#কলা পাতায় বাঁধিব ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৮+০৯
হরিদশ্বের নতুন আগমনে বিদায় নিলো একটি কালো রাত। জন্ম হলো নতুন ভোর। ভোরের মিষ্টি রোদ, পাখির কলতানে মুখরিত প্রকৃতি জানান দিলো ‘শুভ সকাল’।
হসপিটালের ওয়েটিং রুমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বসে আছে পুষ্প। গতরাত থেকে এই পর্যন্ত কয়েকশত কল, মেসেজ করা শেষ। কিন্তু রেসপন্স শূন্য। তাই সকাল সকালই এক দারুণ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। ডাক্তারের রাগ ভাঙাতে আঁট হয়ে নামলো। এমনিতে বললে এই লোক তার দুটো কথা শোনার জন্য আসবেনা। তাই ঠিক করলো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই তার চেম্বারে প্রবেশ করবে।
★★★
অন্যদিনের মতো আজ আর রাউফুনের ঠোঁটে হাসি নেই। রোগীদের সাথে কোমল স্বরে কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু চেহারায় কোমলতার লেশ মাত্র নেই।
দেখতে দেখতেই পুষ্পর সিরিয়াল আসলো। পার্সটি হাতের মুঠোয় চেপে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো।
হঠাৎ পুষ্পকে হসপিটালে দেখে চমকে উঠলো রাউফুন। সে এতটা প্রত্যাশা করেনি৷ দরজা চেপে পুষ্প চেয়ার টে’নে রাউফুনের কাছ ঘেষে বসলো।
রাউফুন শান্ত রইলো। তার চোখের দৃষ্টি জলের মতো স্বচ্ছ। স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলো,
-“কি সমস্যা বলুন।”
পুষ্প অস্থির গলায় বলল,
-“সমস্যা তো অনেক কিছু। কিন্তু কোনটা থেকে শুরু করবো ডাক্তার?”
রাউফুন তীক্ষ্ণ চোখে একবার পরোখ করে বলল,
-“মূল সমস্যা থেকে শুরু করুন।”
পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“সমস্যা হচ্ছে আমার হাজবেন্ড।
না মানে আমার একটা ভুলের কারণে তিনি আমার উপর রেগে আছেন। ভীষণ ভয়ঙ্কর সেই রাগ। এখন তিনি আমার ফোন ধরছেননা, মেসেজ সিন করছেননা। কিন্তু আমিতো শান্তি পাচ্ছি না। আমার বক্ষস্থলে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছি, বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করে, মাঝেমাঝে চিনচিনে ব্যথা হয়। এখন কি করলে আমার রোগ সেরে যাবে বলুন ডাক্তার।”
রাউফুন ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
-“আপনি হার্টের ডাক্তার দেখাতে পারেন। ভুল করে নাক,কান, গলার ডাক্তারের কাছে চলে এসেছেন। হার্টের চিকিৎসা আমি করিনা।”
রাগে,দুঃখে ভীষণ কান্না পাচ্ছে পুষ্পর। কি দরকার ছিলো তার রাগ ঝাড়ার? এখনতো ডাক্তার তার সাথে স্বাভাবিকই হচ্ছেনা। করুণ চোখে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে পুষ্প বলল,
-“সরি! আমি আর কখনো অযথা আপনার উপর রাগ দেখাবোনা ডাক্তার। এবারের মতো ক্ষমা করুন।”
রাউফুন যেনো আকাশ থেকে পড়লো। তার রোগী কি বলছে? কেনো বলছে যেনো কিছুই তার বোধগম্য হলোনা এমন এক প্রতিক্রিয়া দিয়ে বলল,
-“শুনুন মিস, আপনার বোধহয় হার্টের সাথে সাথে ব্রেনের ডাক্তার ও দেখাতে হবে।”
এটা হাসপাতাল। এখানে সিনক্রিয়েট করা সাজেনা। পুষ্প এখানে কিছুই করতে পারবেনা। বড়জোর হাতটা ধরতে পারবে। তাই করলো সে। ঝট করে রাউফুনের হাত চেপে ধরে আকুতি করে বলল,
-“প্লিজ ডাক্তার! ক্ষমা করে দিননা। আমি সত্যিই অনুতপ্ত।”
রাউফুন হাতটা সরিয়ে নিয়ে মুঠোফোনে কারো নাম্বারে ডায়াল করলো,
-“পরবর্তী রোগীকে পাঠিয়ে দাও।”
পুষ্প হতাশ হলো। অন্যের সামনে নিজেদের মনমালিন্য নিয়ে কথা বলে স্বামীর নাম খারাপ করতে চায়না সে। বেরিয়ে ওয়েটিং রুমে এসে বসলো। আজ সে এখান থেকে নড়বেনা। রাউফুনের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত এখানে বসে থাকবে। সে ঠিক করলো বাথরুমে চাপ দিলেও সে যাবেনা। প্রয়োজনে কাপড়চোপড় নষ্ট করে ফেলবে তবুও আজ এক পা ও নড়বেনা।
আধাঘন্টা পেরোনোর পর রাউফুনের অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে বলল,
-“ম্যাম এখানে বসে আছেন কেনো? বাড়ি চলে যান।”
পুষ্প ছেলেটির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনাকে কি আপনার স্যার এখানে পাঠিয়েছে?”
ছেলেটি দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,
-“না ম্যাম, আপনাকে অনেকক্ষণ যাবত বসে থাকতে দেখেই বললাম বাড়ি চলে যান। আপনারতো ডাক্তার দেখানো শেষ।”
পুষ্প উদাসীন হয়ে বলল,
-“আজ আমি সারাদিন এখানে বসে থাকবো। আপনার স্যারকে বলে দেবেন আমি এখান থেকে নড়ছিনা।”
ছেলেটি বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে কে’টে পড়লো। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেই রাউফুনের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“স্যার, ম্যাম তো কঠিন আন্দোলনে নেমেছে। উনি আজ এখান থেকে নড়বেননা।”
রাউফুনও একইভাবে নিচু স্বরে জবাব দিলো,
-“বলে দাও আমি হসপিটাল থেকে পেছনদিকের সিঁড়ি বেয়ে বেরিয়ে গিয়েছি।”
ছেলেটি একমুহূর্ত ও দাঁড়ালোনা। পুষ্পকে বলল,
-“ম্যাম আপনি কিছু খাবেন?
না মানে খালি পেটে কতক্ষণ বসে থাকবেন? স্যার তো পেছনের সিঁড়ি দিয়েই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়েছেন।”
পুষ্প মলিন চেহারায় বলল,
-“আমি কিছু খাবোনা।”
এরপরই উঠে পড়লো। পার্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো হাসপাতাল থেকে। ছেলেটি রাউফুনকে পুষ্পর বেরিয়ে যাওয়ার খবর দিলো। সামনের রোগীটি দেখে রাউফুন উঠে দাঁড়ালো। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে দিলো। পকেটে একহাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়ালো। পুষ্প হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠছে। গাড়িটি চলে যেতেই রাউফুন আগের জায়গায় এসে বসলো।
★★★
পুষ্প বাড়ি যেতেই রেহানা খালা এসে সামনে দাঁড়ালেন। তার দাদুর নামে বিচার দেওয়া শুরু হয়ে গেলো। দুজনে আজও বোধহয় কিছু নিয়ে ঝগড়া করেছেন। এমনিতেই পুষ্পর মন-মেজাজ ভালো নেই। তার উপর এদের প্যানপ্যান। রুক্ষভাষী হয়ে বলল,
-“আজ অর্ধবুড়ী আর ওই পুরো বুড়ীকে পঁচা ডোবায় নিয়ে ফেলবো। কিছুদিন বাড়িটা শান্তিতে থাকবে।”
কথাটি শুনেই পুষ্পর দাদু বিলাপ করে কান্নাকাটি শুরু করলেন,
-“হায়! হায়! হায়! ঘরে দুধ দিয়ে কালসাপ পুষছিলাম। আইজ কালসাপে আমারে ডোবায় ফালাইতে কয়।
দূর কর, দূর কর। শয়তান দূর কর। যেহানের মাছমূল সেহানে নিয়া উঠা। এই ছেরিরে জামাইর বাড়িতে উঠা। এহানে থাইকা আমারে বাড়ি ছাড়া করবো। ও বাবাগো, তোমরা কোথায় আছো গো? দেইখা যাও তোমাগো আদরের কালসাপ আমারে বাড়ি থেইকা বাহির করতে কয়।”
পুষ্প ফোঁসফোঁস করে উঠে বলল,
-“ভেবেছিলাম তিনচারদিনের জন্য পঁচা ডোবায় ফেলে আসবো। কিন্তু এখন মুখ না বন্ধ করলে একবছরের জন্য ডোবায় ফেলে আসবো। সাঁতার কাটতে কাটতে শক্তি বাড়বে তোমার।”
রেহানা খালা এবার দাদুর পক্ষ নিলেন। দুজনে একতাল হয়ে কিছুক্ষণ পুষ্পর গুষ্টিসহ ধুয়ে শুকাতে দিলেন। পরক্ষণেই পুষ্পর দাদু আর রেহানা খালা আবার ঝগড়া করে বসলেন। পুষ্পর দাদু বললেন,
-“অই কুটনির ঘরের কুটনি তুই আমার পোলাগো বংশ লইয়া গাইল্লাস ক্যান? আমরা নাতনি কি আর স্বাদে তোরে ডোবায় ফালাইতে কইছে? আমিই তোরে ডোবায় ফালামু।”
রেহানা খালার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এতক্ষণ এই মহিলাই পুষ্পর গুষ্ঠি ধরে গা’লাগা’ল করলো। এখন আবার পাল্টি খায়। কটমট করে রেহানা খালা বলল,
-“তবেরে কুটনি বুড়ি, আইজ পান চেঁচতে কইও, একটু গরম পানি চাইও? দিমুনি তোমায় গরম পানির ছ্যাকা।”
পুষ্পর দাদু আরেকদফা চিল্লাফাল্লা করে বললেন,
-“ওরে পুষ্পরে। আমার বুবুজান দেইখা যা, এই কুটনি নাকি আমারে গরম পানি ড্যাগে(পাতিল) চুবাইবো।”
পুষ্প শুনতে পেলেও গা দিলোনা। দুজনে যে এতক্ষণ তাকে সহ তার গুষ্টি শুদ্ধো গরম পানির ড্যাগে দিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। দুজনের কাজই হলো খোঁচাখুঁচি করা। তবে এদের একজন বাড়ি না থাকলে বাড়িটা একেবারে শুনশান, ম’রাবাড়ির মতো নিস্তব্ধ হয়ে থাকে। পুষ্প এদের দুজনকেই ভালোবাসে।
★★★
এতবার কল, মেসেজ করার পরও যখন রাউফুন রিপ্লে করলেনা। তখন নিরুপায় হয়ে রিশার নাম্বারে ডায়াল করলো। রিশা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
-“আরে ভাবি কেমন আছো? জানো তোমাকে কত মিস করছিলাম? কবে আসবে আমাদের কাছে?”
পুষ্প ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,
“এ দেখছি ভাইয়ের মতোই হয়েছে। একটা কথার উত্তর দিতে সময় না দিয়েই একশটা প্রশ্ন করে।”
পুষ্প উদাসীন হয়ে বলল,
-“আমার আর ভালো। তোমার ভাই আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে কই?”
রিশা বিস্মিত হয়ে বলল,
-“সে কি ভাবি? ভাইয়া কি তোমায় মা’রধর করেছে? তুমি বলতে পারো আমাকে, কোনো ভয় নেই। আমি বাবা মাকে বলবো আর তারা ভাইয়াকে জুতাপে’টা করবে।”
পুষ্পর কাশি উঠে গেলো। ত্বরিত গতিতে বলল,
-“আরে না না। তোমার ভাই আমাকে মা’রতে যাবে কিসের জন্য? সে তো আমার উপর রাগ করে আছে। তাই আমি ভালো থাকতে পারছিনা। এখন রাগ ভাঙাবো কিভাবে? আমি বুঝতে পারছিনা।”
রিশা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
-“ওহ, এটা কোনো ব্যাপারই না। ভাইয়ার রাগ দুমিনিটে উড়ে যাবে। কিন্তু তারজন্য তোমাকে আমাদের বাড়ি আসতে হবে।”
পুষ্প বলল,
-“কি বলছো? এখনো কি আমাকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে? আমি কিভাবে নাচতে নাচতে চলে যাবো?”
রিশা আশ্বস্ত করে বলল,
-“তুমি এসব আমার উপর ছেড়ে দাও তো। বিনিময়ে তোমার ছোট ভাইকে চাই। নাবিল ছাড়া আমি বাঁচবোনা।”
পুষ্প ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
-“শুধু নাবিল না, আমার উমায়ের ভাইয়াকেও দিয়ে দেবো। তুমি শুধু আমার কাজটা করে দাও।”
★★★
হসপিটাল থেকে বেরিয়েই কারো ডাকে চমকে উঠলো রাউফুন। পেছনে তাকিয়ে দেখলো তার শশুর দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে। মহোদয়কে দেখে বোঝার উপায় নেই তার একটা ২২ বছরের মেয়ে আছে। এখনো শরীরের গঠন কতটা পোক্ত। রাউফুন হাসিমুখে এগিয়ে যেতেই তিনি বলল,
-“কেমন আছো ইয়ং ম্যান?”
রাউফুন সহাস্যে উত্তর দিলো,
-“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
উত্তরে পুষ্পর বাবা মীর হোসেন চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“ভালো। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। চলো গাড়িতে বসা যাক।”
রাউফুন শশুরের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলল।
#চলবে…….
#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৯
নিস্তব্ধ রজনীতে চাঁদের স্নিগ্ধ হাসি, জ্বলন্ত মিটিমিটি তারা প্রাণে ভীষণ ভালোলাগার সঞ্চার করে। সূর্য বিদায় নিয়ে পৃথিবী গাঢ় থেকে গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যায়। কিন্তু আজকের রাতটি ভিন্ন, সে মোটেও অন্ধকারকে গ্রহন করেনি। আকাশের বুকে একফালি চাঁদ নিয়ে নিজেকে মোহনীয় রূপে সাজিয়েছে। এই রাতটি কারো জন্য নব্যপ্রেমের মতোই ভালোলাগার, আবার কারো কাছে এক বিষাক্ততার নিদর্শন। কেউ দুঃখের বালুকণায় পাহাড় বানাচ্ছে, কেউবা উষ্ণ শ্বাসে একটুকরো সুখ খুঁজে নিচ্ছে।
রাতের অনেকখানি সময় শশুর-জামাই গাড়িতে বসেই কাটালো।
পুষ্পর বাবা স্নিগ্ধ হেসে প্রথমে সংলাপ শুরু করলেন।
-“তুমি হয়তো ভাবছো এতোরাতে তোমার সাথে আমার কী কথা থাকতে পারে? কিংবা কথা বলার জন্য এই রাত আর গাড়িকেই কেনো বেছে নিলাম?”
রাউফুন ঠিক এই কথাগুলোই ভাবছিলো। তবে মুখে বলল,
-“ঠিক আছে, আপনি বলুন।”
মীর হোসেন গলা পরিষ্কার করে বলা শুরু করলেন,
-“আমি এই রাত আর গাড়িতে কথাগুলো বলা উপযুক্ত মনে করেছি নিজের কম্ফোর্ট এর জন্য। দিনে তোমার কাজ থাকে। রাত ছাড়া তোমাকে পাওয়ার উপায় নেই। তাছাড়া এই মুহূর্তে কথাগুলো গাড়িতে বলাই শ্রেয়, কারণ এখানে বললে তৃতীয় কারো কান পর্যন্ত পৌঁছাবেনা কথাগুলো।”
মীর হোসেন একটু থেমে ফের বলা শুরু করলেন,
-“আমার মেয়েটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। যখন ওর জন্ম হলো তখন ওকে দেখেই আমার মনে প্রশ্ন জাগলো “এই ভীষণরকম ফুলের মতো দেখতে মেয়েটির নাম কী দেওয়া যায়?”
আমি ওর নাম দিলাম পুষ্প। ফুলের মতোই টকটকে, কোমল মেয়েটা আমার প্রাণ ছিলো। ধীরো ধীরে সময়ের গতি বাড়লো। আমি চাকরি সূত্রে তেমন বাড়ি আসার সুযোগ পেতামনা। তখন সুযোগ পেতামনা, আর এখন সমস্ত সুযোগ পেয়েও বাড়িতে আসিনা।
পুষ্প যখন একটু বড় হলো, নাবিলের মতো সবার সাথে পাকা পাকা কথা বলতো, তখন আমি এক নারীতে আসক্ত হয়ে পড়ি। দিন দুনিয়ে ভুলে ওই নারীর পেছনে ছোটা শুরু করলাম। ভুলে গেলাম আমার বাবা মা আছেন, স্ত্রী আছে, আমার ফুল আমার পুষ্প আছে। সত্য কোনোদিন গোপন থাকেনা। বাড়িতে সবাই ব্যাপারটা জেনে গেলো। পুষ্পর মা চুপচাপ হয়ে গেলো। প্রথম প্রথম না বুঝলেও পরবর্তীতে আমি নিজের ভুলটা বুঝতে পারি। ততদিনে বাড়ি থেকে খবর পেলাম পুষ্পর মা ছাদ থেকে প’ড়ে গিয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে ও কোনো লাভ হলোনা। সেদিন পুষ্পর মায়ের মৃ’ত্যু আমি মেনে নিতে পারলামনা।”
এতটুকু বলে থামতেই চমকে উঠলো রাউফুন। অকস্মাৎ এমন কিছু শুনবে ভাবতে পারেনি। চট করেই তার মস্তিষ্ক প্রশ্ন করলো,
-“তাহলে এখন যাকে পুষ্পর মা হিসেবে জানি তিনি কে?”
মীর হোসেন মাথা নিচু করে জবাব দিলেন,
-“আমার দ্বিতীয় স্ত্রী।”
রাউফুন ইতস্তত করে প্রশ্ন করলো,
-“কিছু মনে করবেন না। উনি কি সেই নারী?”
মীর হোসেন ত্বরিত গতিতে মাথা নেড়ে বললেন,
-“নাহ্! আমি আর ওই নারীর ছায়া মাড়াইনি। এখন যাকে পুষ্পর মা বলে জানো, তাকে বিয়ে করেছি পুষ্পর মায়ের অভাব দূর করার জন্য। চাকরির জন্য আমাকে কাছে পাবেনা, অন্তত মা বলেতো একজনকে পাবে। কিন্তু পুষ্প তাকে মেনে নিতে পারলোনা। নিজের মায়ের জায়গা অন্যকাউকে সে দিলোনা।”
রাউফুন একে একে হিসেব মেলালো। সেই জন্যই কি পুষ্পকে আর তার বর্তমান মাকে কখনো ঘনিষ্ঠ ভাবে কথা বলতে দেখা যায়নি?
পুষ্পর বাবা ফের বলা শুরু করলেন,
-“পুষ্পর মা মা’রা যাওয়ার পর আমি বাড়ি আসি। মেয়েটার কান্না আমার সহ্য হয়নি। নিজেকে অপরাধী মনে হতো। কে জানে হয়তো আমার দেওয়া ব্যথা সইতে না পেরে পুষ্পর মা নিজের জীবন নিজেই দিয়েছিলো। অপরাধবোধে আমি মেয়ের কাছে যেতামনা। পুষ্প দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদতো। বড় ভাইয়ের বউ আর মা এসে কোলে তুলে ওর কান্না থামাতো। ধীরে ধীরে আমার আর পুষ্পর মাঝে দূরত্ব বাড়লো। মেয়েটা আমার সাথে স্বল্পভাষী হয়ে উঠলো, পরবর্তীতে একেবারেই এড়িয়ে চলতো।
সবার চাপাচাপিতে আমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করলাম। পুষ্পর আরেকটা মা আসলো, নামেমাত্র মা। সে পুষ্পর আপন মা হয়ে উঠতে পারেনি। পুষ্প তার সঙ্গ পছন্দ করতোনা। ধীরে ধীরে পুষ্পর মা ও হাল ছেড়ে দিলো। নিজের মতো করে নিজেকে নিয়ে পড়ে রইলো। পুষ্পকে এতটাই ভালোবাসতাম যে দ্বিতীয়বার আর সন্তান নেওয়ার কথা ভাবিনি।
যখন আমার মনে হলো আমার মেয়েটার কাছে যাওয়া উচিত, এতদিন ভুল করে দূরে সরে রয়েছি। ততক্ষণে আমার আর আমার মেয়ের মাঝে যোজন-যোজন দূরত্ব।
আমি বাড়ি আসলে পুষ্প সবার সাথে বসে খেতে চায়না। আমাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। তার ছোট্ট মনে যে বিশাল অভিমান বাসা বেঁধেছে। মেয়ের অবহেলা এখন আর নিতে পারিনা। তাই সুযোগ থাকলেও বাসায় আসতে চাইনা। তোমাদের বিয়েতে আসার কথা ছিলো আমার। সেদিন আসার পথেই একটা এক্সি’ডেন্ট হলো আমার। নিজের অসুস্থতা নিয়ে বিয়ে বাড়ির আমেজ নষ্ট করতে চাইনি। তাই বাড়িতে ফোন করে ব্যস্ততার বাহানা দিলাম। এই যে তোমার সামনে যদি কখনো পুষ্প আমার সাথে কথা বলে, তখন ভেবে নেবে সে পারিবারিক বিষয়গুলো সবাইকে জানাতে চায়না। নিজের ব্যথাগুলো নিজের ভেতরই পুষে রাখে। উপরে সবার সাথে স্বাভাবিক থাকতে চায়।
এখন থেকে আমার মেয়ের বর্তমান আর ভবিষ্যত তুমি। তোমাকে কথাগুলো বলার প্রয়োজন ছিলো। কারণ মেয়েটা আমার কাছ থেকে যে কষ্টগুলো পেয়েছে, আমি চাইনা একই কষ্ট তোমার থেকে পেয়ে পাথর হয়ে যাক। এই মুহূর্তে আমি তোমাকে ভীষণ ভরসা করছি। আশা রাখছি জীবনের সব রকম পরিস্থিতিতে আমার মেয়ের পাশে থাকবে।”
রাউফুন মীর হোসেনকে আস্বস্ত করে বলল,
-“আপনি চিন্তা করবেননা। আমি আছি ওর পাশে।”
মীর হোসেন প্রসন্ন হাসলেন। ঘড়িতে সময় দেখে বললেন,
-“তোমার অনেকটা সময় লস করেছি। এবার বাড়ি ফেরা যাক।”
এরপর দুজনই দুদিকে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে গাড়িতে চড়লো।
পুষ্প যখন আজ রাউফুনের রাগ ভাঙাতে এসেছিলো, তখনই রাউফুনের রাগ উধাও হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তার আরও একটু দেখতে ইচ্ছে করছিলো, তার বউ নামক প্রেমিকাটি তার জন্য কী কী পাগলামি করে।
পুষ্প যখন ওয়েটিং রুমে বসেছিলো, তখন তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার কারণ ছিলো বটে। পুষ্প যদি একবার তাকে বের করে নিয়ে যেতে পারতো, তবে সেখানেই তার মিথ্যে রাগটাও পানি হয়ে যেতো। সেজন্যই আয়োজন করে পুষ্পকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো।
অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় এখন আর পুষ্পকে কল দিলোনা। ভেবে রাখলো আগামীকাল কাজ শেষে রাতে বউকে নিয়ে বের হবে। তাকে সারপ্রাইজ দেবে। আজ ঘুমাতে চলে গেলো।
★★★
নাস্তা শেষ করে হসপিটালের জন্য তৈরী হয়ে বাসা থেকে বের হলো রাউফুন। আজ সবাইকে কেমন ব্যস্ত দেখালো। সে অতো ভাবলোনা। এখন মূল কাজ হচ্ছে হসপিটাল যাওয়া, রোগী দেখা। পরিশেষে বউকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া।
★★★
পুষ্পর মেজাজ আজ বেশ ফুরফুরে। ভার্সিটি যাওয়ার ও চিন্তা নেই। বন্ধু গুলো সব খাওয়াদাওয়ার জন্য সকাল সকাল উঠে বসেছে তার বাড়িতে।
ইমরান পেটে হাত বুলিয়ে বলল,
-“ভুটকি, তুই নিজেই খেয়ে খেয়ে আটার বস্তা, চালের বস্তা হয়ে যাবি? আমাদের কিছু খাবার দে। ক্ষুধায় পেট চৌচির হয়ে যাচ্ছে।”
পুষ্প কটমট করে বলল,
-“আলুর বস্তা সাদ্দাম, আটা চাউলের একদাম।
আর কত খাবি? নিজের দিকেও তাকা, আমার দিকেও তাকা। কোন দিক থেকে আমাকে আটার বস্তা মনে হয়?”
রিয়াদ বলল,
-“শা’লা সারাদিন খাই খাই করে। এবার খাওয়া একটু কমা। তোর এই হাতির মতো শরীর দেখলে বউ বাপ বাপ করে পালাবে।”
ইমরান পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
-“মাগোওওও দুইটা ভাত দেও, কতডা দিন খাইনা আমি।”
জুঁই একটা বালিশ ছুঁড়ে বলল,
-“এই ড্রামের পেট ফুটো করলে খাবার ছাড়া কিছু পাওয়া যাবেনা।”
ইমরান বিজ্ঞদের মতো বলল,
-“নো। শুধু খাবার নয়, সাথে গু ও পাবি।”
প্রিয়া নাকমুখ কুঁচকে বলল,
-“এই হা’লার বলদরে বাথরুমের ট্যাঙ্কিকে আধাঘন্টা চুবিয়ে রাখ। গু খেয়ে পেট ভরাক।”
ইমরান কবিতা বানালো,
ওগো প্রিয়া,
তোমারে দেখি আমি
চোক্ষু মেলিয়া, মেলিয়া।
তুমি আমার জানের জান
বাকী সব থু,
চলো দুজনে মিলিয়া
ভক্ষণ করি গু।
সবাই হো হো করে হেসে গড়াগড়ি খেলো। প্রিয়া কটমট করে বলল,
-“হা’লা ভন্ড, তুই গু খাবি খা। সাথে আমাকে নিমন্ত্রণ জানাস কেন?”
ইমরান আবার ও গানের সুরে বলল,
সাদা-সাদা, কালা-কালা
রং জমেছে সাদা-কালা,
তুমি বন্ধু মেকাপ মাখো,
আমি বলি ছিঃ!
শেষে মনে প্রশ্ন জাগে,
গুয়ের কালার কী?”
পুষ্প হেসে কুটিকুটি। সব পাগলের দেখা তার সাথে। বন্ধুরা এক পাগল, বর আরেক পাগল। হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করে পুষ্প বলল,
-“ভাই তোরা এবার থাম। আমি আর হাসতে পারছিনা। ইমরান তুই বাইরে যা। মা, চাচি কাউকে বললেই তোর ড্রাম ভর্তি করে দেবে।”
★★★
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে বউকে সারপ্রাইজ দিতে রাউফুন সোজা শশুর বাড়িতে গেলো। সেখানে গিয়ে হতাশ হলো। তার বউ নাকি তার নানাশশুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। কি আশ্চর্য! বরের মান ভাঙাতে না পেরে একেবারে নানার বাড়ি গিয়ে উঠতে হবে নাকি?
নাহ্ এবার দেখছি একটা সাংঘাতিক ধোলাই দিতে হবে।
রাউফুন মলিন চেহারা নিয়েই বাড়ি ফিরলো। রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরতেই সে সারপ্রাইজড হলো। প্রচন্ড শকে তার মুখের বুলি উড়ে গেলো।
#চলবে…….