কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২৬

0
500

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৬ (ক)

রাত বাড়ছে সাথে বাড়ছে প্রকৃতির চাপা গর্জনরূপী ঝড়ো হাওয়া। সন্ধ্যের আকাশটা পরিষ্কারই ছিলো রাত বাড়তেই কোথা থেকে ওড়ে এলো দলছুট মেঘের ভেলা। প্রকৃতি যেন আগেই প্রস্তুত ছিলো গর্জে ওঠার সেই সাথে তুমুল বর্ষণের। অর্নিতার কান্না থেমে গেলেও থমথমে ভাবমূর্তি কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। রিদওয়ানও চাইছিলো কিছুটা সময় দিতে তাই একটু আগেই সে রুম ছেড়ে বেরিয়েছে বাইরে। মিনিট বিশেক হোটেলের পুল সাইডে বসে নিরিবিলিতে ভেবেছে অনেক কথা, ভেবেছে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েও। অর্ণব ছোট বাচ্চা নয়, বৃষ্টিও যথেষ্ট বুঝদার। তারা তাদের ভবিষ্যতের চিন্তা নিজেরাই করার ক্ষমতা রাখে তবুও তারা যা করছে আপাতদৃষ্টিতে ভুল বলেই মনে হয়। কিন্তু এরপরও কথা থাকে, তারা দুজন দুজনকে চেনে ছোট থেকেই আর নুপুরের সাথে পরিচয়টা সল্প সময়ের। আবার হতে পারে নুপুরের সাথে অর্ণবের এতোটাও আবেগ জড়ায়নি যতোটা সে কিংবা রিমন ভাবছে। হতে পারে বিয়েটা হয়ে গেলেই অর্ণব ভুলে যাবে ওই মেয়েটাকে! হতে অনেক কিছুই পারে তা নিয়ে নিজেরা বাড়াবাড়ি করা বোধহয় ঠিক হবে না। রিদওয়ান ফিরে এলো রুমে৷ অর্নি মন খারাপ করে এখনো বসে আছে বারান্দায় তা দেখে রিদওয়ান ডাকলো, অর্নি রুমে আয়।

এক ডাকেই উঠে এলো অর্নিতা। বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিয়ে চুল গুলো হাত খোঁপা করতে করতে বসলো এসে বিছানায়। রিদওয়ান অর্নিতার ব্যাগ খুঁজে চিরুনি বের করে তার চুল আঁচড়াতে লাগলো। ঘর জুড়ে নিরবতা ;দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে যেন৷ শোনা যাচ্ছে এসির এক ধরনের ভোঁতা আওয়াজ। কিছু সময় চুপচাপ কেটে যেতেই রিদওয়ান চিরুনি রেখে ঘরের বাতি নেভালো। ঠায় বসে থাকা অর্নিতার হাত ধরে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। বাইরে বৃষ্টি চলছে অবিরত সেই সাথে আবহাওয়ার শীতলতা ঘরটাকে আরও বেশি শীতল করতেই রিদওয়ান এক হাতে অর্নিকে জড়িয়ে অন্য হাতে এসির রিমোট চেপে অফ করে দিলো। ভুল হয়েছে জানালা আর বেলকোনির দরজাটা খোলা রাখা উচিত ছিল।

-ঘুম পাচ্ছে?

অর্নিতার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল রিদওয়ান।

-না।

-আমারও পাচ্ছে না তবে অন্য কিছু পাচ্ছে।

রিদওয়ানের বুক থেকে মাথা তুলে কৌতূহলী চোখে তাকালো অর্নি। গাঢ় অন্ধকারে ডোবা ঘরটাতে দেখা গেল না মানুষটার মুখ৷ রিদওয়ান আবার বলল, বিয়ের পর এই প্রথম আমরা এতো কাছে তাই না!

লজ্জা লাগছে অর্নির। সত্যিই এত কাছে এতো আবেশে বুকে মিশে থাকা এই প্রথম তাদের। লজ্জাতেই এবার একটু নড়াচড়া করতে লাগলো অর্নি। রিদওয়ান তাকে ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালা খুলে পর্দা সরালো, বারান্দার দরজা খুলতেই দমকা বাতাস জায়গা করে নিলো ঘরের ভেতর। বৃষ্টির ছাঁটও ছুয়ে গেল রিদওয়ানের চোখ, মুখ, হালকা ভিজিয়ে দিলো শার্টটা। ভেজা শার্ট গা থেকে খুলে ছড়িয়ে দিলো লাগেজের ওপর। পুনরায় গিয়ে বসলো বিছানায় অর্নিতার সামনে। আলতো হাতে চিবুক তুলে ঠোঁটে স্পর্শ করতেই পেলব ঠোঁটের মদির নেশায় পেয়ে গেছে রিদওয়ানকে। রিদওয়ান একটু ঝুঁকে স্ত্রীর মুখ, চোখে স্পর্শ এঁকে ধীরলয়ে নেমে এলো পুরু ঠোঁটের ভাজে। বহুকালের তৃষিত হৃদয় কবে থেকে অপেক্ষায় ছিল এই তুলো কোমল ছোঁয়ায় ডুবে যাওয়ার। এত কাছে এই ক্ষণে নিজেকে আর যে ধরে রাখা দায়। অর্নিতাও ভুলে গেল কিয়ৎপল আগের বিষাদ হারাতে লাগলো নতুন অনুভূতির জোয়ারে। নিবিড় আলিঙ্গনে মিলে গেল দয়িতের বাহুডোরে।

__________

পড়াশোনায় আর মন বসছে না একদমই। টিউশন আর বাড়ির কাজকর্মই যেন নুপুরের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে আজ চারদিন ধরে। তার বাবা প্রথম দুদিন বিষয়টা আমলে না নিলেও কাল থেকে চিন্তিত আছেন৷ কোন কারণ ছাড়া একটানা চারটা দিন ক্লাশ না করার মত মেয়ে তার নয় ভেবেই আজ তিনি সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে মেয়েকে ডাকলেন। রান্নাঘরে তখন সকালের রান্নার জন্য সবজি কাটতে ব্যস্ত নুপুর। বাবার ডাক শুনতে পেয়ে তরকারি, বটি একপাশে সরিয়ে চলে গেল বাবার ঘরে। সন্ধ্যেক্ষণে আজকাল ছোট মা পান সাজিয়ে বসেন দেখা গেল বাবাও আজ সঙ্গ দিচ্ছেন। এ বাড়িতে পানের আয়োজন খুব বেশিদিন পুরনো নয় তবুও কেন জানি নুপুরের বিষয়টা ভালো লাগে। হতে পারে বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী এই পানের জন্যই ইদানীং সন্ধ্যের পর রসুইঘর খালি করে চলে আসেন আর নুপুর তার চায়ের কাপটা উচ্চবাচ্চ্য না শুনে পূর্ণ করতে পারে বলে। আজ অবশ্য চায়ের পাতিল উনুনে চড়েনি। তরকারি কাটতে কাটতে সে ভাবছিলো গত কয়েকদিনের একটা সমস্যা নিয়ে। বাবা তাকে দেখেই একবার তাকালো ভালো করে।

-তোর কি শরীর খারাপ?

-না তো বাবা।

-তোর কি পরীক্ষা চলে?

– নাতো। পরীক্ষায় আরও মাস তিন বাকি।

-ইউনিভার্সিটিতে যাস না কেন?

বাবার এই প্রশ্নে তৎক্ষনাৎ কোন জবাব এলো না মুখে। এরই মাঝে ছোট মা ঘর ছেড়ে গেলেন তুতুনকে দেখতে। কি করছে ছেলেটা এখনো পড়তে বসলো কিনা কে জানে৷ নুপুরও যেন এটাই চাচ্ছিলো তাই সুযোগ পেয়ে সত্যিটাই প্রকাশ করলো।

-বাবা, আমি বাড়ি থেকে বসে হলে প্রায়ই দেখি একটা বাইক আসে পেছনে পেছনে৷

-কি বলিস এটা!
চমকে উঠলেন নাজিম সাহেব।তার মেয়েকে কেউ নজরে কেন রাখবে। চিন্তিত মন এবার অস্থিরতায় ঘামতে লাগলো।

-হ্যাঁ বাবা। বাইকওয়ালা সবসময় কলেজের সামনে আর উত্তরপাড়া টিউশনি করি সে এলাকায় অনেকদিন চোখে পড়েছে। প্রথম প্রথম কাকতালীয় মনে হতো পরে দেখলাম একই রঙের শার্টে একই বাইকে অনেকদিন পেছনে আসছে।

-কবে থেকে এমন হচ্ছে তুই আমাকে বলিস নাই ক্যান?

– প্রায় বছরখানেক আগে অনেক দিন একটানা এমন হওয়ার পর হঠাৎ আর চোখে পড়েনি লোকটাকে। এখন আবার দিন পনেরো আগে দেখেছি তখন থেকেই ভয় লাগছিলো।

এবার কথাটা বলতে বলতে মাথা নুইয়ে ফেলল নুপুর। বাবাকে আরও আগে না জানানোর জন্যই এখন খারাপ লাগছে।

– এতদিন জানানো দরকার ছিল না!

এবার ধমকে উঠলেন নাজিম সাহেব। মূলত কন্যার কোন বিপদ যদি হয়ে যেত এই ভয়েই এই ধমক৷ উত্তেজনা আর ভয়টাও যেন প্রকাশ পেলো ধমকের সাথে।

-কাল থেকে তুই আর টিউশনিতে যাবি না৷ বাড়ি থেকেই একা বের হবি না। যতদিন না আমি খোঁজ নিতে পারছি কিছু ততদিন বাড়ির বাইরে পাও ফেলবি না বলে দিলাম।

-টিউশনিতে যাই না চারদিন ধরেই৷ কিন্তু ছাত্রের পরীক্ষা কালকে যেতেই হবে।

-দরকার নাই টিউশনি করার৷ আমি আলহামদুলিল্লাহ যা কামাই তোকে পড়াইতে পারব।

মেয়েকে আর কিছু বলতে দিলেন না নাজিম সাহেব। আদরের কন্যাটির মাথার ওপর কেমন বিপদ ঘুরছে তা ভেবেই তিনি ভয়েই ঘেমে উঠছেন বুকটাও ধড়ফড় করছে।

___________

জীবন নিয়ে হেলাফেলা করার মত মানুষ অর্ণব নয়। সারাজীবন একাকীত্বের যন্ত্রণা সয়ে নিজেকে বড় করেছে এ বেলায় এসে সঙ্গী পাওয়া মুহূর্তে মনের মতন কাউকে না পেলে চলবে কেন! অথচ দু হাত দু পায়ে শিকল পরাতে ওঁৎ পেতে আছে কতজন শিকারী যেন সে ছোট্ট এক শাবকছানা। প্রভু হয়প শিকারীরা তাকে নিজের প্রভূত্ব ফলাতে উঠে পড়ে লেগেছে তার দূর্বল দিক চেপে ধরে। প্রত্যেকেই তার খুব কাছের মানুষ না ঠিক হলো না তারা প্রত্যেকেই আপন নামের পর মানুষ। একটু আগেই সে খালুজানের অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে৷ সন্ধ্যের নাশতার জন্য ডেকেছেন তা ছিল কথার কথা। নাশতার জন্য কেন অফিসে ডাকতে হবে! আপন মানুষকে তো বাড়িতেই ডাকা বাঞ্ছনীয়। অফিসে ডাকার পেছনের রহস্য হলো একাকী গোপন এক ডিল করা। ব্যবসায়ে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠতে দুটো জিনিস থাকা জরুরি পুঁজি, দক্ষতা। খালুজান অতিমাত্রায় দক্ষ বলেই হয়তো আজ সফল ব্যবসায়ী। এতটাই দক্ষ যে সম্পর্ককেও ব্যবসায়িক রূপে বদলে নিতে জানেন। আজ বোনের সুখ কিনতে তাকে খালুজানের সাথে ব্যবসায়িক ভাষায় কথা বলতে হলো। হয় বৃষ্টিকে নিয়ে সুখের সংসার করো নয় বোনকে ডিভোর্সে তকমা দাও। ছোট থেকে কন্যার মত স্নেহে বড় করা অর্নিকে নিয়ে খালুর এমন কথায় অর্ণবের মনে হয়েছিল সেখানেই সে বাশার শেখকে খুন করে আসবে। পরক্ষণেই কেমন তার টগবগে ফুটতে থাকা রক্ত বরফসমান গাঢ়, কঠোর হয়ে গেল। কত শান্ত, আদ্র গলায় বলে দিলেন, রিদওয়ানের সাথে অর্নিতার সংসার টিকবে শুধুই তোমার সিদ্ধান্তের ওপর। আমার মেয়ে দুঃখ পেলে তোমার বোন আমার ছেলের সাথে সুখে থাকবে সে কথা ভুলে যেও বাবা আর হ্যাঁ ব্যবসা টিকিয়ে রাখার কথাও ভুলতে হবে। ছোট থেকে সন্তানের মত স্নেহ করে আগলে রেখেছি প্রয়োজন পড়লে তার শোধও নেব। তোমাদের বাপ-মা যা করতো তার প্রায় সবটা আমরাই করেছি এখন যদি তোমাদের জন্য আমার সন্তান দুঃখ পায় তাহলে কি করা উচিত বলো তো!

খালুর হুমকি একটুও গায়ে মাখেনি অর্ণব। যা তার লেগেছে তার একটা খালামনির আঁচলের ছায়ায় থাকার প্রতিদান আর বোনের সুখ। অর্নিতা কখনোই রিদওয়ানকে পরিবারহীন দেখে সহ্য করতে পারবে না। রিদওয়ান, অর্নিতা আর বড় খালামনি এই তিনটি মানুষ বড়ই সরল। এ ধরায় তাদের থাকা বড্ড মুশকিল এ পৃথিবী শুধুমাত্র কুটিল, চতুর আর ধূর্ত প্রাণীর বসবাসযোগ্য স্থান। অর্ণবও তেমন, বাশার শেখ আর সাখাওয়াত চৌধুরীও তেমনই। তাই সর্বান্তকরণে এবার তার চেষ্টা কুটিল মানুষগুলোর মতো করেই এগিয়ে চলা। ভাবতে ভাবতে ভুলেই গেল এ জগতে আরও একটি সরল মানুষের কথা যে মানুষটা তার পথে দৃষ্টি ফেলে অপেক্ষায় আছে। নুপুর! আহ্ বড় ভুল তার এ জনমটা। ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষগুলোকে কাছে পাওয়ার ভাগ্য বোধহয় অর্ণব চৌধুরীর আর কখনোই হবে না।
___________

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৬(খ) (১৮+ এলার্ট)

ভোরের আলোয় চকচক করছে ঘরের ভেতরটা সাথে বুকের মাঝে মিশে থাকা নরম কোমল দেহটির নগ্ন কাঁধ। রিদওয়ান আধখোলা চোখে সেদিকে তাকাতেই তার চোখ দুটো যেন ঝলসে উঠলো। রাতের আঁধারে ছুঁয়ে আদর করা তুলোর মত নরম এই তনু দিনের আলোয় আরও ভয়ানকভাবে মোহিতো করছে তাকে। ঘুমন্ত অর্নির মুখে দৃষ্টি ফেলতেই চমকে উঠলো এবার। ইশ, নিচের ঠোঁটটা কেটে গেছে, লেগে আছে রক্তের ছাপ। ধীরে ধীরে সরে গেল অর্নির বুক থেকে দেখতে পেল নগ্ন বক্ষোজে দাঁতের চিহ্ন। এতোটা এগ্রেসিভ সে কি করে হয়েছিল কাল। প্রথম রাতেই ঠিক কতোটা কষ্ট দিলো সে অর্নিকে ভেবেই এখন খারাপ লাগছে। একটু ঝুঁকে আলতো করেই চুমু খেল অর্নির ঠোঁট, গাল, গলা আর বুকের নরম কোমল মাংসপিন্ডে। অর্নির গাঢ় ঘুম ভেঙে গেল উষ্ণ ছোঁয়ায়। শরীর বাঁকিয়ে হাত মেলে জড়িয়ে ধরলো রিদওয়ানকে। প্রেমের সুখ শরীর নাকি মনে! রিদওয়ানের উপলব্ধি হয় প্রেম এক নাম মাত্র সুখ তো দেহ, মন দুইয়েই থাকে। ভালোবাসলে না ছুঁয়ে থাকা যায় না। ভালোবাসাই টেনে নেয় মধুর আলিঙ্গনে। যারা বলে ভালোবাসা শুধুই মনের তারা ভন্ডামি করে ভেতরে ভেতরে তাদেরও থাকে ছাই চাপা আগুন। হাওয়া পেলে উস্কে উঠবে জলন্ত অগ্নিলাভা আর না পেলেই তা লুকিয়ে রয়। বহুদিনের প্রণয় প্রলয়ে ভেসে গিয়ে অর্নি রিদওয়ান ঠিক জ্বলে উঠলো। অর্ধাঙ্গীনির চোখ মেলার আগ্রহ শূন্য টের পেতেই রিদওয়ানও আদরে জড়িয়ে পুনরায় শুয়ে পড়লো আরেকটু ঘুমের আশায়।

_________
অর্ণবের আজকের সকাল এলো আরও একধাপ বিষন্নতা নিয়ে। ঘুম থেকে উঠেই সে কল দিলো নুপুরকে। একবার, দুবার করে অনেকবার দেওয়ার পরও যখন ওপাশ থেকে ধরা হলো না তখন অধৈর্য্য হয়েই সে মেসেজ দিলো, কল ধরো নইলে তোমার বাড়িতে আসছি, মাত্র দুটো কথা বলব।
নুপুর নিজেই এবার কল দিলো অথচ অর্ণব কিছুই বলতে পারলো না যা বলতে চাইলো। সময় লাগবে কিছুটা তাই বলে বসলো আজকে দেখা করো দুপুরে। নুপুর বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না কথাটা বলতে গিয়েও বলল না। মন মানলোই না অর্ণবের কথার বিপরীত জবাব দিতে৷ কাল পর্যন্তও সে কষ্টে, রাগে পণ করেছিল এ জীবনে আর এই মানুষটার মুখদর্শন করবে না। কোন নাম দেয়া সম্পর্ক নেই তবুও অদৃশ্য এক বাঁধন ছিল দুজনাতে। অর্ণবের তাকে এড়িয়ে চলার দায়ে সে বাঁধন মনে মনেই আবার ছিন্ন করতে চাইছিল নুপুর। পারলো কই! ঠিক তো সেই অর্ণবের কথা মেনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল বারোটা নাগাদ৷ নুপুরের বাবা তখন বাড়ি ছিলেন না ছোট মাও কিছু জিজ্ঞেস করেননি৷ অর্ণবের কথা মত নুপুর এসে হাজির হলো ইউনিভার্সিটির খুব কাছেই রাস্তার ধারে। অর্ণব এলো তার ঠিক পাঁচ মিনিট পরই। বাইকে বসা কালো শার্ট, কালো প্যান্ট হাতে সিলভার শেডের বড় ডায়ালের ঘড়ি। মাথার চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে আছে মুখটাও তার মলিন লাগছিলো। নুপুর ভেবেছিলো আশেপাশেই কোথাও বসবে তারা। তাকে অবাক করে দিয়ে অর্ণব বলল, বসো। তার ইশারা বাইকে নিজেরই পেছনে তা দেখেই নুপুরের বিষ্ময় আকাশ ছুঁলো। হাত পা’ও মুহূর্তেই শীত শীত অনুভূতিতে ঠান্ডা হয়ে এলো। যে মানুষটা কখনো বাড়ি থেকে পৌঁছে দিতে এক রিকশায় বসতে চায় না সে মানুষ আজ বাইকে নিজের পেছনে বসতে বলছে! নুপুর বোধহয় ভাবনায় তলিয়েই যাচ্ছিলো সেই অতল ডুবকি থেকে অর্ণব কেমন হিঁচড়ে তুলে দিলো ডাঙায়।

-দেরি করছো কেন? বসো।

আর সময় নেই বিষ্ময় আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকার। অতি আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থলকে এত কাছে পেয়ে ঝুরঝুর করে ভেঙে গেল নুপুর। বাইকের পেছনে বসতেই বাহু ছুঁলো অর্ণবের পিঠ আর তাতেই সবটা গুঁড়িয়ে গেল। সামনের মানুষটা কি টের পেল পেছনে তার শ্যামাঙ্গিনী আড়ষ্টতায় ঋজু হয়ে আছে! পাক্কা দেড় ঘন্টার পথ পেরিয়ে অর্ণব এলো সাভারের সেই গ্রামটিতে যেখানে এর আগে সে উদাসচিত্তে এসে ভিড়েছিল একদিন। আজ আনমনে নয় বরং ইচ্ছাকৃতই প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে এসেছে মনের আগল খুলে সবটা জানিয়ে দিতে। হতে পারে এই তাদের শেষ সাক্ষাৎ! লম্বা পথ বলেই মাঝ রাস্তায় নুপুর বার কয়েক জানতে চেয়েছে কোথায় যাচ্ছে তারা? বাড়িতে বাবা চিন্তা করবে তার ফেরা উচিত। অর্ণব জবাবে শুধুই বলেছে, ভয় পেয়ো না আমি তোমার জন্য ক্ষতিকারক নেই। আজ একটু মিথ্যে বলে নিও বাবার কাছে।

এরপর আর কথা জোগায়নি নুপুরের মুখে। এ দুনিয়ায় পরিবর্তনশীল হাজারটা জিনিসের মাঝে একটা বোধহয় মানবজাতির অন্তর। প্রথম দেখায় যে মানুষটাকে নুপুর ইস্পাতের মত শক্ত ভাবতো আজ সেই মানুষটাকেই লাগছে মোমের মত। একটুখানি উত্তাপ পেলেই গলে যাবে সে। কি এমন কথা বলতে তাকে আজ এতো কাছে বসিয়েছিল! নুপুর চলতি পথে অনেকবার ছুঁতে চেয়েছিল অর্ণবের কাঁধ, বেহায়া হয়ে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল তাকে। অনুভব করতে চেয়েছিল প্রিয় মানুষের পিঠের পরে মাথা এলিয়ে কেমন লাগে। সাহস হয়নি তেমন কিছুর। এখন এই খোলা প্রান্তরে প্রখর রোদ গায়ে মেখে তার মনে হলো এ রোদে তাপ নয় আছে অর্ণবের গোপন আলিঙ্গন যা অর্ণবকে ছুঁয়ে পিছলে পড়ছে তার গায়ে। তারা এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক সেই জায়গায় যেখানটায় মাস কয়েক অথবা বছর আগে অর্ণব এসে বসেছিল বিধ্বস্ত নিজেকে নিয়ে। আজও সে বিধ্বস্ত আর ক্ষণকাল পেরুতেই ভেঙে যাবে তার পাশে থাকা মেয়েটিও৷

-এখানে কেন এসেছি আমরা?

-কথা বলতে।

– ঢাকায় কি কোথাও বলা যেত না?

-যেত। চাইলেই বসা যেত কোন কফিশপ, কোন হোটেল, পার্ক অথবা আমার অফিসেও। কিন্তু সেখানে থাকতো হাজারো কৌতূহলী দৃষ্টি৷ এখানে চেয়ে দেখো কেউ নেই আশেপাশে।

-এত শূন্য কেন এই জায়গাটা?

-শূন্য জায়গা! আওড়ালো অর্ণব শব্দ দুটো।

-ভালো বলেছো। জায়গাটা আসলেই শূন্য। শূন্য মানুষের জায়গা তো শূন্যই হবে।

চকিতে তাকালো নুপুর।
‘শূন্য মানুষের শূন্য জায়গা মানে!’

-” এই যে সামনের খোলা মাঠ আর ডানদিকের ক্ষেত এই জায়গাটুকু আমার। কোন একদিন ভগ্ন হৃদয় আর বিধ্বংসী রূপ নিয়ে আনমনেই এসে ভিড়েছিলাম এই জায়গায়। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে হঠাৎ মনে হলো এখানে আমার একটা ছোট্ট ঘর হলে ভালো হতো। ওই যে দেখো কলঘরটা ঠিক ওটার মত ছোট্ট। ইট পাথর নয় মাটির তৈরি হবে সে ঘর। জানালার গরাদের ফাঁক গলে পূর্নিমার রাতে আলোয় ভেসে যাবে সে ঘরের মেঝে। মাটির ওপর হবে আমাদের বিছানা।”

চমকে উঠলো নুপুর ‘আমাদের বিছানা!’

অর্ণব বলতে থাকলো, ‘সে বিছানায় পূর্নিমা আর অমাবস্যা মিলেমিশে লুটোপুটি খাবে আমার বুক জুড়ে। অমাবস্যা, পূর্ণিমা একসাথে কি করে তাই ভাবছো না!’

নুপুর ভাবেনি কিছুই। সে তো আমাদের বিছানা ওই এক বাক্যেই এখনো হুঁশ হারা। কি বলছে অর্ণব তা আর বোধগম্য হচ্ছে না। তবুও অর্ণব বিস্তর বলে চলল, অমাবস্যা শুধুই অসুন্দরই নয় আমার অমাবস্যা এ জগতসংসারে সুন্দরের প্রতীক হিসেবেই আমি ধরেছি। তুমিই আমার অমাবস্যা আর পূর্ণিমা ওই চাঁদের দ্যূতিকেই উল্লেখ করেছি।

নুপর আর কিছুই শুনতে চাইলো না। একসাথে এত কিছু তার আর সহ্য হচ্ছে না। যুগ যুগ অপেক্ষার পরও যদি এতটুকু জানতো তাতেও বোধহয় সে সহনক্ষমতা হারিয়ে ঢলে পড়তো এখনি।

-বাড়ি যাব।

-কথা শেষ করে নেই!

দিন ঢলেছে পশ্চিমে৷ সন্ধ্যের আর খুব দেরি নেই। বাবাও সেই দুপুর থেকে কয়েকবার কল করেছেন৷ প্রথমে মিথ্যে বলেছে সে আছে এক বান্ধবীর বাড়িতে। বাবা ঠিকানা চাইলো তাকে নিতে আসবে বলে সেখানেও মিথ্যে বলে কল কেটে দিলো। দিন ঘনিয়ে যেতেই এবার বাবা অস্থির হয়ে কল করেই যাচ্ছেন কিন্তু অর্ণবের সেদিকে খেয়াল নেই। সে বলে চলছে মনের জমানো সকল ভাবনা। নুপুর এবার আর কিছুই শুনতে চাইছে না। অর্ণব তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে এই জানতে পেরে গোটা এক জীবন ধন্য তার।

– উঠুন আমি বাড়ি যাব।

– শেষটুকু শুনবে না?

-কিসের শেষ শুনবো?

-আমার স্বপ্নের সমাপ্তি।

‘না’ বলেই নুপুর বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো বাইকের দিকে তখনি টান পেলো বা হাতে। অর্ণব টেনে ধরেছে তার হাত সে ফিরে চাইলো।

-আমার ঘরে অমাবস্যা নয় জায়গা নেবে বৃষ্টি৷ আমার জীবনে সাজানো স্বপ্ন কখনো বাস্তব হয় না। রিনিঝিনি নুপুর নিক্কন স্বপ্নেই রয়ে যাবে আজীবন রুমঝুম করবে অনাকাংখিত বর্ষণ। এটাই আমার জীবন।

কথাটুকু বলতে বলতেই উঠে দাঁড়িয়েছে অর্ণব। মুখোমুখি নুপুরকে একপলক দেখে আচমকাই সে জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে অস্ফুটে উচ্চারণ করলো, ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি দেখো তোমায় ভালোবেসে আমি আবারও ধ্বংস হয়ে গেছি। আমার জীবন কখনোই পরিপাটি হয় না আজও তাই তুমি আমার হবে না। আমি হেরে গেছি জীবনের কাছে আরও একবার। তুমি ক্ষমা করে দিও আমায়…….

কোমল হাতে নুপুর ঠেলে দিলো অর্ণবকে। অবিশ্বাস্য নজরে তাকিয়ে দেখলো একবার সামনের মানুষটাকে। কি দেখলো কে জানে প্রচণ্ড জোরে অর্ণবের গালে থাপ্পড় মেরে বসলো। অর্ণব হতবাক হয়ে তাকাতেই নুপুর বলল, ‘বাইক স্টার্ট দিন আমি বাড়ি ফিরবো।’

এরপর আর কোন কথা হয়নি দুজনে। নুপুরকে একেবারে তাদের এলাকার বাজার থেকে একটু দূরেই নামিয়ে রিকশায় বসিয়ে দিলো। তবুও বাইক নিয়ে ছুটলো পেছন পেছন ঠিক নুপুরদের গেইট অব্দি। নুপুর বাড়ির ভেতর চলে যেতেই অর্ণব সোজা গেল খালুজানের অফিসে। আজ শেষবার কথা বলে নেবে। খালুজানের মত না বদলালে সে কথা বলবে বৃষ্টির সাথেও এরপরও যদি কাজ না হয় তবে! এ পর্যায়ে স্বগোতক্তির মত বিড়বিড় করলো, হারিয়ে যাব কোথাও নুপুর তোমায় সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু পিছুটান! মস্তিষ্ক তাকে সজাগ করে দিলো, তোমার দাদীর কি হবে, বোনটার জীবন কেমন হবে?

______________

-স্যার, আজকে তো অর্ণব চৌধুরীর বোনরে দেখলাম কলেজের গেইটের সামনে।

……….

-আপনে না করার পর থাইকা আমি তো তারে ফলো করি না। আজকা ওই পথে যাইতে সময় চোখে পড়লো।

…..
-আইচ্ছা। অর্ণব চৌধুরীরে তো নয়ন নজরে রাখে আমি শুধু তার বোনরেই রাখতাম।

ওপাশ থেকে আরও কিছু হলো। গুপ্তচর এই লোকটি অর্নিতা ভেবে আগেও নুপুরকে নজরে রাখতো৷ ভুলটা সে আরও বছর দেড়েক আগেই করেছিল যখন অর্নিতা আর নুপুর কলেজে পড়তো একসাথে। কারো আদেশ পেয়েই সে অর্ণবের বোনের পেছনে লাগলেও একটা ভুলে অর্নিতার জায়গায় নজরবন্দী হয়েছিল নুপুর। আদেশক্রমে লোকটি ফলো করা বন্ধ করলেও পুনরায় অন্য একজনের আদেশেই সে আবারও নুপুরকে নজরবন্দী রেখেছে পার্থক্য শুধু এই এবারের আদেশকারী অন্য কেউ।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে