গল্পঃ কুড়িয়ে পাওয়া ডায়েরি
পর্বঃ০৩
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)
সেদিন নিজেকে ওই মানুষরূপী হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারি নি। ওরা দৌড়ে আমাকে ধরে ফেলে।একসাথে চারটা ছেলের শক্তির সাথে আমি পেরে উঠি নি।সারারাত আমাকে খুবলে খেয়েছিল ওরা। তারপর যখন ভোর হয় তখন আমাকে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যায়।তারপর আর আমার মনে নেই। প্রচন্ড ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি। বাড়ির লোকেদের কাছে শুনেছি রাস্তার পাশ থেকে
আমার ধর্ষিত দেহটা খুঁজে পেয়েছে।এরপর শুরু হয় আমার জীবনের অন্যরকমের গল্প। আমার নামের সাথে যোগ হয় ধর্ষিতার ট্যাগ। আমার শরীরে ওই পশুগুলো এতো পাশবিক নির্যাতন চালায় আমি প্রায় একমাসের মতো অসুস্থ ছিলাম। বড় মামা- ছোট মামা অনেক টাকা খরচ করে চিকিৎসা করে সুস্থ করে আনে। ধর্ষকের নামে মামলা করেও তেমন লাভ হয় না। আমাদের সমাজে ধর্ষকদের শাস্তি হয় না,কিন্তু
সমাজের মানুষদের কথার আঘাতে ধর্ষিতারা প্রতিদিন বারবার মৃত্যুর সমতুল্য যন্ত্রণা সহ্য করে।
আমার জীবনটা হয়ে গেছে সকলের জীবনের চেয়ে একবারে আলাদা। কোন মেয়ে আমার সাথে এখন আর মিশে না।সকলের ধারনা আমিই খারাপ মেয়ে।
এমনকি আমার জন্য ঝুমাআপুর বিয়েটাও ভেঙে যায়।পাত্রপক্ষ সরাসরি জানিয়ে দেয়, ধর্ষিতা পরিবারের সাথে তারা কোন আত্মীয়তা করতে চায় না।ঝুমা আপুর বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় মামি এবারে মুখ খোলেন।অবশ্য তার দোষ আমি দেই না কারন এতো ভালো সমন্ধটা হাতছাড়া হলে যে কেউ রাগ করবে।কিন্তু আমার যে কিছুই করার ছিল না।কেউ তো আর নিজের ইচ্ছায় ধর্ষিত হয় না।মামি আমাকে আর মাকে নিয়ে মুখ দিয়ে যা নয় তাই বলেছিল। এতো কুরুচিপূর্ণ কথা মানুষ বলতে পারে আমার জানা ছিল না। সেদিন মা মামির কথা শুনে আমাকে ভীষণ মেরেছিল।আমাকে মা মারতে মারতে বলেছিল, তুই কেন তোর পোড়ামুখ নিয়ে ফিরে এলি? মরে যেতে পারলি না।তুই মরলে তো আমিও বাঁচতাম।তোর ভাইকে গলা টিপে মেরে আমি নিজেও না হয় গলায় দড়ি দিতাম।কেন মরলি না? আর কতদিন অন্যের বোঝা হয়ে থাকব?
আশেপাশের সকলের কথা, মামির কথা,মায়ের কথা
সকলের কথা শুনে বুঝতে পারলাম আমি মরে গেলেই ভালো হতো। সকলের কথা শুনে আমার নিজেরও জীবনের প্রতি ঘৃণা চলে এলো। অভিমান হলো এই পৃথিবীর ওপর, এই সমাজের মানুষগুলোর ওপর,যারা ধর্ষিত অসহায় মেয়েগুলোকেই সকল দোষ আরোপ করে। অভিশপ্ত জীবনটাকে আর রাখতে চাই না।মরে গিয়ে সবাইকে শান্তি দিতে চাই। ছোট মামাদের ঘর থেকে চুরি করে ইঁদুরের বিষ নিলাম।ঘরে গিয়ে ছোট্ট একটা চিঠি লিখলাম।
ভয়ে ভয়ে হাতে থাকা বিষ মুখের সামনে নিলাম।চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে, আত্মহত্যা করা মহাপাপ।যেখানে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনটাও অনিশ্চিত। ****
…..
এতোটুকু পড়ার পর পরের পৃষ্ঠা ভয়ে আর পড়লাম না। সুইসাইড করার চেষ্টার ঘটনাটুকু পড়ে আমার গায়ের লোম দাড়িয়ে গেছে। আমি ডায়েরিটা রেখে দিলাম। কেন জানি আমার প্রচন্ড ভয় করছে আমার! কেনো মেয়েটা সুইসাইড করার মতো এতবড় দুঃসাহস করলো?
চোখটা বন্ধ করে আমি যেন মেয়েটার পুরো জীবন কাহিনিটা আবার স্মরণ করলাম।আমার মনে হচ্ছে মেয়েটার জীবনের কাহিনিগুলো আমার সামনেই সব ঘটেছে আর আমি জীবন্ত সব দেখতে পাচ্ছি। এর মাঝেই মায়ের ডাক শুনতে পেলাম। মা আমাকে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছে।খাওয়ার টেবিলে বসে খেতে পারছি না, বারবার ডায়েরির মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। না আমি মেয়েটাকে চিনি, আর না আমি মেয়েটার নাম জানি।খাওয়ার টেবিলে আমাকে এমন চুপচাপ দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন,
–কিরে রিনি? কি হয়েছে তোর,শরীর অসুস্থ লাগছে?
–হ্যাঁ..মা
বলে আমি খাওয়া রেখেই আমি নিজের রুমে চলে এলাম। ডায়েরিটার
শেষ পর্যন্ত না পড়া অবধি আমার শান্তি নেই।তবে এবার ডায়েরিটা হাতে একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। ডায়েরিটা বেশ মোটা।শেষের পৃষ্ঠার কোণায় একটু বড় করে লিখা
“নীলা আহমেদ + তামিম হাসান ” নিচে একটা লাভ একে লাভের ভিতরে N+T লিখা। আমি বুঝতে পারলাম যে ডায়েরির মালিকের নাম নীলা আহমেদ।
তামিম হাসান হয়ত তার বয়ফ্রেন্ড কিংবা স্বামী। যাইহোক, ডায়েরিটা খুলে আবার পড়া শুরু করলাম।
**** বিষ মুখে দিতে যাব এমন সময় মামা এসে আমাকে কষে একটা থাপ্পড় মারলেন। মামা এতো জোরে থাপ্পড় দিলেন যে আমার হাত থেকে বিষটুকু পড়ে গেল আর আমিও ফুপিয়ে কেঁদে ফেললাম। আমার খেয়াল হলো আত্মহত্যা করার আগে দরজাটা আটকাতেই ভুলে গেছি। মামার সাথে ঝুমা আপুও এসেছে। মামা আমাকে এবারে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
— নীলা, রাগের বশে তোমাকে থাপ্পড় মেরে ফেলেছি কিন্তু তোমার ভালো চাই বলেই। থাপ্পড় খেয়ে তোমার রাগ হতে পারে এটাই স্বাভাবিক। ঝুমার কাছে জানতে পারলাম আজকে তোমাদেরকে ঝুমার মা বেশ খারাপ কথা বলেছে।রেশমাও তোকে অনেক কিছু বলেছে।শোনো নীলা মা রেশমা তোমার মামির সাথে অভিমান করে তোমাকে কথাগুলো শুনিয়েছে তাই বলে তুমি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিবে। আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেত তাহলে তোমার মায়ের অবস্থা কি হবে?তুমি ভাবতে পারছো। তুমি তোমার মায়ের ভরসা,আশার আলো। সেই কালোরাতের ঘটনা ভুলে তোমাকে পড়ালেখা শিখে অনেক বড় মানুষ হতে হবে,তারপর ওদের মত সব নরপশুদের শাস্তি দিতে হবে। আর কখনো আত্মহত্যা করার চেষ্টা করবে না। ঝুমা যদি না দেখতো তুমি রোমানের ঘর থেকে ইদুরের বিষ চুরি করছো তাহলে এখন কি হতো ভাবতে পারছো?তুমি মন দিয়ে একটা কথা ভেবে দেখো,
আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে ওই নরপশুদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। না হলে ওই পশুগুলো তোমাকে চাইলে মেরে ফেলতে পারতো।আমার বিশ্বাস আল্লাহ তোমাকে দিয়ে বড় কিছু করাবেন বলে তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এখন রেস্ট নাও, আমরা কিছুক্ষন পর আসছি।”
বলে ঝুমা আপু আর মামা চলে গেলেন।
মামার কথাটা শুনে আমার মনে হলো আসলেই তো,প্রায়ই পত্রিকায় পড়ি ধর্ষণের পর কিশোরী / তরুনীকে মেরে হয়।আল্লাহ নিশ্চয় আমাকে দিয়ে ভালো কিছু করাবেন তাই বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমি এখন থেকে বাঁচবো নিজের জন্য নয়,বাঁচবো আমার মত প্রতিটি অসহায় মেয়েদের হয়ে লড়াই করার জন্য।
★★★ ★★★ ★★★ ★★★
আমরা এখন মামার বাড়ির কিছুদূরেই বাসা ভাড়া করে থাকি। মামা অবশ্য আমাদের বাসা ভাড়া নিতে নিষেধ করেছিল কিন্তু মা থাকতে রাজি নয়।আমি কিংবা মা কখনোই চাই নি আমাদের জন্য তাদের ফ্যামিলিতে ঝামেলা হোক। ঝুমা আপুর বিয়ে ভাঙার পর থেকে মামি সামান্য কারনেই মামার সাথে ঝগড়া করতো যার কারন হিসেবে থাকতাম আমি,মা আর না হয় আমার ছোট ভাই রাজু।
বাসা ভাড়া নেওয়ার পর থেকে আমি আবারও টিউশনি পড়ানো শুরু করি।আগে যাদের পড়াতাম,তাদের মধ্যে একজন স্টুডেন্ট আমার কাছে পড়ে।আমার জীবনে আমি সেই স্টুডেন্টের ফ্যামিলির কাছেও ঋনী কারন সেইদিনের ঘটনার পর থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিলেও তারা আমাকে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে।আবার আমাকেও দ্বিগুণ সম্মানি দেয়। সবকিছুতে ওই ভাইয়া-ভাবী আমার পাশে থাকেন। হয়ে ওঠেন রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও আপনজন।
জীবন চলছে আপন গতিতে….
এখন আমার জীবনের মূল লক্ষ্য সমাজে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যাতে রাস্তায় বেরোলে কেউ বলতে না পারে ধর্ষিতা নীলা আহমেদ যাচ্ছে।
সামনে এইচএসসি পরীক্ষা তারপর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। আমি কোচিং সেন্টারের ক্লাসে এসেছি
আমার ফোনে অনেকগুলো কল আসছে,ফোন ভাইব্রেট মোডে থাকায় বেশ বুঝতে পারছি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস থাকায় কলটা রিসিভ করলাম না।
কিন্তু এতো বার কল করছে যে শেষমেষ বিরক্ত হয়ে ফোনটা ধরলাম। ফোনটা ধরে যা শুনলাম তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে…..
#চলবে