#কলা পাতায় বাঁধিব ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৪+১৫
চাঁদ শূন্য গগনে অন্ধকারের বাস। নিস্তব্ধ, শুনশান ঘর। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোনো বস্তুর স্থান নির্ণয় করা যাচ্ছেনা। ঘুম ভাঙতেই চোখে অন্ধকার পড়লো। পাশে হাতড়ে রাউফুনকে পাওয়া গেলোনা। অচেনা জায়গা, তার উপর অন্ধকার, ভীষণ ভয় লাগলো মনে। পুষ্প গলা ছেড়ে ডাকলো রাউফুনকে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। কি আশ্চর্য! পাশে দুজনের একজনের ফোন ও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর ও রাউফুনের সাড়া না পেয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো পুষ্প। পায়ে ঠাওর করে এক পা বাড়িয়েছে এমন সময় “ভেউ” শব্দে চমকে উঠলো। আচমকা ভয় পেয়ে শব্দ করে কেঁদে ফেললো পুষ্প।
রাউফুন পুষ্পকে বক্ষস্থলে চেপে ধরে ফোনের ফ্ল্যাশ অন করলো। আলো জ্বলতেই রাউফুনকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলো। রাউফুন নাছোড়বান্দা, সে ছাড়লোনা।
এখানকার হোটেলের মেইন কানেকশনে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। তারা জানিয়েছে বিশ মিনিট সময় লাগবে। রাউফুনের ঘুম ভাঙলেও পুষ্প ততক্ষণে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। পুষ্পর নড়াচড়ার আভাস পেতেই রাউফুন একটু সরে বসলো মজা করার উদ্দেশ্য। অন্ধকারে পুষ্পর চোখে তো পড়লোইনা বরং দূরে সরে বসায় হাতড়েও খুঁজে পেলোনা। ফোন দুটোই রাউফুনের পকেটে। পুষ্পর ডাকেও সাড়া দিলোনা।
ভয় দেখিয়ে মনে হচ্ছে পস্তাতে হবে। সহজে কাছে ঘেষতে দেবেনা।
পুষ্পর বাড়াবাড়ি রকম মোচড়ামুচড়িতে রাউফুন আরেকটু ভয় দেখাতে বলল,
-“আজ আর কারেন্ট আসবেনা। সারারাত অন্ধকারেই কাটাতে হবে। দূরে গেলেই ভূত আসবে।”
পুষ্প শান্ত হলো। তবে ভূত ভয় দেখানো কথায় তেমন একটা পাত্তা দিলোনা৷ নিশ্চয়ই রাউফুন তাকে ভয় দেখাতে ভূতের কথা বলেছে। ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
-“সরুন এখান থেকে। দূরে গিয়ে বসুন।”
-“আহা! বললামতো আজ রাতে আর কারেন্ট আসবেনা।”
-“আচ্ছা, এত বড় হোটেল শুধু কারেন্ট দিয়েই চলে? অন্যকোনো ব্যবস্থা নেই। আমাকে বোকা পেয়েছেন? কারেন্টের যা মতিগতি, এই যায় তো তিনঘন্টা পর আসে। তো হোটেলে বুঝি সারাদিন সার্ভিস দেয়? কারেন্ট কর্তৃপক্ষ হোটেল মালিকের দুলাভাই লাগে?”
তখনই আলো জ্বলে উঠলো। রাউফুন চুপসে গেলো। আজ বুঝি তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে।
তবে সে মনে মনে পণ করে নিলো। তাড়াতে চাইলেও সে দূরে যাবেনা। ঘাপটি মেরে বসে থাকবে।
পুষ্প মুখ ঝামটা মে’রে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।
বের হতেই রাউফুন বলল,
-“চলো খেয়ে আসি।”
পুষ্প যেনো শুনে ও শুনলোনা। আস্তে ধীরে সব করছে, পরনের জামাকাপড় ঠিক করছে, সাজগোছ নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছে।
হাত ঘড়িতে সময় দেখলো রাউফুন। কোনো কাজ ছাড়াই দশমিনিট লস করেছে। কিছু বললোনা। এমন করে আরও দশমিনিট সময় নষ্ট করার পর রাউফুন মুখ খুললো,
-“আর কতক্ষণ? আমার অনেক আগেই ক্ষুধা পেয়েছে। তোমার ঘুম থেকে ওঠার অপেক্ষায় ছিলাম।”
পুষ্প দরজা ঠে’লে বের হলো, পিছু পিছু রাউফুন রুম লক করে আসছে। করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় দু’রুম পরের রুম থেকে একজন যুবক বের হলো। চলার পথে ছেলেটি মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“এক্সকিউজ মি মিস! আপনাকে বোধহয় আজ একটা ছেলের সাথে রিসিপশনে দেখেছিলাম।”
পুষ্প ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
-“জি, আমার হাজবেন্ড এর সাথে এসেছি।”
ছেলেটি চওড়া হেসে বলল,
-“হানিমুন?”
-“সেরকমই বলতে পারেন।”
-“ডোন্ট মাইন্ড! আপনাদের নাম জানতে পারি?”
-“শিওর! আমি সামিহা জাহান পুষ্প, আমার হাজবেন্ড রাউফুন সপ্ত।”
-“ওহ নাইস নেইম। আমি তুষার। তা আপনারা কি ঘুরতে যাচ্ছেন?”
-“এখনো খাওয়া হয়নি, খেয়ে আশপাশ ঘুরে দেখবো।”
-“সেইম আমিও নিচে খেতেই যাচ্ছি।”
রাউফুন এসে পড়লো। পুষ্প আর কথা বাড়ালোনা। আগে তুষার নামলো, পেছনে পুষ্প আর রাউফুন।
রাউফুন ছোট করে জিজ্ঞেস করলো,
-“ভদ্রলোক তোমার পরিচিত নাকি?”
পুষ্প কিছু একটা ভেবে দুর্বোধ্য হাসলো। পরপরই জবাব দিলো,
-“পরিচিত না হলেও পরিচয় হতে কতক্ষণ? এনিওয়ে, হি ইজ আ নাইস পারসন।”
রাউফুন তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। কিন্তু মুখে কিছুই বললোনা। দুজনে খেয়ে আপাতত হোটেলের কাছাকাছি জায়গা গুলো ঘুরতে বেরিয়েছে। কিছুদূর যেতেই সেই তুষারের সাথে দেখা। দূর থেকে দেখে ছেলেটা হাই জানালো, কিন্তু এগিয়ে আসলোনা। সে বোধহয় বুঝে গিয়েছে কাপলদের মাঝখানে হাড্ডি হওয়া উচিত নয়। পুষ্প মিটিমিটি হেসে নিজ থেকেই এগিয়ে গেলো। পেছন ফিরে বলল,
-“আপনি কি তুষারের সাথে কথা বলতে ইন্টারেস্টেড? ভালো না লাগলে আসতে হবেনা। আমিই গিয়ে কথা বলি।”
রাউফুন দাঁড়িয়ে রইলো। সে মজা নিচ্ছে। যেনো পুষ্প তার কথাবার্তা দ্বারা রাউফুনকে ভীষণ বিনোদন দিচ্ছে।
তুষারের সাথে কথা বলে ফিরে আসলো পুষ্প। চোখেমুখে উৎফুল্লভাব ধরে রাখার চেষ্টা করে বলল,
-“এত ভালো করে মানুষ কিভাবে কথা বলতে পারে? তারউপর ছেলেটা নাকি সিঙ্গেল। ভাবা যায়? বিয়ের আগে এই ছেলের সাথে দেখা হলে কি হতো?”
রাউফুন একটুও রাগ করলোনা। এসব জেলাসি-ফেলাসি খেলা খেলে কোনো লাভ নেই। সে আগেই বউয়ের মতিগতি বুঝে নিয়েছে। অন্ধকারে ভয় দেখিয়েছে বলে এখন প্রতি’শোধ নিতে চাচ্ছে। তুষার ছেলেটাকে দেখে সুযোগ পেয়ে ফায়দা লুটতে চাইছে। রাউফুন মুচকি হেসে বলল,
-“এখন যেতে চাও? ডাকবো ছেলেটাকে?”
অতঃপর দূর থেকে হাত বাড়িয়ে তুষারকে ডাকার চেষ্টা করে বলল,
-“এই যে ভাই, নিয়ে যান। ইন্টারেস্টেড আপনার প্রতি। একঘন্টা হাঁচি সহ্য করতে না পারলে আবার আমাকে ফেরত দিয়ে যাবেন।”
তুষার দূর থেকে বুঝলোনা রাউফুনের কথা। সে এগিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালো। পুষ্প রেগে বোম হয়ে রইলো। পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তার। এই লোকের মধ্যে জেলাসির কোনো ‘জ’ ও নেই। উল্টো তাকে হাঁচি নিয়ে অপমান করলো। ভীষণ রকম অসভ্য খেতাবে ভূষিত করলো রাউফুনকে। পেছন থেকে তুষারকে আসতে দেখে পুষ্প দপদপ পা ফেলে হোটেলের দিকে চলল।
তুষারের সাথে পরিচিত হয়ে পুষ্পর পেছনে ছুটলো রাউফুন। লম্বা কদম ফেলে পুষ্পর পাশাপাশি হেঁটে বলল,
-“চলে যাচ্ছো যে? তুমি না ইন্টারেস্টেড?”
পুষ্পর রাগে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো রাউফুনের একটি বাক্য। এই মুহূর্তে কিছু একটার উপর এই রাগ ঝাড়তে হবে। পুষ্প কোনো কিছু বাচবিচার না করে এক খাবলা বালি তুলে ছুঁড়ে মারলো রাউফুনের শার্টে।
রাউফুন নিজের শার্টের দিকে লক্ষ করে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর সে এক অভাবনীয় কাজ করে বসলো। এক খাবলা বালি নিয়ে পুষ্পর জামায় ছুঁড়ে মারলো।
পুষ্প হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। বিস্ময়ে মুখ হা করে একবার নিজের জামায় একবার রাউফুনের দিকে তাকালো। মানে কী? রাউফুন তার উপর এভাবে প্রতিশোধ নিলো? সে যে এভাবে বালি ছুঁড়বে এটা ছিলো পুষ্পর ভাবনার বাহিরে। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠতেই আস্তে আস্তে ঠোঁট প্রসারিত হলো, অতঃপর খিলখিল শব্দ হেসে ফেললো পুষ্প। ধপ করে বালিতে বসে পড়লো। রাউফুন ধীর পায়ে হেঁটে নিজেও পুষ্পর গা ঘেষে বসলো।
হাসি থামিয়ে রাউফুনের কাঁধে মাথা রাখলো পুষ্প।
-“মনে হচ্ছে সদ্য কিশোরী জীবনে পা দিয়েছি।”
রাউফুন সন্তর্পণে এক হাত গলিয়ে বাহু বন্ধনে বেঁধে নিয়ে বলল,
-“প্রয়োজনে কিশোরী হতে হয়, প্রয়োজন ম্যাচিউর হতে হয়। যখন যেমন প্রয়োজন, তেমন হতে হয়। মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার ভেতরকার বাচ্চামো গুলো হারিয়ে যায়না, মানুষ প্রকাশ ঘটানো কমিয়ে দেয়। নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখাতে গিয়ে প্রানবন্ত নিজেকে হারিয়ে ফেলে। কখনো সুযোগ পেলেই নিজেকে উজাড় করে, ভেতরকার ‘আমি’কে’ প্রকাশ করে।”
পুষ্পর ভীষণ ভালোলাগলো পাশের মানুষটার কথাগুলো শুনতে। অথচ এই বাক্যগুলোতে রস নেই, প্রেম নেই। তবুও একরাশ ভালোলাগা ছুঁয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে। পুষ্প জিজ্ঞেস করলো,
-“আচ্ছা, সময়ের সাথে সাথে কি আমাদের ভালোবাসা ও কমে যাবে? অনেকেই তো বাচ্চা হওয়ার পর দেখি আগের মতো দুজন দুজনকে সময় দেয়না।”
নিঃশব্দে হাসলো রাউফুন।
-“এই যে আমাদের ধারণা সন্তান হলেই ভালোবাসা কমে যায়, দুজনের মাঝে দূরত্ব বেড়ে যায়। এটা ভুল। দূরত্ব বাড়লেও গুরুত্ব কমেনা, ভালোবাসা কমেনা। যে ভালোবাসতে জানে, সে সারাজীবন আঁকড়ে ধরে রাখতে জানে।
সন্তান সুখের স্বাদ ভিন্ন। তখন দেখা যায় আমাদের নিজেদের থেকে সন্তানকে অনেকটা সময় দিতে হয়। জন্ম দিলেই মা বাবা হওয়া যায়না। সন্তানকে সময় দিলে স্বামী-স্ত্রীর হয়তো নিজেদের আগের মতো সময় দেওয়ার সুযোগ থাকেনা। কিন্তু ভালোবাসা কমেনা। এই যে দুজন থেকে তিনজন, চারজন হওয়া? এতেও কিন্তু সুখ রয়েছে, অন্যরকম ভালোবাসা রয়েছে। জীবনে কিছু ভিন্নতা দরকার। এইযে, কয়েকবছর দুজনে এভাবে সময় কাটানোর পর একঘেয়ে চলে আসবে। তখন মনে হবে এবার জীবনে ভিন্নতা আসা উচিত। আর সেই ভিন্নতা, জীবনকে মধুময় করতেই রহমত হিসেবে সন্তান আসে।”
পুষ্প ভেবে পেলোনা এত কেনো ভালোলাগছে? তার কপালটা কি পরিমাণের তুলনায় একটু বেশিই বড়? চুপিচুপি কপালে চার আঙ্গুল রেখে মেপে দেখলো। সত্যিই তার কপাল বড়।
পুষ্পর কান্ড দেখে রাউফুন মৃদু হাসলো। যখন পাশের সঙ্গী আপনাকে পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করে? তখন কিন্তু ভালোই লাগে।
দূরের আবছা আলোয় সমুদ্রের তীর ঘেষে একজোড়া মানব-মানবী। সমুদ্রের জলে, বালিতে বালিতে, দুটি মনের অনুভূতি একে অপরের সাথে মিলেমিশে একাকার। তাদের ভালোবাসার শান্ত রূপে বিঘ্ন ঘটাতেই বোধহয় মুঠোফোনের তীব্র শব্দ হলো।
#চলবে……..
#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৫
সেদিন হাসপাতালে পুষ্পকে দেখে আসার পর ইমরান, রিয়াদ, জুঁই, প্রিয়া এদের কারোরই পুষ্পর সাথে দেখা হয়নি। রাউফুন, পুষ্পর সুন্দর মুহূর্তের বিঘ্ন ঘটাতে তাদের ফোন এলো। পুষ্পর ফোন রাউফুনের পকেটে ছিলো। আসার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছে সে। গ্রুপ কলে সব বন্ধুরা এটেন্ড করে কিছুক্ষণ কথা বলল।
বাড়িতে ফোন করার পর পুষ্প নাবিলকে জিজ্ঞেস করলো,
-“নাবিল তোর জন্য আপু কি আনবো?”
নাবিল বলল,
-“দুলাভাইয়াকে বলবে আমার জন্য বি’ষ আনতে।”
পুষ্প ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-“আচ্ছা, তোর জন্য একগাদা বিষ নিয়ে আসবো।”
নাবিল খুশিতে ফোনেই পুষ্পকে পাপ্পি দিলো। বাড়িতে সবার সাথে কথা বলে দুজনেই হোটেলে ফিরে গেলো। পুষ্প বলল,
-“শীতকালে আসলে বেশি ভালোলাগতো।”
-“আচ্ছা, শীতকালে আবার আসবো।”
★★★
কক্সবাজার থেকে ফিরে পুরোদমে পড়ালেখায় মন দিলো পুষ্প। রাউফুন হসপিটালের কাজ নিয়ে বেশ তাড়াহুড়োয় আছে।
তারা কক্সবাজার থেকে ফেরার দু’মাস পরই রিশার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে। কথাবার্তায় বোঝা গেলো তাদের দুজনের মধ্যে আগে থেকেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে। উপরে শুধু পরিবারকে জানিয়ে রাখছে। দুই পরিবারের মতের ভিত্তিতেই রিশার এনগেজমেন্ট করে রাখা হলো।
নাবিল চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। সবার মুখে মুখে যখন শুনলো রিশার বিয়ে হবে রিশার মতোই বড় একটা ছেলের সাথে, তখন নাবিল মায়ের পেটে মুখ লুকিয়ে কঁদে ফেললো।
-“আম্মু, রিশা আপু আমাকে বিয়ে করবেনা?”
সবাই নাবিলের কথায় হেসে ফেললো।
★★★
এইমাসে পিরিয়ড মিস গিয়ে দুদিন ওভার হয়েছে পষ্পর। এবারে রাউফুন বেশ সতর্ক থাকলো। প্রথমবারের মতো কোনো রিস্ক নিতে চাইলোনা।
আরও কিছুদিন যাওয়ার পরই পুষ্পর হাতে একটা প্রেগন্যান্সি কিট ধরিয়ে দিলো।
একরাশ ভালোলাগা, শিরশিরে অনুভূতি, উৎফুল্লভাব নিয়ে কিট নিয়ে বেরিয়ে আসলো পুষ্প। রাউফুনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আবেগটুকু দমিয়ে রাখতে পারলোনা।
রাউফুনের ঠোঁটে চওড়া হাসি ফোটে উঠলো। পরম আবেশে প্রিয়াতমাকে বাহুবন্ধনীতে আগলে নিলো। বুক থেকে মুখ তুলে আলহামদুলিল্লাহ বলে ললাটে দীর্ঘসময় নিয়ে চুমু খেলো।
পরিবারে নতুন সদস্যের আগমনে দু’বাড়ির লোকজনের মাঝে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেলো। নাবিল লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। ছোট্ট বাবুকে সে কারো সাথে খেলতে দেবেনা। বাবুর আজগুবি নাম ঠিক করছে।
পুষ্প কি খাবে? কি করবে? সব নিয়েই সবার মাতামাতির শেষ নেই। রাউফুন চেকআপ এর জন্য ডঃ হাফসা সানজিদাকে বেছে নিলো। ডেলিভারি পর্যন্ত তিনিই পুষ্পর চিকিৎসা করবেন।
সিঁড়ি বেয়ে উপরনিচ ওঠানামায় রিস্ক আছে বলে পুষ্পকে নিচে নামতে দেওয়া হয়না। বেশিরভাগ সময় সবাই উপরেই কাটায়। খুব বেশি দরকার পড়লে রাউফুন কোলে তুলে নিচে নামায়। তখন বাবা-মা আড়ালে থাকেন।
রোকসানা বললেন,
-“এতটা ঝামেলা না করে তোরা আপাতত নিচের একটা রুমে শিফট হয়ে গেলেই পারিস। এতে সুবিধা হবে।”
রাউফুন মায়ের কথা অনুযায়ী নিচের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করলো।
কয়েকমাস একেবারে ফুল রেস্টে ছিলো পুষ্প। যা পেরেছিলো পাড়াগুলো কিছুটা ঘরে বসেই আয়ত্ত করে নিয়েছে।
পরীক্ষা একেবারে নাকের ডগায় এসে থেমেছে।
আগের তুলনায় পুষ্পর শরীর বেশ মুটিয়ে গিয়েছে। দেখতে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে, গুলুমুলু টাইপ। রাউফুন মাঝমাঝে নাক টিপে দিয়ে বলে,
-“দিনদিন ভীষণ সুন্দরী হয়ে যাচ্ছো।”
পুষ্প হাসে। মাতৃত্বের ছোঁয়া পেয়ে মাঝেমাঝে তার নিজেরই নিজেকে ভালোলাগে। আয়নার সামনে গিয়ে সামান্য উঁচু পেট নিয়ে দাঁড়ায়।
প্রেগন্যান্সির পর থেকেই পুষ্পর রান্না করতে ইচ্ছে করে। যখন তখন মন চাইলে পছন্দমতো রান্না করে। রান্না করেই ঠিক, কিন্তু নিজে খেতে পারেনা। রান্না করার পর কেমন জানি খেতে আর ভালোলাগেনা। বাকীরাই খায়।
রাউফুন পুষ্প সাবধান হয়েছে, তবে রাউফুন বলে দিয়েছে “একেবারে শুয়ে থাকলে চলবেনা। একটু হাঁটাহাঁটি করবে। নয়তো হাত পা ফুলে যাবে।”
পুষ্প রুমের ভেতর, রুমের বাহিরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। রাউফুনের আসার অপেক্ষা করে।
সবার এত এত ভালোবাসা পেয়ে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষের তকমা দিলো।
প্রেগ্ন্যান্সি সময়ই একে একে সব পরীক্ষা কমপ্লিট করলো। বেশিরভাগ সময়ে রাউফুন দিয়ে আসতো। আসার সময় রাউফুন সময় না পেলে তার বাবা নিয়ে আসতো।
ব্যথা হজম করার পাশাপাশি বাবুর কিক করা, নড়াচড়া করার আনন্দ ও বেশ উপভোগ করেছে। রাউফুন আগের তুলনায় এখন আরও বেশিই কেয়ারিং হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার চেষ্টা করে।
দুজনের খুনসুটিতে রাত কাটে। দিনের অর্ধেক সময় রিশার পাগলামোতে কাটে। বাবু আসার কথা শোনার পর থেকে মেয়েটা বড্ড পাগলামি করছে। সময় অসময়ে এসে পুষ্পর পাশে বসে থাকে। নিজে নিজে বাবুর সাথে কথা বলে। পুষ্প হাসে। ভীষণ প্রশান্তির হাসি। তার কোনো গ্লানি নেই, ক্লান্তির ছাপ নেই।
★★★
রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে ওয়াশরুমে গেলো রাউফুন। একেবারে নোংরা জামাকাপড় ছাড়িয়ে গোসল নিয়ে বেরিয়েছে। পুষ্প তার বেড়ে ওঠা উঁচু পেট নিয়ে চুলে বেনি পাকাচ্ছে।
চুল মোছা বাদ দিয়ে রাউফুন পেছনে এসে দাঁড়ালো। শক্তপোক্ত হাতজোড়া দিয়ে আলতো ছুঁয়ে দিলো পুষ্পর গোলগাল উদর। ঘাড়ে থুতনি রেখে কানের লতিতে চুমু দিলো।
পুষ্প আদরে নুইয়ে গিলো। মিইয়ে যাওয়া গলায় শুধালো,
-“বাবু কার মতো হবে? আমার মতো? নাকি তোমার মতো?”
সম্পর্কের উন্নতিতে আপনি থেকে তুমি সম্বোধন এ এসেছে। পুষ্পকে খাটে বসিয়ে দিয়ে সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলো রাউফুন। বলল,
-“যার মতোই হোক না কেন? আল্লাহ তাকে সুস্থভাবে দুনিয়াতে পাঠাক। যাতে মা বাবু দুজনেই সুস্থ থাকে।”
পেটে চুমু খেয়ে পুষ্পর চুলের অবশিষ্ট বেনি পাকানোর চেষ্টায় বসে পড়লো রাউফুন। তার যত্নে কোনো ত্রুটি রাখতে চায়না। সন্তান তাদের দুজনের ফল। একজন তো কষ্ট করছেই, বাকীজনের দায়িত্ব এই মানুষটার যত্ন নেওয়া, তাকে ভালোবাসা।”
বেনি পাকানো শেষে রাউফুন পাশে বসে বালিশ ঠিক করলো। পুষ্পর পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে ইশারা করলো ঠিক হয়ে বসতে। শুক্রবার দিন সুযোগ পেলেই ধরে বেঁধে পুষ্পর হাত পায়ের নখ কে’টে দেওয়া, তেল দিতে না চাইলেও উষ্কখুষ্ক চুলে একটু খানি তেল লাগিয়ে দেওয়া রাউফুন সপ্তাহিক কাজের মধ্যে পড়ে।
শুধু প্রেগন্যান্সি সময় নয়। মেয়েরা সবসময়ই স্বামীর ভালোবাসা, যত্ন প্রত্যাশা করে। স্বামীকে নিজের একজন প্রেমিক রূপে চায়। তবে স্বামীকে প্রেমিক রূপে চাইলেই হবেনা। নিজেকেও হতে হবে একজন দায়িত্ববান, আদর্শ স্ত্রী। একজন পাগলাটে প্রেমিকা।
ডেলিভারি সময় ঘনিয়ে আসলো।
শরীর অনেকটাই ভার দিয়ে যাওয়ায় চলাফেরায় আগের তুলনায় ইদানীং একটু সমস্যা হচ্ছে। তবুও পুষ্প যতটা পারছে হাঁটাহাঁটি করে নিজেকে ঠিক রাখছে।
★★★
দুপুর থেকেই সামান্য সামান্য ব্যথা হচ্ছে। রোকসানা আবার এসব বিষয়ে বেশ খেয়াল রাখেন। একটু পর পর পুষ্পকে শরীরের হালচালের কথা জিজ্ঞেস করেন। পুষ্প সামান্য সামান্য ব্যথা হওয়ার কথা জানালো।
কালক্রমে এই ব্যথা একটু থেকে অনেকখানি হলো। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করছে।
রোকসানা পরিস্থিতি দেখে ঠান্ডামাথায় ছেলেকে ফোন দিলেন। রাউফুনের সামনে রোগী৷ রিশা আর মাকে বলল পুষ্পকে নিয়ে আসতে৷ সে ডঃ হাফসা সানজিদার সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করছে।
হাঁসফাঁস অবস্থায় পুষ্প চাইলোনা আওয়াজ করতে। তবুও মরন ব্যথায় আৎকে উঠে ক্ষণে ক্ষণে গুঙ্গিয়ে উঠছে। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসার পর প্রথমেই চেকআপ করা হলো। আল্ট্রাসনোগ্রাফির পর ডঃ সানজিদা আস্বস্ত করলেন সব ঠিক আছে।
পুষ্পকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো। নরমাল ডেলিভারির বন্দোবস্ত করা হয়েছে। রাউফুন পুষ্পর পাশে আছে। সে শক্ত রয়েছে। অনবরত পুষ্পর হাতে গালে মালিশ করে বিভিন্ন মোটিভেশনাল কথা বলে তাকে সাহস জুগিয়েছে।
তীব্র ব্যথায় চোখমুখ খিঁচিয়ে বারবার রাউফুনের হাত খামচে ধরছে।
-“আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কথা বলার শক্তিটুকু নেই। গলা ছিঁড়ে শব্দগুচ্ছ বের হলোনা। দু’চোখ ভরে নোনাজল গড়িয়ে কর্ণ স্পর্শ করলো। এক টুকরো সুখের ছোঁয়া পেতে অসহনীয় ব্যথায় কাতরে উঠছে মেয়েটা।
দশমাসে অন্ধকারের বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো এক ফুটফুটে নবজাতক। লম্বা শ্বাসে মুদে এলো পুষ্পর চোখজোড়া।
ক্রন্দনরত বাচ্চাটির দিকে হাস্যজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে ডঃ সানজিদা বললেন,
-“আলোকিত জগতকে আরেকটুখানি আলোকিত করে ধরার বুকে জন্ম নেওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন জানাই মিস্টার।”
রাউফুন ছেলেকে কোলে তুলেই সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো। আল্লাহ সুস্থভাবে তাদের সন্তান দান করেছেন। চওড়া হেসে ছেলের কপালে চুমু খেয়ে পুষ্পর পাশে দাঁড়ালো। তার কপালেও একইভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
-“আমার সুখের সংসারে আল্লাহ প্রদত্ত উপহারকে সুস্থভাবে দুনিয়াতে আনার জন্য তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ আমি।”
পুষ্পর অধরকোন প্রসারিত হলো। পাশ ফিরে নিজের ছেলেকে দেখলো। নরম, কচি, তুলতুলে হাতখানি ছুঁয়ে দিতেই যেনো পুষ্পর সমস্ত কষ্ট পইপই করে পালিয়ে গেলো। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে মা ভুলে যায় কতরাত তীব্র ব্যথায় ঘুমাতে পারেনি, মা ভুলে যায় সে মৃ’ত্যুর সাথে লড়াই করে এসেছে। যদি এসব মনে রাখতো, তবে কোনো নারী দ্বিতীয়বার মা হওয়ার কথা ভাবতোনা। পূনরায় নিজেকে যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতিতে ফেলার কথা ভাবতোনা। যন্ত্রণার কথা মনে করেই ভয়ে সিটিয়ে থাকতো।
★★★
পুষ্পকে কেবিনে শিফট করা হলো। নবজাতককে নিয়ে সবার মাতামাতি। নাবিল বাবুকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। তার সাথে বসিয়ে বসিয়ে ভাত খাওয়াবে, কোলে নিয়ে হাঁটবে, ঘুম পাড়িয়ে দেবে।
রিশা বলল,
-“যদি বাবু তোমার কোলে হিসু করে দেয়?”
নাবিল বলল,
-“বাবু আমার কোলে হিসু করবেনা। যদি করে, তাহলে আমি তোমার কোলে হিসু করে দেবো।”
-“যাব্বাবা, এখন সব দোষ আমার?”
পুষ্পর বাবা একমাত্র নাতিকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন, কথা বলছেন। তিনি যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। নাতিকে কোলে নিয়ে মেয়ের কাছে যাচ্ছেন, আবার এমাথায় আসছেন। পুষ্প তাকিয়ে দেখলো তার বাবাকে। এখন আর আগের মতো বাবাকে এড়িয়ে চলেনা। কেউ সঠিক পথে আসতে চাইলে তাকে সুযোগ দেওয়া উচিত।
বাবু নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে সবাই বাবুর ফিডিং করার কথা ভুলে বসলো। রাউফুন সাথে একজন নার্স নিয়ে এলো। সবাই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। রাউফুনের আর পুষ্পর মা রইলো নার্সের সাথে।
★★★
হসপিটালে শুধু রাউফুন রইলো। বাকীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো পুষ্প। রাউফুন মা-ছেলের এই সুন্দর মুহূর্তটিকে ক্যামেরা বন্দী করলো।
জীবন বদলায়। কে জানে এমন সুখী মুহূর্তগুলো খুব বেশি আপন নয়। সুখের পরেই দুঃখ আসে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। হয়তো রাউফুন, পুষ্প কেউই জানেনা তাদের জীবনের আসন্ন বিপর্যয়ের কথা। অনাকাঙ্ক্ষিত বিপ’দ নাড়িয়ে দিতে পারে তাদের সুন্দর জীবনের ভিত।
#চলবে……….