#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (১৫তথা শেষ)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি
রাফি এবং মাধুরি একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। বেশ কিছুক্ষন নিরব কান্নায় কেটে গেলো। মুন এবং রিয়াদ পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। মুন এবং রিয়াদকে লক্ষ্য করে রাফি মাধুরিকে ছেড়ে দিলো। নিরবতা ভেঙে রাফিই বললো,” কেমন আছো মাধুরি”?
মাধুরি কান্নারত অবস্থায় বললো,” যেমন থাকার”।
” এভাবে বলো না। আমরা তো এক হয়ে গেছি তাই না, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা সব ঠিক করে নেবো”।
” হুম”।
রাফি এবার মুনের দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না, তবে তুমি আমাকে আজ যা উপহার দিলে তা…..”।
রাফির কথা শেষ করতে না দিয়ে মুন বললো,” কৃতজ্ঞতা প্রকাশটা পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দিন ভাইয়া। আপনার জন্য আমার আরো বড় উপহার তৈরি আছে”।
” আরো বড় উপহার সেটা কি”?
রাফির প্রশ্নের উত্তরে রিয়াদ বললো,” এই তো আজ আপনার আর মাধুরির সাক্ষাৎ করানো, কাল মাধুরির সাথে হওয়া অন্যায়ের শাস্তি দেওয়া। মাধুরিকে পেয়ে যতটা আনন্দ পেয়েছেন, মাধুরির অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে নিশ্চয়ই তার থেকে বেশি আনন্দিত হবেন”।
” হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আমরা তাদের শাস্তি কিভাবে দিবো”?
রিয়াদ বললো,” এই তো কাল আমরা ‘চন্দ্রকুঠি’ রেট করবো। রেট করার পর সেখানে বাধ্য হয়ে থাকা মেয়েগুলোর মুখ খোলানো ততটা কঠিন হবে বলে আমার মনে হয় না। তাদের মুখ খুললেই তাদেরকে সাক্ষী হিসাবে দাঁড় করাবো আমরা, সাথে মাধুরিতো আছেই”।
” কালকেই রেট হবে”?
মুন বললো,” হ্যাঁ”।
” আচ্ছা। কালকের পর আমরা একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবো”।
” তা তো বটেই”।
মুন এবং রিয়াদ রহস্যময় হাঁসি দিলো।
মুন এবং রিয়াদকে বিদায় দিয়ে রাফি এবং মাধুরি ঘুরতে বের হলো। অনেকদিন পর একে-অপরকে পেয়ে খুব খুশি তারা।
তবে আনন্দ মূহুর্ত সবসময় দীর্ঘ হয় না। তাই বোধহয় হঠাৎ করে মাধুরির মাথাটা ঘুরে উঠলো। চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতে শুরু করলো। কিছু মূহুর্তের মাঝে মাধুরি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
–
বেশ কিছুক্ষন পর মাধুরির জ্ঞান ফিরে। চোখ খুলে নিজেকে যেখানে আবিষ্কার করলো সেখানে নিজেকে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলো না মাধুরি। এই রুমটা মাধুরির চেনা। হ্যাঁ খুব চেনা। এটা ‘চন্দ্রকুঠির’ একটি রুম। মাধুরি পাশ ফিরে তাকিয়ে আরো অবাক হলো, কেননা সেখানে আরো দশ জনের মতো মেয়েকে বসে আছে । মাধুরির কান্না পাচ্ছে নিজেকে এখানে দেখে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে মাধুরি বললো,” আমাদের এই রুমে একসাথে রাখা হয়েছে কেন”?
একটি মেয়ে বললো,” আমাদের মুখ খোলার ভয় রয়েছে তাই আমাদের আজ রাতে পাচার করে দেওয়া হবে”।
” মুখ খোলার কথা আসছে কেন? চাইলেই তো এখান থেকে পালানো সম্ভব নয় তাই না”?
” শুনেছি কাল এখানে রেট হবে তাই আজকেই সব ব্যবস্থা করে রাখছে তারা”।
এবার মাধুরি গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবলো। রিয়াদ বলেছিলো কাল এখানে রেট হবে। তারমানে যারা তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে তাদেরকে পাচার করা হবে আজ! মাধুরি মনেমনে বেশ ভয় পেলো।
কিছুক্ষন পর দরজা খুলে তালুকদার বাড়ির সব পুরুষরা ভিতরে ডুকলো, সাথে ‘চন্দ্রকুঠির’ প্রধান মহিলাও।
রাতুলের বাবা বললেন,” খুব তো এখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলি কিন্তু পালিয়ে বাঁচতে পারলি কি”?
” আমার সাথে আপনাদের কি শত্রুতা কেন করছেন এমন”?
এবার দাদু বললেন,” তোর সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। তুই আমাদের আরিফের মেয়ে, সেই হিসাবে তোর সুন্দর জীবনে আমরা আঘাত করতে চাইনি। কিন্তু”!
” কিন্তু কি”?
এবার রাতুলের বাবা বললেন,” দেখ তুই এখানে আসার আগে অব্দি আমরা জানতাম না তুই আরিফের মেয়ে। তোকে এখানে নিয়ে আসার পর আমাদের জানানো হয়েছে। একটুপর তো চলেই যাবি তাই সব সত্যি শুনেই নাহয় যা”।
এবার রাফির বাবা মুখ খুললেন,” তোর মা চন্দ্রর কথা হয়তো তুই জানিস। না জানলে শুনে নে…… (যতটা জানানো হয়েছে ততটা এখানে বলা হলো)। তো যাই হোক চন্দ্রকে আমার ভালো লাগতো। আমি ওকে পেতে চেয়েছিলাম। তাই কারাগারে ওকে বলেছিলাম,
অতীত,
কারাগারে চন্দ্রর সামনে বসে আছে রাফির বাবা। তাকে দেখে চন্দ্র কিছুটা ভয় পেলো। চন্দ্র কিছু বলতে নেওয়ার আগেই রাফির বাবা বললেন,” আজ তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তোমার সাথে আরিফের সম্পর্কে আমি আজও মেনে নিতে পারিনি। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, আমি একটা প্রস্তাব নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। তুমি কি জানতে চাও কি প্রস্তাব”?
চন্দ্র বেশ অবাক হলো। অবাক হয়েই বললো,” কিসের প্রস্তাব”?
” দেখো আমি এখানকার জেলার। আমি চাইলে তুমি এখান থেকে পালাতে পারো। তাই বলছিলাম চলো আমরা দু’জন আলাদা সংসার শুরু করি। তুমি তোমার বাচ্চাটাকে কোন অনাথ আশ্রমে দিয়ে আমার সাথে নতুন করে সংসার শুরু করবে…..”।
আর কিছু বলতে পারলো না তার আগেই চন্দ্রর হাতের থাপ্পড় পড়লো তার গালে। চন্দ্র বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো,” আপনার লজ্জা করে না, নিজের ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে এমন কু-প্রস্তাব দিতে। আমার ভাবতেও ঘৃনা হচ্ছে আপনি একজন জেলার। ছিঃ। থুতু মারি আপনার মুখে”।
” চন্দ্র”। চিৎকার করে
” চিৎকার করলেই আমার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে এমনটা ভাবার ভুল করবেন না। আর হ্যাঁ একটা কথা শুনে রাখুন আমার যে সন্তানকে আপনি অনাথ আশ্রমে দেওয়ার কথা বলেছেন, একদিন এমন নাহয় এই সন্তানের জন্য আপনাদের আমার স্থানে, এই কারাগারে থাকতে হয়”।
বর্তমান,
সেদিন চন্দ্রর কথায় আমার খুব রাগ হয়েছিলো৷ সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম ওর যে সন্তান হবে তার জীবনটা আমি সুখের হতে দিবো না। তাই তোমাকে প্লান করে এখানে নিয়ে এসেছি।
সব শুনে মাধুরি কান্নায় ভেঙে পড়লো। মাধুরি আস্তে করে বললো,” এই বাড়িতে এসব কবে থেকে শুরু হলো”?
রাফির দাদু বললো,” আধ ঘন্টা পর তোমাদের সবাইকে এখান থেকে পাচার করা হবে। তো শুনেই যাও সেই পুরনো দিনের কথা।
যেদিনকে শরীরের চাহিদা উপলব্ধি করি সেদিন থেকেই আমার নিষিদ্ধ পল্লীতে যাওয়া আসা শুরু হয়। সেখানকারই একজন ছিলো চন্দ্রর কাকীমা। সেখান থেকে কিভাবে জানো চন্দ্র কাকাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করে। সেই হিসাবে চন্দ্রর সম্পত্তির প্রতি আমার যেমন লোভ ছিলো তেমন চন্দ্রর কাকীরো। তো যাই হোক চন্দ্রর ফাঁসি দেওয়ার পর দেহের তারনায় চন্দ্রর কাকী আবার সেই ব্যবসা শুরু করে। তখন তার মাথা থেকেই এই বুদ্ধিটা আসে এই বাড়িতে এসব শুরু করলে কেমন হয়! সেদিন থেকেই এখানে এসব শুরু হয়। আমাদের দিন-কাল ভালোই চলছিলো। হঠাৎ একদিন চন্দ্রর কাকীর সাথে আমার ঝগড়া হয়। কেননা সে এখানকার ব্যবসার সব টাকা নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলো। এখানকার রাজত্ব একার করতে চেয়েছিলো। তাই বুদ্ধি করে তাকে মেরে ফেলি। এরপর এই রাজত্ব আমার হয়। আমার দুই ছেলেই আমার মতো তৈরি হয়েছিলো। শুধু আরিফকেই তৈরি করতে পারলাম না। এই আফসোসটা রয়ে গেলো”।
মাধুরি এবার বেশ বিষ্ময়কর কর একটি কান্ড ঘটালো। রাফির দাদুর গালে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো।
” আপনার লজ্জা করে না, ছেলে খারাপ হয়নি বলে আপনি আফসোস করছেন। যেখানে সব বাবা-মা সন্তানকে ভালো পথে চলতে শেখায়…..”।
মাধুরি আর কিছু বলতে পারলো না। কেননা তার গালে বেশ জোরে কেউ একজন থাপ্পড় মারলো। থাপ্পড়ের যন্ত্রণা থেকে যে মানুষটা থাপ্পড় মেরেছে তাকে দেখে বেশি যন্ত্রণা হলো মাধুরির। বুকের বা পাশটা বেশ ব্যাথা করতে শুরু করলো। কারন সেই মানুষটিকে মাধুরি আপন ভেবে আঁকড়ে ধরেছিলো। সে আর কেউ না মাধুরির ভালোবাসার মানুষ রাফি। মাধুরির কন্ঠ দিয়ে আর কোন কথা বের হলো না। রাফির দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। রাফি মাধুরির দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললো,” পরিবার ছোট থেকে যে শিক্ষায় বড় করে সন্তান সেই শিক্ষায় অর্জন করে। তুমি আমাকে দেখে অবাক হলেও আমি কিন্তু কষ্ট পাচ্ছি না মাধুরি। আমি জানতাম না আমার বাবা তোমাকে ভালোবাসার ছলে এখানে নিয়ে আসতে কেন বললো! না জেনেই তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম। জানার পর একটু কষ্ট হয়েছিলো কারন আমার বাবা আমার মাকে ছেড়ে তোমার মায়ের সাথে সম্পর্ক গড়তে চেয়েছিলো। এটা একজন সন্তানের জন্য কষ্টের। তবে যে পথে আমি পা দিয়েছি সেখান থেকে বেড়োতে পারবো না। তাই তোমাকে আজ এখান থেকে যেতেই হবে”।
রাতুল বললো,” গাড়ি এসে গেছে, সবাইকে অজ্ঞান করার ব্যবস্থা করো”।
মাধুরি এখনো অপলক দৃষ্টিতে রাফির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েগুলো অজ্ঞান করার জন্য একজন এগিয়ে গেলেই পিছন থেকে পুলিশ এসে সবাইকে ধরে নিলো।
রাতুলের বাবা, ” এখন পুলিশ কিভাবে আসলো? রাফি তুই তো বলেছিলি পুলিশ কাল আসবে”।
রাফি নিজেই অবাক। এখানে এখন পুলিশ কোথা থেকে এলো। পুলিশের তো আসার কথা ছিলো না।
” বিশ্বাস খুব দামী জিনিস। বিশ্বাসের ঘরে একবার সন্দেহ ডুকলে সেখানে দ্বিতীয়বার বিশ্বাসের জন্ম হয় না। সেখানে তুমি আমার বিশ্বাস কখনো ছিলেই না, তার আগেই সন্দেহ আমার মস্তিষ্কে ঘোরাফেরা করছিলো। তাই তোমার নিখুঁত অভিনয় আমার সন্দেহ দূর করতে পারেনি”।
পিছন থেকে মুন কথাটি বললো। মুন এবং রিয়াদকে দেখে রাফি আরো বেশি অবাক হলো। রিয়াদ একজন মহিলা পুলিশকে মেয়েগুলোকে নিয়ে যেতে বললো, আর একজনকে মাধুরিকে তার বাবার কাছে নিয়ে যেতে বললো। বাবা নিচে আসে শুনে মাধুরি চলে গেলো। মুনকে দেখে রাফির দাদু বললো,” এই মেয়ে তুই এখানে কেন? তোকে মাধুরির যায়গায় পাঠানোর জন্য আরিফ প্লান করে তোর মুখে সার্জারী করলো আর তুই ওর মেয়েকে বাঁচাতে এসেছিস”।
কথাটি শুনে মুন বেশ অবাক হলো। রাফি তো জানতো মুন মাধুরির বোন। তাহলে রাফি নিজের পরিবারকে বলেনি কেন! মুনের সম্পর্কে সত্যিটা বললে তালুকদার বাড়ির সবাই বুঝে যেতো মুন আরিফ সাহেবের নিজের মেয়ে। মুনকে আরো চমকে দিয়ে রাফি বললো,” তুমি ভুল করছো দাদু। মুনের মুখে কোন সার্জারী হয়নি বরং ও আরিফ কাকার নিজের মেয়ে”।
রাতুল বললো, ” কি বলছিস তুই? তাহলে মাধুরি কে”?
” মাধুরি ময়নামতির মেয়ে। মুনের খালাতো বোন”।
সবাই বেশ চমকালো। মুন এবং রিয়াদও কিছুটা চমকালো। রাফি সব জেনেও এতদিন চুপ ছিলো কেন!
রাফি মুনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,” তোমার মনে আমার জন্য তো ভালোবাসার জন্ম হয়েছিলে, তাহলে সেই ভালোবাসা সন্দেহ পরিনত হলো কিভাবে”?
এবার মুন কিছুটা মুচকি হেঁসে বললো,” সেদিন রাতে তোমার রুমের দেয়ালে পাহারের পেইন্টিং দেখেই সন্দেহ শুরু হয়। কারন ওরকম পেইন্টিং আমি ভিডিওতে দেখেছিলাম যেখানে তুমি বন্দী ছিলে। তখন ইচ্ছে করে তোমার রুমের লাইট অফ করে দেই তারপর বিছানার উপর বসি। বিছানায় বসে আমি নিশ্চিত হলাম ওখানে বসেই ভিডিওটা বানানো হয়েছিলো”।
এরপর রিয়াদ বললো,” আমরা জানতাম তোমাদের বংশের সবাই মেয়েবাজ। তাই ইচ্ছে করে তোমাকে শোনানোর জন্য সেদিন মুন এবং আমি ঐসব কথা বলেছিলাম”।
এবার মুন কিছুটা ব্যঙ্গ করে বললো,” তবে মানতে হবে তুমি খুব ভালো অভিনেতা। এত নিখুঁত অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ। আমাদের জালে তো ফাঁসলেই না উল্টো এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপনা করছিলে মনে হচ্ছিলো মাধুরিকে হারানোর ব্যাথায় তুমি শেষ হয়ে গিয়েছো। আসলে সত্যি হলো তুমিও তোমার বাবার মতো নোংরা মানুষ। বাবার এবং শহরের বড় বড় মানুষদের ব্লাকমেইল করে নিজের পছন্দমতো কারাগারে জেলার হিসাবে জয়েন করেছো। ইচ্ছে করে রেবেকাকে কষ্ট দিয়েছো কারাগারের মধ্যে। ওর শেষ চিঠিতে তোমার কারাগারের মাঝে করা নোংরামি সব উল্লেখ ছিলো”।
এবার রিয়াদ বললো,” তবে ধরা তুমি আমাদের কাছে আগেই খেয়েছো। তোমার অভিনয়ে আমাদের মাঝে কনফিউশান থাকলেও সেদিন মুনকে অনুসরন করে ঐ বাসাটা চিনে সেখানে লোক পাঠিয়ে ঘূর্ণিঝড়(এলেমেলো) বানানোটা তোমার বোকামি ছিলো। তাই তো এভাবে ধরা খেলে। আমরা জানতাম আমরা যদি বলি আমরা কাল রেট করবো তবে তোমরা আজকে এরকম কিছুই করবে। দেখো তাই হলো”।
মুন বললো,” তোমাদের জন্য একটা চমৎকার খবর আছে। মেয়েগুলোর সাক্ষীও আমাদের আর প্রয়োজন নেই কারন তোমরা এতক্ষন যা যা বলেছো করেছো সবকিছুর ভিডিও রেকর্ডিং আছে আমাদের কাছে”।
রাফির দাদু বেশ তেজ দেখিয়ে বললেন, তোমাদের এর ফল ভোগ করতে হবে”।
রিয়াদ মুচকি হেঁসে তাদের সবাইকে নিয়ে যেতে বললো। সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো।
_______
কেটে গেলো কিছুদিন। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে সবাইকে মৃতুদন্ড দেওয়ার নির্দেশ দিলো আদালত। ‘চন্দ্রকুঠিতে’ জোর করে নিয়ে আসা সবাইকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। অন্ধকার জীবন থেকে আমরা যতই মুক্তি পাই না কেন, অন্ধকার মূহুর্তগুলো আমাদের পিছু ছাড়ে না। ঠিক সেরকমভাবে পরিবার তাদের মেনে নিলেও সমাজ মেনে নেয়নি। সমাজের তীক্ত উক্তি সবার মনোবলকে ভেঙে দিয়েছে।
তবে সব অন্ধকারের পিছনেই কিছুটা আলো লুকায়িত থাকে। কারো জীবনে সেই আলো সময়ে ধরা দেয়, কারো বা অসময়ে। মেয়েগুলোর জীবনে আলোটা সময়েই ধরা দিলো তাই তো তালুকদার বাড়ির সকল বউরা মেয়েগুলোকে নিজেদের একজন হিসাবে মেনে নিয়েছে। তাদের সবার দায়িত্ব নিয়েছে। তালুকদারদের সেই অবৈধ টাকা নাহয় মেয়েগুলো সুস্থ জীবন পাক। এই আশায় সবাইকে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন তারা। সেই সাথে এই আশ্বাস দিয়েছেন একদিন তারা সবাই এগিয়ে যাবে। তাদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। সমাজ কথা বলবে, যতদিন নিজের পরিচয় না গড়বে ততদিন সমাজ বলেই যাবে। তাদের সব কথাতে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
এই কথাটা শুধু ঐ মেয়েগুলোর জন্য নয় মাধুরির জন্যও প্রযোজ্য। সেই সাথে সমাজের আনাচে কানাচে থাকা হাজারো মাধুরির জন্য।
মুন দাঁড়িয়ে আছে কারাগারের সামনে। কারাগারের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। মনেমনে বলছে,” জন্মস্থানকে মানুষ ভালোবেসে আপন করে নেয়। আচ্ছা আমিও কি ভালোবেসে এই কারাগারকে আপন করে নিতে পারবো! সবাই কি নিজ জন্মস্থানকে ভালোবাসতে পারে”!
” আমি জানি তুমি এখানে কেন এসেছো”?
রাফির কথায় ভাবনা থেকে বের হলো মুন। হ্যাঁ মুন আজ রাফির সাথে দেখা করতে এসেছে।
” কি জন্য এসেছি”?
মুন প্রশ্ন করলো রাফিকে।
” সত্যি জেনেও আমি নিজের পরিবারকে সত্যিটা কেন বললাম না তাই তো”?
” যদি বলি হ্যাঁ এটাই জানতে চাই”?
” আমি জানি এটাই জানতে চাও তুমি”।
” তাহলে উত্তরটা দিয়ে দেও”?
” মাধুরিকে চন্দ্রকুঠি অব্দি টেনে আনার সময়ও আমি কিছু জানতাম না। জানতে পেরেছিলাম পরে”।
” সে যাই হোক বললে না কেন কাউকে? বললে হয়তো আজ বেঁচে থাকতে”?
মুনের কথা রাফি একটা হাঁসি দিলো। সাধারণ হাঁসি নয় রহস্যময় হাঁসি।
” সব প্রশ্নের উত্তর জানতে নেই মুন। নিজের এই কৌতুহল প্রবন মনকে দমিয়ে রাখো। জীবনে সব প্রশ্নের উত্তর জেনে যাওয়া ঠিক নয়। জীবন কিছু কিছু প্রশ্নকে সারাজীবন বাঁচিয়ে রাখা উচিত। এতে জীবন সুন্দর হয়”।
” মানে…..”।
” এই প্রশ্নটি থাক না তোমার অজানা”।
মুন কিছু বলতে নিবে তখন রাফি বলে উঠলো,” মাধুরিকে ভালো রেখো। সমাজকে এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে বলো। মাধুরি একজন সফল ডাক্তার হলে আমার ভালো লাগবে”।
” সত্যি করে বলবে জীবনে কখনো মাধুরিকে একটুর জন্য হলেও ভালোবেসেছিলে”?
” না। ভালোবাসিনি কখনো তবে এক মূহুর্তের জন্য হলেও মায়ায় পড়েছিলাম। সেই মায়ার জন্যই বলছি মাধুরি ভালো থাকলে আমার ভালো লাগবে। মাধুরি একদিন জীবনে অনেকটা এগিয়ে যাবে সেদিন হয়তো আমি থাকবো না। তবে সেদিন আমার আত্নার মুক্তি ঘটবে”।
” আচ্ছা আসছি আমি”।
মুন মনেমনে ভেবে নিলো,” থাক না কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানা। রাফি কেন তার সত্যিটা প্রকাশ করেনি সেটা নাহয় প্রশ্ন হয়েই থেকে যাক”।
মুন যাওয়ার জন্য বা পা বাড়ালো পিছন থেকে রাফি বলে উঠলো,” ভালো থেকে মাহযাবিন। খুব ভালো থেকো”।
কথাটি বলে রাফি হেঁসে দিলো। মুন পিছনে ঘুরে রাফির হাঁসিময় মুখ দেখে একবার থমকে দাঁড়ালো। কত নিষ্পাপ সেই হাঁসি। সকল ভাবনাকে পিছনে ফেলে মুন চলে গেলো।
মাধুরি ঘরের কোনে চুপটি করে বসে আছে। বসে আছে বললে ভুল হবে নিরবে কাঁদছে। তবে এই কান্নাটা রাফির জন্য নয় নিজের জন্য। মাধুরি আর মুনের সম্পর্কের কথা জানতে পারার কান্না। মাধুরি জেনে গেছে তার আসল পরিচয়। বাবা আর বোন তার খুশির জন্য সত্যিটা আড়াল করলো। কিন্তু তারা জানে না সত্যি আড়ালে থাকতে বড্ড অপছন্দ করে। তাই তো মাধুরির কাছে সত্যিটা ধরা দিলো।
মাধুরি সব ভাবনাকে পিছনে ফেলে মনেমনে ঠিক করে নিলো তার বাবা না চাইলেও সে কোনদিন জানাবে না তার কাছে সত্যিটা ধরা দিয়েছে। সত্যিটা তার কাছে প্রকাশিত জানলে হয়তো মুন তার মুখোমুখি হতে সংকোচবোধ করবে৷ মুনের মনে সবসময় বেদনার অশ্রু থাকবে, তার জন্য মাধুরির জীবনে এতটা কষ্ট। মুনকে কখনো সংকোচে ফেলবে না মাধুরি। তাই ঠিক করে নিলো সেও কখনো জানাবে না কথাগুলো। এখন মাধুরির একটাই লক্ষ্য সমাজকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া।
রিয়াদ ও মুন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। নিরবতায় কিছুটা সময় কাটলো। কখনো কখনো নিরবাত খুব আনন্দ দেয়। তেমনি নিরবতাটা রিয়াদের খুব ভালো লাগলো। তবে ভালো লাগাটা বেশিক্ষন স্থায়ী ছিলো না। নিরবতা ভেঙে মুন বললো, ” আসছি আমি। আপনার আর আমার একসাথে পথচলা এতটুকুই ছিলো। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ”।
” আমাদের আর কখনো দেখা হবে না”?
” চলতি পথে চলতে চলতে কোন এক রোদেলা দিনে হয়তো দেখা হবে। মেঘলা দিনের গল্পগুলো সবার জীবনে থাকে, আমরা নাহয় তপ্ত রোদের গল্প লিখে যাবো”।
রিয়াদ মুচকি হাঁসলো। মুন রিয়াদের সাথে হাত মিলিয়ে চলে গেলো। মুনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রিয়াদ বললো,” ভিক্টিমের পরিবারের সদস্যকে সাথে নিয়ে কখনো কেস সমাধানে যাবো না। কেননা সে মুন নয়”।
দীর্ঘ দিন পর মেয়েদের অসহ্যকর যন্ত্রণার সাক্ষী হতে হচ্ছে না তাকে। যন্ত্রণার কারন হতে হচ্ছে না তাকে। তাই মনেমনে হয়তো ‘চন্দ্রকুঠি’ খুশিতে নেঁচে উঠছে। ইট, পাথরের বাড়িটা তার খুশিটা প্রকাশ করতে পারছে না তাই তো প্রকৃতি তার খুশিকে নিজের করে নিলো। বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় তার আনন্দ ধরা দিলো। বৃষ্টির পানিতে মুছে যাচ্ছে ‘চন্দ্রকুঠির’ সকল পাপ। এভাবেই শেষ হলো ‘চন্দ্রকুঠির’ মেলা।
(সমাপ্ত)
অনেক দিন পর আসল গল্প পড়লাম,