#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১
গল্পের নাম: আমার ছেলে
Misk Al Maruf
পার্কের বেঞ্চে বসা অবস্থায় আকস্মাৎ সাত বছর বয়সী একটি ছেলে আমার পাশে এসে বসলো। আমি ছেলেটির দিকে একনজর তাকিয়ে ওর ভাব ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করলাম। দেখে মনে হলো ওর আবাসস্থলটা এই পথেঘাটেই হবে হয়তো কিন্তু ওর চেহারায় আলাদা একটা মায়াবী ভাব আছে। হয়তো এসব শিশুদের মায়াবী ভাবটা আমার চোখেই ধরা পরে কেননা গত পনেরো বছর অপেক্ষা করার পরও আমার বাবা হবার স্বপ্নটা এখনো ধোয়াশাই রয়ে গেল। সমস্যাটা আসলে আমার নয় বরং আমার স্ত্রী মিমির। একটি সন্তানের আশায় কতবার যে ডাক্তার আর কবিরাজের শরণাপন্ন হয়েছি তাঁর কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ফলাফল সেই শূণ্যই রয়ে গেল। আমার স্ত্রী একটি সন্তানের আশায় নিজেকে দোষী ভেবে প্রতিদিন রাতেই নিজেকে একান্তে নিয়ে কান্না করে। প্রথম প্রথম আমি মিমিকে অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে যথেষ্ট সান্ত্বনা দিলেও এখন আর ওকে সান্ত্বনা দেইনা। কারণ আমার ধারণা কান্না করলে মেয়েরা নিজের মনে জমে থাকা সমস্ত আক্ষেপ আর কষ্টকে প্রশমিত করতে পারে। হঠাৎই ছেলেটি আমাকে অনেকটা ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-আঙ্কেল, সকাল থেকে কিছু খাইনি যদি আমাকে কিছু খাবার কিনে দিতেন তাহলে খুব ভালো হতো।
ছেলেটির এহেন কথায় আমি কিছুটা অবাক হলাম কেননা সচরাচর কোনো পিতৃমাতৃহীন রাস্তার ছেলেগুলো এতোটা সাবলীল আর ভদ্রভাবে কারো নিকট কিছু চায়না বরং তাঁরা অনেকটা জোরপূর্বক পথচারীদের জামা আকড়ে ধরে সাহায্য চায়। ছেলেটির এরকম অসহায় অনুরোধ দেখে আমারও বেশ মায়া হলো তাই ওর কাছে ঘেঁসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-আসলেই কিছু খাওনি?
পুনরায় অনেকটা অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-না আঙ্কেল।
ওর ঐ মায়ামাখা মুখোবয়ব দেখে আমার একটুও বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো না যে ও আসলেই সত্য বলছে। তাই ওকে নিয়ে পার্কের বাহিরে থাকা একটি ছোটখাঁটো রেষ্টুরেন্টে বসে পরলাম। একটি টেবিলে বসতেই একজন ওয়েটার আমাদের দিকে এগিয়ে এসে পরক্ষণেই ছেলেটির দিকে তাকালো আর মুহূর্তেই ওয়েটার টির কপালখানি ক্ষানিকটা কুঁচকে গেলো বোধহয়। কারণ তাঁদের মতো একটি নামিদামী রেষ্টুরেন্টে এরকম একটি রাস্তার ছেলের উপস্থিতি কখনোই কাম্য নয়। তবুও ওর সাথে আমাকে দেখে তেমন কিছু বলার সাহস পেলোনা। আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-কী খাবে?
আমার কথা শুনে ও বললো,
-আঙ্কেল কিছু মনে না করলে মেন্যুটা আমাকে দিন আমি বলে দিচ্ছি।
-এখানেতো সব ইংরেজিতে লেখা আছে তুমি বুঝবেতো?
-হ্যাঁ আঙ্কেল বুঝবো।
আমি পুনরায় অবাক হলাম ওর কথা শুনে। তবুও ওর দিকে মেন্যুটা এগিয়ে দিলাম অনেকটা কৌতুহলের বসেই ঠিক এটা জানার জন্য যে ও আসলে আমাকে কী উত্তর দেয়। বেশ কিছুক্ষণ মেন্যুটা এদিক ওদিক উল্টানোর পর ছেলেটি আমার দিকে মেন্যুটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
-আঙ্কেল এগারো নম্বরের ফ্রাইড রাইস এন্ড এগটা অর্ডার করতে পারেন। এটার দাম সবগুলোর থেকে কম আছে।
আমি ওর কথা শুনে স্বভাবতই ওর দিকে কিছুক্ষণ অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলাম। একটি সাত বছরের বাচ্চা ছেলে কীভাবে এতোটা সাবলীল ভঙ্গিতে ইংরেজিতে লিখে রাখা খাবারের নাম আমাকে বলতে পারলো? আমার এই ভাবনায় ছেদ ঘটালো ওয়েটার। আমি বাস্তবে ফিরে ওয়েটারের দিকে একনজর তাকিয়ে পরক্ষণেই ছেলেটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম এবং বললাম,
-তুমি কম দামীটাই কেন পছন্দ করতে গেলে বলোতো?
-আঙ্কেল ওটাতেই আমার হবে। আর তাছাড়া আমি আপনার কাছে শুধু সামান্য কিছু খাবার চেয়েছিলাম নিজের ক্ষুধা মেটানোর জন্য কিন্তু আপনি আমাকে তাঁর থেকেও বড় জায়গাতে নিয়ে এসেছেন। আঙ্কেল আমার শুধু পেট ভরলেই চলবে আমি এর থেকে দামী খাবার চাইনা। আপনি আমাকে খাবার খাওয়াচ্ছেন এটাই অনেক, আমি চাইনা আপনার বেশি টাকা খরচ হোক।
ছেলেটির একনাগাড়ে কথাগুলো শুনে আমার চোখটা কোনো এক অজানা আনন্দে যেন ঝাপসা হয়ে এলো। একটা বাচ্চা ছেলে কতটা ভালো বুদ্ধিসম্পন্ন হলে এই ধরণের মনমানসিকতা নিয়ে কথা বলতে পারে? অথচ ওর মতো এরকম মানসিকতা আমাদের তেরো চৌদ্দ বছরেও তৈরি হয়নি। আমি ক্ষানিকটা খুশি হয়েই এগারো নম্বরের সাথে আরো তিনটা আইটেম অর্ডার করলাম। খাবারগুলো সামনে আসতেই ছেলেটি কীরকম যেন খেতে ইতঃস্তত ফিল করছিলো। ওর এহেন কান্ডে আমি বললাম,
-কী হলো? খাওয়া শুরু করো।
ও যেন আমার এই কথাটির জন্যই অপেক্ষা করছিলো। ওর খাওয়ার ভঙ্গিমা দেখে মনে হলো কয়েকদিন ধরে বোধহয় পেটে কিছু পরেনি এবং কতকাল ধরে যেন এসব খাবার ও মুখেও নেয়নি। আমি ওর খাবার খাওয়ার স্টাইল দেখে একনয়নে ওর নিষ্পাপ মুখখানার দিকে তাকিয়ে রইলাম আর ভাবতে লাগলাম প্রভু যদি আমাকে ওর মতোই একটি ছেলে দিতো তাহলে আমার আর মিমির কখনোই সুখের সীমা থাকতো না কিন্তু প্রভু তো আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে কোনো দিনই তাকালেন না। কিছুক্ষণ খাওয়ার অন্তর ছেলেটি আমার দিকে একনজর তাকিয়ে বেশ লজ্জা পেলো বোধহয়।
-আঙ্কেল আপনিও খান।
আমি ওর কথায় ক্ষানিকটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,
-আমার পেট ভরা আছে। এগুলো সব তোমার জন্যই। তুমি পেট ভরে খাও।
আমার কথা শুনে ছেলেটি আর কিছু বললোনা। কিন্তু আমার তখনো ওর পরিবার সম্পর্কে সবকিছু জানার চরম আগ্রহ মনে উঁকি দিচ্ছিলো।
.
রেষ্টুরেন্টের বিল দিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে আবার সেই পূর্বের পার্কের সেই বেঞ্চটিতে বসে পরলাম।
-আচ্ছা তোমার নামটাইতো জানা হলোনা।
-জ্বী আংকেল আমার নাম মুনিম। এটা আমার আম্মু রেখেছিলেন।
-ও। আচ্ছা তোমার বাবা মা কোথায় থাকে? আর তুমি এভাবে রাস্তাতেই বা থাকো কেন?
আমার কথাটি শুনে মুনিমের মুখখানিতে ক্ষানিকটা বিষাদের ছায়া ভর করলো বোধহয়। পরক্ষণেই বলে উঠলো,
-আমার আম্মু মারা গেছে আঙ্কেল। আর আমার আব্বুকে আমি কখনো দেখিনি। জানেন? আমার আম্মু সবসময় আমাকে বলতো কখনো কারো সাথে ঝগড়া করবিনা আর সবার সাথে ভালো ব্যবহার করবি। আমার অনেক পড়ালেখা করার ইচ্ছা ছিলো এমনকি আমি একটি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ালেখা করতাম কিন্তু আম্মু মারা যাবার পর স্কুলের বেতন দিতে না পারায় আমাকে তাঁরা বের করে দেয়। কেউ আমাকে ভালোবাসেনা আঙ্কেল আর কেউ আমাকে খাবারও দিতে চায়না।
এই বলেই মুনিম নিজের ডান হাত দিয়ে চোখ দুটো চেপে ধরে কান্না করে দিলো। ওর এরকম আবেগমাখা কথা শুনে আমার চোখদুটোও ক্ষানিকটা ভিজে এলো। আসলেইতো কেউ ওদের মতো ছেলেদেরকে ভালোবাসে না।
এভাবেই চলে যায় বেশকিছুদিন আর আমিও প্রতিদিন মুনিমের জন্য পার্কে বিভিন্ন খাবার নিয়ে চলে আসি।
.
আমাকে মূলত রাজশাহীতে অফিস থেকে পাঠানো হয়েছিলো কর্পোরেট শাখা পরিদর্শনের জন্য। আর বেশিদিন হয়তো এখানে থাকা হবেনা কারণ এখানের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ হতে চলেছে। আমার স্ত্রী মিমিকে আমি ফোনে প্রায়শই মুনিমের কথা বলি। আমার মুখে ছেলেটির এতো গুণগান শুনে স্বভাবতই মিমি মুনিমকে দেখার বায়না ধরে। আমিও আর না করিনি বরং সেদিন যখন মিমির সাথে ভিডিও কলে মুনিমের আলাপ করিয়ে দিলাম তখন ওদের কথোপকথন শুনে আমার মনে হচ্ছিলো মুনিম কোনো বাহিরের ছেলে নয় বরং ও মিমিরই জন্মগত কোনো সন্তান। আমি তখন বেশ খুশি হলেও হৃদয়ের গহীনে রক্ত ক্ষরণ হয়েছিলো এই ভেবে যে,
-আমিতো মুনিমকে কখনো নিজের সাথে নিয়ে যেতে পারবোনা কারণ ওকে নিয়ে গেলে সমাজের মানুষগুলো কটু মন্তব্যের তীর ছুড়তেও পিছপা হবেনা কখনো।
আমি জানতাম মিমির মনেও ঠিক এই কথাটিই ইলেক্ট্রনের ন্যায় ছোটাছুটি করতো তাই সেও মুখফুটে আমাকে কখনো বলেনি মুনিমকে সাথে নিয়ে আসতে।
গত দুদিন কর্পোরেট অফিসে কাজের চাপে আমি একদমই দেখা করতে পারিনি মুনিমের সাথে। এই দুদিন মিমি আমাকে ফোন দিয়ে বেশ করেই বলতো মুনিমের সাথে দেখা করতে যেতে কিন্তু সেভাবে ফ্রি সময়টা করে উঠতে পারিনি। বিকালে হঠাৎই আমার বাসার কেয়ারটেকার এর কল আসলো। কলটি রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে জানালো মিমি নাকি রাস্তা থেকে হেঁটে যাবার সময় এ্যাক্সিডেন্ট করেছে এমনকি হাসপাতালে নিয়ে আসার পরও জ্ঞান ফিরছে না। এই খবর শোনামাত্রই আমি আর একমুহূর্ত দেরী করিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে। কারণ দুনিয়ার যত কিছুই হয়ে যাক না কেন মিমিকে ছাড়া আমার আকাশটা বায়ুমন্ডলহীন এক নিকষ কালো অন্ধকারে রূপ নেয়। আমি বাসে ওঠার পর থেকে কিছুক্ষণ পরপরই কেয়ারটেকার জসিমকে কল দিয়ে জানার চেষ্টা করছিলাম মিমির জ্ঞান ফিরেছে কীনা। কিন্তু বরাবরই যখন ওর মুখে নাবোধক শব্দ শুনছিলাম তখন মনে হচ্ছিলো আমার হৃদয়ের অর্ধেকটা কেউ বোধহয় কেঁটে আলাদা করে দিচ্ছে। হঠাৎই অপরপাশ থেকে জসিমের কল পেয়ে হুড়মুড়িয়ে কলটি রিসিভ করতেই সে বলে উঠে,
-ভাইজান! আফার জ্ঞান ফিরছে। আপনের সাথে কথা কইবো।
এই বলেই সে মিমির দিকে কলটি এগিয়ে দিতেই আমি বললাম,
-মিমি, তুমি ঠিক আছোতো? শরীর কী খুব খারাপ লাগছে? আমি চলে আসছি আর কিছুক্ষণের মধ্যে।
মিমি অনেকটা ভাঙ্গা গলায় আমার কথার জবাব না দিয়ে বললো,
-তোমার সাথে মুনিম আসছেতো?
মিমির এই প্রশ্ন শুনে আমি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই আমি চোখে ক্ষানিকটা অশ্রু আর মুখে কিছুটা হাসি নিয়ে বললাম,
-হ্যাঁ মুনিম আমার সাথেই আছে।
এই বলেই কলটি কেঁটে দিয়ে দ্রুত বাসের হেলপারকে বললাম,
-ভাই আমাকে আবার রাজশাহীতে ব্যাক করতে হবে আমাকে এখানে নামিয়ে দিন।
.
পার্কে উপস্থিত হতেই দেখতে পাই আমি আর মুনিম যেই বেঞ্চটাতে বসে গল্প করতাম সেই বেঞ্চেই ও অনেকটা অসহায় আর নিষ্পাপ বাচ্চার ন্যায় ঘুমিয়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে ওর কপালে ক্ষানিকটা স্পর্শ করতেই ও জেগে উঠলো। আমাকে দেখেই মুনিম বলে উঠলো,
-আঙ্কেল, আপনি এই দুদিন কোথায় ছিলেন? জানেন? এই দুদিন আমি আপনার অপেক্ষায় এখানেই বসে ছিলাম আর রাতেও এখানেই ঘুমিয়েছি।
ওর কথা শুনে আমি নিজের অশ্রুবাধ আটকাতে না পেরে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
-তোমাকে আর কখনোই অপেক্ষা করতে হবেনা, বাবা। আর তোমাকে কখনো একাও থাকতে হবেনা। তোমাকে আমি একেবারের জন্যই নিয়ে যেতে এসেছি। তোমার মা তোমাকে দেখতে চায়, তিনি তোমার অপেক্ষায় আছে।…..
.
(সমাপ্ত)