গল্পের নাম:মুক্তির আলো – লেখিকা:ফাইজা হাবীব নীবুলা

0
708

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১
গল্পের নাম:মুক্তির আলো
লেখিকা:ফাইজা হাবীব নীবুলা
জনরা:সামাজিক
★সাল ১৯২৪, ১৪ই এপ্রিল,বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ।

সুখী মাঠের আল দিয়ে দৌড়ে আসছে বাড়ির দিকে।গুরুর কাছে সকালে ধর্মীয় পাঠ লাভের পর প্রতিদিন বন্ধুদের সাথে গ্রামবাসীর গাছপালার উপর হামলা চালাতে ব্যস্ত থাকলে আজ সে দৌড়ে যাচ্ছে মায়ের কাছে।বৈশাখী মেলার আয়োজনে পুরো গ্রাম যেন আজ নতুন বউয়ের মতো সেজেগুজে তৈরী।নতুন ধানের পায়েশের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশের বাতাস।সুখী তাই আরও তাড়াতাড়ি পা চালাতে শুরু করলো।বাড়িতে ফিরে মনের সব উচ্ছ্বাসগুলো যেন এক নিমিষেই কেউ এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিল।পুরো গ্রাম যেখানে উৎসব মানাতে ব্যস্ত সেখানে তাদের বাড়িটা যেন বিধবাবেশে দাঁড়িয়ে আছে।মা অন্যান্য দিনের মতোই বাড়ির কাজ করে চলেছে।আর আব্বাজীও তার হিসাবের খাতা নিয়ে সবসময়ের মতো ব্যস্ত।মা কে দেখেই সুখী দৌড়ে গেল,গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, মা আজ বৈশাখের আনন্দ আমরা করব না।মেলায় নানা রকম জিনিসের পসড়া বসেছে।আমরা মেলায় যাব কখন?
ছেলের কথা শুনে রত্না দেবীর হাত থেমে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে নির্বিকার চিত্তে বললো, আমরা আজ মেলায় যাব না!বৈশাখীর আনন্দ আমাদের জন্য না।কিন্তু সুখী মায়ের কথা মানলে তো।জিদ করতে লাগলো অনবরত।পুত্রের আর মায়ের বৎসা দেখে হিসাবের খাতা থেকে চোখ উঠিয়ে দেখলেন সুমেন্দার সিং, মায়ের পাঁচ আঙুলের দাগ তার কলিজার টুকরার গালে বসে গেছে।ছেলেকে মেরে মা প্রস্থান করলেও ছেলে চোখভরা টলটলে জল নিয়ে অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।
পুত্রকে দ্রুত বুকে টেনে নিলেন সুমেন্দার সিং,যে পুত্রের গায়ে কখনো ফুলের টোকা ও দেন নি তারা স্বামী স্ত্রী দুজন, সেই পুত্রর গালে লাল হয়ে থাকা পাঁচ আঙুলের দাগ তাকে বরই ব্যথিত করলো।পুত্রের মন ভালো করার জন্য পুত্রকে কাঁধে নিয়ে মেলার দিকে চললেন সুমেন্দার সিং।মেলা থেকে নানারকম মিঠাই কিনে দিয়েছেন পুত্রকে,চড়িয়েছেন নাগরদোলায় চড়িয়েছেন,দুই হাত ভর্তি করে খেলনা কিনে দিয়েছেন কিন্তু বাড়ি আসার আগে পুত্রের কাছে এক ওয়াদা চেয়েছেন।আর যেন কোনোদিন মায়ের কাছে বৈশাখী পালনের জিদ না করে,আর যেন বৈশাখী পালনের জন্য রাগ না করে সুখী।পিচ্চি সুখী বাবার কাছে ওয়াদা করে ঘুমিয়ে গেছে পথিমধ্যেই।সেই রাতে সুমেন্দার রত্নাদেবীর শয়নকক্ষে প্রথমবারের মতো পদার্পণ করে।বাইরের উত্তাল বৈশাখী ঝড়ের মধ্যে তাদের মধ্যে বিনিময় হওয়া শব্দগুলো দাফন হয়ে যায়।

★সাল ১৯৪০, ১৪ই এপ্রিল, বাংলা বর্ষের প্রথম দিন
অন্য সবার জন্য এ দিনটি অনেক আনন্দের হলেও সুখীর জন্য তা গতানুগতিক।ভারত মাতার সুযোগ্য সন্তান সে,ইংরেজরা গদি ছাড়বে বলে! গান্ধীজির ডাকে সারা দেশ উত্তাল।হিন্দু, মুসলমান,ধনী, গরিব,শিখ, বৌদ্ধ সবাই দলমত নির্বিশেষে একযোগে ইংরেজদের ভারত ছাড়ে বদ্ধ পরিকর।আর এখন তার কি বসে থাকার সময় আছে।আন্দোলন বেগবান করতে দেশের মা বোনেরা নিজেদের অর্থ গয়না আজাদীর মশালে আহুতি দিয়ে এর শিখা আর ও প্রজ্জ্বলিত করছে।তার মাও ব্যাতিক্রম নয়।রুপিয়া দিয়ে রত্নাদেবী নিজের কাজে ব্যস্ত হলেও সুখী খেয়াল করলো, আলমারী থেকে কিছু চিঠি আর একটা ছবি ডায়েরি থেকে গড়িয়ে পড়লো।
রুপিয়া গুলো পকেটে ভরে চিঠিগুলো গুছাতে বসলে কৌতুহল বশত তাতে চোখ বুলিয়ে স্থবির হয়ে বসে রইলো সুখী।

★সাল ১৯৪৮,১৪ই এপ্রিল, বাংলা নববর্ষ,১লা বৈশাখ

“আজ অনেক দিন পর ডায়েরি লিখছি।এই প্রথম আমাদের পরিবারে ১লা বৈশাখ পালন হবে।পহেলা বৈশাখ নিয়ে মায়ের এত বিতৃষ্ণার কারণ জানার পর আমারও আর ইচ্ছে করে নি মায়ের ক্ষতকে আরো দগদগে করে দিতে।পহেলা বৈশাখ নিয়ে মায়ের কষ্টের মূল কারণ পেয়েছিলাম চিঠিগুলোর ভেতরে।১৯১৯ সালে বৈশাখীর দিন মায়ের বিয়ে হবার কথা ছিল, কিন্তু জালিওয়ানবাগের সেই ভয়াবহ হত্যাকান্ড মাকে সধবা হবার আগেই বিধবা লাশে পরিণত করেছিল।সেদিন মা তার প্রেমাস্পদ আর হবু সন্তানের পিতার পাশাপাশি বড় ভাইস্বরূপ বন্ধুকেও হারিয়েছিল।একদিকে শোক আরেকদিকে লোকলজ্জ্বার ভয়।দুই বিপদে যখন মা দিশেহারা তখন আব্বুজী এসেছিল মায়ের জীবনে।বিগ্রেডিয়ার ডায়ার সেদিন কোন কারণ ছাড়াই নিরপরাধ মানুষগুলোর দিকে গুলি চালিয়েছিল।সমাবেশ আর তীর্থ যাত্রীদের মাঝে আমার পিতাও মারা গিয়েছিল।রাজনৈতিক সচেতন মানুষ তাই স্টেজের খুব কাছেই ছিল।গুলির প্রথম ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছিল,তার সাথেই হারিয়েছিল আমার মায়ের হাসি।কারফিউ এর জন্য সেই ময়দানে পড়ে থাকা লাশগুলোর দাহ সংস্কারের জন্য কেউ এগুতে পারে নি। সেই থেকে হয়েছিল অভিশপ্ত পহেলা বৈশাখ আমার মায়ের জন্য।সত্য জানতে পেরে সেই না দেখা পিতার জন্য যতটুকু কষ্ট লাগছিলো,তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছিলাম মায়ের এই নির্বাক কষ্ট দেখে।মায়ের কষ্ট উপশমের জন্যই আরো দুর্বার বেগে আজাদীর লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়ি।আজ দেশ স্বাধীন,মা ও স্বাধীন তার ভেতরের কষ্টগুলো।মুক্তি পেয়েছে মা তার বন্দীত্ব থেকে।”
এতটুকু লিখে ডায়েরি বন্ধ করে সুখী আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে ,মা রত্নাদেবী আর কন্যা রাণীর খুনসুটি দেখছে দু চোখ ভরে।সুমেন্দার ও বারান্দায় বসে দাদী নাতনীর এ চমৎকার সময় উপভোগ করছে আর সুখীর বউ ১লা বৈশাখ পালনের সমস্ত যোগাড় যন্ত্র করছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে