কলঙ্ক পর্ব-২৩

0
1507

#কলঙ্ক
#২৩_তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ঈদুল ফিতরের বিকেল। সারাদিন মন খারাপ ছিল। বারবার বাবা মা আর ভাইয়ার কথা মনে পড়ছে।ওরা কতোবার যে ফোন করেছে।আমি শুধু একবার কথা বলেছি। বেশি করে কথা বললে মায়া লাগবে‌।বাড়ি যেতে ইচ্ছে করবে। এই জন্য কম কথা বলেছি!
তবে কষ্ট লাগলো মেহরাবের কথা ভেবেও। কীভাবে ও ভুলে যেতে পারলো আমায়?না থাক আমাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক।সে তো ট্রেনে বসে আমায় বলেছিল, একদিন আমায় ভালোবাসবে।আজ একটা ঈদের দিন।এই অধিকারে হলেও তো সে একটা ফোন করতে পারতো আমায়! জিজ্ঞেস করতে পারতো কেমন আছি। পড়াশোনা করছি কি না ঠিকঠাক মতো!
জিজ্ঞেস করবে না। প্রয়োজন কী জিজ্ঞেস করার। আমার মতো পঁচে যাওয়া,মান সম্মান হারানো একটা মেয়েকে সে ভালোবাসবে কেন? বিয়ে করে ঘর সংসার করবে কেন? তার নিজের কী কোন খুঁত আছে? খুঁত না থাকলে সে আরেকটা খুঁত ওয়ালা মেয়েকে জীবন সাথী করতে যাবে কোন দুঃখে!
আমার কান্না পায়। মুহুর্তে মনে হয়,কেন আমি কষ্ট করছি। কেন পড়াশোনা করছি?কী লাভ হবে এসব করে? কোন লাভ হবে না। আমাকে কেউ চায় না।কারণ সবাই জানে আমি পঁচে গেছি!
ঈদুল ফিতরের আনন্দ মাটি হয়ে যায় আমার।সারা দুপুর বিছানায় শুয়ে থেকে কাঁদি। লুকিয়ে চোরিয়ে কাঁদি। বুঝতে দেইনা এ বাড়ির কাউকে। বিকেল বেলা ম্যাম একবার কাছে এসে বলেন,’কী হয়েছে মা?মন খারাপ?’
আমি কথা বলি না।চোখ মুছে তাকিয়ে থাকি অন্যদিকে।
ম্যাম বলেন,’বিছানা থেকে এখন উঠো তো মা। বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।’
আমি আর সাহস পাই না কিছু বলার। বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে ঢুকি। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি।
ম্যাম এবার আমার জন্য একটা শাড়ি নিয়ে আসেন। কচুপাতা রঙের শাড়ি।কী সুন্দর যে দেখতে!
ম্যাম বলেন,’ এটা পরো।’
আমি চুপচাপ শাড়ি পরি।
তারপর তিনি দু’ ডজন কাচের চুড়ি এনে আমার দু’হাতে পরিয়ে দেন। চোখে নিজের হাতে কাজল মাখিয়ে দেন। তারপর আয়না এনে আমার সামনে ধরে নিজেই তিনি চিন্তিত মুখে বলেন,’কী যেন একটা কম পড়েছে! তিনি মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবেন। কিন্তু হদিস পান না কী কম পড়েছে তার। এবার আমায় জিজ্ঞেস করেন।বলেন,’কী কম পরলো দেখ তো মা! তোমার সাজগোজে কী যেন একটা অপূর্ণতা আছে!’
আমি আয়নায় খুঁজি।যদিও আমার মন ভালো নেই। তবুও বাহানা করি ভালো আছি।খুশি আছি। কিন্তু কী যে অপূর্ণতা তা আর খুঁজে বের করতে পারি না!
তখন হঠাৎ করে বাহির থেকে এসে ঘরে ঢুকে শিশির ভাইয়া।তার পরনে মেরুন রঙা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির সাথে ধুতি পাজামা। অনেক সুন্দর লাগছে তাকে আজ!
শিশির ভাইয়া এসেই আমার দিকে তাকালো। তারপর বললো,’গাধা কী সাজলি এতোক্ষণ ধরে?আসল জিনিসই তো নাই । তোকে আবার সুন্দর লাগবে কী করে!’
বলে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে টিপের প্যাকেটটার দিকে হাত বাড়ায়। তারপর ওখান থেকে একটা নীল সরু টিপ তুলে এনে আমার কপালে পরিয়ে দিয়ে বলে,’এখন আয়নায় দেখ রে গাধা তোকে কেমন লাগছে! একেবারে দেবী হেলেন!’
ম্যাম এবার বলেন,’ঠিক আছে ঠিক আছে।আমি এতোক্ষণ এটাই খুঁজছিলাম। কিন্তু মনেই পড়ছিলো না!’
বলে তিনি বাইরে চলে গেলেন।
শিশির ভাইয়াকে এবার আমি মুখ কুঁচকে বললাম,’তুমি একটা ভয়ংকর মিথ্যুক!’
শিশির ভাইয়া বললো,’মিথ্যুক মানে?’
‘তো কী! তুমি যে বললে দেবী হেলেনের মতো লাগছে।দেবী হেলেন কী কখনো টিপ পরতো নাকি?’
শিশির ভাইয়া তখন আমতা আমতা করে বলে,’তাহলে দেবী অন্নপূর্ণার মতো লাগছে!’
আমি অবাক হয়ে বলি,’এটা আবার কে?চিনি না তো!’
শিশির ভাইয়া বলে,’হিন্দুদের দেবী।দূর্গা ওর আরেক নাম।’
আমি বলি,’শুনো আমায় তুমি কারোর সাথে তুলনা ফুলোনা করবে না কিন্তু খবরদার!আমি এদেরচে সুন্দর!’
শিশির ভাইয়া বলে,’তুই এদের চেয়ে বান্দর!’
আমার ভীষণ রাগ পায় তখন! রেগে গিয়ে আমি বলি,’টিপ খুলে ফেলবো কিন্তু বললাম কপাল থেকে!’
শিশির ভাইয়া আমার হাত ধরে বলে,’উহু।খুলিস না।তোর সাথে মজা করেছি। আসলে তুই বেহেশতের হুরের চেয়ে সুন্দর। এখন দয়া করে আমার সাথে চল!’
আমি অবাক হয়ে বলি,’কোথায় যাবো?’
শিশির ভাইয়া খিলখিল করে হেসে বলে,’তোকে নিয়ে হারিয়ে যাবো!’
আমার কান্না পেতে চায় তখন। আসলে তখনও আমার ভেতর কী চলছে আমি জানি না! মেহরাবের কথা ভুলতে পারছি না। আর শিশির ভাইয়ার প্রতি যে আমার ভালোলাগা এটা কোন পরিণতির ইচ্ছেতে নয়। মানুষের কিছু গুণাবলী ভালো লাগে এমন আছে না?আর এ থেকে যেমন ভালো লাগা কাজ করে ঠিক তেমন!
তার হাসি,জ্ঞানসমৃদ্ধ কথা বলা আমার ভালো লাগে!
তার বইয়ের ভেতর ডুবে থাকাটাও আমার প্রিয়।
তাছাড়া যে বাড়ির মানুষটি আমার এই দুঃসময়ে আমার মাথায় ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।যে আমার সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করেছে।যে মানুষটি আমায় আগ্রহ দিচ্ছে, নিজের মেয়ে ভাবছে তাকে আমি কিছুতেই আঘাত করতে পারি না!
বরং এখন আমার কাজ হবে এগিয়ে যাওয়া।
এগিয়ে যাওয়ার সময় এমন বাঁধা আসবেই।কত জায়গায় মন থেমে যেতে চাইবে। কিন্তু কিছুতেই থামা যাবে না! থামলেই সংগ্রাম ভেস্তে যাবে!
তাই শিশির ভাইয়াকে বলি,’ভাইয়া, তুমি এমন করে কথা বলছো কেন?’
শিশির ভাইয়া আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলে,’কেমন করে কথা বলছি?’
‘ওই যে বললে আমায় নিয়ে পালিয়ে যাবে তুমি?’
‘বলেছি।বললে কী পাপ হবে?’
‘হ্যা হবে।’
বলে ওর একটা হাত ধরে কেঁদে ফেলি আমি।
শিশির ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তখন।বলে,’কাঁদিস না রে ছাগল!তুই কাঁদলে তুই হনুমান হয়ে যাবি এখন। চোখে যে মা কাজল মাখিয়ে দিয়েছে তুই কাঁদলে এটা গলে তোকে আস্ত একটা সং দেখা যাবে বুঝলে?’
আমি রেগেমেগে আগুন হয়ে তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলি,’বুঝলাম।’
‘কী বুঝলে?’
‘বুঝেছি তুমি একটা ফালতু লোক।’
‘ফালতু লোক কেন?’
‘ফালতু না তো কী? আমায় অত রাগাও কেন? আরেকবার রাগালে ভয়ংকর কান্ড করবো।’
শিশির ভাইয়া বলে,’কী করবে রে তোকে রাগালে ছাগল?কামড় টামড় দিয়ে শরীরের মাংস নিয়ে যাবি নাকি রে?’
আমি জানি না কেন হঠাৎ এমন করলাম!
এক কামড় দিয়ে শিশির ভাইয়ার আঙুলে দাগ বসিয়ে ফেললাম একেবারে। শিশির ভাইয়া কিন্তু ব্যথায় একটুও চিৎকার করে উঠলো না। চুপচাপ হাঁটতে লাগলো।
আমি তখন ভীষণ লজ্জিত হলাম। ভাবলাম , এমন একটা ভয়ংকর কাজ কী করে আমি করে ফেললাম! ছিঃ!
তারপর শিশির ভাইয়ার কাছাকাছি হাঁটতে হাঁটতে বললাম,’ভাইয়া সরি!আমি আসলে অবোঝের মতো কাজটা করে ফেলেছি! বুঝতে পারিনি!’
শিশির ভাইয়া হাসেন। হেসে বলেন,’তোর মনের ব্যথার চেয়ে আমার আঙুলের ব্যথা বেশি নয়!তোর আনন্দের প্রয়োজন। তোকে আমি আনন্দ দিতে চাই!’
এরপর আর ভাইয়া আনন্দ দিতে পারলো না। আসলে কেউ বলে কয়ে কখনো আনন্দ দিতে পারে না। আনন্দ বিষয়টা হুট করেই আসে।এটা আসে মনের ভেতর থেকে!আর আপনি যখন একবার মুখে বলে ফেলবেন কাউকে আনন্দ দেয়ার কথা, তারপর আর কোনভাবেই তাকে আনন্দ দিতে পারবেন না!

আমরা গন্তব্যহীন ভাবে হাঁটছি। শিশির ভাইয়া এবার বললো,’আচ্ছা তোকে যদি বলি এক কথায় কিছু আমার কাছে চাইতে তবে তুই কী চাইবি আমার কাছে?’
আমি মজা করে বললাম,’মেহরাবকে যদি চাই তবে এক্ষুনি এনে দিতে পারবে!’
শিশির ভাইয়া —–

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে