কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-৩৩+৩৪

0
543

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৩

রেজিস্ট্রি কাগজ, কলম, কাজী, স্বাক্ষী সব প্রস্তুত অথচ স্বাক্ষর করার মানুষটাই রাজী হচ্ছে না। নুপুরের বেডের পাশে প্রত্যেকটা মানুষ কত আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার হ্যাঁ শোনার জন্য। ঠিক প্রত্যেকে না, বৃষ্টি মনে মনে চাচ্ছিলো প্রত্যাক্ষান করুক নুপুর, রিদওয়ান অবশ্য নির্বিকার। অর্নিও বিকারহীন তবে নুপুরের ছোট মা একমাত্র মানুষ যিনি ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন কখন হবে সইসাবুদ কখন ঘাড় থেকে নামবে আপদ। ক্ষণকাল ব্যয় না করে অর্ণব কাজী সাহেবকে বলেছিলেন বিয়ে পড়ানো শুরু করুন। কাজী সাহেব শুরু করেছিলেন তখনই নুপুর বাঁধা দিলো। শারীরিক যন্ত্রণা এড়িয়ে খুব কঠোর কণ্ঠে জবাব দিলো তার বাবাকে, “এখন কেন! আমি নষ্ট হয়ে গেছি বলে সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাইছো না বাবা? এতদিন ভালো ছিলাম চাইলেই সমন্ধ জোগাড় করা যেত কিন্তু এখন আমাকে কয়েকজন মিলে ভোগ করেছে। শুনতে খারাপ লাগবে, নষ্ট করে দিয়েছে আমাকে তাই এখন ওই লোকের হাতে দিতে চাচ্ছো!”

‘ওই লোক’ বলে হাত উঁচিয়ে অর্ণবকে দেখালো নুপুর। বাবা নিশ্চুপ মাথা নিচু করে বসে আছেন মেয়েরই পাশে৷ নুপুরই আবার বলতে লাগল, “ইনি আগেও তো বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো, আমিও তাকে চাইতাম জানতে তবুও রাজী হওনি কারণ তার পরিবার সঠিক নয়, বাবা-মায়ের সম্পর্ক ঠিক ছিলো না আবার টাকা পয়সাতেও আমাদের চেয়ে অনেকটা উপরে। এখনও তো সে আগের মতই আছে তাহলে এখন কেন চাও? আর আপনি!”

এ পর্যায়ে কঠোর দৃষ্টি আর কঠিন কণ্ঠে অর্ণবকে উদ্দেশ্য করে ডেকে উঠলো নুপুর। সবাই চমকে তাকায় মেয়েটার দিকে৷ এইতো ঘন্টা কয়েক আগেই এই মেয়েটার অবস্থা ছিলো মৃত্যুসম। এখনও সে শরীর টেনে বসতে অপারগ, নিজের ভার বহনের শারীরিক শক্তিহীন অথচ মানসিক দিক থেকে ভীষণ কঠিন আছে এমনটাই উপস্থাপন করছে। প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করতেই যেন এবার সাধ্যমত চেঁচিয়ে উঠলো, ” আর আপনি কি করতে এসেছেন এখানে? উদ্ধার! উদ্ধার করতে এসেছেন আমাকে? উদ্ধার করবেন আমার কন্যা দায়গ্রস্ত বাবাকে! এতোটাই করুণা জেগেছে যে, বিয়ের আসরে বউকে ফেলে চলে এসেছেন! অনেক করেছেন প্লিজ এবার যান। আর কখনো আমার সামনে আসবেন না অনুরোধ রইলো।”

এইটুকু বলে হাঁপাতে লাগলো নুপুর। অর্নি তার অবস্থা দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো কাছে৷ নুপুর ধরতে দিলো না তাকে। আবারও বলল, “সবাই অনেক করেছেন আমার জন্য তা অনুমান করতে পারছি৷ এখন আর করতে হবে না চলে যান সবাই দয়া করে৷ আর বৃষ্টি আপু আমি জানি না আপনি এত উদারতা কেন দেখাচ্ছেন। আজ আপনার বিয়ে আপনি উনাকে নিয়ে বাড়ি যান আপনাদের বিয়ে সম্পন্ন করুন।”

-তোমার বলা শেষ হয়েছে?

অর্ণব গাঢ় স্বরে প্রশ্নটা করলো। সে কথার জবাবে নুপুর শুধু মুখ ফিরিয়ে বাবার মুখে তাকিয়ে রইলো। কিছুটা সময় মৌন রইলো প্রত্যেকেই৷ কাজী সাহেব বোধহয় মনে মনে অতিষ্ঠ বোধ করছিলেন এত সব নাটকে। তিনি কিছুটা মিনমিন করেই বলে বসলেন, “বাবাজী রাত তো বাড়তাছে আমি কি চইলা যাব?”

নুপুরের মামা ইশারা করলো, সবুর করেন একটু। আরও কিছু সময় সবাইকেই ধৈর্য্য ধরতে হলো তারপর খুব আচানক, অর্ণব কাজী সাহেবকে বলল, বিয়ে পড়ানো শুরু করেন কাজী সাহেব। কনের নাম নুপুর, বাবার নাম নাজিম, আমার নাম অর্ণব চৌধুরী, পিতা…. কাজী সাহেবসহ অন্যরাও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো অর্ণবের দিকে। কত উদগ্রীব একটা পুরুষ তার ভালোবাসার মানুষের জন্য হতে পারে! অথচ এই মানুষটাই নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করতে বর বেশে রওনা হয়েছিলো। অর্ণব ঠিক কোন জায়গাটাতে অধিকার পরায়ণ সে বোধটা সকলের নেই। অনেকে হয়তো ভাবছেন, এখন কেন এত ঢং বাপু! প্রথমে তো খুব ভাব দেখিয়েছিলে মেয়েটাকে অবহেলা করে৷ তারা বুঝবেন না এই ভগ্ন হৃদয়ের মানুষটার মানসিক শক্তি ঠিক কোন পরীক্ষাটা দিচ্ছিলো। সে চাইলেই পারতো শুরুতেই মেয়েটাকে নিজের করতে৷ তাতে কি কি লাভ হতো! নুপুর তার হতো কিন্তু নুপুরের সুখ আর স্বস্তি আটকে যেত তার বাবার অমতের মাঝেই। সে বাবা-মা’হীন জীবনে আরো একজনকে এনে ফেলে দিতো তার নিগূঢ় একাকীত্বে। এরপর সে বৃষ্টিকে বিয়ে করতে রাজী হলো ভেবেছিলো জীবনটাকে ব্যবসার মত উল্টেপাল্টে ব্যবহার করবে তাতেও বুঝতে পারলো চরম নির্বুদ্ধিতায় সে ভুল মানুষদের আপন ভেবেছে। যারা আপন হয়ে তাকে সাহায্য করছিলো প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থোদ্বার করতে তৎপর৷ হোক সেটা তার রক্তের মানুষ বড় দাদা আর তার নাতিরা কিংবা খালুজান। এরপর ভাবলো যা হোক ভালোবাসার মানুষের বিয়ে ঠিক হচ্ছে সে নিজে কোন দায়বদ্ধতায় না জড়ালে হয়ত মেয়েটাকে এড়াতে পারবে না। বৃষ্টির পক্ষ থেকেও জেদ অনড় তাই এখানেই এগোনো সমীচীন লেগেছে তার অন্তত দিনশেষে বৃষ্টি তাকে প্রত্যাশা অপূরণ থাকার দাবী নিয়ে সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে না। উপরওয়ালার লিখন তার ভাবনা থেকে অনেক ভিন্ন। তাইতো ঠিক সেই মুহূর্তটাতেই তার কানে পৌঁছুলো প্রিয় মানুষটার নিঃশেষ হওয়ার খবরটা। নিঃশেষ তো সেও হয়েছে সে মুহূর্তে আর তাইতো এখন আর সুযোগ ছাড়তে চাইছে না নিজেকে নতুন করে গড়িয়ে নিতে৷ কাজী সাহেব বিয়ের কাগজটা সামনে এগিয়ে নুপুরকে বলল, এইখানে সই করেন মা।

নুপুর ফিরে তাকালো না কারো দিকে। নুপুরের বাবা অসহায়ের মত চেয়ে আছেন মেয়ের দিকে। সত্যিই তিনি এখন নিজের প্রতি অসহ্যবোধ করছেন। এখানে যা হচ্ছে তা ঠিক না বেঠিক সে কথাও যেন বোধগম্য হচ্ছে না তাঁর।

-শুধু টিপসই চলবে? প্রশ্নটা অর্ণব কাজীকে করলেও উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার জানতে চাইলো কালি আছে? কাজী সাহেব এগিয়ে দিলেন ছোট্ট বক্সখানা। অর্ণব সবাইকে আরও বেশি অবাক করে দিয়ে নিজেই নুপুরের হাত টেনে জোর করে আঙ্গুল চেপে টিপছাপ নিয়ে নিলো। এরপর বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল, “নাটক যখন চলছে আরেকটু চলুক। সবাই ভাববেন কনে অশিক্ষিত নিজের নাম সই করতে পারে না তাই টিপছাপ দিয়েছে। এই নেন আমিও মূর্খ আমিও টিপসই দিছি। কবুল কবুল কবুল তিন কবুল। ওরটা বাকি রইলো যেদিন ওর মন বলবে আবার বিয়ে করবো শিক্ষিতের মত। স্বাক্ষীরাও কি টিপছাপ দিবেন?”
প্রশ্নটা ঠিক কার জন্য অর্ণব নিজেও জানে না। বৃষ্টি একটু দূরে দাঁড়িয়ে এক নজরে শুধু অর্ণবকে দেখে গেল। একটা মানুষ ঠিক কতোটা পাগল হলে এমনটা করে? এই যে বিয়েটা হলে আদৌও তা হলো কিনা কে জানে বৃষ্টি শুধু দেখলো এটা বিয়ে নয় নিজের প্রিয় মানুষটাকে ভঙ্গুর অবস্থায় নষ্ট এ সমাজে একা ছাড়তে চায় না বলে এসব করে গেল। নয়ত কাল অব্দিও সুস্থ প্রেয়সীকে সে পাওয়ার জন্য একটুও জোর করেনি৷ এই পুরুষটা চমৎকার প্রেমিক হতে পারবে না কখনও তবে সে ভয়ংকর এক প্রেমিক তা আজ প্রমাণ হয়েই গেল। পরিবেশ শীতল হয়ে গেল আর কিছুক্ষণের মাঝেই। রিদওয়ান বৃষ্টিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেও অর্নিতাকে পৌঁছে দিলো অর্নিতাদের বাড়িতে। নুপুরের বাবার জন্যও আলাদা এক কেবিন নিয়ে সেখানেই রইলো নাজিম সাহেব, স্ত্রী আর পুত্রসহ। নুপুরের মামা রাতেই চলে গেছেন কাজী সাহেবকে বিদায় করে। নুপুরের কেবিনে এখন শুধুই অর্ণব উপস্থিত। চোখ বুঁজে পড়ে আছে নুপুর হয়তো একটুপরই ডুবে যাবে ঘুমের অতলে। নার্স কিছুক্ষণ আগেই এসে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে গেছেন। চিৎকার, চেঁচামেচি করার দরুন প্রেশার ফল করেছে তার। ড্রিপ চলছে এখন তাই আলাদা খাবারের চিন্তাটা রইলো না। নুপুর এখনো ঘুমিয়ে পড়েনি তবুও চোখ খুলছে না। অর্ণবও বলছে না কিছু সে চুপচাপ বসে আছে বেডের পাশের চেয়ারটাতে। রাত বাজে এগারোটার উপরে আজ এখনো দাদীর কোন খোঁজ নেয়া হয়নি। রুজিনা খালার নম্বরেই করলো কলটা৷ খালা ফোন রিসিভ করে জানালেন দাদীর শরীরটা বেশি ভালো না আজ তাই দ্রুতই খাবার, ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেছেন। এরপরই অর্ণব কল দিলো রিদওয়ানকে৷ সে রিসিভ করেনি তবে কিছু মুহূর্ত বাদই ছোট্ট বার্তা পাঠালো, কোন কিছু নিয়ে টেনশন করিস না৷ সকালে কথা হবে।

মেসেজটা পাওয়ার পর টেনশন বেড়ে গেল। ও বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু ঠিক নেই। কিন্তু এখন কিছু করাও সম্ভব না। কাল সকালেই যা করার করতে হবে। নুপুরের দিকে আরেকবার তাকিয়ে এবার কল করলো অফিসার শরাফত এর কাছে। ভদ্রলোক যথেষ্ট ন্যায়পরায়ণ তা অল্প সময়েই আন্দাজ করা গেছে। ফোন নম্বরটাও অর্ণব তাই যেচে রেখে দিয়েছে কিছু জরুরি আলাপ এবার তাকে করতেই হবে৷ হঠাৎ কানে এলো ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। নুপুর কাঁদছে! কাঁদুক। সে বাঁধ সাধবে না৷ এ কান্নাটুকুই হোক তার ভেতরটাকে ধুয়ে ফেলার অস্ত্র৷ এরপর সব বর্ষার জলের মত ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে নতুন করে জমবে পলিমাটি। তৈরি হবে তার নুপুর তার একান্ত আপনজন। অর্ণব চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে কুঁজো হলো। আলতো ঠোঁটের স্পর্শ দিলো কপালে দু হাতে চেপে ধরলো নুপুরের কোমল দু হাত। নিঃশব্দে আশ্বাস দিলো ভয়হীন এক নতুন ভোরের।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৪

‘বিয়ে’ শব্দটা মানব জীবনে অতি পবিত্র অতি সুখকর এক ব্যাপার যদি তা হয় আপনজনদের আনন্দ, অনুমতি মিলিয়ে। অর্ণবের জীবনে সুখ বরাবরই ছিন্নমুকুল। সুখের লহরী একপাশ দিয়ে প্রবেশ করতেই দুঃখকূলও এসে জড়ো হয় জানান দেয় উপস্থিতি। আর তার বিয়ের ক্ষেত্রেও তাই প্রমানিত হলো। ভালো লাগা, ভালোবাসার মানুষটার সাথেই বিয়ে হলো সেই সাথে হলো কতগুলো আপনজনের সাথে বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের প্রথম নামটাই খালামনি৷ ভোরের আলো ফোটার পর খুব বেশি সময় অর্ণব হাসপাতালে থাকতে পারেনি৷ কাল অন্যায় তো বৃষ্টির সাথেও করেছিলো সে অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতেই আজ তার শর্ত মোতাবেক বৃষ্টির সাথে বিয়েটা সম্পূর্ণ করবে ভেবেছে। নুপুরের নাশতা, ঔষধ সেবন কমপ্লিট হতেই সে স্পষ্ট ভাষায় নুপুরকে অবগত করলো তার বৃষ্টিকে বিয়ে করার কথা। শুনতে হাস্যকর লাগছিল বটে তবুও বলতে হলো। নুপুর নিশ্চুপ তার সকল কথার জবাবে৷ অর্ণব বুঝতে পারলো নুপুর তার সাথে কথা বলবে না। হয়তো অনুভূতিও হারিয়ে গেছে কিছু বলার, বোঝার কিন্তু অর্ণব আর করবেটাই বা কি! তবুও যাওয়ার আগে রাতের মত আরেকটিবার ঠোঁট ছোঁয়ালো শ্যামাঙ্গীনির ললাটে৷ ফিসফিসানি স্বরে বলে গেল, “তোমার অধিকার এক বিন্দু পরিমাণও হরণ হবে না অন্যকারো অনুপ্রবেশের কারণে। আসছি।”

কেবিন ছেড়ে অর্ণব বেরিয়ে যেতেই চোখ খুলল নুপুর। চোখের কার্নিশ গড়িয়ে পড়ল তপ্ত জল।
_______

বাশার শেখের চেকআপ করতে ভোর বেলাতেই হাজির হয়েছেন ডক্টর আশরাফ। বন্ধুমানুষ আশরাফ কালও উপস্থিত ছিলেন এ বাড়িতে তাই বাড়ির পরিস্থিতি সবই তার নখদর্পনে। বন্ধুর ঔষধ পত্র চেক করে প্রেশারের ঔষধটা বদলে দিলেন সেই সাথে যুক্ত করলেন নার্ভ শীতল রাখার ঔষধ। বাশার শেখ বসে আছেন নিজ কক্ষে ডিভানে হেলান দিয়ে। আশরাফ বুঝতে পারলেন এভাবে বন্ধুর উচ্চরক্তচাপ আপাতত ঠিক হবে না তাই তিনি ভাবলেন অন্য কাজ করতে হবে।

-সকালে আমার ওয়াক, ব্রেকফাস্ট কিছুই হয়নি তোর জন্য ।

-হ্যাঁ! ওহহহ ভুলে গেছিলাম আমি… দাঁড়া তোর ভাবীকে বলছি নাশতা দিতে।

বাশার শেখ ব্যস্ত হলেন নাশতার জন্য। আশরাফ তা দেখে বলল, মর্নিং ওয়াক তারপর পানি এরপর নাশতা খেতে হয় নইলে এই বুড়ো শরীরে ঝামেলা পাকিয়ে যায়। তুই চল নাশতার কথা বলে আয়, তোর বাড়িতেই একটু হাঁটি।

বাশার শেখ বুঝলেন বন্ধু মূলত তাকেই হাঁটার কথা বলছেন। উঠলেন দু বন্ধুতে। কাজের বুয়াকে নাশতার কথা বলে দুজনে হাঁটছেন বাড়ির বাগানের ভেতর।

-বৃষ্টির বয়স কত?

– তেইশ চলছে।

-পড়াশোনাও তো শেষ হয়নি তাই না!

-হু।

-আমাদের বৃষ্টি মামনি দেখতে মাশাআল্লাহ, শিক্ষিতা, বাপেরও অবস্থা দুনিয়া জানে। তবুও কেন তুই যেচে অর্ণবকেই বাছাই করলি যখন তোর জানা ছেলেটা অন্য কাউকে পছন্দ করে!

বাশার শেখ চুপ করে আছেন। সত্যি বলতে জবাব দেয়ার মত মুখ নেই তাঁর এখন। বন্ধুকে সত্যিটা বলা সম্ভব না। শুধু মেয়ে পছন্দ করে বলে নয় অর্ণবের অর্থ, সম্পদ আর ছেলেটা নিজের সম্পদের একচ্ছত্র উত্তরাধিকার সে একাই তাই মেয়ের সংসারে কথা বলার বাড়তি লোক থাকবে না এসব চিন্তা করেই তিনি পেছনে পড়েছিলেন। এক কথায়, লোভ পেয়ে বসেছিলো তাই আর তাই অর্ণব ছাড়া কিছু বুঝতে চাচ্ছিলেন না। বন্ধুকে এসব বলে নিজেকে লোভী প্রমাণ করার মত লোক বাশার শেখ নন। তিনি ছোট্ট জবাব দিলেন, মেয়ের ভালোবাসা ওই হারামজাদা তাই চেয়েছিলাম।

আশরাফ মুচকি হাসলেন। তিনি চেনেন তার বন্ধুকে তাই জবাবটা হাস্যকর লাগলো। যে লোক প্রচুর বিত্তশালী এক মন্ত্রীর ডিভোর্সি মেয়ের সাথে পুত্রের অমতেই বিয়ে ঠিক করতে পারে সে শুধু ভালোবাসা দেখে মেয়ে বিয়ে দেবে!

আশরাফ আবারও বলেন, “তাই বলে সব জেনেও?”
বাশার শেখ জবাব দেন না।

-তোর প্রেশার এবং হার্টের অবস্থা কোনটাই সুস্থ নেই। কন্যার সুন্দর একটা গতি না করে দুনিয়া ছেড়ে শান্তিও পাবি না তাই অর্থের পেছনে না ছুটে এখন একটু স্বাস্থ্যের পেছনে ছুট আর হ্যা নিয়মিত দু বেলা হাটাহাটি কর কিছুদিন। সুস্বাদু হয়ে মেয়ের জন্য ভালো দেখে আবার পাত্র খোঁজ আমরাও খুঁজব। বৃষ্টি মামনির জন্য তার যোগ্য পাত্রের কমতি হবে না।

আশরাফ আরও কিছুক্ষণ কথা বলে বাশার শেখকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। দুজনে নাশতা করে একসাথে বেরিয়েছেন বাড়ি থেকে। অর্ণব যখন শেখ বাড়িতে পা দিলো তখন বাড়িতে শুধু বৃষ্টি, রায়না আর রিদওয়ানই ছিল উপস্থিত। অর্ণব বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দারোয়ান একটু কেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকায়, কাজের বুয়া আর বাগানের মালির দৃষ্টিও একই। অর্ণব বুঝতে পারে তার আজকের উপস্থিতি সকলের জন্যই আশ্চর্যজনক। কোনদিকে পাত্তা না দিয়ে সে সোজা চলে যায় খালামনির ঘরের সামনে।

-খালামনি ঘরে আছো?

রায়নার শরীরের হাল একদিনেই বেহাল হয়ে আছে। কাল থেকেই বিছানা ছেড়ে উঠার শক্তি হারিয়ে বসেছেন। রাতে বাশার শেখও অসুস্থ থাকায় দুজন দু কামরায় ছিলেন। রিমন বাবার পাশে আর রায়না মেয়ের ঘরে থাকায় রাত থেকে বৃষ্টি খেয়াল রাখছে তার মায়ের। অর্ণব বার কয়েক ডাকার পরও যখন রায়নার জবাব পেলো না তখন পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো। ঘরটা খালি! এবার দু পা এগিয়ে গেল রিমনের ঘরের সামনে৷ দরজা ভেজানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভেতরে কেউ নেই৷ করিডোরের রেলিংয়ে ঝুঁকে আবারও নিচে তাকালো। এখান থেকে বসারঘর সংলগ্ন রান্নাঘরের দরজা চোখে পড়ে। একজন কাজের লোককে দেখা গেল।

-খালামনি কোথায়?

মহিলা অর্ণবকে দেখেই কপাল কুঁচকে ফেলল। তবুও জবাব দিলো, বৃষ্টি আপার ঘরে আছে।

অর্ণব আর কোন কথা না বলে সোজা হেঁটে গেল রিদওয়ানের পরের ঘরটাতে। দরজায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে বোধহয় সাহস জোগালো কিছুটা। এরপরই ক্ষীণ স্বরে বলল, “খালামনি!”

রায়না বার তিনেক অর্ণবের ডাক শুনলেন তবুও জবাব দিলেন না৷ বৃষ্টি ঘুমাচ্ছিলো পাশেই সে জেগে গেল। মায়ের দিকে তাকাতেই বুঝলো মা কথা বলতে চান না অর্ণব ভাইয়ের সাথে। কিন্তু কথা না বলে মা’ও যে কষ্ট পাবে তা বৃষ্টি খুব জানে। আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টিকারক অর্ণব নয় বৃষ্টি নিজেই তাও সে জানে। অর্ণব বরাবরই তাকে সতর্ক করে এসেছে সে আবেগে ডুবে বাস্তবতাকে হারিয়ে দিতে চেয়েছিলো। আবেগে সে দ্বিতীয়বারের মত নিজের সাথেই খেলল। এবারের খেলাটা হয়ত বেশিই হয়ে গেছে তাইতো আজ তার পরিবারের বিধ্বস্ত অবস্থা। চতুর্থবারের মত অর্ণবের ডাক কানে আসতেই বৃষ্টি শোয়া থেকে উঠে বসে৷

-অর্ণব ভাই ভেতরে এসো।

রায়না মেয়ের দিকে তাকায়৷ বৃষ্টি নির্লিপ্ত চোখে দরজায় দৃষ্টি রাখে৷ কালকের পরিধেয় পোশাকে এলোমেলো অবস্থা অর্ণবের।

-খালামনি, আমাকে মাফ করে দাও… বলতে বলতেই অর্ণব এসে বসে রায়নার মাথার কাছে। রায়না তাকায় না তার চোখের কোণ ভিজে গেছে। অর্ণব হাত বাড়িয়ে খালামনির হাত ধরে। দু হাতের পাতায় মায়ের সমান খালামনির কোমল হাতটা চেপে ধরে কৈফিয়ত দেবার মত করেই বলে, “কাল যখন ফোনটা ধরলাম তখন শুধু কানে এলো নুপুরকে কে বা কারা রেপ করেছে। বিশ্বাস করো খালামনি ওই কথাটা অফিসার যে কয়েক সেকেন্ডে বলেছে ঠিক সেই কয়েক সেকেন্ডই আমার দম বন্ধ হয়েছিল৷ সে যেদিন কিডন্যাপ হলো সেদিন সেই মুহূর্তে ও কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়েছিলো আমার সামনে থেকে। আমি কাঁদিয়েছিলাম সেদিন আর তারপরই ওর এই অবস্থা! আমার শুধু মনে হচ্ছিল ওকে আমি শেষ দেখাও দেখতে পারবো না বিশ্বাস করো খালামনি আমি তোমাদেরও অসম্মান ক……..

অর্ণবের বাক্য পূর্ণ হওয়ার আগেই রায়না উঠে বসেন। বা হাতটা অর্ণবের মুঠোয় তিনি ডান হাতটা উঠিয়ে ঠাস করে বসিয়ে দেন অর্ণবের গালে। ঘটনার আকষ্মিকতায় বৃষ্টি চমকে মাকে ডাকে, আম্মু! এরপর পুরো ঘর নিস্তব্ধতায় ডুবে রইলো কিছু সময়৷ অর্ণব ঠায় বসে আছে বৃষ্টিও তাই৷ শুধু রায়না কাঁদলেন কিছুক্ষণ।

-“তোর বাবা নেই মা থেকেও নেই। নিজের তিন সন্তান থাকা সত্ত্বেও নিঃসন্তান মানুষদের মত আগলে রেখেছি তোকে আর অর্নিকে। শ্বশুর বাড়ির প্রায় প্রতিটা মানুষের মুখে হাজারটা কথা শুনেছি বোনের ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নিয়েছি বলে এমনকি যে মানুষটার সংসার করি সে মানুষটা সংসার ছাড়া করবে বলার পরও তোদের ছাড়িনি। তুই একা থাকতে পারবি ততটুকু বড় ছিলি তাই তোকে তোর দাদীর কাছে রেখে অর্নিকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছি। তোকে দূরে রাখলেও তোর যত্ন, তোর দায়িত্ব দূর থেকেই পালন করেছি। হ্যাঁ হয়তো তোর বেলায় ঠিক মা হয়ে উঠতে পারিনি কিন্তু কিছু তো করেছিলাম৷ কি করে পারলি আমাকে এভাবে ঠকাতে! আমার মেয়েটার জীবন নিয়ে খেলার অধিকার কে দিয়েছে তোকে?”

সারাজীবন নিঃশব্দে সবার দায়িত্ব পালন করা মানুষটা, সবার জন্য স্নেহের ঝুড়ি উপুর করা মানুষটা আজ অভিযোগ করছে। অর্ণব জবাব দিতে পারছে না। কি বলবে সে, খালামনি তোমার মেয়ের জেদের জন্যই সে কষ্ট পেয়েছে এটা বলবে? নাকি বলবে আমার প্রিয় মানুষটাকে ভুলতেই শেষ বার তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলাম৷ কার দোষ দেবে সে। সে কি জানতো বিয়ের দিন এমন কিছু হবে! অর্ণব তো নিজের মনকে শক্ত পাথর করে তবেই এসেছিলো। পারল না শেষ পর্যন্ত শক্ত থাকতে৷ ছোট্ট একটা সংবাদ তাকে পাথর থেকে কেমন গলিয়ে তরল করে দিলো। অর্ণবের নীরবতা যেন এবার রাগিয়ে দিলো রায়নাকে। সে হাত টেনে ছাড়িয়ে নিলো অর্ণবের হাত থেকে।

-আমার সামনে থেকে চলে যা তুই। আর কখনো তোর ছায়াও যেন আমার সামনে না পড়ে।

-এমন কথা বলো না খালামনি৷ তুমি তো আমার মা….

-আমি রিমন, রিদওয়ান আর বৃষ্টির মা, অর্নির শ্বাশুড়ি , তোর কেউ না।

-আমাকে মাফ করে দাও খালামনি৷ আমি বৃষ্টিকে বিয়ে করব তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিও না। আমার জন্য তুমি আমার, অর্নিতার মা৷ প্লিজ খালামনি…

অর্ণব এবার রায়নার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সে কিছুতেই সরবে না খালামনির রাগ না ভাঙিয়ে। তার তো এ জগতে মা বলতে এই মানুষটাই আছে৷ রায়না অবিচল বসে আছে৷ ছুঁয়ে দেখছে না পায়ে পড়ে থাকা ছেলেটার দিকে। তবে বৃষ্টি এবার মুখ খুলল কিছু বলার জন্য।

-তোমার বিয়ে হয়েই গেছে অর্ণব ভাই৷ আমাকে বিয়ে করে আর উদ্ধার করতে হবে না। কালকের রেজিস্ট্রি পেপার যেটাতে আমি সাইন করেছিলাম তা কালই বাতিল করা হয়েছিলো। তোমার ফিরে যাও নিশ্চিন্ত মনে। আর হ্যাঁ আম্মু যা বলল মনে রেখো কখনো এসো না আমাদের সামনে।

খানিকটা গাঢ়, খানিকটা কড়া শোনালো বৃষ্টির কণ্ঠস্বর। অর্ণব সেদিকে পাত্তা দিলো না সে পা পেঁচিয়ে ধরে আছে খালামনির। রায়না বিরক্ত হচ্ছেন এমনটাই বোঝাতে যেন পা থেকে ধাক্কা মেরে সরালেন অর্ণবকে। বিছানা থেকে নেমে টেনে ধরলেন অর্ণবের হাত। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে অর্ণবকে তিনি ঘর থেকে বের করে দরজা আটকে বিছানায় বসে পড়লেন আবার৷ দরজার ওপাশ থেকে অর্ণব সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, আমাকে মাফ করে দাও খালামনি। প্লিজ ক্ষমা করো।

-চলে যেতে বলেছি তোকে। আজকের পর তোর ছায়াটাও দেখতে চাই না আমি৷

-এভাবে বোলো না খালামনি তবে যে আমি হারিয়ে যাব। আমি এতিম তোমার স্নেহও হারিয়ে ফেললে কিভাবে বাঁচব বলো?

-তুই এতিম কে বলল? মনের মত বউ পেয়েছিস, শ্বশুর শ্বাশুড়িও নিশ্চয়ই হয়েছে।

-আমার সাথে এত কঠিন হইয়ো না খালামনি নইলে যে আমি হারিয়ে যাব সত্যিই কোথাও হারিয়ে যাব আমি।

________

নুপুর আছে হাসপাতালের তিন তলায়। অর্ণবের দাদীর ডক্টর বসেন নিচতলায়। অর্নিতা দাদীকে নিয়ে ডাক্তার দেখানোর পরপরই দাদী বললেন, নুপুররে দেখতে চাই।

হাঁটুর ব্যথায় তিনি বাড়িতে দোতলার সিঁড়িই বেয়ে চলেন না আর এখানে তৃতীয় তলায় কি কডে যাবেন? হাসপাতালে এলিভেটর থাকলেও তিনি তাতে চড়তে পারেন না দমবন্ধ অবস্থা হয়। কিন্তু নুপুরকেও যে দেখতে চাইছেন এখন৷ অর্নিতা ভেবেছিলো রিদওয়ান
কে ফোন করে বলবে যেন একটু আসে৷ কল করে জানা গেল রিদওয়ান তার মাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গেছে অন্য হাসপাতালে। অর্নি ভাবলো দাদীকে বলবে আজ নয় কাল ভাইয়ার সাথে এসে না হয় দেখবে অথবা বাড়িতে নেওয়ার পর। কাল রাতের ঘটনা সে আজ সকালেই দাদীকে একটু একটু করে বলেছে। অসুস্থতার মাঝেও দাদী যেন একটু স্বস্তি পেলেন অর্ণবের বিয়ের কথা শুনে। বয়স হয়েছে সেই সাথে আজকাল রোগভোগও বেড়েছে খুব। ইদানীং প্রায় স্বপ্নে স্বামীকে দেখেন সেই থেকে ধারণা তিনিও আর বেশিদিন বাঁচবেন না। এ অবস্থায় অর্ণবকে কোথাও স্থির দেখতে চান। আর আজ এত ঝামেলার পর অর্ণব তার চাওয়া মানুষটাকেই পেয়েছে বলেই বোধহয় তিনি স্বস্তি বোধ করছেন। অর্নিতা বাড়ি ফিরবে বলে দাদীকে নিয়ে গেইটের কছে যেতেই দেখে অর্ণব এসে ঢুকছে। দাদীর ইচ্ছের কথা জানালে সে আর দেরি করে না। পাঁজাকোলে করে সিঁড়ি বেয়ে তুলে নেয় দাদীকে তিনতলায়৷ পেছন পেছন দাদীর লাঠি হাতে এগিয়ে চলে অর্নিতা৷

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে