কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২৭

0
449

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৭(ক)

যাকে ভালোবেসে কখনো ছুঁয়ে দেখার অধিকার নেই তাকেই রাগে-ক্রোধে থাপ্পড় বসিয়েছে। বয়সের ফারাকটাও তখন মাথায় আসেনি এতোটাই ছিল রাগের মাত্রা অথচ বাড়ি ফেরার পর থেকেই মনটা পুড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা ফোন করে একটি বার মাফ চেয়ে নেয়া উচিত না! পরক্ষণেই মনে হলো কিসের উচিত, ভালোবেসে যে ভালোবাসার মানুষকে আপন করতে জানে না তার মত কাপুরুষ, নির্বোধকে শুধু থাপ্পড় নয় ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত। রাগের বশে এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই রাতটা পার হলো নুপুরের। বাবা সে রাতে ব্যস্ততার জন্য বাড়ি ফিরেছেন অনেক রাতে তাই চেয়েও মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। সকাল হতেই নাশতা শেষে নুপুরের ঘরে এলেন। আজ ভার্সিটিতে যাবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে।

-কাল কোথায় গিয়েছিলি?

ভারী গম্ভীর শোনালো বাবার কণ্ঠস্বর। এর আগে কখনো এমন স্বরে কথা বলেননি তিনি।

– একটা টিউশনি….

-একদম মিথ্যে বলবি না আমার সাথে। আমি নিজে দেখেছি তোকে কলেজ রোডে এক ছেলের বাইকে উঠতে।

চমকে গেল নুপুর বাবার কথা শুনে। বাবা দেখে ফেলেছে তাকে!

-সত্যি করে বল কোথায় গিয়েছিলি? ছেলেটা কে সেটাও আমার অজানা নয়। বান্ধবীর ভাইয়ের সাথে ভর দুপুরে বাইকে চেপে গেলি ফিরে এলি সন্ধ্যার পর। তোর কি মনে হয় তোকে কেউ চিনবে না, কিছু বলবে না!

বাবার কথাগুলো শুনেই হাত পা জমে যাচ্ছে নুপুরের। কি জবাব দেবে সে! তার জবাব বাবার পক্ষ থেকেই এলো, ‘আজকের পর কোনরকম যোগাযোগ যেন না থাকে ওই ছেলের সাথে। এমনকি তার বোনের সাথেও দরকার নেই। পড়ালেখা অনেক করেছিস আর লাগবে না। বাড়ির কাজকর্ম শিখে নে আমি শিগ্রই তোর বিয়ে দেব।’

নাজিম সাহেব নিজের বক্তব্য শুনিয়ে চলে গেলেন মেয়ের ঘর থেকে। মেয়েকে যখন দেখলেন ওই ছেলের বাইকের পেছনে বসতে তখন না চমকালেও এক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন অতি শিগগিরই মেয়ের বিয়ে দেবেন। ছেলেটাকে চেনার পর থেকে যথেষ্ট ভালো লাগতো। তাদের পরিবারের খবর খুব বেশি না জানলেও মেয়ের সখ্যতার জন্যই কিছুটা খোঁজখবর রাখতেন সেই সুবাদেই কিছুটা জানা। এই ছেলের মা-বাবার সম্পর্ক ভালো ছিলো না মূলত বাবার পরনারী আসক্তি, নেশাপানি করা এসবেই মা বাবা আলাদা হলো৷ দুটো ভাইবোন তারা একজন বড় হলো খালার বাড়ি আবার বিয়ে হলো সেই খালারই ছেলের সাথে বিয়ে। কথা ছিল অন্য খালার ছেলের সাথে বিয়ে হবে। সব মিলিয়ে তাদের পরিবারে কিছুই ঠিক মনে হয়নি নাজিম সাহেবের তবুও মায়া হতো অর্নি মেয়েটার জন্য তাই নিজের মেয়েকে তেমন নিষেধাজ্ঞা দেননি মিশতে। নিজেই বরং স্নেহের চোখে দেখে এসেছেন তাদের ভাইবোনকে তাই বলে অমন পরিবার ছাড়া ঘরে মেয়ে দেবেন তাও আবার টাকার দিক থেকে নিজের চেয়ে অনেক উপরের ঘরে অসম্ভব! মনে মনে সাজিয়ে নিলেন কিছু কথা। কালই একবার ওই ছেলের সাথে কথা বলে মনের সংশয় দূর করবেন। পরের দিন সকাল বেলায় কড়া গলায় মেয়েকে আরেকবার বলে গেলেন বাড়ি থেকে বের না হতে এমনকি ফোনে ফোনেই টিউশনগুলোও ছাড়তে বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন নাজিম সাহেব। নুপুর খেয়াল করলো আজ বৃহস্পতিবার, বাবা আজ ঘরের রংমিস্ত্রি খবর দিয়েছিলেন বাড়ি রঙ করাবেন বলে৷ অথচ সকাল হতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন কাউকে কিছু না বলে। এমন সময় ছোট মা এলেন ঘরে।

-তোমার আব্বা কই গেলো সকাল সকাল?

নুপুর অবাক হলো ভীষণ। বাবা ওনাকেও বলেনি কোথায় যাচ্ছে!

-আমাকে তো কিছু বলেনি।

-মিছা কথা কও ক্যা! কালকা ঘরের ভিতর ফুসুরফাসুর তো শুনলাম বাপ মাইয়ার। তারপরই দেখলাম ঘটকরে ফোন দিলো আবার কয়েকদিন ধইরা বাড়ি রঙ করব বলতাছিলো। কি আকাম করছো সত্যি কইরা কও তো মাইয়া। হইছো কাইল্লা তারমধ্যে আকাম করলে বিয়া তো দূর মাইনষে থুতু দিতেও আইবো না। হুহ…

হঠাৎ বৃষ্টির মত কেমন ঝপাঝপ কতগুলো নোংরা ইঙ্গিতসহ বাক্য বাণ ছুঁড়ে দিলো ছোট মা। বাবা কি কালকের কথাগুলো উনাকেও বলেছে! ছিহ, এমনই কেন হতে হবে সৎমায়েদের। খায়, পরে বাবার তার অধিকার আছে তবুও এমন কেন বলতে হয় সৎমায়ের! অর্ণবের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোই কেমন বিষছোবল দিচ্ছিলো কাল সেই সাথে বাবার সন্দেহ। সবকিছুতেই এবার বিতৃষ্ণা এসে যাচ্ছে তার। চোখ মুখ বুঁজে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে পড়ে রইলো নুপুর। সব দোষ ওই জল্লাদমুখো মানুষটার। কি হতো যদি তাদের দেখা না হতো! পরমুহূর্তেই ভাবনায় এলো ওই মানুষটা একদমই দোষী নয়। অনাহূত দোষ চাপানো অন্যায় হচ্ছে তার। লোকটা কখনোই তাকে প্রশ্রয় দেয়নি এমনকি তার আগে কখনো তাকে নিয়ে ভাবতেই চায়নি৷ শুরুটা তো সে নিজেই করেছিলো দুনিয়ার সর্বোচ্চ বেহায়া মেয়েটি হয়ে। হ্যাঁ সে নিজেই বেহায়া হয়েছে উল্টো অর্ণব তাকে সতর্কতার সাথে এড়িয়ে গেছে অনেক অনেকটা দিন। দু চোখ ডুবলো এবার জলধারায়। সময় বোঝাবে তাকে বেহায়াপনার শাস্তি৷

_________

বরের আদুরে সান্নিধ্যে মেয়েরা হয় প্রস্ফুটিত পুষ্প। অর্নিতাও হয়েছিলো একরাতের অর্ধেকটা। এরপরের সকালেই সে আবার মূর্ছা গেল একমাত্র ভাইয়ের বিরহ ভাবনায়। সকাল হতেই আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো গত দিনের দূর্ভাবনা কোনো না কোনোভাবে তাকে ঘিরেই যা সংগঠিত হয়ে আছে। ভাই তার যতই অস্বীকার করুক সে তো জানে তার বিয়ে নিয়ে খালুজান কতোটা নাখোশ! সে এও জানে রিদওয়ানের সাথে তার বিয়ে হয়েছে বলেই কয়েক’শ কোটি টাকার অসীম এক লোকসান গুনতে হয়েছে খালুজানকে। দাদী বলতো যার যত আছে তার ততই চাই। খালুজান কতবড় ব্যবসায়ী, তাঁর টাকার পরিমাণ কেমন আর এ দেশের ঠিক কত বড় ধনীর কাতারে তিনি সে আন্দাজ অর্নিতার ছোট থেকেই আছে। যে মানুষটা দেশ ছেড়ে বিদেশেও সফল ব্যবসায় পরিচালনা করতে জানে, যিনি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অপ্রকাশিত রাজত্ব করতে পারছেন অর্থের জোরে তিনি অবশ্যই নিজের সন্তানের জন্যও সেই মাপের কোন পরিবার খুঁজবেন সেটাই স্বাভাবিক। অর্নিতা এও জেনেছে খালুজানের এই স্বাভাবিকতা শুধুমাত্র দুই ছেলের ক্ষেত্রেই, মেয়ের বেলায় তিনি সম্পূর্ণ আবেগী এক পিতা। কন্যাস্নেহে অন্ধত্বের শেষটায় আছেন খালু তাই রিদওয়ানের পছন্দে খুশি হননি। আগেই তো প্রস্তাব যেচে এসেছিলো রিদওয়ানের জন্য দেশের প্রথম সারির ধনাঢ্য পরিবারের পক্ষ থেকে। সেই প্রস্তাব পায়ে ঠেলে ছেলে যখন নিজের বাড়িতে আশ্রিতা খালাতো বোনকে বিয়ে করতে চায় বাবা হয়ে তিনি তা কি করে সহ্য করতেন! তাইতো একটি বছরের মাঝে একবারও পুত্রবধূ ঘরে তোলার মনোভাব ব্যক্ত করেননি। অথচ যেই জানতে পারলো মেয়ে পছন্দ করে বসে আছে অর্ণব ভাইকে অমনি মনে পড়ে গেল ছেলে আর তার বিয়ের কথা! আজব লাগলেও এটাই সত্যি অর্নিতা, রিদওয়ান এখন বাশার শেখের ছোট্ট প্রয়োজন এর বেশি কিছু নয়। ঘুম থেকেই উঠেই কান্নাকাটি শুরু করলেও হঠাৎই কান্না থেমে গেল অর্নিতার। কাতরমুখে তাকে জড়িয়ে পাশে বসে থাকা রিদওয়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতেই কানে এলো অস্বস্তিকর কথা,

-তুমি চলে যাও এখান থেকে। আজকের পর আমাদকোন সম্পর্ক থাকবে না আর।

-এসব কি বলছিস অর্নি!

হকচকিয়ে গেছে রিদওয়ান। অর্নিতার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?

-ঠিকই বলছি। সরো তুমি আমার কাছে আসার দরকার নেই আর। তুমি তোমার বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করো গে যাও৷ আমি আমার ভাইকে একটুও কষ্ট পেতে দেবো না।

বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ আর মূক হয়ে গেছে রিদওয়ান। কি বলছে অর্নি! সর্বদা সল্পবাক থাকা অর্নি এক নাগাড়ে উদ্বাস্তুর মতো কি বলে চলছে এসব যেন কিছুই মাথায় ঢুকলো না রিদওয়ানের।

-আমার কথা শোন অর্নি। তুই ভয় পাচ্ছিস কেন বলতো আমি আছি তো…

কথাগুলো বলতে বলতে দু হাতের মাঝে রিদওয়ান জড়িয়ে নিতে চাইলো অর্নিকে। সেদিকে পাত্তা দিলো না অর্নি। সে রিদওয়ানকে ঠেলে সরিয়ে দিলো নিজের কাছ থেকে। রাতের বিবসনা দেহে ওড়না পেঁচিয়ে এগিয়ে গেল বেডসাইড টেবিলের সামনে। ওই তো ওখানেই আছে বার্থ কন্ট্রোল পিল ট্যাবলেট রিদওয়ানই কাল এনে দিয়েছিলো। সেটা হাতে নিয়ে ট্যাবলেটটা মুখে পুরে পাশেই রাখা বোতল থেকে পানি দিয়ে গিলো ফেলল। দ্রুত পায়ে ছুটে গেল বাথরুমে মুহূর্তেই আবার বেরিয়ে এলো। চঞ্চল হাতে ব্যাগ থেকে জামা বের করে আবারও ঢুকে গেল সে বাথরুমে। গোসল সেরে বেরিয়ে যাবে এখান থেকে আজ এক্ষুনি। রিদওয়ান তখনো হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে বাথরুমের দরজার দিকে। কি হচ্ছে এসব, কেন হচ্ছে কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না। মিনিট দশেকে বেরিয়ে এলো অর্নিতা৷ মাথা মোছা হয়নি চুল বেয়ে পানি পড়ছে, মুখে, চোখে কান্নার ছাপ স্পষ্ট। জামা পরেছে উল্টো আবার ওড়নাটাও নিয়েছে অন্য জামার। সে আর কোন দিকে না তাকিয়ে নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে দরজায় এগোলো। সেদিকে চলতি পথেই রিদওয়ানকে বলল, ‘আজকের পর আর কেউ নই আমরা দুজন দুজনার। তুমি বাড়ি ফিরে যাও তোমার বাবার কাছে। বিয়ে করে নিও ওই নাদিয়াকে।’

চমকে উঠলো রিদওয়ান। নাদিয়া! বিদ্যুৎ বেগে হুঁশ ফিরলো যেন তার। নাদিরার কথা অর্নিকে কে বলল৷ এবার খেয়াল হলো অর্নিতা বেরিয়ে যাচ্ছে৷ দুপদাপ পা ফেলে খপ করে ধরলো অর্নিতার হাত। জাপটে ধরলো বুকের মাঝে, এ্যাই অর্নি কি বলছিস এগুলো মাথা ঠিক আছে তোর! ওই মেয়েকে কেন বিয়ে করব আমি এসব কে বলেছে তোকে?

অর্নিতা জবাব দিলো না রিদওয়ানের কথার। সে রিদওয়ানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতেই আবার বলতে থাকলো, ‘আমি এতিম হয়েও সব পেয়েছি জীবনে। খালামনির কাছে মায়ের আদর, খালুজান দিয়েছিলো বাবার স্নেহ রিমন ভাই আর বৃষ্টি আপুর মাধ্যমে ভাই-বোনের সঙ্গ পেয়েছি তোমার কাছেও পেয়েছি জীবনসঙ্গির সর্বোচ্চ মুহূর্তগুলো৷ কিন্তু আমার ভাই….’

এ পর্যায়ে কান্নার দমক বেড়ে গেল অর্নির৷ নিজেকক ছাড়ানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে রিদওয়ানকেই আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো৷ অস্পষ্ট উচ্চারণে বলে গেল সে, আমার ভাই পায়নি বাবা-মা আর একমাত্র বোনটাকে। নিজের জীবনের ক্রান্তিলগ্নে লড়াই করেছে একাকীত্বের সাথে তবুও শক্ত প্রাচীরের ন্যায় অটল দাঁড়িয়ে ছিল আমার দায়িত্ব, দাদাীর দায়িত্ব পালনের জন্য। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই ব্যবসার পেছনে পরিশ্রম দিয়ে গেছে যেন এই আমাকে প্রয়োজনের সবটা নিজ অর্থে দিতে পারে। আজও আমার জন্যই নিজের খুশি বিসর্জনের জন্য পা বাড়াচ্ছে এটা আমি মেনে নেব? অসম্ভব। তুমি ফিরে যাও বাড়িতে। আমি বুঝতে পারছি খালুজান নিশ্চয়ই আমার নাম করেই জোর করছে ভাইয়াকে৷ বৃষ্টি আপু অনেক ভালো মেয়ে কিন্তু আমার ভাই তাকে ভালোবাসতে পারবে না।’

দম আঁটকে যেন উগরে দিচ্ছে সকল দুঃখ, যন্ত্রণা। রিদওয়ান চুপচাপ শুনে গেল অর্ধাঙ্গিনীর সকল ক্ষোভ, লুকানো কষ্টের ঢালি উল্টে দিলো সবটা ঢেলে। এই মেয়ে এত কথা কি করে বলছে! জীবনের সকল জমানো কথাই কি বলে দিচ্ছে অর্নি? মেয়েটাকে শান্ত করার কোনো উপায়ই যেন খুঁজে পাচ্ছে না রিদওয়ান। বাধ্য হয়েই অর্নিকে একহাতে জড়িয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয় অন্যহাতে ডায়াল করে অর্ণবের নম্বর। কয়েক সেকেন্ডেই তা রিসিভ হয় ওপাশ থেকে। অর্নি তখনও একাধারে বলে চলছে, আমার ভাইকে কষ্ট দিলে আমি এ জীবনে আর কখনোই খালুজানের সাথে কথা বলবো না। তুমি চলে যাও এখান থেকে আমি আমার ভাইকে এবার আর দুঃখে দেখতে চাই না। ছাড়ো আমাকে…..

অর্ণবের কানে পৌঁছে গেছে বোনের হাহাকার ভরা আর্তনাদ। বুকের ঠিক ভেতরটায় গিয়ে লাগলো সে আঘাত। ওর খুশির জন্য জীবন দিতে ভাববে না অর্ণব সেখানে বৃষ্টিকে বিয়ে করা তো দুধভাত। অথচ বোনটাই দেখো কি অস্থির হয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছে তার কথা শুনে। কে বলেছে তার জীবনে কারো আদর,স্নেহের কমতি আছে। তার জীবন তো পরিপূর্ণ বোন আর দাদীর ভালোবাসায়। কল কেটে আবার কল দিলো অর্ণব। রিদওয়ান ধরতেই অর্ণব বলল, ফোনটা অর্নির কানে ধর। তাই করলো রিদওয়ান। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল নিশ্চুপ কিছু শুনছে ভাইয়ের কাছ থেকে তারপরই কান্না থামিয়ে চুপ হয়ে গেল। রিদওয়ান জানে না কি এমন বলল তার ভাই যা শুনে সব কান্না মিলিয়ে গেল এমন করে।

_____________
অর্ণবের সাথে নুপুরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আগেও খুব ছিল তেমন নয় তবুও কিছু ছোট বার্তা, কিছু আবেগ প্রকাশিত হতো ফোনকলেও। আজ এক সপ্তাহ হয় সেই ছোট্ট যোগাযোগটাও নেই। হয়তো হয়ে যেত কিছুটা তা একেবারেই বন্ধ হলো দু দিন আগে নুপুরের বাবার কথা শুনে। অর্ণব তখন অফিসের জন্যই বের হচ্ছিলো। বাইকে স্টার্ট করে গলির মোড়ে যেতেই চোখের কোণে ভেসে এলো কারো হাতের ইশারা। ততক্ষণে বাইক টেনে চলে গেছে অনেকটাই দূর। চেনা প্রতিচ্ছবি দেখেছে মনে হতেই সে বাইক থামায় পুনরায় ফিরে আসে পেছনে৷ দেখতে পায় দু বার দেখা মুখটা। সালাম জানিয়ে সামনে দাঁড়াতেই মানুষটা জানায় কিছু কথা আছে তার সাথে। অর্ণব সম্মতি জানিয়ে বাইকে বসতে বলে। দুজন এসে বসে বাড়ি থেকে অনেকটাই দূর নির্জন এক জায়গায়। ঘনবসতিপূর্ণ এ শহরে খুঁজলে এখনো পাওয়া যায় একটু আধটু কোলাহলমুক্ত পরিবেশ। তা অতিসামান্যই বটে; তেমনই এক জায়গায় মুখোমুখি দাঁড়ানো দুজন মানুষ৷ সময় ক্ষণ ব্যয় না করে নাজিম সাহেবই মুখ খুললেন প্রথমে।

-আমি বাবা কিছু কথা বলতে ও জানতে এসেছি তোমার কাছে।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় অর্ণব৷ নাজিম সাহেব তা বুঝতে পেরে আবার বললেন, আমার মেয়ে আর তোমার মধ্যে কি কোনরকম সম্প……

আর বলার দরকার পড়লো না অর্ণব নিজেই এবার জবাব দিলো, না আঙ্কেল। কিছু নেই হয়তো হতো কিন্তু হয়নি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আপনার মেয়েকে নিয়ে।

-গত সপ্তাহে ভর দুপুরে তোমার বাইকে করে গেল।

-কিছু কথার বলার ছিল তাকে। বলে দিয়েছি আমি স্পষ্ট করে সেও নিশ্চয়ই বুঝে গেছে। এখন আর ভয় নেই যা নিয়ে আপনি অস্থির হবেন।

মুখে কিছুটা হাসি টানার বৃথা চেষ্টা করেই জবাব দিলো অর্ণব। নাজিম সাহেব তাতে আশ্বস্ত হলেন কিনা বোঝা গেল না৷ তিনি যেন আরেকটু দৃঢ়ভাবে কোন কিছু শোনায় অপেক্ষায় ছিলেন৷ শেষমুহুর্তে চলে যাবেন ভেবে পা বাড়াতে গিয়েও আবার থামলেন। জানানোর উদ্দেশ্যেই যেন আবার বললেন, ‘আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করছি আমি৷ পাত্র দেখা হয়ে গেছে মেয়েও পছন্দ তাদের শুক্রবারে এলেই হয়তো আংটি পরাবে৷ তাই বলছিলাম কি যদি কোন যোগাযোগ থেকেও থাকে তার সমাপ্তি টেনো।’

কথাটা বলে আর একটুও দাঁড়াননি নুপুরের বাবা। অর্ণব মাথা নিচু করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো৷ একটা বাবা মেয়ের সুখের কথা ভেবে এসেছেন তাকে মেয়ের থেকে তাকে দূরে থাকার অনুরোধ করতে। আরেকজন বাবা মেয়ের সুখে তাকে সকাল দুপুর হুমকি, ধমকি দেয় মেয়ের সাথে তাকে জুড়ে দিতে। কি আশ্চর্য! দুজনেই মেয়ের বাবা অথচ দুজনের চাওয়ায় আকাশ-পাতাল ব্যবধান। আচ্ছা তার নিজের বাবা বেঁচে থাকলে কি অর্নির সুখ নিয়ে আগে ভাবতো না! অবশ্যই, তার বাবাও নিশ্চয়ই অর্নির সুখের কথা ভাবতো কিন্তু তার বাবা নেই। হঠাৎই মনে হলো বাবা নেই তো কি হয়েছে অর্নির ভাই তো আছে। সে করবে সব বাবার মত করেই। খালুজানের হুমকি ধমকিকে ঠিক পায়ে মাড়িয়ে দিয়েই যেন সে খালুকে ফোন করে মুখের ওপর বিয়ের প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করলো। অর্নির সুখ রিদওয়ানের পাশে থাকা। জীবনসঙ্গীর চেয়ে বেশি সুখ আর কেউ দিতে পারবে না তার বোনকে। মনে মনে ছক কষে নিলো সে। অর্নিকে এ দেশেই রাখবে না৷ ডাক্তারি পড়া সে দেশের বাইরে থেকেও পড়তে পারবে৷ চট্টগ্রাম যাবে সে দ্রুতই তারপর খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করতে পারবে। রিদওয়ানও তো বিদেশেই থাকছে, দুজনে না হয় নিজেদের সেদিকেই গুছিয়ে নেবে৷ আর রইলো তার বিয়ে নিয়ে কথা! নুপুরের বাবাকে আজই ফোন করে প্রস্তাব রাখবে সে। জীবন তো একটাই, এক জীবনে সুখটাই যদি না পায় তবে বেঁচে থাকা কিসের আশায়!

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৭(খ)

মহাকালের গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া প্রাণ কি কখনো পুন:স্পন্দিত হয়! অর্ণব এমন এক প্রাণের পরিচয় যার জন্মই হয়েছে অতলে হারিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার গুছিয়ে রাখা পরিকল্পনা উল্টে গেল হাওয়ার মত। ইচ্ছাকৃত নয় তবুও একটা কথা আছে, লাইফ ইজ সো আনপ্রেডিক্টেবল। তা-ই যেন প্রতিদিন একটু একটু করে জেনে আসছে অর্ণব। গতরাতের মধ্যেই সে বোনকে, রিদওয়ানকে এমনকি খালুজানকেও জানিয়ে দিয়েছিল বৃষ্টিকে বিয়েটা সে করছে না। বৃষ্টি আর অর্নির মাঝে পার্থক্যটা সে কখনোই করেনি তাই তার প্রতি তেমন কোন অনুভূতি নেই যা নিয়ে একটা সংসার সাজানো যায়। আর তারপরও যদি তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে নিতে আরও কোন গভীর কারণ চাই তবে সহজ ভাষায় বলা যায় সে একজনকে ভালোবাসে। বিয়ে যদি করতেই হয় সেই মেয়েটিকেই করবে এবং কালই মেয়েটির বাড়িতে সে বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাবে। মেয়েটি ‘কে’ সে কথা অর্ণবের বলতে হয় না বৃষ্টি নিজেই সর্বসম্মুখে জানিয়ে দিয়েছিল, মেয়েটি নিশ্চয়ই অর্নিতার সেই কালো করে বান্ধবীটি! অর্ণব সায় জানিয়ে বৃষ্টিকে বলেছিল, ‘ভুল বুঝিস না বোন আমি চাই তুই সুখী থাক। সেই সুখ তুই আমার কাছে পাবি না বিশ্বাস কর।

-বিশ্বাসের আশ্বাস তোমায় দিতে হবে না অর্ণব ভাই। আমি জানি আমি কিসে সুখী হব। তুমি ছাড়া আমি আর কাউকে বিয়ে করবো না কক্ষনোও না।

এরপর আর মুখ খোলেনি বৃষ্টি৷ সে উঠে চলে গেল বাবা আর অর্ণব ভাইয়ের আলোচনার থেকে। সেখানে উপস্থিত ছিল রিমন আর তার মা রায়নাও। আলোচনা বলতে অর্ণব চেয়েছিল নিজের দিক পরিষ্কার করে বৃষ্টিকে মানিয়ে বুঝিয়ে নিতে। তা আর হলো না তখন। তবুও অর্ণব দায় কাটাতেই অত বিস্তারিত বলে খালার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিল৷ মনে মনে ঠিক পণ করেই বেরিয়ছিল বোঝাপড়ার সময় এখানেই সমাপ্তি৷ এরপর যা ঘটবে সবটাই তার ইচ্ছানুরূপ আর শ্যামাঙ্গীনির মতাদর্শে। রাতটা সে জোরপূর্বকই ভালো ঘুমে কাটাতে চাইলো। ঘুম কি কারো ইচ্ছের ধার ধারে! এক্ষেত্রে জবাব হবে অবশ্যই না। অর্ণবেরও ইচ্ছে কাজে দিলো না। রাতভর অফিসের টুকরো কিছু কাজ করেই কাটিয়ে ভোরে উঠে দাদীর ঘরে গেল সে। ফজরের ওয়াক্ত শুরু হয়েছে আরও আধঘন্টা আগে। দাদীরও সালাত আদায় শেষে এখন চলছে দোয়া-জিকিরের সময়। তিনি তসবীহ হাতে সবেই কাৎ হয়ে শুয়েছিলেন বিছানায় তখনই দরজায় করাঘাত।

-অর্ণব!

-হ্যাঁ, আসবো?

-আয়।

মুখে ‘আয়’ বললেও মনে মনে বলছিলেন আসিস না ভাই৷ তোর মনে যা চলছে তা নিয়ে কথা বলতে ভয় হয় পাছে অর্নির সংসারটা না ভেসে যায়!

অর্ণব ঘরে প্রবেশ করেই তাকালো জানালার দিকে। রুজিনা খালা ঘরে নেই তাি হয়তো জানা খোলা হয়নি। নামাজ শেষে রান্নাঘরে যাওয়ার আগে রোজ জানালা খুলে দেয় খালা। দাদীর নাকি এ সময়টা বাইরে থেকে আসা ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস ভালো লাগে খুব৷ দাদা বেঁচে থাকার সময়টায় তারা স্বামী-স্ত্রীতে নামাজ শেষে বাইরে বাগানের একপাশে চেয়ার বিছিয়ে সময় কাটাতেন। দাদী নিশ্চয়ই মিস করেন সেই সময় আর সঙ্গীকে! বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। এ জীবনে একাকীত্ব ঘুচাতে জীবনসঙ্গীর বিকল্প আসলেই আর কিছুই নেই। দাদীর পায়ের কাছে খাটের ওপর বসতে বসতেই অর্ণব পকেট থেকে ফোন বের করলো।

-অর্নির সাথে কবে থেকে কথা হয় না তোমার?

-তোকে না বলছিলাম আপনি কইরা বলবি আমায়।

-বলি তো মাঝেমধ্যে।

-সবসময় বলবি।

-হুটহাট কি যে হয় তোমার! হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল অর্ণব। দাদী মাঝেমাঝেই এমন করে। কোন ব্যাপারে আপসেট থাকলে অর্ণবের সম্মোধন নিয়ে কথা শোনাবে। কারণে, অকারণে রুজিনা খালাকে বকাঝকা করবে এমনকি গেইটের দারোয়ানকে ডেকেও বকাবকি করতে ভোলে না। আজও বোধহয় তেমনই কিছু হবে কিন্তু অর্ণবকে দমে গেলে চলবে না। সে তুমি,আপনির সম্মোধন এড়িয়ে সরাসরি বলল, ‘আজ নুপুরদের বাড়ি যাব দাদী বিকেলে তৈরি থেকো।’

_______
বিকেল বললেও অর্ণবরা রওনা হলো দুপুরের খাবারের পরপরই। দাদী নিজেই তাড়া দিলেন তাড়াতাড়ি যাবেন বলে। অর্ণবও আর দেরি না করে তৈরি হলো। আজ বাইক নয় দাদী যাবেন তাই উবার কল করেছে সে। আজ হঠাৎই মনে হলো গাড়ি এবার একটা কেনা দরকার। প্রায় দু তিন বছর ধরেই ম্যানেজার আঙ্কেল জোর করছিলেন একটা গাড়ির জন্য। একটা কোম্পানির মালিক বাইকে করে বিভিন্ন মিটিং, পার্টিতে উপস্থিত হয় এটা নাকি দৃষ্টিকটু। ইমেজ রক্ষা করে চলা জরুরি তাই কেনা প্রয়োজন। দাদী আর অর্নি অবশ্য এ ব্যাপারে তাকে ডিমোটিভেট করে গেছে সর্বদা। তাদের গাড়ি লাগে না, অর্ণবও বাইকে কমফোর্ট বেশি সে হিসেবে গাড়ি আর ড্রাইভার খরচটা অযথাই৷ কিন্তু আজ হুট করেই মাথায় এলো বিয়ের দিন বউ আনতে কি ভাড়ার গাড়ি নিয়ে যাবে! দ্যা ইংয়গেস্ট বিজনেসম্যান অর্ণব চৌধুরীর নিজের একটা গাড়ি নেই? হাস্যকর! উবার এলেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে দাদীকে নিয়ে রওনা হলো শ্যামাঙ্গিনীর বাড়িরতে। পথে অবশ্য দাদী তাকে দিয়ে মিষ্টি আর পান সুপারি কিনিয়েছিল। মনমতো কথাবার্তা যদি এগিয়ে যায় তখন একেবারে সময় নিয়ে আকদ করে তবেই বাড়ি ফিরবেন বৃদ্ধা এমনই মনস্তাপে পা বাড়িয়েছেন পাত্রীর বাড়িতে। এ খবরটা অর্ণবেরও অজানা৷ আপনজনদের সাথে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে আজ তিনি ঘটা করে নাতির জন্য পাত্রী দেখতে আসতেন। বড় ভাসুর আর তার ছেলে,পুলে, বউ আর অর্ণবের খালা, মামাদেরও ডেকে নিতেন। কিন্তু আফসোস, দু দিককার কোন আত্মীয়ই তাদের জন্য মঙ্গলকর হয়ে পাশে নেই তাই আজ শুধু নাতিকে নিয়েই চলে এলেন। গাড়ি এসে থামলো নাজিম সাহেবের বাড়ির সামনে। সদ্য রঙে ঝলমলে বাড়ির সামনে লোহার গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলো অর্ণব তার দাদীকে নিয়ে। বাড়ির সামনে খানিকটা আঙিনা একপাশে বড় একটা বরই গাছ, পাশাপাশি কতগুলো আম গাছ। কিছুটা সামনেই একতলা রঙিন দালান। দালানের মূল দরজায় লোহার কেঁচি গেইট আধখোলা।চোখে পড়ছে সেখানটায় অনেকগুলো নতুন জুতোজোড়া। বাড়িতে পরার মত নয় সেই জুতোগুলো দেখেই আন্দাজ করা যায় বাড়িতে হয়তো মেহমান এসেছে। অর্ণবের এবার অস্বস্তি হচ্ছে খুব। ভুল সময়ে এলো নাতো! একহাতে পান, মিষ্টির অনেকগুলো প্যাকেট অন্যহাতে দাদীকে আগলে রাখা। আচমকাই অর্ণবের বেশ ওজন অনুভূত হলো হাতের প্যাকেট আর দাদীকে ধরে রাখাটা। ধীর পায়ে দরজার কাছটায় দাঁড়ায় সে৷ দাদী এবার আওয়াজ তুলে ডেকে উঠলেন, নুপুর! দিদিভাই বাড়িতে আছো?

প্রথম ডাকে কারো সাড়া পাওয়া গেল না। দ্বিতীয়বার আওয়াজ তুলতেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন নাজিম সাহেব। পেছন পেছন এলো তার স্ত্রী আর ছোট্ট ছেলে তুতনও। দরজায় দাঁড়ানো অর্ণবকে দেখেই ভড়কে গেলেন নাজিম সাহেব। মুখ খুলে কিছু বলার আগেই দাদী আবার বলে বসলেন, ‘অসময়ে এসে পড়লাম বাবা কিছু মনে করো না বাবা। এটা কি বউমা? মা একটু ধরোতো আমাকে।’

বৃদ্ধা আপনমনে একেকজনকে একেক কথা বলে চলছেন অথচ একটিবার ভালো করে তাকালে দেখতে পেতেন নাজিম সাহেবের মুখটা কেমন থমথমে। নাজিমের স্ত্রী বৃদ্ধাকে না চিনলেও কথা শুনে আগে বৃদ্ধাকে ধরে ঘরে আনলেন। লম্বাটে ঘরগুলোর ঠিক মাঝখানের ঘরটাই বসারঘর আর সেখানটায় বসে আছে কিছু মেহমান। তাদের পাশেই মাথায় ওড়না টেনে বসে আছে নুপুর। সদর দরজা থেকেই তা চোখে পড়েছে অর্ণবের। সে এক মুহূর্তের জন্যও পলক ফেলেনি নতজানু হওয়া মুখটা থেকে কিন্তু নাজিম সাহেব কিছুটা তাড়া দিয়ে অর্ণব আর দাদীকে পাঠিয়ে দিলেন নুপুরের ঘরটাতে। তাদের শোবার ঘরটাতেও মেহমান দুজন মহিলা বসেছে বিধায় নুপুরের খালি ঘরটাতেই তাদের বসাতে হলো। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও যখন কারো হদিশ মিললো না তখন দাদীই মুখ খুললেন, ‘কিরে দাদাভাই কেউ তো আর এলোনা এখানে। মনে হলো সামনের ঘরে কিছু মানুষ দেখছি৷ ভুল সময় আসলাম নাতো!’

দাদীর মনোভাব যা অর্ণবেরও ঠিক তেমনই হতো যদি না কাল নুপুরের বাবার সাথে সাক্ষাতে নেতিবাচক কথা হতো৷ কিন্তু এই মুহূর্তে মন বলছে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করছে। আর নুপুর! সে ওখানে ওভাবে কেন বসে আছে?
ভাবনার প্রসার ঘটার আগেই এ ঘরে উপস্থিত হলেন নুপুরের মা৷ অর্ণব জানে নুপুরের সৎ মা আছেন। মহিলাটির আচরণ কেমন তা ন জানলে এ মুহূর্তে তার হাতের ট্রে দেখে মনে হলো আন্তরিকই হবেন।

-বসেন চাচী, পরিচয় তো এখনো ঠিকঠাক পাইলাম না তবুও এট্টু শরবত খান।

দাদী আর অর্ণব দুজনেই যেন অবাক হলো মহিলার কথায়। মুখের ওপর কেউ এভাবে বলতে পারে! তারা অবশ্য প্রতিক্রিয়া দেখানোর পূর্বেই মহিলা আবার বললেন, বাড়িতে এমনিতেই মেহোমানে ভরা। পাত্রপক্ষ না গেলে এদিকে নজর দিতে পারতাছি না। তা আপনেরা কি দুপুরে খাইয়া আসছেন?

মুখের ওপর কথাগুলো বেশ লাগছে দাদীর। অর্ণবের শীতল দৃষ্টি প্রচণ্ড ক্রুর হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। নাতিকে ভালো করেই জানেন বলে দ্রুত হাত চেপে ধরলেন দাদী। যার অর্থ সামলে যাও ভাই।

-না না খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না তোমার। তুমি শুধু এইটুক কও পাত্রপক্ষ কার জন্য আসছে?

-কার আবার আমার সৎ মাইয়ার বিয়ে ঠিক করতাছে৷

-দিন তারিখ পাকা হইছে?

-না সবে তো আংটি দিল। আগামী সপ্তায় আমরা যাইয়া ঠিক করব।

‘আংটি দিল! আংটি বদল হয়ে গেল নুপুরের? এত তাড়া! কই অর্ণব তো কত বিগ্রহ এড়িয়ে এখনো নিজেকে একান্ত তার করবে বলে এত দূর এলো।’ আচমকা রাগের উত্তরণ হয়ে গেল। এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে নজর আটকালো রিডিং টেবিলের ওপর মোটা একটি বইয়ে। বইয়ের সামনের দিকে আচর কেটে বাঁকা করে ‘N’ তার সাথে সংযুক্ত ‘A’ লেখা। স্পষ্ট চোখে পড়ার মত যুক্ত সে অক্ষর। তার কোন কথাতেই কান নেই যেন সব মনোযোগ আটকে আছে বইয়ের সেই অংশে। মেয়েটা কেমন ভালোবাসতো তাকে? পাগলের মত! নাহ পাগলকেও হার মানায় তো। অর্ণবের ইচ্ছে করলো বইটা একটু ছুঁয়ে দেখতে৷ সে সত্যিই এগিয়ে গেল টেবিলের সামনে। দাদী আর নুপুরের সৎ মায়ের কোন কথাই আর প্রবেশ করলো না তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে। হাত বাড়িয়ে ছু্ঁয়ে দিল বইটা পরমুহূর্তেই দৃষ্টিতে কাড়লো খোলা বইয়ের পাতা যেন, তার জন্যই খুলে রেখেছিল কেউ। নজর বুলিয়ে আরও যেন হতবিহ্বল হয়ে পড়লো অর্ণব৷ কি চমৎকার হাতের লেখায় বইয়ের পাতার ওপর স্পষ্ট করে লেখা, আমার জল্লাদমশাই। পাশেই আঁকা গোঁফসহ একটি অবয়ব। কেমন পাগল মেয়ে একাডেমিক বইয়ের পাতায় এসব লেখা! নুপুর কি জানতো সে আসবে আর তা জেনেই কি এভাবে বইটা খুলে রেখেছে! সদা সতর্ক, চৌকশ মানব অর্ণব আজ কতোটা বেখেয়ালি সে নিজেই জানে না। দাদীর অনবরত ডাক তাকে ঘোর থেকে টেনে আনলো বাস্তবে।

– অর্ণব.. দাদাভাই আমার, ফিরা যাওয়া দরকার।

দাদী খুব থেমে থেমে রুদ্ধশ্বাসে বাক্য সম্পন্ন করলো। অর্ণব শুনলো তবুও বুঝলো না যেন দাদীর কথা৷ সে কেমন বোকার মত চেয়ে রইলো শুধু। দাদী এবার এগিয়ে এসে নাতির হাত ধরলেন৷

-চলো ভাই। আর এইখানে কাম নাই আমাগো।

-নাহ দাদী। আমি একটু কথা বলে যেতে চাই আঙ্কেলের সাথে৷

-দেখো ভাই মাইয়া মানুষের দোষ অনেক হয়৷ আজকা যা পরিস্থিতি তাতে কারো দোষ নাই কিন্তু আমরা যদি এহন নুপুরের বাপেরে ডাকি, কথা কই পাশেই যেই মেহমান আইছে তাদের মনে সন্দেহ হইতে পারে। আর কোন কথা বাজলে মাইয়াটা বদনাম হইবো।

অর্ণব যেন বুঝলো দাদীর কথা সে চুপ রইলো কিন্তু কথা না বলে ফিরে যেতে নারাজ। হলোও তাই, বিকেল অব্দি তারা বসে রইলো নুপুরের ঘরে। এরই মাঝে নুপুরের আংটি বদল হলো, মিষ্টি মুখ হলো তারপর যখন নুপুরকে বসার ঘর থেকে বের করা হলো তার বাবা তাকে নিজের ঘরে আসতে বাঁধা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো ছাদে।ঘুণাক্ষরে সে জানতে পারলো না তার একান্ত কামরাটিতে ঘন্টার পর ঘন্টা তারই মনপুরুষটি বসে আছে। নিয়তির ঘটা করে ছড়িয়ে দেওয়া বিষাদ সে পায়ে মাড়িয়ে উদাস বেলা কাটিয়ে দিলো ছাদের কার্নিশে বসে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে