কলঙ্ক পর্ব-২৪

0
1528

#কলঙ্ক
#২৪_তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক


‘শিশির ভাইয়া বললো,’এনে দিলে তুই কী দিবি আমায়?’
‘যা চাও তাই!’
শিশির ভাইয়া বললো,’আমি চাই তুই তোর ইমোশন কমা। এখনও তুই বাচ্চা না। অনেক বড় হয়েছিস। আরেকটা কথা।বললে হয়তোবা তুই কষ্ট পাবি। কিন্তু সত্য এটাই যে তোর প্রতারণার শিকার হওয়ার কারণ তোর এই ভীষণ রকমের ইমোশনটাই! তাছাড়া তুই সিদ্ধান্তহীনতায় বারবার ভোগস!এটাও একটা সমস্যা।আমি চাই এই দুটোই তুই কাটিয়ে উঠবি।এই দুটো কাটিয়ে উঠতে পারলে তুই বড় হতে পারবি।আর নয়তো গোল্লায় যাবি!’
আমি মৃদু হাসি। হেসে বলি,’আমি তোমার কথা রাখবো। এখন থেকে এই দুটো থেকেই দূরে থাকবো। তোমার কথা রাখা হলো ব্যস। এখন আমার কথা রাখো। মেহরাবকে এনে দাও!’
শিশির ভাইয়া খিলখিল করে আবার হেসে উঠলো।বললো,’তুই না বললি তোর ইমোশন আর থাকবে না, তবে এখন যে আবার ইমোশন দেখাচ্ছিস?’
আমার রাগ উঠে গেলো হঠাৎ।আমি রাগত স্বরে বললাম,’এটা ইমোশন না ভাইয়া। এর নাম ভালোবাসা।’
শিশির ভাইয়া বললো,’তাহলে আমানের সাথে কী ছিল?’
‘ওটাও ভালোবাসা।’
‘আমানকে ভুলে গেলি কী করে তবে? ভালোবাসা কী ভুলা যায় কখনো?’
আমি কেঁদে ফেললাম। বললাম কাঁদতে কাঁদতেই,’ও যে আমার সাথে চিট্ করলো এটা জেনেও কী করে জিজ্ঞেস করছো আমি তাকে কীভাবে ভুলে গেছি?’
শিশির ভাইয়া বললো,’তো একটা ছেলে তোর সাথে চিট্ করার পরেও আরেকটা ছেলেকে তুই কী করে বিশ্বাস করে ফেললি?তোর কী ভয় হয় না?’
‘হয়। কিন্তু এটাও বাঁচার জন্য করেছি। মানুষ বিশ্বাস ছাড়া বাঁচতে পারে না!’
‘তোর যদি এই বিশ্বাসের জন্য আবার ক্ষতি হয়?’
‘হবে না।ও আমায় শর্ত দিয়েছে।আমি শর্ত পূরণ করলে সে বলেছে আমায় ভালোবাসবে। বিয়ে করবে।’
‘শর্ত কী পূরণ করেছিস?’
আমি থমথমে গলায় বললাম,’না।’
‘তবে?’
আমি চুপ মেরে থাকি।আর কথা বলতে পারি না।
শিশির ভাইয়া তখন বলে,’তুই তো একটা বিরাট লেভেলের আনমেচ্যুয়ূরড রে! গাছে কাঁঠাল রেখেই গোঁফে তেল মালিশ শুরু করেছিস!’
শিশির ভাইয়া হাসতে লাগলো।
আমার কান্না পাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে আমি বললাম,’আমি একটা পচেঁ যাওয়া মানুষ। এই জন্য লজ্জা দিচ্ছো আমায় না? দেও।দিবেই তো। আমি তো একটা নোংরা মেয়ে। চরিত্রহীন!’
আমি কাঁদছি। মুখে আঁচল চেপে ধরে কাঁদছি।
শিশির ভাইয়া বললো,’তাকা। উপরের দিকে চোখ তুল।’
আমি তুলি না চোখ। মুখে আঁচল চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকি।
এই সময় একটা গলা শুনে চমকে উঠি। ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকাতেই দেখি মেহরাব।আমি অবাক করা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকি।
শিশির ভাইয়া বলে,’এখন হলো তো কথা রাখা? এখন তুই তোর কথা রাখিস।যে দুটো জিনিস তোকে ইগনোর করতে বলেছি ওই দুটো জিনিস তুই এখন থেকে ইগনোর করতে শুরু করবি।বুঝলে?’
আমি উপর থেকে নীচে মাথা দুলিয়ে বলি,বুঝেছি।
তারপর শিশির ভাইয়া মেহরাবের পিঠে হাত দিয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে দিয়ে বলে,’তোরা গল্প কর।আমি আসছি!’
বলে শিশির ভাইয়া রাস্তা ধরে শহরের দিকে চলে যায়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকি আমি আর মেহরাব।
মেহরাব আমার দিকে তাকিয়ে বলে,’কেমন আছো?’
আমি শুকনো মুখে বলতে চেয়েছিলাম,তা আর জেনে কী করবে কেমন আছি?আমি তোমার কে?’
কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে শিশির ভাইয়ার কথা। সফলতার জন্য আমার ইমোশন পরিহার করতে হবে।
আমি তখন নিজেকে সামলে নিয়ে বলি,’ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
‘ভালো আছি ‌।’
মেহরাব বলে,’আমার একটা বিয়ের আলাপ হচ্ছে।মার খুব পছন্দ।বিয়েটা কী করে ফেলবো?’
আমার তখন ভীষণ জেদ চাপে। ইচ্ছে করে ওর ঠুটি চেপে ধরে বলতে,’এই তুই না আমায় কথা দিয়েছিলে যে আমি সফল হলে তুই বিয়ে করবি? তবে এখন বিয়ে করে ফেলার কথা বলছিস কোন মুখে?
কিন্তু তখন অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রাখি। শিশির ভাইয়ার কথাটা ভাবি। আমাকে সফল হতে হলে অবশ্যই বাস্তববাদী হতে হবে।ইমোশনের সাগরে নিমজ্জিত হলে চলবে না!
আমি তখন সহজ গলায় বলি,’আমার তো সফল হতে অনেক দেরি। পড়াশোনা শেষ হতে তিন বছর লাগবে। তারপর চাকুরী বাকুরি কবে হয় তারও নাই ঠিক। তুমি কোন আশায় বসে থাকবে? বিয়ে করে ফেলো। তাছাড়া তোমার মায়েরও পছন্দ ওই মেয়ে!’
মেহরাব খানিক সময় চুপ থাকে। তারপর বলে,’তোমার কষ্ট হবে না?’
আমি মৃদু হেসে বলি,’একটু কষ্ট তো হবেই।তা কাটিয়ে উঠতে হবে। তবে তোমায় অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমার লাইফে না এলে আমার অতটুকু পর্যন্ত আসা হতো না!’
মেহরাব মৃদু হাসে। হেসে বলে,’আমি বিয়ে করবো না ততোক্ষণ পর্যন্ত যতোক্ষণ না তুমি সফল হতে পারো! তোমার সফল হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করবো। কিন্তু আবার এই ভেবে পড়াশোনা কিংবা তোমার চালিয়ে যাওয়া সংগ্রামকে থামিয়ে দিয়ো না যে আমি তো তোমাকে বিয়ে করবোই! বিষয়টা কিন্তু এমন না।মনে রেখো, মুখস্থ করেও রাখতে পারো কথাটা। তুমি সফল হলেই আমি তোমাকে বিয়ে করবো।সফল হতে না পারলে আমি বিয়ে করবো না।অন্য কোন মেয়েকেও না!’

আমরা বসে আছি একটা বেঞ্চির উপর। মেহরাবের কথাগুলো শুনে আমার ভেতরটা জুড়িয়ে গেলো।আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,’মেহরাব, মা যে বললো তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে অন্য একটা মেয়ের সাথে।এটা কী সত্যি?’
মেহরাব হাসলো। হেসে বললো,’মিথ্যে।’
‘তাহলে মায়ের কাছে এটা জানিয়েছো কেন?’
সে বলে,’এটা জানিয়েছিলাম এই জন্য যে এতে তোমার ভেতর একটা জেদ কাজ করবে। কিন্তু বলার পর আমার ভয় হতে থাকে। যদি এতে তোমার মন ভাঙ্গে। পড়াশোনা নষ্ট হয়।জেদের বদল ডিপ্রেশড হয়ে পড়ো!তাই এখন জানিয়ে দিলাম।’
মেহরাবের কথাগুলো শুনে আমার চোখ কেমন জলে ভুরভুর করে উঠলো।আমি অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ মুছলাম। তারপর মেহরাবকে বললাম,’মেহরাব, তুমি যদি আমায় কোনদিন বিয়ে না করো তবুও দুঃখ পাবো না। তবে আজ তুমি আমার জন্য যে শিক্ষা রেখে গেছো তা কখনো ভুলবো না।দেখো,আমি ঠিক সফল হবো।সত্যি হবো।’
মেহরাব বলে,’তোমার হাতটা একটু ধরতে দিবে?’
আমি চুপ করে থাকি।কথা বলি না।
মেহরাব নিজেই হাত ধরে। তারপর বলে,’তোমার হাত ধরেছি কেন জানো?’
আমি বললাম,’কেন?’
মেহরাব তখন বললো,’এই কথাটিও আজ বলবো না। কিন্তু একদিন বলবো ঠিকই। তোমার মনে না থাকলেও আমি মনে করে বলবো।’

সন্ধ্যা হয়ে আসছে।পাখিরা উড়ে উড়ে নীড়ে ফিরছে। আকাশ তামাটে হয়ে আসছে।আর হলুদ বিকেল গলে জমে উঠছে আবছা অন্ধকারের মিলান্তি!
মেহরাব বললো,’আজ উঠি। সন্ধ্যা সাতটায় আমার ট্রেন আছে।’
‘ঠিক আছে।পারলে মাঝেমধ্যে আসো।’
মেহরাব উঠে যায়।আর রাস্তা ধরে সামনের দিক থেকে এগিয়ে আসে শিশির ভাইয়া।
আমি পেছন থেকে মেহরাবকে ডাকি।
মেহরাব দাঁড়ায়। আমিও গিয়ে এবার তার পাশে দাঁড়াই। তারপর জিজ্ঞেস করি,’মেহরাব, তুমি শিশির ভাইয়াকে চিনো কী করে?’
মেহরাব বলে,’শিশির যেভাবে আমায় চিনে আমিও ঠিক সেভাবেই তাকে চিনি।’
আমার কেমন খারাপ লাগে। খারাপ লাগে এই জন্য যে কেন সে আমার কাছে লুকিয়ে রাখছে শিশির ভাইয়ার সাথে তার সম্পর্কের কথা।
আমি তখন ধরা গলায় বলি,’বলবে না?’
মেহরাব হাসে।আর ঠিক তখন শিশির ভাইয়া আমাদের কাছে এসে যায়।
মেহরাব শিশির ভাইয়ার সাথে হেন্ডশেক করে বিদায় নিয়ে দ্রুত পা ফেলে চলে যায়।
আমি দাঁড়িয়ে থাকি। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকি। আমার ভেতরে কান্না জমে। অভিমান হয় খুব। মেহরাবের কথা খুব ভাবতে ইচ্ছে করে। মেহরাব অতো ভালো কেন!
শিশির ভাইয়া আমায় চুপচাপ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,’কী হলো? অতবড়ো সারপ্রাইজ পাওয়ার পরেও এমন হুতোম পেঁচার মতো মুখ করে রেখেছিস কেন?’
আমি খানিক সময় চুপ করে থাকি। তারপর বলি,’ভাইয়া, একটা জিনিস জানতে চাইবো তোমার কাছে। তুমি বলবে?’
শিশির ভাইয়া বললো,’আগে বল কী জানতে চাস। তারপর ভেবে দেখবো!’
আমি তখন বলি,’মেহরাবের সাথে তোমার কী সম্পর্ক? তুমি কীভাবে চিনো তাকে?’
শিশির ভাইয়া অদ্ভুত করে হাসে। তারপর বলে,’বলবো না।’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে