানতে পারছিলাম না।
তৃপ্তিকে একটা বেডে দেয়া হলো।

আমি তৃপ্তিকে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলাম।
ওর বাবা মা কাঁদতে থাকলো।
-তৃপ্তি,এই তৃপ্তি।কথা বলছোনা কেন?
বলেছিলেনা,সারাজীবন আমার সাথে থাকবে,আমার হাত কোন দিন ছাড়বেনা।
কেন তাহলে আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলে?কেন কেন কেন?
কথা বলো?প্লিজ কথা বলো।

একটা নার্স এসে বল্লো,
-সে বার বার বলছিলো,আমার কিছু হলে হোক।আমার সন্তানের যেন কিছু না হয়।কতটা ভালবাসে তিনি তার সন্তান কে।অথচ একটা বার কোলেও নিতে পারলোনা।না দেখতে পারলো সন্তানের মুখ টা।

তৃপ্তির লাশ বাড়ীতে নিয়ে আসা হলো।
দাফন সম্পূর্ণ হয়েছে।

মা আমার কাছে ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে এলো।

-আরাফ,নে বাবা।ওকে কোলে নে।তোর সন্তানকে কোলে নে।
-ও কে মা?
-তোর সন্তান,তোর মেয়ে।
-না মা,ও আমার তৃপ্তির হত্যাকারী।ওর জন্য আমার তৃপ্তি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।ও আমার সন্তান না মা,ও আমার দু চোখের বিষ।ওকে নিয়ে যাও মা,আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।ওর মুখ আমি দেখতে চাইনা।
-এসব কি বলছিস বাবা?হায়াত মওত সব আল্লাহর হাতে।এখানে এই নিষ্পাপ জানের কি দোষ?
-না মা,ওর জন্যই আজ আমার তৃপ্তিকে ওই মাটির ঘরে রেখে আসতে হলো।
তুমি জানো মা আমার তৃপ্তি অন্ধকার খুব ভয় পায়।অথচ আজ আমি নিজে হাতে ওকে অন্ধকার ঘরে রেখে আসলাম মা।
কত স্বপ্ন ছিলো ওর,ও ওর পরিবার,আমার পরিবার সবার সাথে মিলেমিশে থাকবে এখন থেকে।

কিন্তু সব স্বপ্ন ওর মাটির সাথে মিশে গেলো।
ডাক্তার যদি একটা বার বলতো,
আপনি কাকে চান,আপনার সন্তান নাকি আপনার স্ত্রীকে।
বিশ্বাস করো মা,আমি আমার তৃপ্তিকে চাইতাম।
আমার সন্তান লাগবেনা মা,আমার তৃপ্তিকে এনে দাও মা।আমার তৃপ্তিকে এনে দাও।

মেয়েটা সুখের মুখ দেখার আগেই দুঃখ নিয়ে চলে গেলো মা।
রাতেও ও আমাকে বলছিলো,
আমার খুব ভয় হচ্ছে আরাফ।
আমি ওকে বুঝিয়েছিলাম,কিচ্ছু হবেনা।
এখন আমি কিভাবে আমাকে বুঝাবো মা?

-কাঁদিস না বাবা।আল্লাহ্‌র মাল আল্লাহ্‌ নিয়ে গেছেন।
এখানে কারো হাত নেই।
তুই এভাবে কাঁদলে ভেঙে পড়লে এই অবুঝ বাচ্চাটাকে কে দেখবে?
এখন তো তোকেই ওর মানুষ এর মত মানুষ করে গড়ে তুলতে হবে।

-মা প্লিজ!
ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।আমি ওর মুখ দেখতে চাইনা।
প্লিজ মা,প্লিজ।

-আচ্ছা ঠিক আছে বাবা,আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।তুই প্লিজ শান্ত হ।প্লিজ শান্ত হ।

সেদিন আমি আমার তৃপ্তিকে ওই মেয়ের জন্য হারিয়ে ফেলি।
যার জন্য আমি আমার তৃপ্তিকে হারিয়েছি।তার মুখ আমি দেখবো কি করে?ও তো আমার চোখের বিষ।
সেই জন্য আমি ওর নাম মুখে নেয়াতো দূরের কথা,ওর নাম টাও শোনা পছন্দ করিনা।

এবার হয়েছে শান্তি আপনাদের?
হয়েছে এবার রহস্য উন্মোচন?
জেনেছেন তো সব কিছু।নাকি আরো কিছু জানার বাকি আছে?

-সরি আরাফ সাহেব,আমরা বুঝতে পারিনি আপনার মনে এত কষ্ট লুকোনো আছে।
ক্ষমা করবেন আমাদের।
তবে একটা কথা বলতে চাই।
আপনার মা ঠিকই বলেছেন,হায়াত মওত সব আল্লাহ্‌র হাতে।
এখানে আপনার মেয়ের কোন দোষ নেই।
তাহলে ও কেন বিনা দোষে ওর বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবে?
কেন ও বাবা থেকেও এতিমের মত বড় হবে।

-প্লিজ!আমি আর কোন কথা শুনতে চাচ্ছিনা।প্লিজ।
ওর জন্য ওর দাদী আছে,নানা নানী আছে।
-তবে সব থেকে যাকে বেশি প্রয়োজন সেই তো নেই।
যার ছায়া মা মরা মেয়েটার উপর সব থেকে বেশি প্রয়োজন।তার ছায়াই তো নেই।
একবার ভেবে দেখবেন,ও কেমন যন্ত্রণা অনুভব করে।
যার মাকে সে জন্মের সময়ই হারিয়েছে।
আর যার বাবা থেকেও নেই।

আরাফ সাহেব কোন কথা না বলে সেদিন অফিস থেকে বাসায় চলে আসেন।

-কি রে আজ এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে আসলি যে?
-এমনিই ভালো লাগছেনা।এক কাপ চা দিওতো।
-আচ্ছা যা তুই ফ্রেশ হয়ে নে।আমি চা দিচ্ছি।

-বাবা! ও বাবা,সবার বাবা সবাইকে কত আদর করে।কত ভালবাসে।
বাইকে করে শায়লার বাবা শায়লাকে কলেজে দিয়ে যায়।
কত কিছু কিনে দেয়।সারপ্রাইজ দেয়।কত জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়।আর তুমি আমাকে একটা বার বুকে জড়িয়েও ধরোনা।আদরও করোনা।আমি তো তোমার কাছে আর কিছু চাইনা বাবা,শুধু একটু আদর আর ভালবাসা চাই।
আমিও সবার মত বুক ফুলিয়ে বলতে চাই,আমার বাবা আমাকে খুব ভালবাসেন।আমার মায়ের অভাব আমাকে বুঝতে দেন না।
কিন্তু পারিনা বাবা,পারিনা,কাউকে কিছু বলতে পারিনা।
কত টা অসহায় আমি জানো বাবা?
আমাকে কি একটু ভালবাসা যায় না বাবা?একটু?

আর মা,তুমি আমাকে কেন একা করে চলে গেলে বলোনা,ও মা বলো।জানো মা,আমার মত অভাগী কেউ নেই হয়তো দুনিয়ায়।না পেলাম তোমার আদর,না পেয়েছি বাবার ভালবাসা।
আমার তো তোমাদের আদর পেতে খুব ইচ্ছে করে মা।
আমার তো তোমার আদর পেতে ইচ্ছে করে।
তোমার হাতে খাবার খেতে ইচ্ছে করে।
তুমি চুল বেধে দিবে,আমি সবাইকে বলবো আমার মা আমার চুল বেধে দিয়েছে।
কিন্তু আমি কাউকে বলতে পারিনা মা।
কাউকে বলতে পারিনা।

কলেজ থেকে বাসায় ফিরতে দেরি হলে সবার মা,বাবা সবাইকে ফোন করে।
কিন্তু আমাকে কেউ ফোন করেনা মা।
কেউ আমাকে ফোন করেনা।কেউ আমার বাসায় ফেরার অপেক্ষা করেনা মা,কেউ আমার জন্য চিন্তা করেনা।

আমাকে একটা বার বুকে জড়িয়ে নিবে মা?একটা বার?আমি তোমার কোলে মাথা রেখে একটা বার ঘুমাতে চাই।
নাও না আমায় বুকে জড়িয়ে মা।নাওনা প্লিজ।

বাবার রুমে থাকা মা বাবার এটাচ ফটোটা হাতে নিয়ে কাঁদছিলাম আর কথা গুলো ফটো দেখে বলছিলাম।
আর সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম কে যেন আমার কাঁধে হাত রেখেছে।

পেছন ফিরে ঘুরে তাকাতেই দেখি,
রাগি মানুষটা চোখ ভর্তি জল নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ানো।
না এ চোখে আজ কোন রাগের ছাপ নেই।যা দেখা যাচ্ছে তা শুধু মেয়ের জন্য বাবার ভালবাসা।

-বাবা,
-আয় মা আমার বুকে আয়।

আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরি।

-আমি আমার মেয়েটাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়েছি না মা?আমাকে ক্ষমা করে দে মা।আমাকে ক্ষমা করে দে।
আজ থেকে নিজেকে আর অসহায় এতিম ভাব্বি না।একদম না।
তোর বাবা এখনো বেঁচে আছে।
আজ থেকে আমি তোকে প্রতিদিন কলেজে দিয়ে আসবো।
তোর বাসায় ফিরতে লেইট হলে আমি ফোন করবো।

তুই ভালো রেজাল্ট করলে আমি তোকে সারপ্রাইজ গিফট দিবো।
সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবো।

-কেঁদোনা বাবা,তুমি কেঁদোনা।
-নিজে কাঁদছিস আবার আমাকে কাঁদতে নিষেধ করছিস।
তুই চিন্তা করিস না মা,
আমি এখন থেকে তোকে নিজ হাতে খাইয়ে দেবো।
তোর চুলও বেধে দেবো।

-বাবা,
-বল মা,
-তুমি চুল বাধতে পারো?
-কান্নার মাঝেও আমার মেয়েটা আমাকে হাসিয়ে ফেলে।ঠিক মায়ের মত হয়েছিস।
পারিনা তাতে কি হয়েছে?
আগে তোর মায়ের চুলও উলটে পালটে বেধে দিতাম।
তোর মা খুব হাসতো।
আর এখন তুই না হয় বাবাকে চুল বাধা শিখিয়ে দিবি।
দিবিনা?
-দিবো বাবা দিবো।
-এবার চোখ মোছ,আর ফ্রেশ হয়ে নে।
আমরা আজ এক সাথে খাবার খাবো।

তারপর খাওয়া দাওয়া করেই আমরা মা ছেলে ঘুরতে যাবো।

-ওহ মা ছেলেই শুধু ঘুরতে যাবে।
আমাদের কেউ নিবে না আপা।

দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি দিদি ভাই,নানা নানু চোখ মুছছে আর হাসছে।
নানা নানু আমাকে দেখতে এসেছেন।
প্রায়ই আসেন।

-তোমাদেরও নেবো।
চলো এবার সবাই ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে ঘুরতে যাই।

এত দিন পর আজ আমি আমার বাবার আপন হতে পেরেছি।তাকে আপন করে পেয়েছি।তার চোখের বিষ থেকে আজ আমি চোখের মণি হয়েছি।
বাবা আজ আমাকে নিজ হাতে আমার মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছেন।
রাস্তা পাড় হবার সময় বাবা আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন,
যেন আমি তার ছোট্ট মেয়েটি।
আমরা অনেক ছবি তুলেছি।
বাবা আমার কপালে চুমু দিয়েছেন।
দিদি ভাই আবার সেই ছবিও তুলে নিয়েছেন।
আমরা রাতের খাবার বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।

উপস অনেক রাত হয়েছে এখন ঘুমিয়ে পরি।নইলে বাবা যদি জানে আমি না ঘুমিয়ে রাত জেগে আছি,তাহলে খুব বকবেন।যে রাগি বাবা আমার।

আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।
হঠাৎ কে যেন আমার রুমে এলো,
আমার গায়ে কাঁথা দিয়ে দিলো।কপাল আর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলো।
আমার মশারিটা টানিয়ে দিয়ে দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

তিনি আর কেউ নন।
আমার বাবা।হ্যাঁ আমার বাবা।

#প্রতিটা মেয়ে তার বাবার চোখের মণি হয়ে থাকুক,সেই কামনা।
আল্লাহ্‌ হাফেজ!

(সমাপ্ত)

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে